ভূমিকা: মহাকাব্য আদি, মধ্য ও অন্ত্য সমন্বিত বর্ণনাত্মক কাব্য। মানবজীবনের গভীর ও সমগ্র অনুভবে শিল্পরূপ হচ্ছে মহাকাব্য। সাহিত্যের এ প্রাচীন ফর্মটি জীবনের সমগ্রতা সন্ধানী। মানুষের চিরায়ত শিল্প অন্বেষার কাছে মহাকাব্যের মূল্য অপরিসীম। শিল্পতাত্ত্বিক ও সাহিত্যরসিকদের কাছে মহাকাব্যের আবেদন অনিঃশেষ। সেজন্যই এ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে এ কালের কাব্যতাত্ত্বিকরাও মহাকাব্য বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন।
আধুনিককালে রচিত মহাকাব্য ‘লিটারারি এপিক’ একক কবির রচনা। একক কবির লেখা যে কাব্যে কোনো জাতির সর্বলোকের সাধনা, আরাধনা ও সংকলন মূর্ত হয়ে উঠে এবং জাতির হৃদয়ের দর্পণরূপে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয় তাই লিটারারি এপিক। এ ধরনের মহাকাব্যের আকার সংক্ষিপ্ত, কাব্যরূপ সুপরিণত, কাহিনি দৃঢ়সংবদ্ধ। অকৃত্রিমতা, সারল্য সূক্ষ্ম শিল্পচাতুর্য ও যুগধর্মিতা লিটারারি মহাকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভার্জিলের ‘ইনিড,’ দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’, ট্যাসের ‘জেরুজালেম ডেনিভার্ড’, কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ ও ‘কুমার সম্ভব’ এবং মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এ শ্রেণির মহাকাব্য।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত: উনিশ শতকের সৃষ্টি এবং পরবর্তীতে যুগস্রষ্টা, আধুনিক বাংলা কাব্যের এক বিরল বিস্ময়কর প্রতিভা মহাকবি মধুসূদন দত্ত [১৮২৪-৭৩]। অসামান্য মেধা আর অসাধারণ আন্তরিকতার যৌথ প্রযোজনায় যে ক’জন কবি বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন মধুসূদন দত্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর অমর সৃষ্টি “মেঘনাদবধ কাব্য” [১৮৬১]- যা বাংলা সাহিত্যে একমাত্র সার্থক এবং প্রথম মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে যে রাম বা রাবণ তা বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের নয়, বরং কবির নিজস্বতার অনুপম প্রয়াস। কবি গ্রিক পুরাণের উৎকৃষ্ট সৌরভটুকু নিয়ে সনাতন কাহিনিকে সুরভিত করে তুলেছেন। মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ কাব্য” সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্যের গৌরব সর্বাংশে দাবি করতে পারে না। তবে তিনি তাঁর কাব্যকে অষ্টাধিক সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী কাব্যে নগর, বন, উপবন, শৈল, সমুদ্র, প্রভাত, সন্ধ্যা, যুদ্ধ, যন্ত্রণা প্রভৃতির সমাবেশ ঘটিয়েছেন। সর্বোপরি মহাকাব্য সুলভ বিশালতা সমন্বিত ও আশ্চর্যদীপ্তি কাব্য আনয়ন করেছেন। যদিও কবি নিজেও বলেছেন যে তিনি সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী তাঁর কাব্য রচনা করেননি। বাল্মীকি রামায়ণ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন মাত্র। কাব্যের ভাব, কল্পনা, বিষয়বস্তু তিনি হোমারের ও মিলটনের কাব্য থেকে সংগ্রহ করে সম্পূর্ণ স্বাধীন চিন্তাধারায় তাঁর কাব্যের শরীর সাজিয়েছেন। তিনি তাদের মতো করেই কাব্যের শুরুতেই বীণাপাণির সাধনা করেছেন।
শুধু পরিকল্পনা নয়, চরিত্র সৃষ্টিতেও “মেঘনাদবধ কাব্য” মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে। মহাকাব্যের উপযোগী চরিত্র সৃষ্টিতে মধুসূদন দত্ত কোথাও দক্ষতার অভাব দেখাননি। ক্ষত্রীয় নয়, রাক্ষস কিন্তু তারা সম্বংশজাত, ধীরোদাত্ত চরিত্র বিশিষ্ট এবং সর্বোপরি বীরত্বের মানবিকতায় উজ্জ্বল। এমনকি সরমা চরিত্রটি পর্যন্ত নারী চরিত্রের মহিমায় মহিয়সীন। এছাড়াও হোমারের আদর্শে মধুসূদন দত্ত এর সৃষ্ট দেব-দেবীর চরিত্রগুলো আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা শৌর্য ও শক্তিতে পরিপূর্ণ। মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ কাব্যে” Literary Epic প্রাণবস্তুর সাথে Authentic Epic এর বর্ণনাভঙ্গি ও ভাষার স্পষ্টতার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের শুরুতেই কবি বলেছেন-
“গাহিব মা বীররসে ভাসি / মহাগীত।”
মধুসূদন নানা দেশীয় মহাকবিগণের কাব্য উদ্যান হতে পুষ্প চয়নপূর্বক এ গ্রন্থখানি রচনা করেছেন। কিন্তু সেসব কুসুমরাজিতে যে অপূর্ব মালা গ্রথিত হয়েছে তা বঙ্গবাসীরা চিরকাল কণ্ঠে ধারণ করবেন। এ কাব্যের নায়ক রাবণ কবি ধৃত আধুনিক সংকটাপন্ন চরিত্র যেমন, তেমনি কবির স্বীয় জীবনের ও স্বদেশের বিপর্যয় ও পরাধীনতার প্রতীক। রাবণের আর্তনাদ আমাদের জাতীয় জীবনের ব্যষ্টি ও সমষ্টি মানবের আর্তনাদ। এ জাতীয়তাবোধ পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা অর্জনেরই প্রভাবজাত। এ কাব্যে সরমা, সীতা ভারতীয় নারী চরিত্রের আদর্শ, কিন্তু অন্য নারী চরিত্রগুলোতে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে তাদের ব্যক্তিত্ব, তেজস্বিতা, বীরত্ব পাশ্চাত্য নারীরই আদল। চিত্রাঙ্গদা বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী, যে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে পুত্রের জন্য স্বামীর কাছে কৈফিয়ত চায়, যা পাশ্চাত্যের প্রভাব। প্রমীলা প্রেমিকা, স্বামী সোহাগিনী। পক্ষান্তরে, তেজস্বিনী, বীরাঙ্গনা, প্রমীলা চরিত্রটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নারী চরিত্রের সার্থক সমন্বয়। রামায়ণের রামচন্দ্র এখানে কবির আনুকূল্য পায়নি। লক্ষ্মণকে বীরের স্থলে তস্কর করে গড়েছেন। পক্ষান্তরে, রাক্ষসরাজ রাবণের প্রতি অনুকম্পা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন বিশেষ দরদে, যা পাঠককে অশ্রুসিক্ত যেমন করে, তেমনি রাবণের দেশপ্রেম আমাদের মুগ্ধ করে। এখানে রাবণকে রাক্ষস না করে সংকটাপন্ন আধুনিক মানুষ করে তুলেছেন। কাব্যের অধিকাংশ চরিত্র রামায়ণ থেকে গৃহীত হলেও পুরাতনের আবেশ খুলে নতুনত্বের স্পর্শ দিয়েছেন। প্রমীলা, বীরবাহু ও চিত্রাঙ্গদা এ চরিত্র তিনটির স্বতন্ত্র উপস্থাপনই সেকথা প্রমাণ করে।
ভাষা ব্যবহারে ও বর্ণনার ক্ষেত্রে আমরা সর্বত্রই এ কাব্যে মহাকাব্যোচিত ওজস্বিতা গাম্ভীর্য ও বিস্তৃতির পরিচয় পাই। তিনি এ কাব্যে ছন্দের পরে ভাষায়ও বিবর্তন আনলেন। হোমার যেমন কোন দেবতা বা বীরের নাম করলেই তার উপযুক্ত বিশেষণ প্রয়োগ করে তার বর্ণনায় সমৃদ্ধি আনয়ন করতেন। মহাকাব্যের অন্যতম লক্ষণ উপমা বৈশিষ্ট্য। এই উপমার প্রয়োগও মধুসূদন এর প্রতিভা আশ্চর্য নৈপুণ্যে সমাহিত। হোমারের মতোই তিনি অধিকাংশ বিষয়কে উপমার সাহায্যে বর্ণনা করেছেন। সাধারণত উপমাগুলোর উপমেয় এবং উপমানের বৈশিষ্ট্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করে মাহাকাব্যকে মহাকাব্য সুলভ বিশালতা দান করেন। “মেঘনাদাবধ কাব্য”ই কবি অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম সার্থক ব্যবহার করেছেন। মহাকাব্যের প্রধান অবলম্বন হলো ‘রস’। এদিক দিয়েও “মেঘনাদাবধ কাব্য” মহাকাব্যের লক্ষণাক্রান্ত। কাব্যের প্রথম দিকে ‘গাইব মা বীর রসে ভাসি মহাগীত’। বললেও সমস্ত কাব্য বিচারে করুণ রসই প্রধান হয়ে উঠেছে। তবে স্থানে স্থানে আবার বীর রস ও প্রবাহিত। মোটামুটি বীর রসও করুণ রস মিলে মেঘনাদবধ কাব্য রস প্রবাহ উৎকর্ষতা লাভ করেছে। যেমন-
“করি স্নান সিন্ধুনীরে, রক্ষোদল এবে
ফিরিলা লঙ্কার পানে আর্দ্র অশ্রুনীরে-
বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে
সপ্ত দিবানিশী লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কাহিনির বিন্যাস, গ্রন্থ বিশালতা, চরিত্র সৃষ্টি, ভাব, ভাষা, শব্দ, উপমা, রস প্রভৃতির ক্ষেত্রে মেঘনাদবধ কাব্য মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের [১৮৩৮-১৯০৩] প্রধানতম ও সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত রচনা ‘বৃত্রসংহার’ [১ম খণ্ড ১৮৭৫, ২য় খণ্ড ১৮৭৭) মহাকাব্য। ইন্দ্রকে পরাজিত করে বৃত্রের স্বর্গ অধিকার, ইন্দ্র ও শচীর দুঃখদুর্গতি ভোগের পর দধীচির অস্থিনির্মিত বজ্রে ইন্দ্রের বৃত্রবধ ও স্বর্গোদ্ধার এই মহাকাব্যের বিষয়বস্তু। কাহিনির কাঠামোটুকুই শুধু পৌরাণিক, বেশিরভাগ অংশই কবির নিজস্ব কল্পনা, কতকটা ইংরেজি কাব্যের অনুকরণ। ‘বৃত্রসংহার’ এর কথাবস্তুতে ও পটভূমিতে যে মহাকাব্যোচিত বিশালতা আছে, মেঘনাদবধ কাব্যে তা দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈশোর বয়সের সমালোচনায় ‘মেঘনাদবধে’ নয়, ‘বৃত্রসংহারে’ই মহাকাব্যের ভাবসমুন্নতি নির্দেশ করেছিলেন। স্বর্গ উদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের ফলে বৃত্রের সর্বনাশ-যথার্থ মহাকাব্যের বিষয়। কবি হিসেবে হেমচন্দ্রের অত্যধিক খ্যাতি অর্জনের পিছনে তাঁর কাব্যে উনিশ শতকের হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শ রূপায়ণ, হিন্দুধর্ম, আচার- অনুষ্ঠানের মর্যাদা, পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্যের আঙ্গিক ব্যবহার প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য কার্যকরী ছিল। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁর কবিত্ব প্রতিভার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির যুগোপযোগী ধারক হিসেবে বাংলা মহাকাব্যের ধারায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
হেমচন্দ্রের কাব্যসাধনার পশ্চাতে জাতীয়তাবোধের যে বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তা এদেশের সমগ্র অধিবাসীর একটি অংশমাত্র- বিশেষত হিন্দুজাতিকে কেন্দ্র করেই প্রকাশ পেয়েছে। মাইকেল মধুসূদনের রচনায় যে উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়- তা হেমচন্দ্রের কাব্যে অনুপস্থিত। তাছাড়া ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য রচনা করতে গিয়ে হেমচন্দ্র মাইকেলের অনুসরণ করেছিলেন। পৌরাণিক কাহিনি ভিত্তি করে কল্পনার প্রাচুর্যপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে বক্তব্যস্থাপনায় মাইকেলের মতো তাঁর কৃতিত্ব নেই। তবে বীর ও রুদ্ররস বর্ণনায় হেমচন্দ্র যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। হেমচন্দ্রের ভাষার নমুনা হিসেবে বৃত্রের বর্ণনা উল্লেখ করা যায়-
“ত্রিনয়ন, বিশাল বক্ষ অতি দীর্ঘকায়,
বিলম্বিত ভুজদ্বয়, দোদুল্য গ্রীবায়
পারিজাত পুষ্পহার বিচিত্র শোভায়।”
নবীনচন্দ্র সেন: নবীনচন্দ্র সেনের [১৮৪৭-১৯০৯] মহাকাব্য ‘রৈবতক’ (১৮৩৩), ‘কুরুক্ষেত্র’ [১৮৯৩] ও ‘প্রভাস’ [১৮৯৬] এই তিনটি মহাকাব্য একত্রে ‘ত্রয়ীকাব্য’ নামে পরিচিত। তিনি মহাভারত, ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ প্রভৃতি কৃষ্ণলীলাবিষয়ক গ্রন্থ থেকে উপকরণ নিয়ে তৎকালীন ভারতের সমাজ ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণচরিত্র অবলম্বনে চৌদ্দ বছরে এই মহাকাব্য রচনা করেন। এই কাব্যত্রয়ের বিষয়বস্তু পুরাণাশ্রয়ী। হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র সেনের কাব্য সম্পর্কে প্রমথনাথ বিশী বলেন- “মহাকাব্য না লিখিয়া হেমচন্দ্র যদি সমাজবিষয়ক ব্যঙ্গকাব্য ও ব্যঙ্গনাট্য রচনা করতেন, নবীনচন্দ্র যদি মধুসূদনকে অনুসরণ করিয়া কাব্য না লিখিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে অনুসরণ করিয়া উপন্যাস লিখিতেন, হয়ত তাঁহাদের কীর্তি সময়ের বিচারে অধিক টেকসই হইত।” নবীনচন্দ্র সেন হেমচন্দ্রের মতই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর কবিমানসের অভিব্যক্তি ঘটেছিল হিন্দুদের সনাতন ধর্মবিশ্বাস অবলম্বনে।
তবে, নবীনচন্দ্র সেনে বিষয়বস্তুতে মহাকাব্যোচিত বিশালতা লক্ষণীয়। তাঁর কাব্যে কেন্দ্রীয় ঘটনা যথাক্রমে সুভদ্রাহরণ, অভিমন্যুবধ ও যদুবংশ ধ্বংস। নিষ্কাম ধর্ম ও নিষ্কাম প্রেমের সূত্রে আর্য অনার্যের ঐক্যবন্ধন এবং অখণ্ড হিন্দুসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা। এই উদ্দেশ্যসাধনেই নায়ক শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। তাঁর সহায় ছিল অর্জুনের বীরত্ব, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মনীষা, সুভদ্রার প্রীতি ও শৈলজার প্রেম। দুর্বাসার অকারণ প্রতিহিংসা ও অভিমান এবং বাসুকির সংশয় ছিল তাঁর বিরোধী শক্তি। কল্পনা ও আবেগের মাত্রাহীন অসংযম, রচনারীতিতে শৈথিল্য, সুলোচনার অসংযত কৌতুকচাপল্য ও লঘুতা, চরিত্র চিত্রণে দুর্বলতা প্রভৃতি ত্রয়ী কাব্যের মহাকাব্যের গৌরব অর্জনে গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিছক আখ্যায়িকা কাব্য হিসেবেও ঘটনা ও চরিত্রের টানাপোড়েন তাদের সংহত রূপ দিতে কবি ব্যর্থ হয়েছেন। অসংযত ভাবোচ্ছাস, গম্ভীর বিষয় থেকে তুচ্ছ বিষয়ে অতর্কিতে অবতরণ আখ্যানের অতিপল্লবিত রূপ, গীতিমূর্ছনা প্রভৃতি এই মহাকাব্যের ত্রুটি হিসেবে বিবেচ্য। তাঁর কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার এরূপ-
“একাকী নির্জনে এক তরুর ছায়ায়
একটি উপল খণ্ডে করিয়া শয়ন
চাহি অনন্তের শান্তদীপ্ত নীলিমায়
ভাবিতেছি, জীবনের ভাবনা প্রথম,-“
কায়কোবাদ: মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী ১৮৫৮-১৯৫২] সাহিত্যের ক্ষেত্রে কায়কোবাদ নামে অধিক পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদের কবি হিসেবেই বাঙালি মুসলমানদের কাছে তাঁর শ্রদ্ধার আসন। মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাসের কাহিনি অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘মহাশ্মশান’ [১৯০৪) মহাকাব্য। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ইতিহাস কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’ কাব্যের উপজীব্য বিষয়। স্বদেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর কাব্যকে কিছুটা মহিমা দিয়েছে। ‘মহাশ্মশান’ কাব্য মূলত হিন্দু-মুসলমানের সংগ্রামের কাব্য- কিন্তু কবি তাতে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিলেন। কাব্যের ভূমিকায় অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে কবি লিখেছেন- ‘মুসলমানদের বীরপুরুষ হিন্দুগণেরও বীরপুরুষ, এই দুই বীরজাতি হৃদয়ের উষ্ণ শোণিতে আপনাদিগের জাতীয় গৌরব ও ভীষণ বীরত্ব অক্ষয়পটে লিখিয়া গিয়াছেন।” ইতিহাস থেকে ‘মহাশ্মশান’ কাব্যের বিষয়বস্তু নির্বাচনের মাধ্যমে কবি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়েছেন। ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে কবি সমকালের জীবন সমস্যার সাথে একীভূত করে উপস্থাপন করেছেন। এ মহাকাব্যে অনেকগুলো গান সংযোজিত- এসব কবির গীতিকবিতা রচনায় কৃতিত্বের নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। তবে এ কাব্যে ভাষার সরলতা বক্তব্যকে ব্যঞ্জনাহীন করে তুলেছে। তাছাড়া অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যাপারেও কায়কোবাদ মোটেই সার্থকতা লাভ করতে পারেনি। তাঁর কাব্য থেকে ছন্দ-ব্যবহারের নমুনা-
“এ কোন অমরাবতী কহ লো কল্পনে
সুধামুখি, কর শুনি এ কার উদ্যান
মর্ত্যভূমে? ত্রিদিবের নন্দন-কানন
নহে সমতুল্য;”
ইসমাইল হোসেন সিরাজী: বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে মুসলমানদের নবজাগরণে ইসলামি আদর্শে
অনুপ্রাণিত হয়ে যাঁরা কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন সিরাজগঞ্জের কবি আবু মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী [১৮৭৯-১৯৩১] তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ‘স্পেনবিজয়’ (১৯১৪) মহাকাব্যের রচয়িতা। এই কাব্যে স্পেনের সম্রাট রডারিকের সঙ্গে মুসলমান বীর তারেকের সংগ্রামকাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কাব্যের মাধ্যমে সিরাজী মুসলমানদের বীর্যবয়া, ন্যায়পরায়ণতা, অকুতোভয় ও সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। কাব্যের আখ্যানভাগ ইতিহাস থেকে গৃহীত- বীররস এ কাব্যের প্রধান অবলম্বন বলে বিবেচিত হতে পারে। গ্রন্থটি রচনার পিছনে কবির উদ্দেশ্য ছিল- মুসলমানদের অতীত ইতিহাসের গৌরবময় কাহিনির মাধ্যমে স্বীয় গৌরব উপলব্ধি করে বর্তমান জীবনেও যেন তারা গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা করতে সমর্থ হয়। কবি কামনা করেছেন এভাবে-
গৌরব কাহিনি-গাথা করুক স্মরণ
গঠিত করুক সবে জাতীয় জীবন।
উঠুক গগনে পুনঃ সৌভাগ্য চন্দ্রমা
মোহিত করুক বিশ্ব ইসলাম সুষমা।”
সিরাজীর কাব্যের ভাষায় মধুসূদনের সার্থক অনুসরণ আছে- কিন্তু কাব্যরচনায় সার্থকতার তেমন নিদর্শন নেই।
মহাকাব্যের ধারায় অন্যান্য রচয়িতাগণ: হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্র সেনের সময়ে এবং তাঁদের পরবর্তী অন্যান্য মহাকাব্য রচয়িতাগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হামিদ আলী (১৮৭৪-১৯৫৪), যোগীন্দ্রনাথ বসু [১৮৫৪-১৯২৭), রাজকৃষ্ণ রায়, আনন্দচন্দ্র মিত্র, শিবনাথ শাস্ত্রী, অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী, ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দীনেশচরণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক সংকট নিয়ে মধুসূদনের হাতে মহাকাব্যের যাত্রা শুরু তা মধুসূদনের পরবর্তী কবিদের প্রতিভার অভাবে মহাকাব্যের শাখাটি আর অগ্রসর হয়নি। তাছাড়া মহাকাব্য জাতীয় সাহিত্যসৃষ্টির নিদর্শন হিসেবে রচিত হতে দেখা গেলেও এ যুগে তার আবেদন না থাকার জন্য সেসব রচনা গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশের পরে- এমন কাব্য আর রচিত হয়নি; তাছাড়া যুগের চাহিদা এবং প্রতিভাধর কবির অভাবের কারণেও মহাকাব্যের-যুগটি হয়তো শেষ হয়ে গেছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment