ভূমিকা : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ হল একটি আধুনিক বিষয়। তবে আধুনিক উদারনীতিবাদ ও সাবেকি উদারনীতিবাদের মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। কিন্তু আধুনিক রাজনীতিক সংস্কৃতির সম্যক অভিব্যক্তি হিসাবে উদারনীতিক চিন্তাদর্শনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আধুনিক রাজনীতিক সংস্কৃতির প্রকাশ হল এই উদারনীতিবাদ। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আধুনিক অর্থে উদারনীতিবাদের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। তবে ‘উদারনীতি’ হল একটি প্রাচীন ধারণা। এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগেই। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী হবহাউস-এর অভিমত অনুসারে আগেকার সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামোসমূহ উদারনীতিক ভাবধারার প্রভাবে ধীর গতিতে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। হবহাউস তাঁর Liberalism শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The social structure… under the inspiration of Liberal ideas is slowly but surely giving place to the new faric of the civic state.”
উদারনীতিবাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:
‘উদারনীতিবাদ’-এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হল ‘Liberalism’। ইংরেজী ‘লিবারেলিজম’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে স্পেনের রাজনীতিক দল ‘Liberals’-এর নামানুসারে। স্পেনের এই রাজনীতিক দলটি দেশে সাংবিধানিক সরকারের সপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কালক্রমে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার সপক্ষে এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়। স্পেনের বাইরেও অন্যান্য দেশে সরকার, রাজনীতিক দল, সরকারী নীতি, মতামত প্রভৃতিকে চিহ্নিত করার জন্য উদারনীতি কথাটির ব্যবহার শুরু হয়। ‘উদারনীতিবাদ শব্দটির মূল ব্যুৎপত্তিগত অর্থটিও অনুধাবন করা আবশ্যক। ব্যুৎপত্তিগত বিচারে ‘উদারনীতিবাদ’ (liberal ism) শব্দটি এসেছে একটি ল্যাটিন শব্দ থেকে। এই ল্যাটিন শব্দটি হল ‘liber’। এই ল্যাটিন ‘liber’ শব্দটির ইংরেজী অর্থ হল ‘liberty’ বা স্বাধীনতা। প্রকৃত প্রস্তাবে ‘স্বাধীনতা’ (liberty) এবং ‘উদারনীতি-বাদ’ শব্দ দুটি অভিন্ন উৎস থেকে উদ্ভূত। স্বভাবতই উদারনীতিবাদের মূল কথাই হল ‘স্বাধীনতা’। স্বাধীনতাই হল। উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার মূল উপাদান। সমাজবিজ্ঞানী স্মিথ Inernational Encyclopedia of the Social Sciences গ্রন্থের নবম খণ্ডে বলেছেন: “Liberalism is the belief in and commitment to set of methods and policies that have as their common aim greater freedom for individual men.” সমাজবিজ্ঞানী স্মিথ উদারনীতিবাদের কতকগুলি ধারণাগত উপাদানের কথা বলেছেন :
-
(ক) ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাধীন অভিব্যক্তির মূল্যায়ন;
-
(খ) এই অভিব্যক্তিকে নিজেদের কাছে এবং সমাজের কাছে মূল্যবান করে তোলার ব্যাপারে মানুষের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস; এবং
-
(গ) সেই স্বাধীনতার উপর আস্থা ও স্বাধীন অভিব্যক্তির বিকাশ ও সংরক্ষণের সহায়ক নীতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে তুলে ধরা।
উদারনীতিবাদে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের স্বাধীন বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যক্তি ও সমাজের মঙ্গল সাধিত হবে। হবহাউস তাঁর Liberalism শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Liberalism is the belief that society can safely be founded on… self-directing power of personality, that it is only on this foundation that a true community can be built, and that so established its foundations are so deep and so wide that there is no limit that we can place to the extent of the building.”
