উনিশ শতকে বাংলা গীতিকবিতা বিকাশের ধারাক্রম বর্ণনা কর
ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব, বিকাশ, পরিণতি ও পরিপূর্ণতা দেখা যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতা যে ছিল না তা নয়। চর্যাগীতি, বৈষ্ণব পদাবলী, বাউলগান এসবই গীতিকবিতা। কিন্তু আধুনিক গীতিকবিতার সাথে এগুলো বড়ো রকমের পার্থক্য আছে।
গীতিকবিতার উদ্ভব: গীতিকবিতা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ লিরিক (Lyric)। ইংরেজি লিরিক শব্দের মূলে রয়েছে প্রাচীন গ্রিক অনুষঙ্গ। Lyric নামক যন্ত্রের সাহায্যে যে ছন্দোবদ্ধ রচনা গীত হতো মূলত তাকেই বলা হতো Lyric। অর্থাৎ, বীণার সাহায্যে গান করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে লিরিক বা গীতি কবিতা। কবির একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি যখন সহজ সাবলীল গতিতে সংঙ্গীত মুখর হয়ে আত্মপ্রকাশ করে তখন তা গীতি কবিতা হয়ে উঠে।
কবির ব্যক্তিগত অনভূতির সঙ্গে কবিতাটি যুক্ত, তারই স্বীকৃতি এই ‘গীতি কবিতা’ শব্দে। Cassele’s Encyclopaedia of literature G Lyric, গীতি কবিতার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে রয়েছে Lyric (i) A short poem intruded for singing ually to the accompaniment of a lyric of other instrument, (ii) A short poem expressing personal feeling.
গীতিকবিতার সংজ্ঞা: গীতি কবিতা ব্যক্তিধর্মী, ইংরেজি সংজ্ঞা অর্থাৎ, যে কবিতায় কবির আত্মানুভূতি বা একান্ত ব্যক্তিগত কামনা বাসনা’ ও আনন্দ-বেদনা তাঁর প্রাণের অন্তঃস্থল থেকে আবেগ কম্পিত সুরে অখণ্ড ভাব মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে তাকে গীতি কবিতা বলে। গীতিকবিতাকে আমরা ভক্তিমূলক, স্বদেশপ্রীতিমূলক, প্রেমমূলক, প্রকৃতিমূলক, সনেট, চিন্তামূলক, শোকগীতিমূলক, স্তোত্র ও লঘু বৈঠকী কবিতা হিসেবে বিভক্ত করতে পারি।
১. ভক্তিমূলক গীতি কবিতা: ভক্তি বা ধর্মভাবকে অবলম্বন করে যে কবিতা রচিত হয় তাকে ভক্তিমূলক গীতি কবিতা বলে। যেমন- রামপ্রসাদের পদাবলি, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি, নজরুল ইসলামের গজল।
২. স্বদেশপ্রীতিমূলক কবিতা: যে কবিতায় কবির স্বদেশপ্রীতি উৎসারিত হয়, দেশের গৌরবকাহিনি ও অতীত বীরগণের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দেশ ও জাতির ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ পায়, তাকে বলা হয় স্বদেশ প্রীতিমূলক কবিতা। যেমন- মধুসূদনের বঙ্গভাষা, রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ, সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’।
৩. প্রেমমূলক কবিতা: কবির প্রেম ভাবনা, প্রেমের বিচিত্র প্রকাশ, আশা-নৈরাশ্য, বেদনা- মাধুর্য, আনন্দ-দুঃখ, বিরহ-মিলন প্রভৃতি যে কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায় তাকে প্রেমমূলক গীতি কবিতা বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ নজরুল ইসলামের ‘চক্রবাক’, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’।
