ভূমিকা : বর্তমান যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক রাজনৈতিক দর্শন এবং মতবাদ হল উদারনীতিবাদ। বিগত তিন শতাব্দী ধরে প্রাচীন এই উদারনীতিবাদের অদলবদল বা পরিবর্তন ও পরিমার্জন ঘটেছে।

ইংল্যান্ডের পিউরিটান বৈপ্লবিক আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম উদারনৈতিক ধ্যান ধারণার সূচনা হয়। তবে লুই ওয়াইজারম্যান মনে করেন, পনেরাে শতকে উদারনীতিবাদের উদ্ভব ঘটেছে। মূলত কর্তৃত্ববাদের বিরােধিতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠাই হল উদারনীতিবাদের মূল কথা। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (Encyclopaedia Britannica)-তে বলা হয়েছে যে, উদারনীতিবাদ হল এমন একটি ভাবধারা বা ভাবাদর্শ যা সরকারের কার্যপ্রণালী হিসেবে, সামাজিক গঠন সম্পর্কিত নীতি হিসেবে এবং ব্যক্তি ও সমাজের জীবনাদর্শ হিসেবে স্বাধীনতাকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠিত করে। তবে সহজভাবে বলা যায়, উদারনীতিবাদের অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরােধিতা করা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির উপযােগী স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। উদারনীতিবাদের প্রথম রূপকার হলেন বিখ্যাত কবি জন মিলটন। এ ছাড়াও জন লক, জেরেমি বেন্থাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, টমাস পেইন প্রমুখরা।

উদারনীতিবাদের ভিত্তি

প্রথমত, রাষ্ট্র প্রয়ােজনীয় ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান।উদারনীতিবাদ তত্ত্বটি চরম রাষ্ট্রের পরিবর্তে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের আদর্শ প্রচার করেছে। বলা যেতে পারে, সমাজকল্যাণ ও জনকল্যাণই হল রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতাই হল উদারনীতিবাদের মূল মন্ত্র। কি তত্ত্ব ব্যক্তির উদ্যোগ, উৎসাহ, আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ধারণাকে সমর্থন করে। 

তৃতীয়ত, উদারনীতিবাদ হল সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্কারের প্রবক্তা। এই তত্ত্বটি সকল সামাজিক ও আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।

চতুর্থত, ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তি, উদ্যোগ ও আগ্রহকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে মানবিক অধিকারের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করে।

পঞ্চমত, উদারনীতিবাদ তত্ত্বটি সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্কারের মাধ্যমে জনকল্যাণের আদর্শ, মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করে।

মূলত প্রাচীন মতবাদ হিসেবে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই উদারনীতিবাদ সম্পর্কে অনেকে মনে করেন যে, সনাতন এই উদারনৈতিক মতাদর্শ চিন্তার স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার আদর্শের মধ্য দিয়ে প্রথম আবির্ভূত হয় প্রাচীন গ্রিসে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, প্রাচীন গ্রিসে সমাজের নারী, শ্রমিক, শিশুদের চিন্তার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উদারনীতিবাদ সমগ্র ইউরোপে ব্যাপক স্বীকৃতিলাভ করে। অধ্যাপক ল্যাস্কি ‘The Rise of European Liberalism’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, উদারনীতিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে ইউরোপের মধ্যযুগের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন এবং ফরাসি বিপ্লবের অন্তর্বর্তী সময়ে। উদারনীতিবাদ একটি সুসংহত চেহারা লাভ করে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের ইংল্যান্ডে গৌরবময় বিপ্লব’-এর মাধ্যমে। উদারনীতিবাদের ক্রমবিকাশের পর্যায়সমূহ নিম্নে তালিকাবদ্ধ করা হল –

প্রথম পর্যায়: প্রকৃতপক্ষে উদারনীতিবাদের উদ্ভব ঘটেছে দীর্ঘ বিবর্তনের পথ বেয়ে। ষোড়শ শতাব্দীর নৈতিক বোধ বুদ্ধি জাগরণকে উদারনীতির প্রথম পর্যায় বলা হয়। মূলত, মধ্যযুগে ক্যাথােলিক চার্চের ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রােটেস্টান্টদের ধর্মীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম উদারনৈতিক চিন্তাধারাকে শক্তিশালী করে। যাজক সম্প্রদায় ও সামন্তপ্রভুদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব। স্বাতন্ত্র এবং মনুষ্যত্বকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে উদারনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। ইংল্যান্ডের অধিকারের সনদ (Bill Of Rights) এবং আমেরিকার স্বাধীনতার ঘােষণার মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রকাশই উদারনীতিবাদ।

দ্বিতীয় পর্যায়: প্রকৃতপক্ষে, উদারনীতিবাদ প্রতিষ্ঠা করেন সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক। তিনি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরােধিতা করে ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকারকে সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে উদারনীতিবাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। প্রধানত এই শতাব্দীর উদারনীতিবাদ হল অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদ। কারণ উদারনীতিবাদীরা শিল্পায়ন ও অবাধ বাণিজ্য নীতির প্রবল সমর্থক।

তৃতীয় পর্যায়: অষ্টাদশ শতাব্দীকে চিহ্নিত করা হয় উদারনীতিবাদ প্রতিষ্ঠার যুগ হিসেবে। এই সময় আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণা (১৭৭৬ খ্রি.) এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘােষণার (১৭৮৯ খ্রি.) মাধ্যমে উদারনীতিবাদ তার আদর্শ বাস্তবরূপ লাভ করে। উদারনৈতিক মূল্যবোধের, বাক ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রভৃতি পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থার মূলনীতি হিসেবে পরবর্তীকালে গৃহীত হয়েছে। ভারতেও উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এবং সাফল্য লাভ করেছে। বলা যায় যে,সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে উদারনীতিবাদ একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, মনােভাব, জীবনবােধ, দর্শন ও মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে।

চতুর্থ বা শেষ পর্যায়: পরবর্তীকালে উনবিংশ শতাব্দীতে উদারনীতিবাদ কি আরও সম্প্রসারিত করা হয় ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেন্থামের হিতবাদী দর্শনের সাহায্যে। বোমের মতে, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করাই হল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। আবার উদারনীতিবাদের আর-এক প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি বা Laissez-faire-এর ব্যাখ্যা দেন।

উদারনীতিবাদ আরও সংশােধিত ও পরিবর্তিত হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। এইসময় শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদারনীতিবাদের বিভিন্ন নীতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর ফলে সাবেকি উদারনৈতিক ধ্যান ধারণার পরিবর্তন প্রয়ােজন হয়। উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে সবাইকে উদারনীতিবাদ এর সংশােধন ও পরিমার্জন শুরু হয়। উনিশ শতকের শেষ ভাগে উদারনীতিবাদের যে রূপটি ফুটে ওঠে, সেটি ইতিবাচক বা সদর্থক উদারনীতিবাদ নামে পরিচিত।

উদারনীতিবাদের চিন্তাসমূহ

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে উদারনীতিবাদ আরও প্রসারিত হয় গ্রিন, ব্রাডলি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মাধ্যমে। উদারনীতিবাদের দুটি চিন্তাধারা বা পর্বㅡ

  • (ক) সাবেকি উদারনীতিবাদ বা নেতিবাচক উদারনীতিবাদ,
  • (খ) আধুনিক উদারনীতিবাদ বা ইতিবাচক বা সদর্থক উদারনীতিবাদ।

(ক) সাবেকি উদারনীতিবাদ বা নেতিবাচক উদারনীতিবাদ: সাবেকি উদারনীতিবাদের পথিকৃৎ হলেন সপ্তদশ শতকের বিশিষ্ট ইংরেজ রাষ্ট্র দার্শনিক জন লক। এই মতবাদের অন্যান্য সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন রুশো, কনস্ট্যান্ট, টকভিল, ভলতেয়ার, মন্তেস্কু, জেফারসন, বেন্থাম, জেমস মিল এবং অ্যাডাম স্মিথ। সাবেকি উদারনীতিবাদের কেন্দ্রীয় ধারণা হল স্বাধীনতা। এই মতবাদে সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাবেকি উদারনীতিবাদ লেসে ফেয়ার তত্ত্ব অর্থাৎ প্রতিযােগিতাভিত্তিক এবং প্রতিবন্ধকতাহীন অবাধ বাণিজ্য নীতি বা একাকী চলতে দেওয়ার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

(খ) আধুনিক উদারনীতি বাদ বা ইতিবাচক বা সদর্থক উদারনীতিবাদ: ইতিবাচক উদারনীতিবাদের প্রবক্তা হিসেবে যারা পরিচিত তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জন স্টুয়ার্ট মিল, হবহাউস, গ্রিন, বােসাঙ্কেত, ল্যাস্কি, ম্যাকাইভার প্রমুখ। সাবেকি উদারনীতিবাদ ব্যক্তির যে স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকাকে অস্বীকার করেছিল, আধুনিক উদারনীতিবাদীরা সেই নীতির বিরােধিতা করে বলেন যে, ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য দরকার রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা। ল্যাস্কির ভাষায়, প্রত্যেক রাষ্ট্রই নাগরিকরা কীরূপ অধিকার ভােগ করে তার দ্বারা পরিচিত (Every state is known by the rights it maintain)। নাগরিকদের রাজনৈতিক, পৌর অধিকার, একাধিক দলীয় ব্যবস্থা, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযােগিতা, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ইত্যাদি আধুনিক উদারনীতিবাদের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বিংশ শতাব্দীতে উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের সীমিত ক্ষমতা ও সাংবিধানিক ভূমিকা পালনের উপর জোর দিয়েছে। তবে উদারনীতিবাদের সামনে ধর্মীয় মৌলবাদ, বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি নতুন চ্যালেঞ্জ দাঁড় করিয়েছে, এই অবস্থায় রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা কী, এই বিষয়ে উদারনীতিবিদদের মধ্যে পরস্পরবিরােধী মত পরিলক্ষিত হচ্ছে।