‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে আদর্শবাদী, নীতিবাদী বঙ্কিমচন্দ্র যদিও দাম্পত্য প্রণয়ের জয়গৌরব ঘোষণা করেছেন, কিন্তু কবি বঙ্কিম, স্রষ্টা বঙ্কিম শৈবালিনীর যে জীবনকথার পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে আধুনিকতার বাণীমন্ত্রবাহী। আধুনিক যুগ হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রতিষ্ঠার যুগ। নারীমুক্তি, স্বাধীন হৃদয়বৃত্তির পরিচয় প্রকাশে সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরই জয়গৌরব ঘোষিত হয়েছে। অবৈধ অসামাজিক প্রণয়কথা আধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যস্বরূপ। তবে শুধুমাত্র বন্ধনহীন প্রণয়ালেখ্য চিত্রণে বিশেষ কোনো অভাবনীয়তার পরিচয় মেলে না, বিবাহিত পুরুষের পরকীয়ার প্রতি প্রণয় মোহ, পরকীয়ার অন্য পত্নীকের প্রতি প্রণয়াকর্ষণের আলেখ্য আধুনিক কথাসাহিত্যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। আধুনিক কথাসাহিত্যে নারীর স্বাধীন ও মুক্ত প্রেমের প্রতিষ্ঠার যে আকাংক্ষা ও অভিপ্রায় নির্ভীক কণ্ঠে, সোচ্চার উল্লাসে উদ্‌ঘোষিত হয়ে চলেছে তার সঙ্গে শৈবালিনীর হৃদয়াভিব্যক্তির সাদৃশ্য অনুভূত হয়। ব্যক্তিমনের আশা-আকাংক্ষা প্রত্যাশার সঙ্গে সমাজশক্তির দ্বন্দ্ব সংঘাতের যে পরিচয় সে আধুনিক কথাসাহিত্যে নারী চরিত্রাবতারণার মধ্য দিয়ে গৌরব লাভ করে চলেছে, প্রতাপকে কেন্দ্র করে শৈবালিনী হৃদয়ের অসংবরণীয় প্রণয়তৃষ্মা ও সমাজশক্তির সঙ্গে, নিয়তি শক্তির সঙ্গে শৈবালিনীর যে দ্বন্দ্বসংঘাত আধুনিকতার মূলমন্ত্র স্বরূপ।

বাল্য কৈশোরের প্রণয়ী প্রতাপের আকর্ষণের অমিত-উন্মাদনা-উচ্ছ্বাসে শৈবালিনী স্বামী চন্দ্রশেখরের নিরাপদ নির্বিঘ্ন গৃহ পরিবেশ বর্জন করেছেন, সেই উদ্দেশ্যে নিঃশংকচিত্তে ফষ্টরের নৌকায় পা দিয়েছেন, নবাব সমক্ষে প্রতাপকে নিজের স্বামী বলে পরিচয় দিয়েছেন, সামাজিক কঠিন অনুশাসন অস্বীকার করেছেন, হিন্দু সমাজের পাতিব্রত্যের আদর্শকে ধুলিলুণ্ঠিত করেছেন, এইভাবে সমাজবিদ্রোহিনী শৈবালিনীর স্বাধীন ও মুক্ত হৃদয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। অনুমিত হয়, আখ্যায়িকার প্রথমদিকে কবি বঙ্কিম শৈবালিনীকে সহৃদয়তা সহানুভূ তির মধ্য দিয়ে অঙ্কন করেছেন, যদিও তিনি শৈবালিনী প্রতাপের প্রণয় প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘বাল্যপ্রেমে অভিশাপ আছে।’ কিন্তু তবুও এ সম্পর্কে তাঁর অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। শৈবালিনীর নারীসত্তার অর্ন্তলোকে প্রবেশ করে তিনি তাঁর অবরুদ্ধ যৌবন বেদনাকে যথার্থ উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু কবি বঙ্কিম ও নীতিবাদী বঙ্কিমের দ্বন্দ্বের পরিচিতি হল– বঙ্কিম শৈবালিনীকে বলেছেন ‘পাপীয়সী’, ‘পাপিষ্ঠা’, মানস-ব্যাভিচারিণী শৈবালিনীর কঠোর প্রায়শ্চিত্যের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু প্রায়শ্চিত্যের মধ্য দিয়ে রমানন্দ স্বামী কর্তৃক তাঁর ওপর যোগশক্তি প্রয়োগেও শৈবালিনী হৃদয়ের নিকট পরাজয় বরণ করেছেন। বাইরের কোনো শক্তি প্রয়োগে, কারো নির্দেশে বিধানে নারী হৃদয়ের দুর্মর প্রণয় চেতনাকে স্থানান্তরিত, কালান্তরিত, এমনকি পাত্রান্তরিত ও যে করা যায় না, শৈবালিনী তারই নিদর্শনস্থল। তাই সেই প্রায়শ্চিত্যের পরেও, রমানন্দ স্বামী কর্তৃক যোগশক্তির প্রয়োগের পরেও শৈবালিনী প্রতাপকে বলেছেন- “আমি সুখি হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই। যতদিন তুমি এ পৃথিবীতে থাকিবে, আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিও না। স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার, কতদিন ভালো থাকিবে জানি না, এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” –অর্থাৎ, যোগশক্তির প্রয়োগ, মানসিক প্রায়শ্চিত্য বিধান কোনোকিছুই শৈবালিনীর মধ্যে পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বরং প্রেমমহিমাই সেখানে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে।