৪. প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা: প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ কবি যখন আত্মগত ভাব-কল্পনায় গীতি মধুর রূপে কবিতায় আত্মপ্রকাশ করেন তখন তাকে প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা বলে। যেমন- রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষামঙ্গল’, নজরুলের ‘বাদল দিন’ প্রভৃতি।
৫. সনেট: চৌদ্দ বা আঠারো অক্ষরে সমন্বিত ছন্দে চতুর্দশ পংক্তিতে একটি মাত্র অখণ্ড ভাব কল্পনা যখন গীতি কবিতার রস পরিবেশনে সমর্থ হয় তখন তাকে সনেট বলে। মাইকেল মধুসূদন প্রথম এদেশে সনেট ‘কপোতাক্ষ নদ’ লিখেন।
৬. চিন্তামূলক কবিতা: জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কবির ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা যে কবিতায় বাণীরূপ লাভ করেছে তাকে চিন্তামূলক গীতি কবিতা বলা হয়। যেমন- রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’।
৭. শোকগীতি: কবিতায় ব্যক্তি মানসের শোকানুভূতি বিশেষভাবে কাব্যরূপ লাভ করলে তাকে শোক গীতিমূলক কবিতা বলে। যেমন- নজরুলের ‘চিত্তনামা’, জসীমউদ্দীনের ‘কবর’।
৮. তোত্র: প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে রচিত যে গান রঙ্গমঞ্চের উপর বিভিন্ন সুরে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নৃত্যবাদ্যাদি সহযোগে গীত হতো তাই স্তোত্র। যেমন- রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষাশেষ’, মোহিতলাল মজুমদারের ‘নারী স্তোত্র’।
৯. লঘু বৈঠকী কবিতা: সমাজ ও ব্যক্তির লঘু আনন্দের চিত্র কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি দ্বারা কাব্যরূপ লাভ করলে তাকে লঘু বৈঠকী কবিতা বলে। যেমন- ঈশ্বর গুপ্তের ‘পাঁঠা’, ‘তপসে মাছ’।
গীতি কবিতার বিকাশ: আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারায় গীতি কবিতার উদ্ভব ও বিকাশ উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে। যোড়শ সপ্তদশ শতকে সংঘটিত ইংল্যান্ডের রেনেসাঁর আদর্শে মধ্যযুগের চিন্তা ও জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবার সাধনা করেছে উনিশ শতকের বাঙালি। রেনেসাঁর প্রধান প্রত্যয় মানবতাবাদ। রাজা রামমোহনের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় সতীদাহ নিবারণের চেষ্টায় কিংবা ইংরেজি শিক্ষার আমন্ত্রণে, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের সাধনায় এবং স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের উৎসে সর্বাধিক সক্রিয় ছিল। এ মানবমুখিতার ফলেই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকীর্তি নারীর দেবীমূর্তি অধুনাকালে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত মানসী রূপকল্পনায় কবির কাছে ধরা দিয়েছে। মধুসুদনের কাব্যে হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও অন্যদের রচনায় বিচিত্র পথে যে মানবতা আপনকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিহারীলাল বা তাঁর অনুসারীদের হতে সে মানব রসাশ্রিত নারীর জননী, প্রেয়সী, কল্যাণময়ী মূর্তি সমুদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
