অথবা, উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ণ কর।
ভূমিকাঃ বৈজ্ঞানিক ও মানবচিন্তার বিভিন্ন অঙ্গনে উনিশ শতকে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়, বিবর্তনবাদ তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম। প্রকৃতির জগতে যেসব ঘটনা ঘটে চলছে, তাদের কোনােটিই সম্পূর্ণ অভিনব নয় বরং প্রত্যেকটিই তার পূর্ববর্তী ঘটনার বৃদ্ধি ও বিকাশের ফল বলে যে বিবর্তনবাদী মত ঊনিশ শতকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে তা আসলে কোনাে নতুন ব্যাপার নয়। প্রাচীন গ্রিকরাও জীবনের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে কম-বেশি চিন্তা করেছেন। এই বিশ্বজগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা খুঁজে পেয়েছি বিবর্তনের ধারণাকে। বির্বতন বিজ্ঞানসমর্থিত মতবাদ হলেও এর স্বরূপবা প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে। বিবর্তনের স্বরূপ সম্পর্কে দুইটি মতবাদ দেখা যায়; যথা- ক, যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ খ, উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ। বিবর্তনবাদের প্রকারভেদ হিসেবে নিম্নে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের একটি সমালােচনামূলক ব্যাখ্যা দেওয়া হলাে-
উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদঃ ইংরেজি ‘Teleology’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলাে উদ্দেশ্যবাদ। এই ‘Teleology’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Telos’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ‘Telos’ শব্দের অর্থ শেষ বা পরিণতি। সুতরাং শাব্দিক দিক থেকে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের অর্থ হলাে যে বিবর্তনের কোনাে একটা পরিণতি বা উদ্দেশ্য আছে। এ মতবাদ হলাে বিবর্তনপ্রক্রিয়ার একটি ভাববাদী ব্যাখ্যা। যে মতবাদ অনুসারে জগতের গতি প্রকৃতি ও অভিযাত্রার পেছনে কোনাে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে তাকে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ বলে। এই মতবাদ অনুসারে বিবর্তন কখনই উদ্দেশ্যহীনভাবে বা আপনা আপনি হতে পারে না। কাজেই বিবর্তনের পেছনে কোনাে না কোনাে উদ্দেশ্যমূলক কারণ আছে।
উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তন অনুসারে, পৃথিবীর বর্তমান রূপ একটা সুস্পষ্ট ক্রমবিবর্তনের ফল এবং এই ক্রমপরিবর্তনের পিছনে রয়েছেন একজন বুদ্ধিমান কর্তা। যিনি তার কোনাে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জগৎকে এমনভাবে বিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জগতের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত নিয়ম-শৃঙ্খলা, নির্বাচন, ধাপ বিন্যাস, ঐক্য ইত্যাদি এর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এই মতবাদের সমর্থকরা বলেন যে, এগুলাে কোনাে অন্ধ যান্ত্রিক শক্তির ফল হতে পারে না। নিয়মশৃঙ্খলার পিছনে অবশ্যই কোনাে মনের উপস্থিতি বিদ্যমান।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, এনাক্সাগােরাস, এরিস্টটল পেটো প্রমখ দার্শনিক ছিলেন এই মতবাদের সমর্থক। আধুনিককালের দার্শনিকদের মধ্যে লাইবনিজ, বার্কলি, ফিখটে ফেকনার, হেগেল, মার্টিনিউ, লােটজা, বােসাঙ্কোয়েট, পলসেন প্রমুখ ভাববাদীরা এই উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদকে সমর্থন করেছেন। ভাববাদী দার্শনিকরা ছাড়াও স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ও সর্বাত্মকবাদী চিন্তাবিদরাও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী।
উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের পক্ষে যুক্তিঃ উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদীরা তাদের মতবাদের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তাদের যুক্তিগুলাে-
(১) হেন্ডারসনের মতে, জড় প্রকৃতির উদ্দেশ্য রয়েছে। পথিবীতে প্রাণের আবির্ভাবের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, নীহারিকা থেকে গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি প্রভৃতির মূলে ছিল একটা উদ্দেশ্য। প্রাণের আবির্ভাবের পূর্বেই জড় উপাদানের মধ্যে এই প্রস্তুতি নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক।
(২) মানুষের কর্মপদ্ধতি উদ্দেশ্যমূলক। মানুষ যান্ত্রিক নিয়মে কাজ করে না। লক্ষ্যকে সামনে রেখে মানুষ কাজ করে। জগৎব্যাপী উদ্দেশ্যের স্থান আছে। তা না হলে মানুষ উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে কাজ করত না।
(৩) এই জগতের বিভিন্ন শক্তিকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে কোনাে এক উদ্দেশ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজ।
(৪) কার্যকারণের মধ্যে উদ্দেশ্য আছে। কারণ কার্যকে নিয়ন্ত্রণ করে, আবার একই কারণ সর্বদা একই কার্য সৃষ্টি করে। এর ব্যাখ্যা যান্ত্রিকতার সাহায্যে চলে না। সুতরাং জগতের মূলে উদ্দেশ্য নিহিত।
(৫) মার্টিনিউ নির্বাচন, সংযােগ এবং ক্রমিক স্তরভেদের কথা বলেছেন, যেগুলাে বুদ্ধি, প্রজ্ঞাশীল পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জগতে এই তিনটি লক্ষ্যেরই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সুতরাং জগতের বিবর্তন উদ্দেশ্যমূলক।
উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের বিভিন্ন রূপঃ উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতিমূলক বিবর্তনবাদ দু’ধরনের; যথা- ১ বাহ্য উদ্দেশ্যবাদ ও ২. অন্তস্থিত উদ্দেশ্যবাদ। নিম্নে এগুলাে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হলাে-
(১) বাহ্য উদ্দেশ্যবাদঃ বাহ্য উদ্দেশ্যবাদ অনুসারে, যে উদ্দেশ্য বা পরিণতি সাধনের জন্য জগতে এই বিবর্তন, তা জগতের বাইরে অবস্থিত। বুদ্ধিমান সত্তা বাইরে থেকে নিজে ঐ পরিণতির দিকে টেনে নিচ্ছেন। প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ মনে করে যে, ঈশ্বর জগৎকে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি করে তার মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করে জগৎকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ বাহ্য উদ্দেশ্যবাদকে সমর্থন করে বলে যে, ঈশ্বর জগৎ অতিক্রম করে জগতের বাইরে অবস্থান করেন। ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তির দ্বারা জগৎ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতে থাকে, এবং জগতে যখন কোন বিশৃঙখলা দেখা দেয় তখন ঈশ্বর প্রয়ােজনমতাে জগতের সুষ্ঠু ক্রিয়াবলির জন্য হস্তক্ষেপ করেন।
(২) অন্তস্থিত বা অন্তর্বর্তী উদ্দেশ্যবাদঃ অন্তস্থিত উদ্দেশ্যবাদের মতে, জগতের উদ্দেশ্য জগতের মধ্যেই নিহিত, বাইরে নয়। এই মতবাদের প্রধান সমর্থক হচ্ছেন হেগেল। তার মতে, বিশ্বজগৎ এক পরম চৈতন্যময় সত্তার প্রকাশ। এবং সেই অর্থে তাতে তিনি নিহিত। সেই সত্তার আত্মােপলব্ধির পথ হলাে বিবর্তনপ্রক্রিয়া। তিনি বিবর্তনের মাধ্যমে তার পরিপূর্ণতা লাভ করেন। এই মতবাদ অনুসারে জগতের প্রতিটি বস্তুই- যেমন জড়, প্রাণ, মন-সমগ্রের এক-একটা অংশ হিসেবে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসাধনের জন্য কাজ করে চলেছে। এই পরম চৈতন্য সত্তা জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রকাশিত করে চলেছেন এবং নিজেকে উপলব্ধি করছেন। বস্তুত জড়, প্রাণ ও মন এই তিন সত্তা পরম চৈতন্য সত্তার প্রকাশের তিনটি স্তরমাত্র এবং এগুলাে এক-একটি স্বতন্ত্র সত্তা নয়। জগতের সাথে এই অন্তস্থিত পরম আত্মসচেতন সত্তার একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বজগৎ এক আঙ্গিক ঐক্য, যেখানে সমগ্র ও অংশ পরম্পর নির্ভরতার সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত। বিশ্বজগৎ যেহেতু এই পরম আত্মচেতনার প্রকাশমাত্র, সেহতুে বিশ্বপ্রকৃতির সর্বত্রই বুদ্ধি ও উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব রয়েছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যৌক্তিক ভুল-ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের চেয়ে একটি উন্নততর মতবাদ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতএব, উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ জগৎ ও এর অন্তর্ভুক্ত প্রাণ ও যাবতীয় বস্তুর একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম।
Leave a comment