সূচনা: উনবিংশ শতকের শেষদিকে পাঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে সমাজসংস্কার আন্দোলন যথেষ্ট তীব্র হয়ে ওঠে। এই সময় শিখ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমাজসংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
[1] সিংহসভা আন্দোলন
-
আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা: সর্দার ঠাকুর সিংহ, বাবা শ্রীখেম সিংহ বেদি ও বিক্রম সিংহ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের অমৃতসরে ‘শ্রীগুর সিংহসভা’ নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। অধ্যাপক গুরুমুখ। সিংহের উদ্যোগে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে লাহাের সিংহসভা স্থাপিত হয়। বহু শিখ পূজারি ও জ্ঞানী ব্যক্তি এই আন্দোলনে শামিল হয়।
-
কার্যকলাপ: সিংহসভার উদ্যোগেই সর্বপ্রথম শিখদের মধ্যে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। শিখ সমাজ ও ধর্মে দুর্নীতির অবসান এবং শিখদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে এই সংঘ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এই সভা পাঞ্জাবি ও গুরুমুখি ভাষাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে। লাহাের সিংহসভা অস্পৃশ্যতা ও গুরুবাদের প্রভাব থেকে তাদের সমাজ ও ধর্মকে মুক্ত করার চেষ্টা চালান।
[2] নিরঙ্কারী আন্দোলন
-
দয়াল সিং-এর নেতৃত্ব: পাঞ্জাবের নিরঙ্কারী আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন বাবা দয়াল সিং (১৭৮৩-১৮৫৫ খ্রি.)। তিনি বলতেন, মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে যােগসূত্র রক্ষা করার জন্য পুরােহিতের কোনাে প্রয়ােজন নেই। তিনি শিখধর্মকে কলুষতা মুক্ত করে পবিত্র ধর্মে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। তার মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র বাবা দরবারা সিংহ (১৮১৪-১৮৭০ খ্রি.) নিরঙ্কারী সংস্কার আন্দোলন চালিয়ে যান।
-
গুরুত্ব: [a] খালসা বাহিনীর সামরিক আদর্শ ত্যাগ করে তারা সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় জোর দিয়েছিলেন। [b] ঈশ্বরের নিরাকার রূপের প্রতি বিশ্বাসী নিরঙ্কারীরা নিজ ধর্মের পুরােহিতদের দিয়ে তাদের উপাসনা ও পূজাকেন্দ্রগুলি পরিচালনার প্রথা চালু করেন। [c] রাওয়ালপিণ্ডিতে নিরাকারী দরবার স্থাপন করে এই সভার অনুগামীরা মাংসভক্ষণ, মদ্যপান, প্রতারণা, মিথ্যাচার প্রভৃতি দূর করার উদ্দেশ্যে প্রচার চালান। [d] এই আন্দোলন উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাবে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। অ-জাঠ শিখদের মধ্যে এই আন্দোলনের সর্বাধিক প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল।
[3] নামধারী আন্দোলন
-
আন্দোলনের নেতৃত্ব: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে নামধারী আন্দোলনের প্রবর্তন করেন বাবা বালক সিং। এই আন্দোলনটি ‘কুকা আন্দোলন’ (Kuka Movement) নামেও পরিচিত। পরবর্তীকালে বাবা রাম সিং (১৮১৬-৮৫ খ্রি.)-এর নেতৃত্বে এই আন্দোলন খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
-
বৈশিষ্ট্য: [a] নামধারী অনুগামীরা গ্রন্থসাহেব-কে প্রকৃত সত্য বলে মানতেন। [b] তারা নারী-পুরুষের সমান অধিকার দাবি করে। [c] তারা জাতিগত অসাম্যের বিরােধিতা করেন। [d] তারা বাল্যবিবাহের বিরােধিতা এবং অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ ও নারীকল্যাণকে সমর্থন করেন। [e] সব ধরনের আচার-অনুষ্ঠান থেকে বিরত হয়ে সহজসরল জীবনযাপন এবং ঈশ্বরের নামকীর্তন করা ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।
[4] অকালি আন্দোলনের গুরুত্ব:
-
আদর্শ বিচ্যুতি: অকালি আন্দোলনের অংশরূপে পরিচালিত নিরষ্কারীরা নামধারী আন্দোলনের মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে এসেছিল।
-
সমান্তরাল সরকার গঠন: পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় নামধারীরা সংগঠন গড়ে তুলে এক সমান্তরাল সরকার গঠন করে যা ব্রিটিশকে উদবিগ্ন করে তােলে।
-
গুরুদ্বার আইন প্রবর্তন: অকালি আন্দোলনের তীব্রতায় অবশেষে, ব্রিটিশ এক নতুন শিখ গুরুদ্বার আইন প্রবর্তনে (১৯২৫ খ্রি.) বাধ্য হয়।
Leave a comment