ভূমিকা: উনিশ শতকে মহরাষ্ট্রের সমাজসংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে জ্যোতিবা গােবিন্দ ফুলে (১৮২৭-১৮৯০ খ্রি.) এক শ্রদ্ধেয় নাম। শূদ্র- সহ নিম্নশ্রেণির মানুষের সর্বিক উন্নয়নে জ্যোতিবা ফুলে ছিলেন বদ্ধপরিকর। জ্যোতিবার জীবনীকার অধ্যাপক পাওয়ারের মতে “ভারতে সমাজ ও শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বিপ্লবী” (He was a true revolutionist of India in social reforms and education)।

[1] যুক্তিবাদী সংস্কার: প্রথম জীবনে জ্যোতিবা ফুলে খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ও হিন্দুধর্ম-বিরােধী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যুক্তিবাদ ও সাম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাবলির সমাধান ও ধর্মীয়-সামাজিক কুসংস্কারগুলির অবসান ঘটুক। তিনি আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন।

[2] সমাজসংস্কার: মহারাষ্ট্রের জনজীবনে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আধিপত্য, জাতিভেদ প্রথা এবং শূদ্র ও নারীদের সীমাহীন দুর্দশার বিরুদ্ধে জ্যোতিবা গােবিন্দরাও সস্ত্রীক জেহাদ ঘােষণা করেন। শিশুহত্যা নিবারণের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তােলেন ‘হােম ফর প্রিভেনশন অব ইনফ্যানটিসাইড’। যেখানে সমাজের তথাকথিত অবৈধ ছেলেমেয়েরা (পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন) আশ্রয় পেত। দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জ্যোতিবা ফুলে সত্যশােধক সমাজ (১৮৭৩ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।

[3] ব্রাহ্মণ্য বিরােধিতা: জ্যোতিবা ফুলে মনে করতেন—সমাজে দরিদ্র, অস্পৃশ্য ও নীচু জাতের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ব্রাহ্মণগণ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা ‘গুলামগিরি’ গ্রন্থে তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানান। পাশাপাশি কুনরি, মালি, মাভ, মাহার প্রভৃতি নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য-বিরােধী প্রচার শুরুর মধ্য দিয়ে অব্রাত্মণ আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

[4] নারীকল্যাণ: তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সরব হন এবং শিশুকন্যা হত্যা নিবারণের প্রচেষ্টা চালান। নিম্নবর্ণের নারীদের জন্য মহাত্মা ফুলে যেমন একাধিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তেমনই বিদ্যাসাগরের মতাে বিধবাবিবাহের সমর্থনে মহারাষ্ট্রে প্রবল আন্দোলনও গড়ে তােলেন।

[5] শিক্ষাসংস্কার: জ্যোতিবা মনে করতেন শূদ্রসহ বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষকে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার আলােয় নিয়ে আসা প্রয়ােজন। তাই তিনি ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাঈ পুনাতে পশ্চিম ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৫১ খ্রি.)। শিক্ষা সংস্কারক জ্যোতিবার শিক্ষামূলক কাজগুলিতে সাহায্য করেন সদাশিব, বল্লাল পরাঞ্জপে প্রমুখ মারাঠা সংস্কারকগণ।

মূল্যায়ন: যুক্তিবাদ ও আধুনিক মনের অধিকারী জ্যোতিবা ফুলে মহারাষ্ট্রীয় নিম্নবর্ণের মানুষদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আজীবন কাজ করে গেছেন। এমনকি ব্রাহ়মণ্যতন্ত্রের কাঠামাে থেকে নিম্নবর্ণের মানুষদের রক্ষার জন্য তিনি ব্রিটিশ শাসনের সাহায্য নিতেও দ্বিধা করেননি। এম আর লেভারলের মতে—“সাম্য ও যুক্তিবাদীতার ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ কাঠামাে তৈরির লক্ষ্যে ফুলে কাজ করে গেছেন” (Phule worked for a new social structure built on quality and nationality)।