বাংলা সাহিত্যে নাটকের সৃষ্টি ইংরেজি সাহিত্য ও সভ্যতা প্রভাবে। ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বাঙালি সমাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকেই পাশ্চাত্য ভাব ও সভ্যতার সাথে বাঙালি নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে থাকে। কলকাতার ইংরেজ সাহেবরা তখন আনন্দবিধানের জন্য নাচ, গান এবং রঙ্গমঞ্চে বিভিন্ন ‘পে’র আয়োজন করে। ইংরেজদের এই আয়োজন কলকাতা ধনী বাঙালিদেরকে নিজেদের ঘরে নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা দান করে। বাঙালির নাট্যপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় অনেক আগে থেকেই। মধ্যযুগের বহুকাব্যে নাট্যধর্মিতা প্রত্যক্ষ গোচর। এছাড়া পাঁচালি, কথকতা ইত্যাদি ও সংলাপধর্মী রচনা অনেক সময় অভিনয়ের মাধ্যমে প্রচার করা হতো। লোকনাট্য বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিত। কিন্তু এসব রচনার মধ্যে আধুনিক নাটকের কোনো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল না। ১৭৫৩ সালে ইংরেজরা কলকাতায় রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে। ১৭৯৫ সালে রুশ দেশীয় হেরোসিম লেবেদভ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করে The Disguise এবং Love is the best Doctor নামে দুটি ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে মঞ্চস্থ করেন। ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের মাধ্যমে নাটকের সূত্রপাত এবং ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নাট্য সাহিত্য এদেশে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়।
রাম নারায়ণ তর্করত্ন ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলা নাটকের উদ্ভব ও বিকাশে রামনারায়ণ তর্করত্ন ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভূমিকা নিচে তুলে ধরা হলো:
রামনারায়ণ তর্করত্ন: মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধুর পূর্বযুগের নাট্যকার হিসেবে রামনারায়ণ তর্করত্নের নাম বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। তিনি তৎকালে ‘নাটুকে রামনারায়ণ’ নামে পরিচিত ছিলেন। সুপণ্ডিত রামনারায়ণ অনেকগুলো নাটক রচনা করেন। তাঁর রচিত নাটকগুলোকে নিম্নোক্ত শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়:
ক. সামাজিক নাটক: কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪), নবনাটক (১৮৬৫)।
খ. অনুবাদমূলক নাটক: বেণীসংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৮৬০) ও মালতীমাধব (১৮৬৭)।
গ. পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত নাটক: রুক্মিণীহরণ (১৮৭১), কংসবধ (১৮৭৫) ও ধর্মবিজয় (১৮৭৫)।
ঘ. প্রহসন: যেমন কর্ম তেমন ফল (১২৭৯ ব.) উভয় সংকট (১৮৬৯), চক্ষুদান (১৮৬৯) প্রভৃতি।
ঙ. রোমান্টিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত স্বপ্নধন (১৮৭৩)।
এছাড়াও সে সময়ের অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি তাঁকে দিয়ে অনেক নাটক রচনা করান। কালীপ্রসন্ন সিংহ লেখান ‘বেণীসংহার’ (১৮৫৪)। বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চের জন্য লেখেন ‘রত্নাবলী’। গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখান ‘নবনাটক’। পাথুরিয়াঘাটায় অভিনয়ের জন্য যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর লেখান ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘মালতীমাধব’। কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে লেখার জন্য তৎকালীন রংপুরের জমিদার কালীচন্দ্র চৌধুরী ৫০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। রামনারায়ণ ‘পতিব্রতোপাখ্যান’ (১৮৫২) নাটক রচনা করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন।
রামনারায়ণ তর্করত্ন অনেকগুলো নাটক রচনা করলেও ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটক দিয়েই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। নাটকের নামকরণ থেকেই এর কাহিনির উদ্দেশ্য বুঝা যায়। এক কুলীন বৃদ্ধ তার চার কন্যাকে ষাট বছরের এক পাত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে তার কুলধর্ম রক্ষা করেন। কুলিনের এই চার কন্যার দুঃখ ও বেদনার কথাই বর্ণিত হয়েছে ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে। নাটকের কাহিনি অত্যন্ত করুণ ও হৃদয়বিদারক। নাট্যকার অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে চার কন্যার বেদনা উপস্থাপন করে সমাজের এই নিষ্ঠুর দিকটি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্যে ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ প্রথম নাটক যা অসাধারণ অভিনয় সাফল্য লাভ করেছিল। নাটকের কাহিনি ও চরিত্র এমন কিছু প্রশংসারযোগ্য নয়; কিন্তু সাধারণ লোকের চরিত্র, ভাষা ও ভঙ্গিমায় তর্করত্ন যে হাস্যকৌতুক, ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও বাস্তবতার আমদানি করেছিলেন যার ফলে এই নাটক সে যুগে বহুবার অভিনীত হয়েছিল।
মধুসূদনের প্রথম নাটক: নাটক রচনার প্রধান সমস্যা বর্ণনীয় বিষয়কে প্রত্যক্ষবৎ করে তোলা। পরোক্ষ বিবৃতির পরিবর্তে নাট্যক্রিয়া নাট্যরসের প্রধান অবলম্বন। মধুসূদনেই প্রথম এই শিল্পকৌশল বিষয়ে সচেতনতা লক্ষ করা যায়। অবশ্য তিনি প্রথম নাটকেই পূর্ণসিদ্ধি অর্জন, করতে পারেননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথেই তাঁকে সাফল্যের দিকে অগ্রসর হতে হয়েছে। মধুসূদনের প্রথম নাটক শর্মিষ্ঠাকে পরীক্ষামূলক রচনাই বলা যায়। ‘শর্মিষ্ঠা’র মহাভারতের আদিপর্বের শর্মিষ্ঠা যযাতি দেবযানীর প্রেমের কাহিনি ব্যবহার করা হয়েছে। এই ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি ঈর্ষা ও কামবৃত্তির বিরোধে নাট্যরসের প্রভৃত সম্ভাবনা ছিল।
পদ্মাবতী : মধুসূদনের দ্বিতীয় নাটক পদ্মাবতী অপেক্ষাকৃত উন্নত রচনা। এই নাটকটির ভিত্তি গ্রিক পুরাণের একটি বিখ্যাত গল্প। সেই কাহিনিতে হেরা, আথেনে এবং আফ্রোদিতে-এই তিন দেবীর মধ্যে একটি সোনার আপেলের অধিকার নিয়ে বিরোধ এবং প্যারিসের মধ্যস্থতায় আফ্রোদিতের জয়লাভ ও পরবর্তী স্তরে তিন দেবীর মধ্যে ঈর্ষা ও দ্বন্দ্বের যে জটিলতা দেখা যায়, মধুসূদন কৌশলে সেই কাহিনি ভারতীয় পুরাণের দেবদেবী চরিত্র অবলম্বনে বিবৃত করেছেন। গ্রিক পুরাণের দেবীত্রয় মধুসূদনের রচনায় শচী, রতি ও মুরজার রূপ ধারণ করেছে। প্যারিস ও হেলেন হয়েছে ইন্দ্রনীল ও পদ্মাবতী। ‘পদ্মাবতী’ নাটকে ‘শর্মিষ্ঠা’র তুলনায় প্রত্যক্ষ ঘটনা এবং নাট্যক্রিয়া অনেক বেশি, অবশ্য সমস্ত ঘটনার গতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নেপথ্যের দৈবশক্তি দ্বারা।
অনেক সমালোচকের মতে এর ফলে নাট্যকাহিনি স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। ‘শর্মিষ্ঠা’র তুলনায় ‘পদ্মাবতী’ গঠনের দিক থেকে অনেক শিথিলবদ্ধ এবং অবিন্যস্ত। কিন্তু এই নাটকে সংলাপের ভাষা অনেক স্বচ্ছন্দ এবং নাটকীয় গুণসম্পন্ন। এই নাটকেই মধুসূদন সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। চারিত্রিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টিই নাটকের প্রধানতম গুণ, এইদিক থেকে বহু ত্রুটি সত্ত্বেও ‘পদ্মাবতী’তে সতর্কভাবে উপস্থাপন করেছেন।
কৃষ্ণকুমারী: মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারী। কৃষ্ণকুমারী উদয়পুরের রাজা ভীমসিংহের কন্যা। অপরূপ সুন্দরী কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব আসে জয়পুরের রাজা জগৎসিংহের কাছ থেকে। জগৎসিংহের রক্ষিতা বিলাসবতী এই বিয়ে বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়। বিলাসবতীর দূতী মদনিকার কৌশলে কৃষ্ণকুমারী মানসিংহের প্রতি ভালোবাসার অভিনয় করবেন, কিন্তু মানসিংহ কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করতে আগ্রহী জেনে তিনি মহাসঙ্কটে পড়লেন। উদয়পুরের শত্রু মহারাষ্ট্রপতি এবং মুঘল শক্তি মানসিংহের সমর্থক। জয়সিংহ এবং মানসিংহ উভয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীই স্থির করলেন কৃষ্ণকুমারীকে না পেলে উদয়পুর আক্রমণ করবেন। ভীমসিংহের মন্ত্রী কৃষ্ণকুমারীকে হত্যা করতে পরামর্শ দিলেন, কৃষ্ণকুমারী মৃত্যুই এই সঙ্কট হতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। দুঃসহ মানসিক দ্বন্দ্বে ভীমসিংহ উন্মাদগ্রস্ত হলেন। ভীমসিংহের ভ্রাতা বলেন্দ্র কৃষ্ণকুমারীকে হত্যা করবেন স্থির করলেন, কিন্তু তার আগে কৃষ্ণকুমারী আত্মহত্যা করল। এই কাহিনি রাজস্থানের ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। ইতিহাস অবলম্বনে এই প্রথম বাংলায় নাটক লেখা হলো। পৌরাণিক কাহিনির অলৌলিক, দৈবশাসিত বার্তাবরণের পরিবর্তে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে মধুসূদন দ্বন্দ্বময় বাস্তবতার উপর নির্ভর করেছেন। ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং ‘পদ্মাবতী’র তুলনায় এ কাহিনি অনেক বলিষ্ঠ।
কৃষ্ণকুমারী, ভীমসিংহ এবং সমগ্র উদয়পুরের বাইরের দুটি প্রবল শক্তির আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে সমস্ত নাটকে এই অসহায়তাবোধ এবং বিপদের ছায়া প্রলম্বিত। স্বদেশের বিপদ দূর করার জন্য কৃষ্ণকুমারী আত্মহত্যার ঘটনায় নাটকটিতে ট্র্যাজেডি ঘনীভূত হয়। এই বিষাদান্ত পরিণাম কৃষ্ণার নিজের কোন দুর্বলতার জন্য না ঘটায় হয়তো বা কিছুটা আকস্মিক এবং যুক্তিক্রম বিবর্জিত, তবুও দেশরক্ষার জন্য এই আত্মোৎসর্গে কৃষ্ণকুমারী যথার্থ ট্র্যাজেডির নায়িকার মর্যাদালাভ করে। ‘কৃষ্ণকুমারী’ই বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক। ‘কৃষ্ণকুমারী’তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তর উত্তীর্ণ হয়ে যথার্থ নাটকীয় রসবস্তু সৃষ্টিতে প্রশ্নাতীত সাফল্য অর্জন করেছেন মধুসূদন।
মধুসূদনের প্রহসন: উনিশ শতকের বাংলা নাট্যসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট শাখা প্রহসন। বাংলা প্রহসন বাংলাদেশের লেখকদের নিজস্ব সৃষ্টি, এই জাতীয় রচনা পাশ্চাত্যসাহিত্যে দেখা যায় না। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা এবং প্রাচীনপন্থি ও নব্য সমাজের মানুষদের চারিত্রিক অসঙ্গতিই প্রহসনের বিষয়। উনিশ শতাব্দীর গদ্যসাহিত্যে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, মনে হয় নাটকের আঙ্গিকে সেই জাতীয় বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা থেকেই প্রহসনের জন্ম হয়। মধুসূদন রচিত দুটি প্রহসন হলো- (১) একেই কি বলে সভ্যতা এবং (২) বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ।
পরিশেষে বলা যায় যে, মধুসূদনের পূর্বে রামনারায়ণ তর্করত্ন একমাত্র নাট্যকার যিনি শুধু অভিনয়ের উদ্দেশ্যেই অধিকাংশ নাটক রচনা করেছিলেন এবং বেশ সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু মধুসূদনের আবির্ভাবের ফলে রামনারায়ণ তর্করত্নের পুরাতন রীতির নাট্যাভিনয় ক্রমে ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। তবু তিনি অভিনয়কে জনপ্রিয় করার জন্য যে কয়েকটি নাটক রচনা করেছিলেন তা অত্যন্ত মঞ্চসফল হয়েছিল। আর এজন্যই তিনি এদেশের নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment