গণতন্ত্র সম্পর্কিত প্রাথমিক পর্যায়ের মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যক্তিগত অধিকার ও স্বার্থসমূহের সুরক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। অনতিবিলম্বে গণতন্ত্র সম্পর্কে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। গণতন্ত্র সম্পর্কিত এই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিটিতে ব্যক্তিমানুষ ও জনসম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও বিকাশ সাধনের উপর জোর দেওয়া হয়। গণতান্ত্রিক শাসন সম্পর্কে নতুন একটি মডেলের সৃষ্টি হয়। ব্যাপক অর্থে এই নতুন মডেলটি উন্নয়নমূলক বা বিকাশমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসাবে পরিচিত। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে পূর্ববর্তী সংরক্ষণমূলক মডেলের সঙ্গে সঙ্গে এই বিকল্প মডেলটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে।

উন্নয়নমূলক বা বিকাশশীল গণতন্ত্রের মডেলের আত্মপ্রকাশ ঘটে মূলতঃ ইংল্যান্ডের নানা বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে লেভেলার ও ডিগারদের বিপ্লবী কর্মসূচীর মধ্যে এবং সর্বোপরি ফরাসী বিপ্লবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মডেলের মূল ঝোঁকটা ছিল সক্রিয় সচেতন নাগরিক গড়ে তোলার জন্য যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অপরিহার্যতার উপর জোর দেওয়া।

সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মধ্যে লেভেলার ও ডিগারদের কর্মপরিকল্পনায় গণতন্ত্রের এই ধারার প্রাথমিক প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। তবে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের উন্নয়নমূলক মডেল বিশেষ সাড়া জাগায়। গণতন্ত্রের এই নতুন মডেলটির বিকাশ ও বিস্তারে সাহায্য করেছে দুটি ধারার ব্যাখ্যা – র‍্যাডিক্যাল ও উদারনীতিক। গণতন্ত্রের সমর্থনে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল টমাস প্রণীত Rights of Man। তবে গণতন্ত্রের র‍্যাডিক্যাল ধারাটি বিকশিত হয়েছে ফরাসী দার্শনিক রুশোর রচনার মাধ্যমে। ডেভিড হেল্ডের অভিমত অনুযায়ী রুশোই হলেন উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক। তিনি যে র‍্যাডিক্যাল গণতন্ত্রের কথা বলেছেন সেখানে নাগরিকগণ সম্মিলিতভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনসমাজের জন্য যথাযথ নিয়মকানুন তৈরী করে। র‍্যাডিক্যাল গণতন্ত্রের আর এক প্রবক্তা হলেন গ্যারি উলস্টনক্রাপ্ট। অষ্টাদশ শতাব্দীর এই চিন্তাবিদ নীতিবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। গণতন্ত্র সম্পর্কিত রুশো ও উলস্টনক্রাপ্টের র‍্যাডিক্যাল গণতন্ত্রের বিপরীতে বিকশিত হয় গণতন্ত্র সম্পর্কিত উদারনীতিক ধ্যান-ধারণা। এক্ষেত্রে সুবিদিত নামটি হল জন স্টুয়ার্ট মিল। জে. এস. মিল হলেন হিতবাদী দার্শনিক জেমস মিলের পুত্র।

গণতন্ত্রের উন্নয়নমূলক মডেলে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের বিষয়টিকে নতুনভাবে পর্যালোচনার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে গণতন্ত্র কেবলমাত্র স্বার্থপূরণের উপায় মাত্র নয়। গণতন্ত্রের উচ্চতর একটি নৈতিক মূল্য আছে। কারণ গণতন্ত্রের মাধ্যমে ব্যক্তি-মানুষের বিকাশ সাধিত হয়। সংরক্ষণমূলক মডেলে গণতন্ত্রকে দেখা হয়েছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কিন্তু গণতন্ত্রের উন্নয়নমূলক মডেলে ইতিবাচক ব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রকে দেখা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের আত্মিক শক্তির ও গুণাবলীর বিকাশ সাধিত হয়। উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাজনীতিক জীবনে আবশ্যক শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ, বিকশিত ও অঙ্গীকারবদ্ধ নাগরিক গড়ে তোলা আবশ্যক। রাজনীতিক অংশ গ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষের শক্তি-সামর্থ্য ও গুণাবলীর সুসংহত বিকাশ সাধন সম্ভবপর।

জ্যা-জ্যাক্ রুশো (Jeam Jacquess Rousseou): প্রথম পর্যায়ের সংরক্ষণমূলক গণতন্ত্রের ধারণার পরবর্তী পর্যায়ে ব্যক্তির এবং সমাজের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে গণতান্ত্রিক তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। এর প্রবক্তা রুশো। তাঁর মতে নাগরিকের স্বাধীনতা নির্ভর করে জনজীবনের উন্নয়নে নাগরিক দায়িত্ব পালনে কতটা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছে তার ওপর। অর্থাৎ রুশোর মতে স্বাধীন নাগরিক আত্মপ্রকাশ করতে পারে একমাত্র প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। সমগ্র মানব সমাজের উন্নয়নের প্রশ্নটি রুশোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি যে সাধারণের ইচ্ছার প্রসঙ্গটি তুলছেন, তার অবস্থান ব্যক্তিগত স্বার্থচিত্তার ঊর্ধ্বে। নিজ ব্যক্তিগত স্বার্থ চিন্তাকে বাদ দিয়ে সাধারণের ইচ্ছা। এই ইচ্ছা তার প্রকৃত ইচ্ছারই প্রকাশ। এই ইচ্ছা সমগ্র মানবসমাজের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। রুশো রাজনৈতিক সাম্যের পাশাপাশি সাধারণের উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সাম্যের কথাও বলেছেন।

গণতন্ত্র সম্পর্কিত রুশোর ভাবনা দুটি প্রত্যক্ষ সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই দুটি সূত্র হল প্রজাতন্ত্র ও সাধারণের ইচ্ছা। রুশো উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের র‍্যাডিক্যাল প্রবক্তা। প্রজাতন্ত্রের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। রুশোর অভিমত অনুযায়ী চুক্তির মাধ্যমে মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বশাসনের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তিনি সর্বোচ্চ নাগরিক ধর্মে ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নিজের ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তির পক্ষে স্বাধীনতা সংরক্ষণ সম্ভব হবে। রুশোর মতানুসারে, সার্বভৌমত্বের হস্তান্তর বা প্রতিনিধিত্ব সম্ভবপর নয়। সাধারণের ইচ্ছাই হল সার্বভৌম। জনসাধারণের দ্বারা সঞ্চালিত সর্বসাধারণের কল্যাণের ভাবনাই হল সাধারণের ইচ্ছা। সাধারণের ইচ্ছাকে সৃষ্টি করে নাগরিক নিজেই। এই সাধারণের ইচ্ছার কাছে নাগরিক বশ্যতা স্বীকার করে। রুশোর মতানুসারে ব্যক্তিবর্গ সমবেতভাবে নিজেরাই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ। তারাই আইন সৃষ্টি করে। কিন্তু জনগণ সাধারণের ইচ্ছাকে সঞ্চালনার কাজে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকলে, তবেই তারা সার্বভৌম হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। রুশো অভিন্ন দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যকে দেখেছেন। জনগণই রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। জনগণই হল আইনসভা। সরকার জনগণের দ্বারা প্রণীত আইনকে বলবৎ করে। সরকার সৃষ্টি করা হয়েছে কিছু সুবিধার কথা বিবেচনা করে।

রুশো চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে স্বশাসনের উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি জনসাধারণের সঙ্গে সরকারের পার্থক্যের কথা বলেন নি। তিনি রাষ্ট্র এবং পৌর সমাজের মধ্যেও বিভাজন করেন নি। রুশোর পরিকল্পিত রাজনীতিক শৃঙ্খলার মধ্যে শাসনকার্যে সর্বসাধারণ সংযুক্ত। এই শাসনব্যবস্থা কেবলমাত্র একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়; এ একটি সমাজব্যবস্থাও বটে।

স্বাধীনতা সম্পর্কিত রুশোর ধারণার মধ্যে প্রয়োজনীয় সম্পত্তির অধিকারের বক্তব্য বর্তমান। আর্থিক নির্ভরতা থেকে তিনি মুক্তির কথা বলেছেন। কোন নাগরিকই যেন এমন দরিদ্র না হয় যে, অনন্যোপায় হয়ে নিজেকে অপরের কাছে বিক্রি করবে। আবার কোন নাগরিকই এমন সম্পদশালী হবে না যে, অপরকে ক্রয় করার সামর্থ্য তার থাকবে। বস্তুত রুশো জনসাধারণের আর্থিক অবস্থানের ব্যাপারে সাধারণ সমতার পক্ষপাতী ছিলেন। এই সাম্য সাধারণের ইচ্ছা সৃষ্টির সহায়ক হবে।

উন্নয়নশীল গণতন্ত্রের র‍্যাডিক্যাল প্রবক্তা রুশোর তাত্ত্বিক অবস্থান সম্যকভাবে তুলে ধরেছেন অ্যান্ড্রু হেউড। তিনি তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: …. What gives Rousseau’s model its novel character is his insistence that freedom ultimately means obedience to the general will Rousseau believed the general will to be the ‘ture’ will of each citizen, in contrast to his or her ‘private’ or selfish will. By obeying the general will, citizens are therefore doing nothing more than obeying their won ‘true’ natures, the general will being what individuals would will if they were to act selflessly. In Roussesu’s view, such a system of radical developmental democracy required not merely political equality but a ralatively high level of economic equality. Although not a supporters of common ownership, Rousseau nevertheless proposed that ‘no citizen shall be rich enough to buy another and none so poor as to be forced to sell himself.”

দার্শনিক রুশো যে উন্নয়নশীল গণতন্ত্রের র‍্যাডিক্যাল ধারণা তুলে ধরেছেন তা হল তৃণমূলস্তরের গণতন্ত্রের ধারণা। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা হয়েছে যে, সর্বাধিক নিম্নস্তরে রাজনীতিক ক্ষমতা ব্যবহৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সমাজের মুখ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে খোলামেলা অবস্থা, বিকেন্দ্রীকরণ ও দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করা দরকার। মুখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে কর্মক্ষেত্র, স্থানীয় জনসম্প্রদায়, পরিবার প্রভৃতির কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কথাও বলা হয়েছে। রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান বলতে বিভিন্ন রাজনীতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ এবং আইনমূলক সংস্থাসমূহ।

রুশোর মতবাদ বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ট্যালমন (J. L. Talmon) তাঁর The Origins of Totalitarian Democracy শীর্ষক গ্রন্থে এমন মন্তব্য করেছেন যে, অনেক সময় রুশোকে তথাকথিত ‘সামগ্রিকতাবাদী গণতন্ত্র’ (Totalitarian Democracy)-এর রূপকার হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ জনগণ ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হয়ে অন্ধভাবে আচরণ করতে পারে। সুতরাং নাগরিকরা কী চায়, শুধু এ কথার মাধ্যমে সাধারণের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সমাজের উপরতলা থেকে সাধারণের ইচ্ছা ব্যাখ্যা করার এবং চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ থেকে যায়। একজন স্বৈরাচারী শাসকও দাবি করতে পারেন যে, তিনি সমাজের সম্যক স্বার্থেই কাজ করেছেন।

  • নাগরিকের প্রকৃত (true) ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত (felt or subjective) ইচ্ছার মধ্যে পৃথকীকরণও সমালোচিত হয়েছে।

  • রুশোর উন্নয়নমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দরিদ্রদের ও মহিলাদের রাষ্ট্র শাসনের কাজে উপযুক্ত বলে বিবেচিত করা হয়নি। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, দরিদ্রদের সম্পত্তির অভাব এবং মহিলাদের বিচারবুদ্ধির অভাব হল রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে অযোগ্যতা। এই কারণে তারা জনগণ বা নাগরিকের অন্তর্ভুক্ত নয়।

  • রুশোর মতবাদ সরাসরি শাসনের কোন প্রত্যক্ষ প্রণালী হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না। মতবাদটি সুসঙ্গত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।

বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রুশোর উন্নয়নমূলক গণতান্ত্রিক র‍্যাডিক্যাল ধারণা দায়িত্বশীল নাগরিক শাসনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। রুশোর স্বশাসনের ধারণা সাম্প্রতিককালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে। মার্কসবাদের মতো বিপ্লবী তত্ত্বকে রুশোর মতবাদ প্রভাবিত করেছে। ফরাসি বিপ্লবের পিছনে এই মতবাদের অনুপ্রেরণামূলক অবদান অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীর ষাটের ও সত্তরের দশকে নব্য বামপন্থী চিন্তাবিদরা আধুনিক অংশগ্রহণ লব গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রেও রুশোর মতবাদের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “This extols the virtues of a participatory society’, a society in which each and every citizen is able to achieve self-development by participating in the decisions that shope his or her life.”

জন স্টুয়ার্ট মিল (J. S. Mill): উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের পরবর্তী বিশিষ্ট প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল। তাঁর মতে গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তি-নাগরিকের মধ্যে যে সম্ভাবনাগুলি আছে তার যথাযথ এবং সর্বোচ্চ বিকাশ। রাজনৈতিক জীবন ও সরকারী কাজকর্মে অংশগ্রহণ করে নাগরিকেরা সচেতনতা লাভ করে এবং ব্যক্তিগত উন্নতি ঘটায়। তিনি অবাধ গণ-অংশগ্রহণের পক্ষে। তিনি এই উদ্দেশ্যে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটিয়ে তিনি গণতন্ত্রকে নাগরিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেবার কথা বলছেন। কারণ একমাত্র এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের ব্যক্তিত্বের স্বাধীন বিকাশ ঘটে। সরকারী কাজকর্মে নাগরিকদের উৎসাহ অনেকটাই বেড়ে যাবে যদি জোট ব্যবস্থা, স্বায়ত্বশাসন এবং জুরী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই কারণেই তিনি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমর্থক। ব্যক্তিগত সম্ভাবনার প্রকাশের পরিবেশ গড়ে তোলার পক্ষে তিনি। এই কারণেই তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের ধীনতা এবং সমাবিষ্ট হবার স্বাধীনতা সম্পর্কে সোচ্চার। আবার একই সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে সচেতন যে প্রাচীন গ্রীক নগর-রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে আধুনিককালে হুবহু অনুসরণ করা সম্ভবপর নয়। গ্রীক নগর রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা মুখোমুখি গণতন্ত্র সম্ভব একমাত্র কম জনগোষ্ঠী বিশিষ্ট নগরে। কিন্তু আধুনিক ব্যাপক জনবহুল, ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রই শ্রেয়। এখানে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন এবং তাদের মধ্য দিয়ে জনগণ সক্রিয়ভাবে সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।

জন স্টুয়ার্ট মিলের রাজনীতিক চিন্তাধারার সুবাদে উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের বিকাশের ও বিস্তারের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও প্রসারিত হয়েছে। মিল যে উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের চিত্র চিহ্নিত করেছেন। প্রতিনিধিমূলক সরকারের উদারনীতিক মডেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের এ হল এক অনুদূত রূপ। জে.এস. মিলের রাজনীতিক চিন্তার মুখ্য বিষয়বস্তু হল ব্যক্তিগত সামর্থ্যসমূহের সর্বোচ্চ ও সামঞ্জস্যযুক্ত বিকাশ ও বিস্তার। আধুনিক কালের রাজনীতি বিজ্ঞানের বিশিষ্ট লেখক অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “For Mill, the central virtue of democracy was that it promotes the highest and harmonious development of individual capacities. By participating in political life, citizens enhance their understanding, strengthan their sensibilities, and achieve a higher level for personal development. In short, democracy is essentially an educational experience.” ” মিলের রাষ্ট্রদর্শনে প্রাধান্য পেয়েছে ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিস্তার, দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা ও সুদক্ষ সরকারী প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট প্রবক্তা হিসাবে মিল মানবিক উদ্যোগ-আয়োজনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিধিকে প্রসারিত করার ব্যাপারে বিশেষভাবে আন্তরিক ছিলেন। মিল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার সমর্থনে মুখর হয়েছেন। কারণ ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাধীন ও সম্যক বিকাশ সাধনের জন্য এবং ব্যক্তিবর্গের পরিতৃপ্তি বা সন্তুষ্টির পরিধিকে প্রসারিত করার জন্য উদারনীতিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র আবশ্যক। ব্যক্তি-স্বাধীনতা সম্পর্কে মিলের ধ্যান-ধারণার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর On Libirty শীর্ষক গ্রন্থে। মিলের মতানুসারে, ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের জন্য আবশ্যক হল একটি অনুকূল অবস্থার বা সহায়ক পরিবেশের। এই পরিবেশটিই হল স্বাধীনতা। ব্যক্তিস্বাধীনতা বা স্বাধীনতা বিকাশের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি ও সংরক্ষণই হল গণতন্ত্রের মুখ্য ভূমিকা। ব্যক্তি মানুষের আত্মবিকাশের অনুপন্থী হল গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা। ব্যক্তির আত্মবিকাশ ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার সহায়ক ব্যবস্থা হিসাবে মিল প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার কথা বলেছেন। ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিধির প্রসার সাধনের জন্য মিল সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সংস্কারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

বিশেষ দুটি বিপদের কথা বলে জন স্টুয়ার্ট মিল উন্নয়নশীল গণতন্ত্রের সমর্থনে তাত্ত্বিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছেন। মিল স্বৈরাচারি ক্ষমতার বিপদ এবং অতি-রাষ্ট্রীয় বিপদ – এই দুটি বিপদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন তাঁর Consideration on Representative Government শীর্ষক গ্রন্থে। মিল সর্বাত্মকভাবে স্বৈরী ক্ষমতার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যাদির মোকাবিলা করতে গিয়ে ব্যক্তি-স্বাধীনতায় অধিক মাত্রায় হস্তক্ষেপ করে। তেমনি অতিরাষ্টীয় ক্ষমতা এবং এই ক্ষমতা প্রয়োগের বিপদ সম্পর্কেও মিল বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। এই আলোচনার ভিত্তিতে তিনি উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের স্বপক্ষে তাত্ত্বিক যুক্তির অবতারণা করেছেন।

মিল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের উপর আস্থা প্রকাশ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রকে সার্থক করে তোলার জন্য গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের মতামত প্রকাশের এবং শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। মিল সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, গণতন্ত্রের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারের আশঙ্কা আছে। বেহাম যে সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রের কথা বলেছেন তার মধ্যেই স্বৈরাচারী মানসিকতার সৃষ্টি হতে পারে। এই মানসিকতার কারণে সংখ্যাধিক্যের জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে সংখ্যালঘুদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে এবং সংখ্যালঘুদের অগ্রাহ্য করা হতে পারে। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন : “Mill’s particular concern was that democracy would undermine debate, criticism and intellectual life in general by encouraging people to accept the will of the majority, there by promoting uniformity and dull conformism. Quite simply, the majority is not always right, wisdom cannot be determined by the simple device of a show of hands.” গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে স্বৈরাচার সৃষ্টির আশঙ্কা সম্পর্কিত ধারণা ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে মিল বিশিষ্ট ঐতিহাসিক টকভিলের লেখা Democracy in America শীর্ষক গ্রন্থের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।

মিল গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারের বিপদের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বিপদের আশঙ্কার কথাও বলেছেন। এই বিপদটি হল আমলাতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। এই প্রভাবের পরিণামে ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিধি সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। মিলের মতানুসারে সরকার যুদ্ধ ও শান্তি, ব্যক্তির জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা, সুবিচার সম্পাদন প্রভৃতি করবে; কিন্তু মূলত ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যেই সরকারের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ থাকবে। এ বিষয়ে মিলের ভাবনার বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর On Liberty এবং Considerations on Representative Government শীর্ষক দুটি গ্রন্থে।

মিল ব্যক্তি-স্বাধীনতার অন্ধ সমর্থক ছিলেন এমন নয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে তিনি অবাধ অধিকার বা নিরঙ্কুশ ধারণা হিসাবে বিবেচনা করেন নি। তিনি স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণাটিকে দুটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে বিভক্ত করেছেন। এই ক্ষেত্র দুটি হল আত্মসম্পর্কিত এবং অপর সম্পর্কিত। অর্থাৎ আত্মসম্পর্কিত ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং অপরসম্পর্কিত ক্ষেত্রে স্বাধীনতা। মিলের মতানুসারে, আত্মসম্পর্কিত ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ বা অবাধ হতে পারে; কিন্তু অপরসম্পর্কিত ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সীমাহীন হতে পারে না।

উন্নয়নমূলক গণতন্ত্রের আলোচনায় মিল নারী-পুরুষের সমতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সৃষ্টির বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। নারীজাতির উপর পীড়নমূলক ব্যবস্থার অবসানের কথা তিনি বলেছেন। ক্ষমতা ও সুবিধার বিষয়টিকে মিল যোগ্যতার উপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। এ বিষয়ে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক বলপ্রয়োগমূলক ব্যবস্থাকে স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। রাজনীতিক ক্ষেত্রে এবং কর্মক্ষেত্রে মহিলাদেঁর দাবিয়ে রাখার উদ্যোগকে তিনি সমর্থন করেন নি। মিল বিশ্বাস করতেন যে, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা ব্যক্তিবর্গের উন্নয়নের সুযোগ-সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। মিলের মতানুসারে, ‘মানুষের বাস্তব চেতনা ও যুক্তিবোধ জাগ্রত হয় স্বাধীনতার সুবাদে। স্বাধীনতার অভিব্যক্তির সহায়ক হল যুক্তিবোধের বিকাশ। স্বাধীনতা ও যুক্তির পরিচর্যা, প্রতিপালন ও সংরক্ষণে সাহায্য করে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা’।