মধ্যযুগে অসংখ্য কবি কাব্য রচনা করেছেন। সেসব কাব্য অধিকাংশই ছিল কাহিনি কাব্য। প্রাচীন যুগের চর্যাপদ এবং মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলিতে গীতি কবিতার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেলেও আধুনিক অর্থে যাকে গীতি কবিতা বলে, সেগুলো ছিল না। গীতি কবিতা একান্তই আধুনিক কালের সৃষ্টি। কবি হৃদয়ের অনুভূতি এতে প্রকাশ পায়। আন্তরিকতাপূর্ণ অনুভূতি, অবয়বের স্বল্পতা, সংগীতমাধুর্য গীতিস্বাচ্ছন্দ্য হলো গীতি কবিতার বৈশিষ্ট্য। কবি হৃদয়ের একান্ত অনুভূতিটি গীতি কবিতায় ঝংকৃত হয় আবেগ কম্পিত সুরে। গীতি কবিতায় কবির ব্যক্তি পরিচয়টি বড়ো হয়ে উঠে।
উনিশ শতকে এদেশে যে নব জাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল তা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে। কাব্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন কাহিনি কাব্য ও গীতি কবিতা বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। দুটি ধারা পাশাপাশি চললেও গীতি কবিতার ধারাটি টিকে আছে। কাহিনি কাব্য রচনার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়েছে।
মধুসূদনের চতুর্দশপদী কবিতায় গীতি কবিতার সুর শোনা গেলেও তাঁর গীতিধর্মী কবি মানস যন্ত্রণাবোধে দগ্ধ এবং তপ্ত জীবনের দুঃখ অভিমান ভারে আপ্লুত। সে আবরণ অতিক্রম করে মধুসুদন তাঁর কোন কবিতাতেই নিভৃত মনের গোপনতম বাসনার খবর খুঁজে পাননি, তাকে পারেননি সকল প্রকাশে মুক্তি দান করতে।
হেমচন্দ্র বা নবীনচন্দ্রের গীতি কবিতায় এবং ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্য কবিতায় স্থানে স্থানে কবির নিভৃত ব্যক্তিত্বের পরিচয় উদ্ভাসিত হয়েছে। কিন্তু সমকালীন জীবন প্রচ্ছদের সান্ধ্যতা এবং অভিপ্রাতে ব্যক্তিচিত্তের বেদনা বা অনুশোচনা বোধের তীব্রতা এ কবি কুলের নিভৃত গোপন ‘নিজের কথার’ উৎসমূলকে রুদ্ধ করে রেখেছিল। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরগুপ্তের ২/১টি কবিতায় গীতি কবিতার সুর ফানিত হয়েছে। এরপর মাইকেল মধুসূদন দত্তের চতুর্দশপদী কবিতাবলীর ২টি কবিতায় গীত কবিতার সার্থক রূপ ফুটে উঠেছে তা হলো ‘আত্মবিলাপ’ ও ‘বঙ্গভাষা’।
১. বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-৯৪): বিহারীলালই সর্বপ্রথম বাংলার কবি। যিনি কাব্য বীণায় আপন মনে সুরের পর সুর সৃষ্টি করেছেন। যে সুর সমকালীন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অভিনব এবং যা সম্পূর্ণরূপে কবির মগ্ন চৈতন্যের সৃষ্টি। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলালকে বাংলা কাব্যের ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পাখির কুজনের মতো বিহারীলালের কাব্যে কবির নিভৃত কথার গূঢ়ভাবব্যঞ্জনাটুকু পাঠকের মর্মলোকে রহস্যাবরণের সৃষ্টি করে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সবটুকু অর্থ নিঃশেষে প্রকাশ করতে পারে না। এজন্য রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের কবিকর্মকে স্বগতোক্তি নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর প্রখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সারদা মঙ্গল’ (১৮৭৯) নিজের অন্তর্নিহিত ধ্যান কবি সত্তাকে উদ্দেশ্য করে কবি জিজ্ঞাসা করেছেন-
“হে যোগেন্দ্র যোগাসনে
ঢুলু ঢুলু দু’নয়নে বিভোর বিহ্বল
মনে কাঁহারে ধেয়াও।”
সমগ্র কাব্যটিতে কোথাও এ প্রশ্নের উত্তর বোধগম্য হতে পারেনি। তাই এক রসবিদগ্ধ পাঠিকা এ প্রশ্নের উত্তর যুক্ত নতুনতর করে দাবি করেছিলেন কবির কাছে। কবি নতুন কাব্যে আবার সেই পুরাতন কথাই লিখলেন তাঁর “সাধের আসনে” (১৮৮৯ খ্রিঃ)
“ধেয়াই কাহারে দেবী
নিজে আমি জানিনে।”
সেজন্য বলা যায়, কবি নিজেই তাঁর কাব্য ধ্যানের স্বরূপ সম্বন্ধে স্পষ্ট অবহিত ছিলেন না। কবির মনের গভীরে ভাবের উচ্ছাস সর্বদাই তরল চপল ভঙ্গিতে প্রবাহিত হয়েছে; কিন্তু কোন মুহূর্তেই তা ঘনবদ্ধ কাব্য ভাবনার অবয়ব লাভ করতে পারেনি। ‘সারদা মঙ্গলের’ সারদা তার কাছে কখনো জননী, কখনো প্রেয়সী, কখনো বা কন্যা। তিনি দয়া, হে, প্রেমে মানবের চিত্তকে অহরহ বিচলিত করেছেন। তিনি সৌন্দর্যরূপে জগতের অভ্যন্তরে বিরাজ করেছেন এবং জগতের মূলীভূত সৌন্দর্যকে কবি তাঁর আত্মার ব্যক্তিগত প্রেমসূত্রে গেঁথে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন।
বিহারীলাল বিহঙ্গ সৌন্দর্যকে তাঁর নিভৃত মানসলোকে বিচিত্র রূপান্বিত করতে চেয়েছিলেন রোমান্টিক কল্পনার স্পর্শ দিয়ে সেই সঙ্গে ছিল গভীর নিসর্গ প্রীতি। তাঁর স্পর্শকাতর কবিমন বস্তুজগত থেকে মুক্তি কামনায় প্রকৃতির নিভৃত জীবন লোককে স্বেচ্ছায় বিচরণ করেছে। ‘সারদা মঙ্গলের’ স্থানে স্থানেও ‘নিসর্গ সন্দর্শনে’ (১৮৭০) তাঁর প্রকাশ রয়েছে। তার অন্যান্য কাব্যের মধ্যে সঙ্গীতশতক (১৮৬২) ‘বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০)’, ‘বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০)’, ‘প্রেম প্রবাহিনী (১৮৭০) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
২. কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৭-১৯০৫): কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার পারস্য কবি হাফিজের অনুসরণে ‘সম্ভাব শতক’ (১৮৬১) রচনা করেন। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পরিচিত। কবির খণ্ড কবিতাগুলো নীতিবাদমূলক হলেও উপদেশ এবং সৃষ্টার প্রতি আত্মনিবেদনের এমন সহজ, সরল ও অনুভূতিগ্রাহ্য অভিব্যক্তি সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিরল। একটি উদাহরণ দিলেই তা বুঝা যাবে। অপব্যয়ের ফল-
“যে জন দিবসে, মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি;
আশুগৃহে তার দেখিবে না আর,
নিশিতে প্রদীপ বাতি।”
মহাভারতের ‘বাসব নহুষ’ উপাখ্যান অবলম্বনে ‘মোহন ভোগ’ (১৮৭১) নামে একখানা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
৩. সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৩৮-৭৮): বিহারীলাল এর রচনায় আত্মলীন গীতি ভাবনায় প্রথম প্রকাশ অসীম উচ্ছাসে অতি স্ফীত হয়েছিল। সে পথ ধরেই বাংলা কাব্যে এলেন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার। রোমান্টিক ভাবনার ধারাকে তিনি ক্ল্যাসিক্যাল ভাবনায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায় পাণ্ডিত্য, দক্ষতার অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে। সুরেন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ‘মহিলা কাব্য’ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৮৮০ ও ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে। ড. সুকুমার সেন মনে করেন “মহিলার পরিকল্পনা অবশ্যই বিহারীলালের ‘বঙ্গ সুন্দরীর’ পাঠের ফল।” নারী সৌন্দর্যের অনবদ্য রূপ সৃষ্টি মহিলা কাব্যের বৈশিষ্ট্য। যেমন-
