উদ্বৃত্ত-মূল্যের তত্ত্ব


উদ্বৃত্ত-মূল্যের গুরুত্ব:

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার আর্থনীতিক বিকাশ ও গতি-প্রকৃতির ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের মূল লক্ষ্য হল মুনাফা অর্জন। এই উদ্দেশ্যে পুঁজিপতি শ্রমিককে শোষণ করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই শ্রমিক-শোষণের প্রকৃতি সম্পর্কে পর্যালোচনা পাওয়া যায় উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে আর্থনীতিক ব্যবস্থাই হল বনিয়াদ। রাজনৈতিক উপরিকাঠামো (Super structure) তার উপরই গড়ে ওঠে। ইতিহাসের এই বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মার্কস আর্থনীতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উপর জোর দিয়েছেন। আর উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব হল মার্কসের অর্থনীতিক তত্ত্বের মূল কথা। মার্কসবাদের আলোচনায় উদ্বৃত্ত-মূল্যের তত্ত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে লেনিন বলেছেন: The doctrine of surplus value is the cornerstone of the economic theory of Marx.’ এঙ্গেলস মন্তব্য করেছেন: “The discovery of surplus value suddenly threw light on the problem, in trying to solve which all previous investigators-bourgeois economists and social critics, had been groping in the dark.”

উদ্বৃত্ত মূল্য কাকে বলে:

মূল্যের শ্রম তত্ত্ব (Labour theory of value) এর সূত্রপাত ঘটেছে অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখ অর্থনীতিবিদদের আর্থনীতিক ব্যবস্থার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে। মার্কস মূল্যের শ্রমতত্ত্বকে বিকশিত করেছেন। তাঁর মতানুসারে পণ্য উৎপাদনে সামাজিকভাবে আবশ্যক শ্রমসময়ের ভিত্তিতে তার মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকের শ্রমশক্তি পণ্য হিসাবে গণ্য হয়। পণ্য মাত্রেরই ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময় মূল্য আছে। যে-কোন পণ্যের মত শ্রমশক্তিরও বিনিময় মূল্য আছে। পণ্য উৎপাদনের ন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক শ্রম-সময়ের দ্বারা বিনিময় মূল্য (Value in exchange) নির্ধারণ করা হয়। শ্রমিকগণ শ্রমের দ্বারা যে দ্রব্য উৎপাদন করে তার সমপরিমাণ মজুরী পায় না। উৎপন্ন সামগ্রীর বিনিময় থেকে যে পরিমাণ মজুরী শ্রমিককে দেওয়া হবে না অর্থাৎ বঞ্চিত করা হবে তা হল উদ্বৃত্ত মূল্য।

উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব:

জীবনধারণের জন্য শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে শ্রমিক বাধ্য। কিন্তু সেই শ্রম-শক্তির দ্বারা শ্রমপ্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মূল্য এবং শ্রম-শক্তির মূল্যের মধ্যে পার্থক্য থাকে। মার্কস বলেছেন: “The Value of labour power and the value which the labour power creates in the labour process are two entirely different magnitude.” শ্রমিকের মোট শ্রম-সময় দু’ভাগে বিভক্ত: (১) সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রমের সময় এবং (২) অতিরিক্ত পরিশ্রমের সময়। সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রমের সময়ের মূল্যটুকু শ্রমিককে দেওয়া হয়। সেই মজুরীর মূল্য তাঁর নিজের এবং তার পরিবারের জীবনধারণের উপায়ের মূল্যের সমান হয়। অতিরিক্ত পরিশ্রমের সময়ের মজুরী থেকে শ্রমিককে বঞ্চিত করা হয়। অর্থাৎ মোট শ্রম-সময়ের মাত্র একটি অংশের মূল্য শ্রমিক পায়। মোট শ্রম সময়ের বাকী অংশের মজুরী থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে বঞ্চিত করে মালিক শ্রেণী ভোগ করে। শ্রমিকের শ্রম-শক্তির মূল্য বা মজুরী উত্তল হয়ে যাওয়ার পর এই মূল্য পাওয়া যায়। তাই এই মূল্যকে উদ্বৃত্ত মূল্য বলা হয়। লেনিন বলেছেন: “The worker uses one part of the labour-day to cover the expenditure for the maintenance of himself and his family (weges), and the other part of the day he toils without remuneration and creates surplus value for the capitalist which is the source of profit….”