উদারনীতিবাদের ধারণা
পশ্চিমী শিল্পসভ্যতার মতাদর্শ: এক দিক থেকে বিচার করলে উদারনীতিবাদ হল পশ্চিমী শিল্পসভ্যতার মতাদর্শ। উদারনীতিবাদকে পশ্চিমী সভ্যতা থেকে স্বতন্ত্র করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আর্থনীতিক, রাজনীতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রভাবের এই গভীরতাকে পৃথক করে পর্যালোচনা করা দুরূহ ব্যাপার। আবার উদারনীতিবাদকে একটি বিশ্বজনীন মতাদর্শ হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। কারণ বলা হয় যে উদারনীতিক মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের দ্বারা মানব জাতির ইতিহাস ক্রমশ কিন্তু অনিবার্যভাবে প্রভাবিত হবে। উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রগতির বিষয়টি বিবেচিত হবে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারনীতিক চিন্তাবিদরা বিশ্বজনীন যুক্তিবাদের বিকশিত বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন।
নীতিগতভাবে নিরপেক্ষ: বিংশ শতাব্দীতে উদারনীতিবাদকে নীতি-নিরপেক্ষ মতাদর্শ হিসাবে প্রতিপন্ন করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, ‘ভালো-মন্দের’ থেকে ‘সঠিক-বেঠিক-এর উপর উদারনীতিবাদ অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। উদারনীতিবাদে এমন এক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের কথা বলা হয়, যেখানে ব্যক্তিমানুষ বা মানবগোষ্ঠী উন্নত জীবন যাপন করতে পারবে। কিন্তু উদারনীতিবাদে বিশেষ কোন ধারণাকে ভালো বলে তুলে ধরা হয় না। এদিক থেকে বিচার করলে উদারনীতিবাদ কোন একটি সাধারণ মতাদর্শ নয়; এ হল এক অতি উচ্চমানের মতাদর্শ (metaideology)। এর ভিত্তিতে রাজনীতিক ও মতাদর্শগত বিতর্ক পরিচালিত হতে পারে। তবে এ প্রসঙ্গে উদারনীতিবাদের অন্য একটি দিকের কথাও বলা দরকার। উদারনীতিবাদে উন্মুক্ত ব্যবস্থা, বিতর্ক ও আত্মনির্ধারণকে সমর্থন করা হয়। এ কথা ঠিক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই মতাদর্শের মধ্যে একটি প্রবল নৈতিক চাপও আছে।
উদারনীতিক অর্থ: উদারনীতিক মতবাদ রাষ্ট্রের কার্যাবলী ও প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তানায়কের ভাবনায় উদারনীতির নানান অর্থ ও ব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। স্বভাবতই উদারনীতির মত যে তত্ত্বচিন্তা বহুকাল ধরে বিভিন্ন রূপে বিকাশ লাভ করেছে তার নির্দিষ্ট একটি সংজ্ঞা দেওয়া সহজ নয়। সাধারণভাবে উদারনীতির অর্থ হল সব রকম কর্তৃত্বের নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় উদারনীতির অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা করা এবং ব্যক্তি-নাগরিকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ বিরোধী স্বাধীনতার নীতির উপস্থিতি হল উদারনীতির অর্থ। যে-কোন রকম স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র বা একত্ববাদী সার্বভৌম কর্তৃপক্ষকে অস্বীকার করাই হল উদারনীতির মৌল চরিত্র। এ হল উদারনীতির নেতিবাচক অর্থ। ইতিবাচক অর্থে উদারনীতি হল স্বাধীনতার নীতি বা মৌল গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ-বিরোধী এই স্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠার প্রথম সচেতন প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডে।
কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা: উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হল কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা করা এবং স্বাধীনতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। উদারনীতির মৌল চরিত্র হল যে কোন ধরনের কর্তৃত্ববাদ বা যে কোন রকমের একনায়কতন্ত্রী ও স্বৈরতন্ত্রী কর্তৃপক্ষকে অস্বীকার করা। এ হল উদারনীতিবাদের নেতিবাচক দিক। ইতিবাচক দিক থেকে উদারনীতিবাদের মূল বিষয় হল স্বাধীনতার নীতি তথা মৌল গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ-আয়োজন। অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদের অবস্থান হল রক্ষণশীলতা ও সমাজতন্ত্রের মধ্যবর্তী ক্ষেত্রে। উদারনীতিবাদে সংস্কারের কথা বলা হয়। এ দিক থেকে উদারনীতিবাদ হল রক্ষণশীলতার থেকে প্রগতিশীল একটি ধারণা। কিন্তু উদারনীতিবাদে সংস্কারের কথা বলা হলেও কখনই সমাজ ও রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনের কথা বলা হয় না। অতএব সমাজতন্ত্রের তুলনায় উদারনীতি হল অনগ্রসর একটি অবস্থা।
মধ্যবিত্ত পেটি-বুর্জোয়াদের রাষ্ট্রতত্ত্ব: সমাজতন্ত্রবাদীরা উদারনীতিবাদকে প্রকৃতপ্রস্তাবে মধ্যবিত্ত পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর রাষ্ট্রতত্ত্ব হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। সমাজতন্ত্রীদের অভিমত অনুসারে অপেক্ষাকৃত উন্নত পর্যায়ে আর্থনীতিক অবাধ নীতির সঙ্গে উদারনীতিবাদ সংযুক্ত হয়। এই অবস্থায় উদারনীতিবাদ এক পূর্ণাঙ্গ বুর্জোয়া ব্যবস্থার বনিয়াদ গড়ে তোলার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ রকম মূলত সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত মানসিকতা নিয়ে উদারনীতিবাদ ব্যাখ্যা করেছেন অনেকেই। ইংরেজ কবি জন মিলটন থেকে আরম্ভ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হার্বার্ট স্পেনসার পর্যন্ত অনেকেই সাবেকি উদারনীতিবাদের ঐতিহ্য রচনায় এ রকম অবস্থান গ্রহণ করেছেন। জন স্টুয়ার্ট মিল উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রধান রূপকার হিসাবে পরিচিত। তাঁর আলোচনায়ও অনুরূপ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
গণতন্ত্রের সমার্থক্য: ব্যাপকতর বিচারে উদারনীতিবাদ গণতন্ত্রের সমার্থক হিসাবে পরিগণিত হয়। বস্তুত ব্যাপক অর্থে বিবিধ মূলগত পরিবর্তনের মধ্যে উদারনীতির অভিব্যক্তি ঘটতে থাকে। বৃহত্তর বিচারে ছোটখাট সংস্কারমূলক কাজকর্মের মধ্যে উদারনীতিবাদ সীমাবদ্ধ থাকে না। জর্জ স্যাবাইনের অভিমত অনুসারে উদারনীতিবাদের ব্যাপকতর অর্থটি নির্দেশ করে পশ্চিমী রাজনীতিক চিত্তার ঐতিহ্যের সর্বোচ্চ বা চূড়ান্ত পর্যায়কে। এই উদারনীতিবাদ হল সমগ্র পশ্চিমী সভ্যতার এক লোকায়ত ধর্মনিরপেক্ষ রূপ। আধুনিক কালের জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রসমূহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থনীতিক পরিকল্পনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমানভাবে কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এই সমস্ত কর্মসূচীর মধ্যে উদারনীতিবাদের ব্যাপকতর অর্থটির অভিব্যক্তি ঘটেছে।
স্বাধীনতা: স্বাধীনতা হল উদারনীতিবাদের মূল বিষয়। ইংরেজ কবি জন মিলটন থেকে আরম্ভ করে অ্যাংলো-আমেরিকান লেখক টম পেইন পর্যন্ত প্রথম যুগে স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতার অর্থ ব্যাখ্যা করা হত। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর এই সমস্ত চিন্তাবিদদের মতানুসারে মানুষের অধিকার প্রকৃতির নিয়ম সম্ভৃত (The Rights of Man rested on the Law of nature)। স্বাভাবিক অধিকারের নীতির ভিত্তিতে মিলটন বলেছেন মানুষ মাত্রেরই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের জন্মগত প্রাকৃতিক অধিকার আছে। জন লকের মতানুসারে প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী সকল মানুষ সমান অধিকারের দাবিদার। সমকালীন উদারনীতিবাদী চিন্তাবিদদের অধিকাংশের অভিমত অনুসারে স্বাধীন ও সমানাধিকার সম্পন্ন মানুষই সকল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে বর্তমান। Encyclopaedia Britanica গ্রন্থে বলা হয়েছে: “(Liberalism is) an idea committed to freedom as a method and policy in government, as an organising principle in society, and a way of life for the individual and community.”পরবর্তী কালের উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী স্বাধীনতা হল একমাত্র শর্ত যার ভিত্তিতে ব্যক্তিবর্গ তাদের দক্ষতা ও প্রতিভার বিকাশ সাধন করতে পারে এবং সুপ্ত গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন করতে পারে।
উদারনীতিবাদীরা কিন্তু ব্যক্তিবর্গের অবাধ স্বাধীনতার ধারণাকে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। সীমাহীন স্বাধীনতা স্বাধীনতার অপব্যবহারের আশঙ্কাযুক্ত। অবাধ স্বাধীনতা উচ্ছৃঙ্খলতায় পরিণত হতে পারে। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর On Liberty শীর্ষক রচনায় এ বিষয়ে অর্থবহ আলোচনা করেছেন। মিলের মতানুসারে সভ্য জনসমাজের কোন সদস্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর একটি মাত্র কারণে ক্ষমতা ব্যবহার করা যাবে। এই কারণটি হল অপরের অকল্যাণ আটকানো। মিল মানুষের ক্রিয়াকর্মকে সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন: আত্মসম্পর্কিত কর্ম (self-regarding actions) এবং ‘অপর সম্পর্কিত কর্ম’ (other-regarding actions)। আত্মসম্পর্কিত কর্মের উপর ব্যক্তির স্বাধীনতা সীমাহীন। কিন্তু অপর সম্পর্কিত কর্মের ব্যাপারে ব্যক্তির স্বাধীনতা সীমাহীন হতে পারে না। কারণ এই সমস্ত ক্রিয়াকর্ম অপরের স্বাধীনতাকে সীমায়িত করে বা অপরের ক্ষতি সাধন করে। আধুনিক কালের উদারনীতিবাদী জন রলস (John Rawls) তাঁর A Theory of Justice শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে অর্থবহ আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী প্রত্যেকে ততদূর পর্যন্ত স্বাধীনতার অধিকারী হতে পারে, যতদূর পর্যন্ত অপরের সমপরিমাণ স্বাধীনতার সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ। অ্যান্ড্রু হেউড জন রলস-এর এই বক্তব্যটি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন: “… that everyone is entitled to the widest possible liberty consistent with a like liberty.”
স্বাধীনতার মূল্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে উদারনীতিবাদীরা সকলেই সহমত পোষণ করেন। কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য স্বাধীনতার প্রয়োগ পদ্ধতি কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে উদারনীতিক চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। একটি হল স্বাধীনতার নেতিবাচক মতবাদ এবং অন্য আর একটি হল স্বাধীনতার ইতিবাচক মতবাদ। ধ্রুপদি উদারনীতিবাদীরা স্বাধীনতার নেতিবাচক মতবাদে বিশ্বাসী। তদনুসারে ব্যক্তির উপর বাহ্যিক বাধা নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির ভিত্তিতেই স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়। প্রত্যেককে এককভাবে অবস্থানের সুযোগ দিতে হবে। কারুর উপর কোন রকম হস্তক্ষেপ থাকবে না। প্রত্যেকে তার পছন্দমত পথে আচরণ করবে। এ হল স্বাধীনতা সম্পর্কিত সনাতন উদারনীতিবাদীদের নেতিবাচক মতবাদ। আধুনিক উদারনীতিবাদীরা স্বাধীনতা সম্পর্কে সদর্থক ধারণা পোষণ করেন। তদনুসারে নিজেই নিজের প্রভু হওয়ার বা স্বনিয়ন্ত্রিত হওয়ার সামর্থ্যই হল স্বাধীনতা। তারজন্য নিজের দক্ষতা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ব্যাপারে ব্যক্তি সমর্থ হবে। মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হবে। ইংরেজ ইতিহাসবিদ বারলিন (Isaiah Berlin) তাঁর Two Concepts of Liberty শীর্ষক রচনায় স্বাধীনতার নেতিবাচক মতবাদ এবং ইতিবাচক মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী: ‘স্বাধীনতা অধিকার’ তত্ত্বে অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কথা বলা হয়। উদারনীতিবাদে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ‘স্বাভাবিক অধিকার’-এর নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে সরকারী কাজকর্মের ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করার কথার বলা হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারনীতির উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে যথাসম্ভব সীমিত করা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ ঘটে। তার প্রধান রূপকার হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ব্যক্তিসমষ্টি বা সামাজিক গোষ্ঠীর উপরে ব্যক্তি মানুষের প্রাধান্যমূলক গুরুত্বে বিশ্বাস করা হয়। পদ্ধতিমূলক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (methodological individualism) অনুযায়ী ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সমাজ গঠিত হয়। সুতরাং ব্যক্তিবর্গের পরিপ্রেক্ষিতেই সমাজ সম্পর্কিত যে কোন বক্তব্য ব্যক্ত করা উচিত। যে কোন সামাজিক ব্যাখ্যা বা রাজনীতিক মতবাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-মানুষই হল কেন্দ্রীয় বিষয়। অহংবাদী বা আত্মবাদী (egoistical) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে আত্মবিশ্বাস ও আত্মস্বার্থপরতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ধ্রুপদী উদারনীতিবাদীরা এই শ্রেণীভুক্ত। নৈতিক (ethical) ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদে বলা হয় যে, ব্যক্তির অধিকার, স্বার্থ ও প্রয়োজনসমূহের ব্যাপারে নৈতিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যক্তি মানুষের সুবিধার্থে বা কল্যাণের স্বার্থে সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উন্নয়নমূলক (developmental) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুযায়ী স্বার্থের সন্তুষ্টি সম্পাদনের পরিবর্তে মানবিক বিকাশ সাধনের উপর অগ্রাধিকার আরোপ করা হয়। আধুনিক উদারনীতিবাদীরাই এই শ্রেণিভুক্ত।
উদারনীতিক মতাদর্শের একটি বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় হল ব্যক্তি মানুষের প্রাধান্যে বিশ্বাস। সামন্ততান্ত্রিক জীবনধারার অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এক বৌদ্ধিক পরিবেশ-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়। সাবেকি ধর্মীয় ধ্যান-ধারণাকে হীনবল করে দিয়ে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ক্রমশ প্রাধান্য পায়। ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে দেখা শুরু হয়। মানুষমাত্রেই ব্যক্তিগত ও বৈশিষ্ট্যযুক্ত গুণাবলীর আধার হিসাবে পরিগণিত হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, ব্যক্তিমাত্রেরই বিশেষ মূল্য আছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বিকাশের মাধ্যমে এই ধারণার অভিব্যক্তি ঘটে। ব্যক্তি মানুষের প্রাধান্যমূলক ধারণা উদারনীতিক চিন্তাধারাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে।
রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্ফারসন (C. B. Macpherson) তাঁর Democratic Theory Essays in Retrieval শীর্ষক গ্রন্থে প্রাথমিক পর্যায়ের উদারনীতিবাদকে ‘স্বত্বাধিকারমূলক উদারনীতিবাদ’ (Possessive liberalism) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তাঁর অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তিমাত্রেই তার ব্যক্তিসত্তা ও সামর্থ্যসমূহের স্বত্বাধিকারী। এসব বিষয়ে ব্যক্তি মানুষ কোনভাবেই সমাজের কাছে ঋণী নয়। পরবর্তী কালের উদারনীতিবাদীরা মানব প্রকৃতি প্রসঙ্গে অধিকতর সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তিবর্গের কিছু সামাজিক দায়দায়িত্ব আছে। একে অন্যের প্রতি এবং বিশেষত অসমর্থ মানুষজনের প্রতি ব্যক্তিবর্গের দায়-দায়িত্ব অনস্বীকার্য। উদারনীতিবাদীদের মধ্যে কেউ কেউ সামাজকে ব্যক্তিবর্গের সমাহার হিসাবে দেখেন। সমাজস্থ ব্যক্তিমাত্রেই স্ব স্ব প্রয়োজন পূরণে ও স্বার্থ সাধনে সক্রিয়। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতানুসারে সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ হল পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন পরমাণু স্বরূপ। তদনুসারে সমাজের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। সমাজ হল স্বনির্ভর ব্যক্তিবর্গের এক সমাহার মাত্র। এ হল এক চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি এই অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, ব্যক্তিমানুষ আত্মম্ভরী, আত্মস্বার্থসর্বস্ব এবং অনেকাংশে আত্মবিশ্বাসী। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে, সকল উদারনীতিবাদীই এমন এক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষপাতী, যেখানে মানুষমাত্রেই তার সুপ্ত গুণাবলীর বা ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে সক্ষম হবে।
সামাজিক ক্ষেত্র উদারনীতিবাদ : সামাজিক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদের স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার বিষয়টি আলোচনা করা আবশ্যক। সামাজিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ ধর্মনিরপেক্ষতা বা অনাধ্যাত্মিকতার উপর জোর দেয়। অর্থাৎ ধর্মীয় গোড়ামির শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্ত অবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ধর্ম ও নীতিবোধের ব্যাপারে মানুষের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করাই হল সামাজিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদের উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে উদারনীতিবাদের প্রবক্তারা আশা করেন যে, যে সমস্ত অভ্যাস, প্রথা ও আচার-ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বা প্রকৃত স্বাধীনতার উপর শৃঙ্খল হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছে, মানুষ সেগুলিকে পরিবর্তন করবে। জোহারী তাঁর Contemporary Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন “…it not only repudiates naturalistic or deterministic interpretation of human action but lays stress on the value of a free individual conscious of his capacity for self-expression and an unfettered development of his personality.”
আর্থনীতিক ক্ষেত্র উদারনীতিবাদ: আর্থনীতিক ক্ষেত্রেও উদারনীতিবাদের ব্যঞ্জনা তাৎপর্যপূর্ণ। উদারনীতির আর্থনীতিক ব্যাখ্যায় উন্মুক্ত বাণিজ্যের আদর্শ এবং সঙ্গে সঙ্গে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উৎপাদনের ব্যাপারে স্বাধীনতা এবং বাহ্যিক ক্ষেত্রে বাণিজ্যের স্বাধীনতার কথা বলা হয়। অর্থাৎ দ্রব্য-সামগ্রীর আমদানী-রপ্তানীর উপর নিয়ন্ত্রণবিহীনতা এবং মুক্ত বা পূর্ণ প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়। এই কারণে উদারনীতির আর্থনীতিক ব্যাখ্যায় প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের যথাসম্ভব ব্যবহার এবং লভ্যাংশ বণ্টনের অধিকার বা ক্ষমতা ব্যক্তিবর্গের হাতে ন্যস্ত থাকার কথা বলা হয়। এই ব্যবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশের কথা বলা যায়। কারণ এই শ্রেণীই হল উৎপাদন ও বণ্টনের উপায়সমূহের মালিক ও নিয়ন্ত্রক। বুর্জোয়াশ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশের কারণে মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণী দুঃখ দারিদ্র্য ও অনাহার পীড়িত অবস্থার প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে উদারনীতিবাদের থেকেই সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার উদ্ভব পরিলক্ষিত হয়। জোহারী বলেছেন: “This meaning of classical economic liberalism should, however, be revised in the light of new conditions of a market society that have led to the emergence of the emergence of the doctrine of socialism.” এই অবস্থায় বুর্জোয়া উদারনীতিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক উদারনীতিবাদীর সৃষ্টি হয়। বুর্জোয়া উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতাদর্শ প্রচার করেন। তাঁরা রাষ্ট্রকে ক্ষতিকর বা অশুভ কিন্তু অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপন্ন করেন। তাঁরা রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে সীমিতকরণের কথা বলেন। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক উদারনীতিবাদীরা জনসাধারণের স্বার্থে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে প্রসারিত করার কথা বলেন। এঁরা দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বণ্টনের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলেন।
রাজনীতিক ক্ষেত্র উদারনীতিবাদ: রাজনীতিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ সামগ্রিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তার পূর্বশর্ত হিসাবে রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। রাষ্ট্রের সম্প্রসারিত কর্মক্ষেত্র এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আধিক্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে রাজনীতিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদের উৎপত্তি হয়। উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্রের এ ধরনের ভূমিকার কারণে ব্যক্তির স্বাধীনতার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়। রাজনীতিক উদারনীতিবাদীরা স্বাধীনতার আদর্শ ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আনুষঙ্গিক উপায় পদ্ধতির উপর জোর দেন। সংসদীয় গণতান্ত্রিক উপায়-পদ্ধতি হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল : শাসনবিভাগের উপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ; বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা; ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ; সংখ্যালঘুদের স্বার্থের সংরক্ষণ; নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি; ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ; সর্বসাধারণের জন্য আইন প্রভৃতি। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক উদারনীতিবাদীরা সামাজিক ন্যায় বিচারে সরকারের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। পরিশেষে জোহারী বলেছেন: “In fine, liberalism is the philosophy of the modern age that replaces religion as the controlling factor in giving shape thoughts of men, the idea of a golden age in the past with its concommitant idea of original sin that gives way to the doctrine of scientific progress, with its own concommitant of perfectibility through reason.”
যুক্তিবাদ: পৃথিবীর একটি যুক্তিসঙ্গত কাঠামো আছে। মানবিক যুক্তি এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাঠামোর পরিচয় পাওয়া যায়। এই বিষয় সম্পর্কিত বিশ্বাসই যুক্তিবাদ। সাধারণ নীতি হিসাবে যুক্তিবাদ কিছু বিষয়ে মানুষের সামর্থ্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। এই বিষয়গুলি হল নিজেদের দুনিয়াকে বোঝা ও ব্যাখ্যা করা এবং সমস্যাসমূহের সমাধান বের করা। দার্শনিক মতবাদ হিসাবে যুক্তিবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, যুক্তি থেকে জ্ঞান জন্মায়, অভিজ্ঞতা থেকে নয়। সুতরাং অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গে যুক্তিবাদের সম্পর্ক বিরোধিতার।
স্বাধীনতার জন্য উদারনীতিবাদীদের বক্তব্য যুক্তির উপর গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জ্ঞানালোকিত যুক্তিবাদ বিভিন্নভাবে উদারনীতিবাদকে প্রভাবিত করেছে।
(ক) ব্যক্তি ও স্বাধীনতা উভয়ের উপর উদারনীতিবাদের বিশ্বাসকে যুক্তিবাদ অধিকতর শক্তিশালী করে। নিজেদের শ্রেষ্ঠ স্বার্থসমূহের অনুধাবন ও অনুসরণের ব্যাপারে মানুষের সামর্থ্য নির্ভর করে কতদূর পর্যন্ত মানুষ যুক্তিবাদী তার উপর।
(খ) নিজেদের জীবনের দায়-দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ব্যাপারে যুক্তির শক্তি মানুষকে সামর্থ্য জোগায়। অতীতের মুঠো থেকে এবং প্রথা ও ঐতিহ্যের চাপ থেকে যুক্তিবাদ মানুষকে মুক্তি দেয়।
(গ) উদারনীতিবাদীরা প্রগতিতে বিশেষভাবে বিশ্বাস করেন। প্রগতি বলতে অগ্রগমন বা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে বোঝায়। উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জ্ঞানের বিকাশ ও বিস্তার নিজেদের দুনিয়াকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে এবং উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে মানুষকে সাহায্য করে।
(ঘ) আলোচনা, বিতর্ক ও যুক্তি প্রদর্শনের গুরুত্বকে উপরে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যুক্তির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। যুক্তির একটি বড় সুবিধা এই যে, এর ভিত্তিতে বিভিন্ন বিরোধী দাবি ও চাহিদাসমূহের মূল্যায়ন করা যায়।
(ঙ) উদারনীতিবাদীরা আক্রমণ ও বলপ্রয়োগের বিরোধিতা করেন। যুদ্ধকে একেবারে শেষ পর্যায়ের একটি বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শান্তিপূর্ণভাবে বিবাদ-বিরোধের মীমাংসা না করলে যে অতি উচ্চ মূল্য দিতে হয় তা যুক্তিবাদের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। বিবাদ-সংঘাত অব্যাহত থাকলে হিংসা, রক্তারক্তি ও মৃত্যুই হল পরিণাম।
(চ) উদারনীতিবাদে শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। উদারনীতিবাদের এই বৈশিষ্ট্যটিও যুক্তিবাদে আলোচিত হয়েছে। আধুনিক উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষার মধ্যেই মঙ্গল নিহিত আছে। ব্যক্তিগত আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক ও ঐতিহাসিক সাফল্যের সুযোগ-সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। জ্ঞান অর্জন এবং কুসংস্কার ও পক্ষপাতিত্ব পরিহারের মাধ্যমে মানুষজন নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারে।
ন্যায়পরায়নতা: বিশেষ এক ধরনের নৈতিক বিচারকে বলা হয় ন্যায় বা ন্যায়বিচার। সংক্ষেপে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য প্রদানই হল ন্যায় বা ন্যায়পরায়নতা। সমাজে বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা ও পারিতোষিক বণ্টনই হল সংকীর্ণ অর্থে সামাজিক ন্যায়। ন্যায়পরায়নতার উদারনীতিক মতবাদ সাম্যের বিশ্বাসের উপর ভিত্তিশীল। সাম্যের উপর এই বিশ্বাস বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কিত।
(ক) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ভিত্তিমূলক সাম্যের প্রতি অঙ্গীকারের কথা বলা হয়। মানুষ জন্মগতভাবে সমান। ব্যক্তিমাত্রেরই নৈতিক মূল্য সমান। মানবাধিকার বা স্বাভাবিক অধিকারের ধারণার মধ্যে এই বক্তব্য নিহিত আছে।
(খ) প্রথানুসারী সাম্যের ধারণায় বিশ্বাসই হল ভিত্তিমূলক সাম্য। অর্থাৎ সমাজের ব্যক্তিবর্গ অভিন্ন আনুষ্ঠানিক মর্যাদা ভোগ করবে। বিশেষত সুযোগ-সুবিধা ও স্বত্বাধিকারের বণ্টনের ব্যাপারে সমাজে সমতা থাকবে। প্রথানুসারী সাম্যের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকার হল আইনমূলক সাম্য এবং রাজনীতিক সাম্য। উদারনীতিবাদীরা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বা বিশেষাধিকারসমূহকে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ প্রভৃতি ভেদে অধিকার প্রদান ও ভোগের ক্ষেত্রে অসাম্যের বিরোধিতা করেন উদারনীতিবাদীরা। বিশেষ কোন ব্যক্তি বা শ্রেণীর জন্য অধিকার সংরক্ষিত থাকবে না।
(গ) উদারনীতিকদের অভিমত অনুযায়ী সমাজে ওঠাপড়ার ব্যাপারে সকলের অবস্থান হবে অভিন্ন। উদারনীতিবাদীরা সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্যনীতির উপর জোর দেন। উদারনীতিবাদীদের কাছে সাম্য হল, ‘অসমান সামর্থ্য ও দক্ষতার বিকাশের ব্যাপারে ব্যক্তিবর্গ সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে।’ অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Equality, for a liberal, means that individuals should have an equal opportunity to develop their unequal skills and abilities.”
উদারনীতিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, জন্মগতভাবে ব্যক্তিবর্গ সমান নয়; স্বভাবতই সামাজিক সাম্য অনভিপ্রেত। গুণগত যোগ্যতা ও দক্ষতার বিচারে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জন্মগত পার্থক্য বর্তমান। উদারনীতিকদের অভিমত অনুযায়ী গুণগত যোগ্যতা, সামর্থ্য ও কঠিন পরিশ্রমের প্রবণতাকে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন। জন্মগতভাবে বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণদের প্রণোদিত করার জন্য প্রণোদক প্রদান অপরিহার্য। সুতরাং এদিক থেকে বিচার করলে উদারনীতিবাদে বাছাই করা যোগ্যতর ব্যক্তিদের শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করা হয়েছে। অর্থাৎ সামাজিক সাম্যকে অন্যায় বলা হয়েছে। কারণ সামাজিক সাম্যের ক্ষেত্রে অসমান ব্যক্তিবর্গকে সমানভাবে দেখা হয়।
তবে ন্যায়ের নীতির প্রয়োগের ব্যাপারে উদারনীতিবাদীদের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। সনাতন উদারনীতিকরা গুণগত যোগ্যতাকে কদর করার পক্ষপাতী। তাঁরা বাছাই করা যোগ্যতর ব্যক্তিদের শাসনকে কঠোরভাবে সমর্থন করার পক্ষপাতী। আর্থনীতিক এবং নৈতিক – উভয় দিক থেকেই তাঁরা এই নীতিকে সমর্থন করেন। কিন্তু আধুনিক উদারনীতিকরা ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁরা সামাজিক সাম্য সম্পর্কিত কিছু ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন। জন রলস (John Rawls)-এর মতানুসারে সমাজের সর্বাধিক দরিদ্রদের কল্যাণের সহায়ক হলে আর্থনীতিক অসাম্যকে ন্যায়সঙ্গত বলা যাবে। অ্যান্ড্রু হেউড বলেছেন: “… social liberals such as Rawls have concluded that a just society is one in which wealth is redistributed through some form of welfare system for the benefit of the less Well-off.”
বৈচিত্র্য ও সহিষ্ণুতা: নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকে স্বীকার করার এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে সম্মতি উদারনীতিক সামাজিক আচরণবিধির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বৈচিত্র্যের ব্যাপারে উদারনীতিক আগ্রহ সাধারণভাবে সহনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সহনশীলতা কথাটির অর্থ হল ধৈর্যশীলতা বা আত্মসংযম। অর্থাৎ অনুমোদন বা স্বীকার না করলেও মানুষজনকে তাদের নিজেদের মত করে চিন্তা করার কথা বলার ও কাজ করার ব্যাপারে বাধা না দেওয়া। সহনশীলতা হল একটি সামাজিক নীতি এবং একটি নৈতিক আদর্শ। সহনশীলতা একাধারে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের লক্ষ্যের প্রকাশ এবং সঙ্গে সঙ্গে সহনশীলতা হল ব্যক্তিবর্গ পরস্পরের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবে সে সম্পর্কিত কিছু বিধি-ব্যবস্থা।
সপ্তদশ শতাব্দীতে জন মিলটন (John Milton) ও জন লক (John Locke) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করার জন্য বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের রচনার মাধ্যমেই প্রথম উদারনীতিক সহিষ্ণুতার ধারণার উন্মেষ ঘটে। লকের অভিমত অনুযায়ী জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি সংরক্ষণই হল সরকারের মূল কাজ। সুতরাং মানুষের আত্মিক ব্যাপারে অনধিকার চর্চার অধিকার সরকারের নেই। উদারনীতিবাদীদের কাছে মানবজীবনের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দিকের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়েছে। সহিষ্ণুতা হল নেতিবাচক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। ব্যক্তিগত সকল বিষয়ের ক্ষেত্রেই সহিষ্ণুতার নীতি প্রযোজ্য। কারণ ধর্মের মতই ব্যক্তিগত বিষয়াদি নৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বভাবতই সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।
জন স্টুয়ার্ট মিলের অভিমত অনুযায়ী সহনশীলতা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। সহনশীলতা হল প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের নিশ্চয়তার স্বীকৃতি। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বিচার করলে সহনশীলতা হল নৈতিক আত্মবিকাশের একটি শর্ত। আবার সামগ্রিকভাবে সমাজের সুস্বাস্থ্য ও শক্তির জন্য আবশ্যক হল সহনশীলতা। সামাজিক প্রগতির শক্তি হল বিতর্ক, প্রতিযোগিতা ও যুক্তিতর্ক। এবং এগুলি হল বৈচিত্র্যের বা বিভিন্নতার ফলশ্রুতি। অ্যান্ড্রু হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “Only within a free market of ideas will ‘truth’ emerge, as good ideas displace bad ones and ignorance is progressively banished.”)
বাস্তবে ব্যক্তিবর্গ এবং সামাজিক গোষ্ঠীসমূহ বিভিন্ন স্বার্থের অনুগামী হয়ে থাকে। কিন্তু উদারনীতিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে সংশ্লিষ্ট বিবদমান স্বার্থসমূহের মধ্যে এক গভীরতর সামঞ্জস্য বা ভারসাম্য বর্তমান থাকে। উদারনীতিবাদীরা ভারসাম্যযুক্ত সমাজের পক্ষপাতী। তাঁরা মৌলিক বিবাদ-বিসংবাদের বিরোধী। স্বভাবতই উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে বৈচিত্র্য ও সহনশীলতার জন্য সহানুভূতি সংযুক্ত ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীসমূহ আত্মস্বার্থের অনুগামী হয়। কিন্তু একটি স্বাভাবিক ভারসাম্য কায়েম হওয়ার প্রবণতা সক্রিয় থাকে।
কিন্তু উদারনীতিক সহনশীলতার নীতিতে অনিয়ন্ত্রিত বৈচিত্র্য বা বহুত্ববাদকে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় নি। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “Faith in tolerance is … linked to the universalist belief that liberal theories and values are ultimately destined to triumph over their illiberal alternatives.” বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উদারনীতিবাদীদের মধ্যে অনেকে সহনশীলতার নীতিকে অতিক্রম করে গেছেন। এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীরা নৈতিক নিরপেক্ষতার ধারণাকে সমর্থন করেছেন।
Leave a comment