সংযম শাসিত হলেও প্রতাপের ক্ষেত্রে আধুনিক মুক্তি স্বাধীন আদর্শবাদী প্রেমচেতনার পরিচিতি লক্ষিত। আখ্যায়িকার শেষাংশে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয়ে রয়েছে, রমানন্দ স্বামী মৃতুপথযাত্রী প্রতাপকে প্রশ্ন করছেন– “তুমি শৈবালিনীকে ভালোবাসিতে?” এ প্রশ্নের উত্তর ও প্রতাপের মানস-বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বঙ্কিম লিখেছেন– “সুপ্ত সিংহ যেন জাগিয়া উঠিল। সেই শবাকার প্রতাপ, বলিষ্ঠ, চল, উন্মত্তবৎ হুংকার করিয়া উঠিল – কী বুঝিবে তুমি সন্ন্যাসী। এ জগতে মনুষ্য কে আছে যে আবার ভালোবাসা বুঝিবে? কে বুঝিবে এই ষোড়ষ বৎসর শৈবালিনীকে কত ভালোবাসিয়াছি? পাপচিত্তে আমি তার প্রতি অনুরক্ত নহি—আমার ভালোবাসার নাম জীবনবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা। শিরে শিরে, শোণিতে শোণিতে, অস্থিতে অস্থিতে আমার এই অনুরাগ অহোরাত্র বিচরণ করিয়াছে। কখনো মানুষে তাহা জানিতে পারে নাই—মানুষে তাহা জানিতে পারিত না—এই মৃত্যুকালে আপনি কথা তুলিলেন কেন? এ জন্মে এ অনুরাগে মঙ্গল নাই বলিয়া, এ দেহ পরিত্যাগ করিলাম। আমার মন কলুষিত হইয়াছে—কী জানি শৈবালিনীর হৃদয়ে আবার কী হইবে? আমার মৃত্যু ভিন্ন হইবে উপায় নাই—এইজন্য মরিলাম।”

একদা শৈবালিনীর জন্য চন্দ্রশেখর আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। আখ্যায়িকার শেষ অংশে চন্দ্রশেখর শৈবালিনীসহ বেদগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেছেন, কিন্তু উভয়ের মধ্যে কী নির্দ্বন্দ্ব দাম্পত্য বন্ধন গড়ে ওঠা সম্ভব? কখনোই না। নিরাসক্ত চন্দ্রশেখরের সাহচর্যে দীর্ঘদিন থেকেই তো শৈবালিনী আবার প্রতাপের কথা স্মরণ করতে শুরু করেছিলেন এবং প্রতাপের জন্যই তিনি কুলত্যাগিনী হয়েছেন। শৈবালিনীর প্রতি মোহগ্রস্ত চন্দ্রশেখর ও শৈবালিনীকে গৃহমধ্যে না পেয়ে তিনিও নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। এই দীর্ঘ ব্যবধানের পর মহাকালের সৌজন্যে যখন আবার তাঁরা একত্র বসবাসের জন্য বেদগ্রামে ফিরলেন, তাতে কী কখনোই সম্ভব হবে পূর্বের সেই সুখী দাম্পত্য জীবন ফিরে পাওয়া?

প্রসঙ্গক্রমে দলনী বেগমের কথাই যদি বলা যায়, সেখানে নবাবের প্রতি তার প্রেম- অমরালেখ্য সৃষ্টি সহায়ক। তিনি অন্ধের মতো নবাবকে ভালোবাসতেন, নিজের অপরাধের বিচারের অপেক্ষা না করে প্রভুর নির্দেশ মানতে বিষ খেয়ে যেভাবে তিনি আত্মহত্যা করলেন তাতে সততই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বোধ করি ইউরোপীয় ট্রাজেডিতে এমন নিদর্শন মেলে।

সর্বোপরি, স্বীকার করতেই হয়, শৈবালিনী অনন্যসাধারণ এক পরমাশ্চর্য রমণী চরিত্র। তাঁর প্রণয়তৃষার দুর্মর আবেগ, আমাদের সচকিত করে। এমনকি তাঁর সম্পর্কে রমানন্দ স্বামীও মন্তব্য করেছেন– “আজ এতকাল সর্বশাস্ত্র অধ্যয়ন করিলাম, সর্বপ্রকার মনুষ্যের সহিত আলাপ করিলাম, কিন্তু সকলই বৃথা—এই বালিকার মনের কথা বুঝিতে পারিলাম না। এ সমুদ্রে কী তল নাই?” বস্তুতঃ লেখক শৈবালিনীর চরিত্রে লেখক যে জটিলতার সৃষ্টি করেছেন তা ভবিষ্যৎকালে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রকে বিব্রত করতে ছাড়েনি। অর্থাৎ নিঃসংশয়চিত্তে স্বীকার করতে হয়, উনিশ শতকে সৃষ্ট চন্দ্রশেখর উপন্যাসখানি মানবিক প্রেমের ব্যতিক্রমী নিদর্শন।