উদ্বৃত্ত মূল্য ও শ্রমিক শোষণ:

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন হল এক অনিবার্য নিয়ম। পুঁজিপতি শ্রেণীর মুনাফার উৎস হল এই উদ্বৃত্ত মূল্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক নির্দিষ্ট মজুরীর চুক্তিতে পুঁজিপতি বা শিল্পপতির কাছে শ্রমশক্তি বিক্রয় করে। নিজের এই নির্দিষ্ট মজুরির সমান মূল্য সৃষ্টির জন্য শ্রমিককে যতক্ষণ কাজ করতে হয়, সেই সময়কে আবশ্যিক শ্রম সময় বলা হয়। শ্রমিকের এই শ্রম সময় আবশ্যিক। তার কারণ শ্রমিকের এবং তার উপর নির্ভরশীল পরিবার পরিজনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয়মূল্য সৃষ্টি করতে এই শ্রম সময় অবশ্যই ব্যয় করতে হয়। বাকী সময়ে শ্রমিক কোন মজুরী ছাড়াই মালিকদের জন্য যে শ্রম ব্যয় করে তাকে বলে উদ্বৃত্ত শ্রম সময়। অর্থাৎ শ্রমিক সারাদিনের পরিশ্রমে যে মূল্য সৃষ্টি করে তার একটা অংশ সে মজুরী হিসাবে পায়। বাকী অংশ মালিকশ্রেণী উদ্বৃত্ত-মূল্য হিসাবে আত্মসাৎ করে। অর্থাৎ আবশ্যিক শ্রম সময় এবং উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়ের যোগফলই হল মোট শ্রম-সময়। মোট শ্রম-সময়ে সৃষ্ট পণ্যমূল্য = মোট শ্রম সময়ের মজুরীর মূল্য + উদ্বৃত্ত মূল্য। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে মালিকশ্রেণী শ্রমিক শোষণ কায়েম করে। পুঁজিপতি মালিকশ্রেণী শ্রমিকের উপর শোষণ অব্যাহত রেখে উদ্বৃত্তমূল্য বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে থাকে। মার্কসবাদ অনুসারে একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরই উদ্বৃত্ত মূল্যের মাধ্যমে শ্রমিক শোষণের অবসান ঘটতে পারে।

বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব

বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের ভূমিকা:

বিচ্ছিন্নতাবাদ বা বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বিচ্ছিন্নতার বহু অর্থ ও মাত্রা বর্তমান। বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে আলোচনার আগে বিচ্ছিন্নতা শব্দটির অর্থ বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নতার অর্থ হল নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, বিযুক্ত করে নেওয়া। এটি একটি মানসিক অনুভূতি—এই গুটিয়ে নেওয়া, বিযুক্ত করে নেওয়া সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম প্রভৃতি যে-কোন কিছু থেকে হতে পারে। আবার অনেক সময় বিচ্ছিন্নতা নিজের সত্তা থেকেও হতে পারে।

বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ধারণা নতুন নয়। রুশো মানুষের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে মত প্রকাশ করেছিলেন, মানুষ কখনই স্বাধীনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে পারে না, কারণ স্বাধীনতা বিনিময়, বিচ্ছিন্ন করা যায় না। তার মূল্যবান সন্দর্ভ ছিল এই যে, মানব প্রজাতি ও স্বাধীনতা অচ্ছেদ্য, মানব প্রজাতি থেকে স্বাধীনতাকে বিচ্ছিন্ন করা হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, ক্রীতদাসে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে অষ্টাদশ এবং উনিশ শতকের শুরুতে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক যেমন হেগেল, ফয়ারবাখ, কার্ল মার্কস, ওয়েবার, দূর্খেহেইম প্রমুখ সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের অর্থ ও প্রকৃতি:

বিচ্ছিন্নতার নানা ধরন বা প্রকার হয় যেমন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা হল সেই বিচ্ছিন্নতা যেখানে ব্যক্তি নানা কারণে বৃহত্তর সমাজ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নেয় বা নিতে বাধ্য হয়। যেমন প্রাচীন গ্রীসে ক্রীতদাস সমাজকে রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে জোর করে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হত। ভারতেও নিম্নবর্ণের মানুষদের সামাজিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হত বা এখনও কিছু পরিমাণে হয়। অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা হল সেই বিচ্ছিন্নতা যেখানে শ্রমজীবি সম্প্রদায় উৎপাদনের উপকরণের (জমি, কারখানা) মালিকানা থেকে বঞ্চিত করার কারণে মালিক শ্রেণীর দ্বারা শোষিত হয়ে, নিজসৃষ্টির আনন্দ থেকে বিযুক্ত হয়ে যে বিচ্ছিন্নতার শিকার হয় তাকেই বোঝানো হয়েছে। মার্কস এই বিচ্ছিন্নতার কারণ, ফলাফল, প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় ব্যক্তি নাগরিকের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাসহীনতা, রাজনৈতিক ব্যবস্থার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া বা বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখান করা। সাধারণভাবে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাকে দুটি পর্যায়ভুক্ত করা যায়: রাজনৈতিক অপরাগতা (incapability) এবং রাজনৈতিক অসন্তুষ্টিতা (discontentment)। প্রথমটির ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে তার পরিবেশ বাধ্য করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে, আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। (সূত্র উইকিপিডিয়া)। প্রধানত চারটি উপায়ে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আত্মপ্রকাশ করে :

১। রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতা : এটি একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি যেখানে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সরকারের কাজকর্মকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

২। রাজনৈতিক অর্থহীনতা : রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা আবার আসতে পারে যখন ব্যক্তি মনে করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি অস্পষ্ট ও খামখেয়ালী পূর্ণ। স্পষ্ট কোন যুক্তিসঙ্গতা ছাড়াই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে অনেক সময়ই ব্যক্তি রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।

৩। রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা : সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে সমস্ত রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ গ্রহণ করে ও মেনে চলে তা যদি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পছন্দ না হয় বা তাকে বর্জন করে তখন তারা সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।

৪। রাজনৈতিক হতাশা : বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশা থেকেও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম হতে পারে। রাজনৈতিক নেতৃবর্গের দুর্নীতি, চারিত্রিক অসততা ও কলঙ্কও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিতে পারে।

বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্ব

কার্ল মার্কসের বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব বিচ্ছিন্নতাকে বর্ণনা করে এমন এক অবস্থা হিসাবে যেখানে ব্যক্তি একটি শ্রেণীবিভক্ত ব্যবস্থায় বসবাসের ফলে নিজেকে তার প্রজাতি সত্ত্বা (species essence) থেকে বিযুক্ত করে নিতে বাধ্য হয়। প্রজাতি সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া হল সামাজিক শ্রেণীর একটি যান্ত্রিক অংশ হিসাবে বাস করতে বাধ্য হবার পরিণতি, এইরকম পরিস্থিতিতে ব্যক্তি শুধু তার প্রজাতি সত্ত্বা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয় না, মানবতা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক শুধু যে তার জীবন ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তা নয়, একইসঙ্গে সে নিজের কাজকর্ম নিজে নির্ধারণ করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়; বঞ্চিত হয় অপরের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নির্ধারণ করার অধিকার থেকে, বিচ্ছিন্ন হয় নিজের শ্রমের দ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য বা সেবার মালিকানা থেকেও।

বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে হলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃতি, এই ব্যবস্থার শোষণমূলক প্রকৃতির বিরুদ্ধে ইউরোপে যে প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়েছিল সে সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে হেগেল ও ফয়ারবাখের ধারণা আলোচনা করা প্রয়োজন কারণ বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব রচনাকালে মার্কস এদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

মার্কসের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট ছিল। সেই প্রেক্ষাপটটি হল শিল্পবিপ্লব, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উত্থান ও এই ব্যবস্থার নিষ্ঠুর অমানবিক শোষণজনিত ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিই শুধুমাত্র উৎপাদন ব্যবস্থার নয়, পুরো সমাজব্যবস্থার নিয়ামক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল শ্রমপ্রক্রিয়া থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা, কারণ শ্রমশক্তি পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়ার ফলে শ্রমপ্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায় সৃষ্টিবিমুখ, অর্থাৎ পুঁজির বশংবদ। শ্রমপ্রক্রিয়া থেকে ব্যক্তি মানুষের বিচ্ছিন্নতা শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ইউরোপীয় সমাজে এক বৌদ্ধিক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। এই বিপ্লব রোমান্টিক আন্দোলন নামে পরিচিত। যন্ত্রসভ্যতা ও মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা যে খণ্ডিত, ক্ষতবিক্ষত, বিচ্ছিন্ন মানবসত্ত্বার জন্ম দিয়েছিল তাকে অতিক্রম করে মানবসত্বার পূর্ণ বিকাশ বা প্রতিষ্ঠাই ছিল এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। এই রোমান্টিক আন্দোলন দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল— প্রথমটি ছিল নৈরাজ্যবাদী রোমান্টিক আন্দোলন যার পুরোধা ছিলেন ফরাসী দার্শনিক রুশো ও অন্যান্যরা, দ্বিতীয় ধারাটি ছিল প্রথমটির বিপরীত— এই ধারাটি ছিল বিদ্রোহী রোমান্টিক— শেলী, বায়রণ প্রমুখ ছিলেন এই ধারাটির মূল প্রবক্তা (সূত্র : মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তা – শোভনলাল দত্তগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ)। নৈরাশ্যবাদী রোমান্টিক আন্দোলন ছিল পুঁজিবাদ ও আধুনিকতাবিরোধী, যারা যন্ত্রসভ্যতা কিভাবে মানুষের মানবিকতাকে ধ্বংস করছে সে বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন, এরা চেয়েছিলেন মানুষকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে। ফলে এরা বেছে নিয়েছিলেন অতীতকে, যাকে আঁকড়ে থেকে এরা বর্তমান ব্যক্তির যন্ত্রণাময় জীবন অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন। রুশো ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা। রোমান্টিক আন্দোলনের দ্বিতীয় ধারাটি ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করতে চেয়েছিলো, তবে তা অতীতকে আঁকড়ে ধরে নয়, বর্তমানের সমাজব্যবস্থার অমানবিক, নিষ্ঠুর দিকগুলিকে ধ্বংস করে ব্যক্তিকে তার পূর্বের মর্যাদায় ফিরিয়ে দিতে। মার্কস বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব প্রণয়ণকালে এই বিদ্রোহী রোমান্টিক আন্দোলনের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

মার্কসের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব:

রোমান্টিক আন্দোলনের পাশাপাশি অন্য যে দুজন চিন্তাবিদদের দ্বারা মার্কস প্রভাবিত হয়েছিলেন তারা হলেন হেগেল ও ফয়ারবাখ। হেগেলের মতে আত্মা (spirit) তার অনন্ত সত্তা সম্পর্কে সচেতন হবার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে জগৎকে—এইভাবেই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মা স্ববিচ্ছিন্নতা ঘটায়। কিন্তু আত্মা যেহেতু অসীম ও অনন্ত, তার সৃষ্ট কোন বস্তুর মধ্যেই সে তার প্রকৃত স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারে না— তাই আত্মা সবসময়ই নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে পেতে চায়। বিচ্ছিন্নতা ও তার থেকে নিষ্ক্রমণের যে তত্ত্ব হেগেল দিয়েছেন তরুণ মার্কস তা থেকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি হেগেলের বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। মার্কস 1844 সালে রচিত The critique of Hegelian Dialectic and Philosophy as a Whole নামক বিখ্যাত প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন হেগেল যে বিচ্ছিন্নতার অধিবিদ্যামূলক (metaphysical) ব্যাখ্যা দেন তা কখনই সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ যেহেতু সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত আছে তাই কোন অধিবিদ্যামূলক সূত্রের সাহায্যে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না বা একে অতিক্রম করা যায় না।।

হেগেলের মত মার্কস, ফয়ারবাখের চিন্তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মার্কসের রচনার প্রাথমিক পর্যায়ে তার উপর ফয়ারবাখের প্রভাব ছিল খুবই স্পষ্ট। ফয়ারবাখ বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন যে বিচ্ছিন্নতার কারণ spirit বা আত্মার আত্মপ্রকাশ নয়, এটি এমন এক সমস্যা যার কারণ বস্তুজগতের মধ্যেই নিহিত আছে, কোন অধিবিদ্যামূলক ধারণার মধ্যে নয়। তিনি আরও দেখান ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন সত্তাই ঈশ্বরের জন্ম দেয়। ঈশ্বর কখনই ব্যক্তিসত্ত্বাকে সৃষ্টি করে না। ফয়ারবাখ আরও বলেন, ব্যক্তি ও তার পরিবেশের একাত্মকরণের মাধ্যমেই বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করা সম্ভব হবে। কিন্তু ফয়ারবাখ যদিও বিচ্ছিন্নতা বস্তুজগত ও পরিবেশ থেকে উদ্ভূত বলে সঠিকভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু মার্কসের মতে বস্তুজগৎ ও পরিবেশের পরিবর্তনে মানুষের ক্রিয়াশীল ভূমিকা ফয়ারবাখের ধারণায় উপেক্ষিত হয়েছে।

মার্কসের অন্যান্য লেখায় বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি এলেও এই বিষয়টি নিয়ে তিনি গভীরভাবে আলোচনা করেন 1844 সালে রচিত প্যারিস পণ্ডুলিপিতে। মার্কস বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব প্রণয়নকালে রোমান্টিক আন্দোলন, কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ, হেগেল, ফয়ারবাখের দ্বারা প্রভাবিত হলেও তার তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে মৌলিক কেননা বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব রচনাকালে তিনি অন্য তত্ত্বগুলির দ্বারা প্রভাবিত হলেও সবগুলিকেই তিনি নিজের বিচারবুদ্ধি অনুসারে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে এক সামগ্রিক তত্ত্ব রচনা করেন।