“স্পর্শে পদ রাগ ভরা,
আশোক লভিল ধরা;
এলো কেশে কে এল রূপসী।
কোন বনফুল কোন গগনের শশী।”
কবির ভাব কল্পনায় বিহারীলালের অনুসারী হলেও প্রকাশশৈলীর বিচারে তিনি ছিলেন তাঁর পরিণততর উত্তর সাধক। তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে ‘ষড় ঋতু বর্ণনা’ (১৮৫৬) ‘সবিতা সুন্দর্শন’ (১৮৭০) ও ‘ফুল্লরা’ ইত্যাদি কাব্য।
৪. দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬): রবীন্দ্রের অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলালের অনুসারী ছিলেন না, ছিলেন তার সমাজকর্মী বন্ধু। বিহারীলালের সময়কালে কাব্য রচনা করেও রোমান্টিক ভাবনার সঙ্গে অপূর্ব চিন্তা সংসক্তির যোজনা করেছিলেন তিনি। এ দিক থেকে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অনন্যতুল্য। দ্বিজেন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কবি সুলভ স্বপ্নাবিষ্টিতার সঙ্গে অনুসৃত হয়েছিল দুর্লভ দার্শনিক চিন্তা। এ দু’য়ের সফল সম্পূর্ণ কাব্যরূপ ধরা পড়েছে তাঁর ‘স্বপ্ন প্রয়াণ’ (১৮৭৫) কাব্যে। ‘যৌতুক ও কৌতুক’ (১৮৮৩) নামে একটি গাঁথা কাব্যও লিখেছিলেন তিনি।
৫. দেবেন্দ্রনাথ সেন (১৮৫৫-১৯২০): বিহারীলালের সহজ আত্মলীন ভাবস্বপ্ন ও সুরেন্দ্রনাথের অতিশয় রূপ সচেতনতা দেবেন্দ্রনাথের রচনায় সমন্বিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ রোমান্টিক কাব্য স্বরূপকে জাগ্রত করে তুলেছিল। তাঁর কবি ভাবনা ছিল প্রধানত গার্হস্থ্য প্রেমসুখ তন্ময়। নিজের কবি স্বভাবকে পরিচালিত করে তিনি লিখেছেন-
“চিরদিন চিরদিন রূপের পূজারী আমি
কংগের পূজারী
সারা সন্ধ্যা সারা।নশি রূপ বৃন্দাবনবাসি
হিন্দোলায় দোলে নারী আনন্দে নেহারি।”
কবির রূপ সৌন্দর্য প্রীতিমানব লোকোত্তীর্ণ হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যে একীভূত হয়ে গেছে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অশোকগুচ্ছ’ (১৯০০), শেফালীগুচ্ছ (১৯১২), পারিজাতগুচ্ছ (১৯১২), পুষ্প প্রীতির সাথে প্রকৃতি প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর অন্যান্য কাব্য গ্রন্থ ‘ঊর্মিলা কাব্য’ (১৮৮১), ‘হরিমঙ্গল (১৯০৫) ইত্যাদি বিশেষ ভাবে তাঁর যোগ্য কবি কৃতির স্বাক্ষর বহন করে।
৬. অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯): বিহারীলালের প্রত্যক্ষভাব শিষ্যদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কবি অক্ষয়কুমার বড়াল। বয়সের বিচারে তিনি রবীন্দ্রনাথের বয়স্ক ছিলেন। কিন্তু কাব্য ভাবনার দিক থেকে ছিলেন রবীন্দ্রপূর্ব বিহারীলালের যুগের শিল্পী। নারীর গার্হস্থ্য সুন্দর রূপ পিপাসায় তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের সমধর্মী উত্তর সাধক। অক্ষয়কুমারের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য ‘এষা’ (১৯১২) লিখিত হয়েছিল পত্নী বিয়োগ উপলক্ষ্যে। রোমান্টিক উৎকণ্ঠা তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্পর্শকাতরতার অনুভব কোথাও আনন্দে উদ্বেল, কোথাও বিষণ্ণ উদাস। অন্যান্য গীতি কবিদের মতো তিনি নারী বন্দনামূলক কবিতা লিখেছেন। নারী বন্ধনার যে আকুতি ফুটিয়ে তুলেছেন তার মূলে ছিল পত্নী প্রেম। ‘প্রদীপের নারী’ বন্দনায় তিনি লিখেছেন-
“রমণীরে, সৌন্দর্য তোমার
সকল সৌন্দর্য আছে বাঁধা!
বিধাতার দৃষ্টি যথা জড়িত প্রকৃতি সনে,
দেব- প্রাণ বেদ-গানে সাধা।।”
এছাড়া তার অন্যান্য কাব্য গ্রন্থের মধ্যে ‘কনকাঞ্জলী’ (১৮৮৫), ‘ভুল’ (১৮৮৭), ‘শঙ্খ’ (১৯১০), ‘প্রদীপ’ (১৮৮৪) ‘এষা’ (১৯১২) তার সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্য।
৭. গোবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৬-১৯১৮): ভাওয়ালের স্বভাব কবি গোবিন্দ দাসের কবিতায় আন্তরিক অনুভূতি ও সহজ কবিত্ব শক্তির অভাব ছিল না। কিন্তু কবিতা রচনায় যত্নকৃত কলাকৌশল সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না তিনি। তাঁর ভাষা বাকভঙ্গিতে ঋজুতা ও বলিষ্ঠতা ছিল, কিন্তু তার কোনো সুমার্জিত শিল্পরূপ ছিল না। তাই তাঁকে স্বভাব কবি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রেমের কবিতায় গোবিন্দ দাস পরম মানবিক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। প্রেমিকার প্রতি তার অনুভূতি- “আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংস সহ।”
তাঁর ‘কুমকুম’ (১৮৯২), ‘বস্তুরী’ (১৮৯৫), ‘ফুলরেণু’ (১৮৯৬), ও ‘বৈজয়ন্তী’ (১৯০৫) ইত্যাদি সমাজে সমাদৃত হয়েছে।
৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১): বাংলা গীতি কবিতার জগতে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ঘটনা। তিনি বাংলা গীতি কবিতার জগৎকে শুধু ভাব এবং রূপেই সমৃদ্ধদান করেননি। বিশ্ব সভায় বাংলা কবিতার পরিচিতি এনেছেন। তারই হাতে বাংলা গীতি কবিতা পরিণতি কাব্য গুণে গুণান্বিত হয়ে উঠে। সীমা এবং অসীমের মিলন সাধনের চেষ্টাই ছিল কবির কাব্য বচনের মূল প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃতি ও রূপচিত্রণের পাশাপাশি মানব জীবনের বিভিন্ন বাস্তব অনুভূতি ও মহিমা প্রকাশ হতে দেখা গেছে। যেমন-
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য গীতি কবিতা লিখেছেন। তাঁর মতো এত অধিক কবিতা আর কোনো কবিই রচনা করেননি। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে “প্রভাত সংগীত’ (১৮৮৩), ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৫), ‘চিত্রা’, ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০), ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), ‘নৈবেদ্য’ (১৯১০), ‘কল্পনা’ (১৯০০), ‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘মহুয়া’ (১৯২৯) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
৯. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬): নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যে একটি নতুন সুর জুড়ে দিলেন। তিনি বিদ্রোহের কথা বললেন, আত্মসচেতন হতে আহ্বান জানালেন। নজরুল ছিলেন উৎপীড়িত জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল। কবি তাঁর কাব্যের আবেদন ছড়িয়ে দিলেন শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল মানুষের মধ্যে। ‘অগ্নিবীণা’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া ‘বিষের বাশী’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘সর্বহারা’, ‘ঝিঙ্গেফুল’, ‘দোলন চাঁপা’, ‘ডাঙ্গরগণ’ ও চক্রবাক তাঁর বিখ্যাত কবিতার বই।
গীতি কবিতার ধারায় মহিলা কবিদের মধ্যে ‘স্বর্ণকুমারী দেবী, গিরীন্দ্রমোহন দাসী, মানকুমারী বসু ও কামিনী রায় এর নাম উল্লেখযোগ্য।
স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২): স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো বোন। তাঁর কবিতা ও গান বিভিন্ন সংকলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কাব্য, সাহিত্যের প্রায় সকল ক্ষেত্রে তাঁর অল্প বিস্তর কৃতিত্বে বিরাজমান ছিল। সাহিত্য চর্চা, সংবাদপত্র পরিচালনাও তিনি করেন। তাঁর কাব্য গ্রন্থগুলো হলো- ‘বসন্ত উৎসব’ (১৮৭৯), ‘গাথা’ (১৮৮০), ‘বিবাহ উৎসব’ (১৮৯২), ‘কবিতা ও গান’ (১৮৯৫), ‘দেব কৌতুক’ (১৯০৬), ও ‘যুগান্তর’ (১৯২৮)। ‘বসন্ত উৎসব’ ও ‘বিবাহ উৎসব’ গীতিনাট্য এবং ‘দেব কৌতুক’ ও ‘যুগান্তর’ কাব্যনাট্য। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের জাতীয়তাবোধ এবং বিহারীলালের বৃন্দ অনুসরণ করে স্বর্ণকুমারী দেবী কাব্যরচনা করেছিলেন।
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী (১৮৫৮-১৯২৪): ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ আগস্ট, কলকাতার ভবানীপুরস্থ মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার কাব্যের মূলসুর দুঃখ এবং বেদনা। তাঁর দু’খানা কবিতার বই ‘কবিতা হার (১৮৭৩) ও ভারতকুসুম (১৮৮২)। তিনি ‘অশ্রুকণা’ কাব্যের মাধ্যমে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ‘অশ্রুকণার’ পরে ‘আভাষ’ (১৮৯০) ঐতিহাসিক নাট্য কাব্য ‘সন্ন্যাসিনী বা মীরাবাঈ’ (১৮৯২), ‘শিখা’ (১৮৯৬), ‘অর্ঘ্য’ (১৯০২), ‘স্বদেশিনী’ (১৯০৬) এবং ‘সিন্দুগাথা’ (১৯০৭) প্রকাশিত হয়।
মানকুমারী বসু (১৮৬৩-১৯৪৩): মাইকেল মধুসূদনের ভ্রাতুস্পুত্রী মানকুমারী বসু। তিনি ইংরেজি ও সংস্কৃত দুই ভাষাই জানতেন এবং তাঁর রচনায় এ জ্ঞানের পরিচয় আছে। তাঁর প্রথম বই ‘প্রিয় প্রসঙ্গ’ (গদ্য-পদ্য) প্রকাশিত হয়। তারপর কাব্য ‘কুসুমাঞ্জলি’ (১৮৯৩), ‘কনকাঞ্জলি’ (১৮৯৬), ‘বীরকুমার বধ’ কাব্য (১৯০৪), ‘বিভূতি’ (১৯২৪), ‘সোনার সাথী’ (১৯২৭) ইত্যাদি প্রকাশিত হয়।
কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩): বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি কামিনী রায়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর প্রথম ‘আলো ও ছায়া’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কামিনী রায় বহুগ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো-‘নির্মাল্য’ (১৮৯১), ‘পৌরাণিকী’ (১৮৯৭), ‘গুঞ্জন’ (১৯০৫), ‘মাল্য ও নির্মাল্য’ (১৯১৩), ‘অশোক সঙ্গীত’ (১৯১৪), ‘দীপ ও ধূপ’ (১৯২৯) এবং ‘জীবন পথে’ (১৯৩০)।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক গীতি কবিতার ধারাটি প্রবর্তন করেন বিহারীলাল চক্রচর্তী। তিনি ছিলেন গীতি কবিতার বেলায় ভোরের পাখির মতো। তাঁর অস্ফুট বাণীতে গীতি কবিতার সূচনার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিল। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে এ ধারাটি বিশেষভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে এবং একমাত্র তাঁরই বিস্ময়কর প্রতিভার স্পর্শে বাংলা গীতি কবিতার একটি পূর্ণ পরিণত ঘটে। তাছাড়া এ কথাও স্মরণীয় যে, বিহারীলাল ও রবীন্দ্রযুগের বিভিন্ন কবিতার ইতিহাস একক রচনা সীমাতে আবদ্ধ নয়। সমসাময়িক নানা শিল্পীর রচনায় তাঁদের ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সে যুগ স্বভাবের পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে বিচিত্র রূপরসে তা আলোচনা থেকে বুঝা যায়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment