“উনিশ শতকের বাঙালির মন-বুদ্ধি-আত্মার বিকাশ ঘটিয়েছিল প্রবন্ধ সাহিত্য।”
ভূমিকা: প্রবন্ধ এক ধরনের মননশীল গদ্য রচনা বিশেষ। কোন নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে লেখকের যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য প্রকাশকারী গদ্য রচনাই সাধারণ অর্থে প্রবন্ধের পর্যায়ভুক্ত। জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন-ইতিহাস, সমাজ-রাজনীতি, সাহিত্য- শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যেসব তত্ত্বকেন্দ্রিক ও বস্তুগত গদ্যনিবন্ধ রচিত হয় তাকে বলা যেতে পারে প্রবন্ধ। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। দার্শনিক তত্ত্বালোচনা, ঐতিহাসিক গবেষণা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, সামাজিক সমস্যা, সাহিত্যিক বিতর্ক ও সমালোচনা প্রভৃতি প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। বস্তুতপক্ষে জগৎ ও জীবনের বিচিত্র বিষয় প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংরেজি সাহিত্যের সান্নিধ্যে গদ্যের প্রচলনের ফলে এদেশে প্রবন্ধ সাহিত্যের উৎপত্তি। ইংরেজি শিক্ষার ফলে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে এদেশের শিক্ষিত বাঙালির আত্মিক যোগাযোগ ঘটে এবং তার ফলেই প্রবন্ধ সাহিত্য বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের সূত্রপাত হলেও দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই এর যথার্থ বিকাশ। উনিশ শতকে গদ্যের উন্মেষ ও পরিণতির প্রেক্ষিতে গদ্যকে বাহন হিসেবে পেয়ে নানা ধরনের বিষয়বস্তু প্রবন্ধের মাধ্যমে রূপায়িত হয়ে উঠে। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও আত্মজিজ্ঞাসার তীব্রতায় এর কারণ। প্রথম দিকের প্রবন্ধ সাহিত্যে যথার্থ সৃজনশীল রচনার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেনি, তাতে বাঙালির মন-বুদ্ধি-আত্মার বিকাশের দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়েছিল।
বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ও বিকাশের মতোই প্রবন্ধ সাহিত্যের উৎপত্তির সাথে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা জড়িত। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে বাংলা বিভাগ। খোলা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে বাংলা গদ্য রচনার সূচনা হয়, তার পথ ধরেই বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের যাত্রা শুরু। উইলিয়াম কেরি এবং তার সহযোগী রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় প্রমুখের রচনাই বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের সূচনা হিসেবে গণ্য। রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত’ গ্রন্থে যথার্থ সাহিত্যরস সঞ্চারিত না হলেও প্রবন্ধের লক্ষণ স্পষ্ট। তাঁর অপর গ্রন্থ ‘লিপিমালা’ চিঠির আকারে লেখা কতকগুলো প্রবন্ধের সমষ্টি। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতং’ জীবনচরিত গ্রন্থ হিসেবেই বিবেচ্য।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রচিত ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ ও ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ প্রবন্ধগ্রন্থ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় এ দেশে প্রবন্ধের সূত্রপাত হলেও তাদের লেখায় কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ ছিল না। খ্রিষ্টধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা ও বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ, ঐতিহাসিক কাহিনি ও ছাত্রদের পাঠপোযোগী গ্রন্থ রচনায় ছিল সে যুগের গ্রন্থরচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীতে যুক্তিনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ সাহিত্যের সূচনা করেন রাজা রামমোহন রায়। যে সমস্ত প্রাবন্ধিকের প্রচেষ্টায় উনিশ শতকে বাঙালির মন-বুদ্ধি-আত্মার বিকাশ ঘটেছিল নিচে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩): সমাজসংস্কার ও ধর্মবিচারের উদ্দেশ্যে প্রবন্ধ রচয়িতা হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি নানা বিষয়ে বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করেন। বাংলা ছাড়াও তিনি ইংরেজি, হিন্দি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করেন। ‘বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার, ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, গোস্বামীর সহিত বিচার, পথ্য প্রদান, সহমরণ বিষয়, প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর মন ও মননের পরিচয় সুস্পষ্ট। ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যে তাঁর আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকলেও তিনি তাঁর গ্রন্থে যথাযথ প্রাণসঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯৪) রাজা রামমোহন রায়ের উত্তরসূরি এবং বাংলায় বুদ্ধিদীপ্ত গদ্য রচনার পথিকৃৎ। ‘বাল্য বিবাহের দোষ’, ‘পশুগণের প্রতি ব্যবহার’, ‘পরিশ্রম’, ‘স্বচিন্তা ও স্বাবলম্বন’, ‘বিনয়’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেযোগ্য প্রবন্ধ সংকলন। এ সময়ের আরো দু’জন লেখক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) ও অক্ষয়কুমার দত্তের (১৮২০- ১৮৮৬) নাম উল্লেখযোগ্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মীয় বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। অক্ষয়কুমার দত্তের প্রবন্ধে পাণ্ডিত্য ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে বুদ্ধিগ্রাহ্য ও মননশীল ধারার প্রবন্ধ রচয়িতা হিসেবে রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২২-১৮৯১), রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৪) ও ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছিলেন গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর জ্ঞানবিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ তৎকালীন সুধীমহলে সংগ্রহে গৃহীত হয়েছিল। ‘সেকাল আর একাল’, ‘ব্রাহ্মণ সমাজের বক্তৃতা’, ‘বৃদ্ধ হিন্দুর আশা’ প্রভৃতি রাজনারায়ণ বসুর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ইংরেজি শিক্ষার গভীরতা ও দেশীয় সংস্কৃতির উদার সম্মিলন ঘটেছে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে। ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’, ‘সামাজিক প্রবন্ধ’, ‘আচার প্রবন্ধ’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ।
বাংলা প্রবন্ধ যাঁর হাতে পরিণতি লাভ করেছে, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দেশীয় সংস্কৃতি ও সমাজ সম্পর্কে তিনি অজস্র প্রবন্ধ রচনা করেন। বিদ্যা, রস ও অনুভূতি তাঁর প্রবন্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস সব বিষয়েই তিনি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এসব প্রবন্ধের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের গভীর জীবনবোধ ও তীক্ষ্ণ জীবনদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা:
ক. ব্যঙ্গাত্মক ও সরস- ‘লোক রহস্য’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’, ও ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’।
খ. জ্ঞানবিজ্ঞান ও সমালোচনা বিষয়ক- ‘বিজ্ঞান রহস্য’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, ‘বিবিধ সমালোচনা’।
গ. দর্শন ও শাস্ত্রচর্চা বিষয়ক- ‘কৃষ্ণচরিত’ ও ‘ধর্মতত্ত্ব’।
বঙ্কিম সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রবন্ধকারদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭- ১৯১৯), মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯২২), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১), কালীপ্রসন্ন ঘোষ (১৮৫৯-১৯২৬) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। দিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্কিম পরবর্তী প্রবন্ধকারদের মধ্যে অন্যতম। ‘নানা চিন্তা’, ‘প্রবন্ধ মালা’, এবং ‘চিন্তামণি’ গ্রন্থে তাঁর প্রবন্ধগুলো সংকলিত। বাংলাদেশের তৎকালীন সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ‘বক্তৃতা স্তাবক’, ‘ধর্মজীবন’, ‘প্রবন্ধাবলী’ ইত্যাদি তাঁর প্রধান প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের প্রথম অসলোমান শক্তির বিকাশৰ পীয় মেশাররফ হোসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জানাই। বাংলা সাহিত্যের এবং নিরপেক্ষ বিচারশক্তির প্রকাশ পেয়েছে। মশাররফ হোসেন রচিত উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগাছ তার প্রবন্ধে সহজ বুদ্ধিমত্তা ইউসোফ’, ‘হযরত বেলালের জীবনী’ প্রভৃতি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গবেষক ও পত্তিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রবন্ধে পাণ্ডিত্যের কোনো প্রভাব ছিল না। ‘ভারত মহিমা’, ‘বাল্মীকির জয়’, ‘মেঘদূত’, ‘বৌদ্ধধর্ম’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রচলিত ধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। শিল্প- সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, সমাজচিন্তা, মানবচিন্তা কোনো বিষয়ই তাঁর প্রবন্ধ থেকে বাদ যায়নি। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অর্ধ শতাধিক। এর মধ্যে ‘আধুনিক সাহিত্য’, ‘সাহিত্য’, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, ‘শিক্ষা’, ‘সমাজ’, ‘শব্দতত্ত্ব’, ‘সাহিত্যের পথে’, ‘কালান্তর’, ‘সভ্যতার সংকট’, ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্র সমসাময়িক যুগে যাঁরা প্রবন্ধ রচনায় প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩- ১৯০২), রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯), দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯), প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
উনিশ শতকের প্রাবন্ধিকগণ নানা বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য নবযৌবনের দীপ্তিতে ভরে উঠেছে। বিষয়বস্তু ও রচনাপদ্ধতিতে আবেগ ও মন দুই-ই প্রভাব বিস্তার করেছে। সর্বোপরি সাহিত্যের সাথে গোটা বাঙালি জাতির মনের ও ঐতিহ্যের সংযোগ ঘটেছে। তাই বলা যায়, বাঙালির মন-বুদ্ধি-আত্মার বিকাশ ঘটিয়েছিল উনিশ শতকের প্রবন্ধ সাহিত্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment