সূচনা: উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল। এই সময় বাংলা সমগ্র ভারতবর্ষকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল।

উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সমাজ, ধর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।

[1] সমাজসংস্কার:

  • ব্রাহ্মসমাজ ও বিদ্যাসাগরের ভূমিকা: কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়। পাশাপাশি নারী স্বাধীনতা, অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ প্রভৃতির পক্ষে ব্রাহ্মসমাজ সারা দেশে এক আন্দোলন গড়ে তােলে। কেশবচন্দ্রের পরবর্তী সময়ে তরুণ ব্রাহ্ম নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমােহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামােহন দাস প্রমুখের প্রচেষ্টায় সমাজ সংখ্যার মূলক কাজের অগ্রগতি ঘটে। বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের অনুকূলে আইন রচনার জন্য আন্দোলন গড়ে তােলেন ও সরকারের কাছে আবেদন জানান। তার আবেদনে সাড়া দিয়ে সরকার বিধবাবিবাহ বৈধ বলে ঘােষণা করে (১৮৫৬ খ্রি. ২৬ জুলাই, ১৫ নং রেগুলেশন)।

  • রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রচেষ্টা: শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ শিবজ্ঞানে জীব সেবার কথা বলে এক উন্নত সমাজ গঠনের পথ দেখান। বিবেকানন্দ তীব্র ভাষায় জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা করেন। তিনি সমস্ত জাতিকে এক হয়ে সমাজের উন্নতিতে নিয়ােজিত হওয়ার কথা বলেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার মিলন ঘটিয়ে এক নতুন জাতি গড়ে তােলার আহ্বান জানান।

  • সৈয়দ আহমেদ ও আলিগড় আন্দোলনের ভূমিকা: সৈয়দ আহমেদ মুসলমানদের মধ্যযুগীয় আচার-আচরণ ও চিন্তাধারা ত্যাগ করার পরামর্শ দেন। তিনি মুসলমান সমাজের কুপ্রথাগুলির নিন্দা করেন ও সমাজে দাসপ্রথাকে সমাজ বিরােধী বলে আখ্যা দেন। তিনি নারীমুক্তির স্বপক্ষে প্রচার চালান। নারীদের পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধেও তিনি প্রতিবাদ জানান। পরবর্তীকালে মৌলবি চিরাগ আলি মুসলিম সমাজের পুরুষদের একটিমাত্র বিবাহের স্বপক্ষে মত দেন।

[2] ধর্মসংস্কার:

  • ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপনিষদ থেকে বিধি সংকলিত করে ব্রাহ্মমতকে আস্তিক্যবাদের রূপ দেন। কেশবচন্দ্রের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ব্রাহ্মধর্ম বিশ্বজনীন সর্বধর্ম- সমন্বয়ের রূপ নেয়।

  • রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বেদান্তবাদ: শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব বেদান্তের মূল কথাগুলিকে খুবই সহজ ও সরলভাবে ব্যাখ্যা করেন। তার বেদান্তের এই মানবিক ব্যাখ্যা নববেদান্তবাদ নামে পরিচিতি পায়। এতে বলা হয়, মানব সেবাই ঈশ্বর সেবা। গুরুর এই বাণীকে শিষ্য বিবেকানন্দ গ্রহণ করেন ও বলেন— “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”

  • সৈয়দ আহমেদ ও আলিগড় আন্দোলন: সৈয়দ আহমেদ গোঁড়া ও রক্ষণশীল মনােভাব ছেড়ে মুসলিমদের উদার হওয়ার কথা বলেন। তিনি মুক্তির আলােকে পবিত্র কোরানশরিফ গ্রহণ করার কথা বলেন। পীরের পুজো ও মুরিদি প্রথাকে তিনি নিন্দা করেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে দেওবন্দে স্থাপিত হয় দার-উল-উলুম। এখানে বিশুদ্ধ কোরানীয় ইসলাম ধর্মের চর্চা শুরু হয়।

[3] শিক্ষা সংস্কার:

  • ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টা: কেশবচন্দ্র বয়স্কদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানাের লক্ষ্যে কলকাতার কলুটোলায় এক নৈশ্যবিদ্যালয় গড়ে তােলেন। পাশাপাশি শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মবন্ধু সভা, সংগত সভা প্রভৃতি। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তােলেন বামাবােধিনী সভা, ব্রাহ্মিকা সমাজ, নেটিভ লেডিজ নর্মাল স্কুল প্রভৃতি। বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তােলেন একটি শিল্প বিদ্যালয়।

  • বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা: বাংলা গদ্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিস্তারে নিজেকে নিয়ােজিত করেছিলেন। হার্ডিঞ্জের সাহায্যে তিনি বহু বাংলা স্কুল স্থাপন করেছিলেন। নিজের শিক্ষা রূপায়ণের জন্য তিনি ২০টি মডেল স্কুল গড়ে তােলেন। তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন (বিদ্যাসাগর কলেজ)। ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন একটি মেয়েদের স্কুল গড়ে তুললে বিদ্যাসাগর এই স্কুলে বহু ছাত্রীর পাঠদানের ব্যবস্থা করে দেন। নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর গ্রামাঞ্চলে নিজ খরচে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তােলেন।

  • সৈয়দ আহমেদ ও আলিগড় আন্দোলনের ভূমিকা: সৈয়দ আহমেদ গাজীপুরে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে তােলেন। ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি গঠন করেন ট্রানস্লেশান সােসাইটি নামে একটি সমিতি (বর্তমান সায়েন্টিফিক সােসাইটি অব আলিগড়)। মুসলিমদের উচ্চশিক্ষা দানের লক্ষ্যে তিনি অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে গঠন করেন আবাসিক, আলিগড় অ্যাংলাে ওরিয়েন্টাল কলেজ (বর্তমান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়)।