‘সাধারণের ইচ্ছা’ (General will) ও ‘গণ-সার্বভৌমত্ব’ (Popular Sovereignty)-এর নীতির ভিত্তিতে একটি রাজনীতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মানুষ যেখানেই সংগঠিত ও আন্দোলনের সামিল হয়েছে সেখানেই উদারনীতিবাদী দর্শনের অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায়। নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের (Re naissance and Reformation movements) বিজয় ধর্মীয় কর্তৃত্বমূলক শক্তিসমূহের উপর প্রাথমিক পর্যায়ে উদারনীতিবাদের সাফল্যকে সূচিত করে। প্রথমে ধর্মীয় প্রাধান্যমূলক শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে উদারনীতিবাদের উদ্ভব হয়। তারপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ঐতিহ্যের অবসানে উদ্যোগী রাজনীতিক কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে উদারনীতিবাদের প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই প্রথম উদারনীতিবাদের অভিব্যক্তি অনুধাবন করা যায়। গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন “…liberalism appeared in Europe in a peculiar historical setting. The stage was sit by Renaissance, Reformation and the Scientific Revolution. Its intellectual contest was shaped by the Enlightenment. Its political and economic foundations were laid by the Industrial Revolution.”

কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা হল উদারনীতিবাদের মূল কথা। তদনুসারে সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপেই উদারনীতিবাদের সূত্রপাত ঘটে। ইংল্যাণ্ডে ১৬৪০-এর দশকে সংঘটিত পিউরিটান বৈপ্লবিক আন্দোলনের মাধ্যমে উদারনীতিবাদের সূত্রপাত ঘটেছে। সমকালীন ইংরেজ কবি জন মিলটন ‘অ্যারিওপেজিটিকা'(Areopagitica) শীর্ষক গ্রন্থে ব্যক্তি-স্বাধীনতার অর্থবহ আলোচনা করেন। উদারনীতিবাদের প্রথম রূপকার হিসাবে মিলটনের নাম সুবিদিত। উদারনীতিবাদের সাবেকি ঐতিহ্যটি বিকশিত হয়েছে মিলটন থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রদার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল পর্যন্ত। দু-একজন ফরাসী ও মার্কিন চিন্তাবিদের কথা বাদ দিলে, অধিকাংশ উদারনীতিক দার্শনিকরা হলেন ইংরেজ। এ প্রসঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীর জন মিলটন ও জন লক, অষ্টাদশ শতাব্দীর জেরেমী বেথাম, ঊনবিংশ শতাব্দীর জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বার্ট স্পেনসার প্রমুখ চিন্তানায়কদের নাম উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় (Amal Kumar Mukhopadhya) তাঁর Liberalism: A Dilemma for Indian Political Science শীর্ষক এক রচনায় উদারনীতিবাদের সুদীর্ঘ ইতিহাস প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Liberalism, among all political doctrines, enjoys the longest tradition. From Locke to the present day liberals it has been a three hundred years’ marathon run for it. Yet it gets along with unabated vigour and most of the world is still under its spell.”

উদারনীতিকদের সূত্রপাতের আগে অবধি মানবসমাজে প্রাধান্য পেয়েছে কর্তৃত্ববাদের নীতি। পুরাতন রাষ্ট্রব্যবস্থাসমূহ ছিল কর্তৃত্ববাদী। আদিম জনজাতিভিত্তিক সমাজজীবনের পর্যায়েও অপরিহার্যভাবে কর্তৃত্ববাদ ছিল। মানবসভ্যতার সেই প্রাথমিক অবস্থায় কর্তৃত্ববাদের বিকল্প বলতে অরাজকতাকে বোঝাত। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃত্ববাদের প্রাধান্য কিন্তু হ্রাস পায়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শোনা গেছে ‘সার্বভৌমের আদেশই হল আইন।’ যাইহোক প্রাচীনকালে গ্রীক নগররাষ্ট্রে কর্তৃত্ববাদের বিকল্প হিসাবে স্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। তবে গ্রীক নগর-ব্যবস্থা সাফল্য লাভ করেনি। মধ্যযুগের ইউরোপে ভূস্বামী ভূমিদাসের মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের ভিত্তিতে সামস্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আর এক ধরনের কর্তৃত্ববাদের অভিব্যক্তি ঘটে। সামস্ততান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ হল প্রধানত আরোপিত আচার-বিধির এক জটিল ব্যবস্থা।

নবজাগরণের (Renaissance) গোড়ার দিকে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সার্বভৌম কর্তৃত্বের ধারাটি পরিলক্ষিত হয়। নবজাগরণের মাধ্যমে যুক্তিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাবাদের আদর্শ ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু ইউরোপের নবজাগরণ বা সার্বিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সময় মানবতাবাদের অন্তর্ভুক্ত ধারণাস্বরূপ স্বাধীনতার নীতি সমর্থন লাভ করেছে। স্বভাবতই ষোড়শ শতাব্দীতে ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে (Reformation Movement) চরম প্রতিবাদের অভিব্যক্তি ঘটেছে।

সংস্কার আন্দোলনের পথে লুথার, ক্যালভিন প্রমুখ উদারনীতিক চিন্তাবিদ্রা ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। ইংল্যাণ্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে পিউরিটান বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতার নীতি বা উদারনীতি রাজকীয় কর্তৃত্ববাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়। ইংল্যাণ্ডে ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লব (Glori ous Revolution, 1688) হল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ কিন্তু সুসংগঠিত ও শক্তিশালী এক গণ-আন্দোলন। এই গণ-আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তত্ত্বগত বিচারে জন মিলটন ও জন লকের আগে উদারনীতিবাদের সমর্থনে তেমন জোরালো ও অর্থবহ আলোচনা পাওয়া যায় না।

ইংল্যান্ডের সপ্তদশ শতাব্দীর বিপ্লবের মত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের আমেরিকার ও ফরাসী বিপ্লবের মধ্যেও সুস্পষ্টভাবে উদারনীতিক উপাদানসমূহ ছিল। তবে রাজনীতিক অর্থে উদারনীতি শব্দটি সে সময় ব্যবহার করা হয়নি। সে সময় ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের ধর্মীয় ভিত্তির উপর চরম রাজতন্ত্রের অবাধ অসীম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত ছিল। উদারনীতিবাদীরা চরম রাজতন্ত্রের এই অবাধ ক্ষমতার বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। তাঁরা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এবং ভূস্বামী অভিজাত সম্প্রদায়ের রাজনীতিক ও আর্থনীতিক বিশেষাধিকারসমূহের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিল। চরম রাজতন্ত্রের অবাধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে উদারনীতিকরা প্রথমে সাংবিধানিক সরকার এবং পরবর্তী কালে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের সমর্থনে বক্তব্য বিন্যস্ত করেছিলেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত সীমাগুলির কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। উদারনীতিবাদীরা ধর্মীয় বিষয়ে বিবেকের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন।

গোড়ার দিকে উদারনীতিবাদের উদ্ভবের পিছনে কোপারনিকাস, ক্যালভিন, মার্টিন লুথার, ম্যাকিয়াভেলি, মোর, মিলটন প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আধুনিক যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে উদারনীতিবাদের মৌল বৈশিষ্ট্যসমূহ বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন জন লক্, টমাস পেইন, মণ্টেস্কু, বোঁদা প্রমুখ চিন্তানায়কগণ।

একটি সুসংবদ্ধ রাজনীতিক মতাদর্শ হিসাবে উদারনীতিবাদের আবির্ভাব ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে হয়তো হয় নি। কিন্তু বিগত শ’তিনেক বছর ধরে যে সমস্ত ধারণা ও মতবাদ বিকশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতেই উদারনীতিবাদ সমৃদ্ধ হয়েছে। ইউরোপে সামস্ততন্ত্রবাদের অবসান এবং তার জায়গায় বাজার ব্যবস্থা বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিকাশের সূত্রে উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ১৮১২ সালে প্রথম স্পেনে ‘উদারনীতি’ কথাটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে স্বতন্ত্র একটি রাজনীতিক ধারণা হিসাবে উদারনীতি সমগ্র ইওরোপে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনে উদারনীতি স্বীকৃতি পেয়েছে ধীরে ধীরে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে হুইগরা (Whigs) নিজেদের উদারনীতিবাদী হিসাবে পরিচিত করতে উদ্যোগী হন। ১৯৬৮ সালে গ্ল্যাডস্টোন (Gladstone) – এর নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম একটি উদারনীতিক সরকার গঠিত হয়।

সমকালীন ইওরোপে চূড়ান্ত রাজতন্ত্র ও ভূস্বামী অভিজাততন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার সঙ্গে উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংঘাতের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি ঘটে উদারনীতিবাদের মাধ্যমে। সমকালীন পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিবাদ ছিল বিশেষভাবে র‍্যাডিক্যাল। উদারনীতিবাদীরা মৌলিক সংস্কার এবং এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন।

ল্যাস্কির অভিমত অনুযায়ী উদারনীতিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে ইউরোপের ধর্মসংস্কার আন্দোলন এবং ফরাসী বিপ্লবের অন্তর্বর্তী সময়ে। ল্যাক্সি তাঁর The Rise of European Libaralism শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে উদারনীতিবাদ হল নতুন যুগের এক নতুন দর্শন। এ হল এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষ, মানবসম্পদ ও মানবজীবন সম্পর্কিত। ল্যান্সির মতানুসারে উদারনীতিবাদ হল একটি জীবনধারা। ইংল্যাণ্ডের রাজনীতিক মতবাদের অভিজ্ঞতায় এর অভিব্যক্তি ঘটে। উদারনীতিবাদের সূত্রসমূহ সমকালীন ইংল্যাণ্ডের সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, দায়িত্বশীল শাসন, সংবিধানবাদ প্রভৃতির মধ্যে নিহিত ছিল। মধ্যযুগে ধর্মীয় গোঁড়ামি, ঐতিহ্য, আধিপত্য, কৃষিমূলক গ্রামীণ সমাজজীবন প্রভৃতির প্রাধান্য ছিল। নতুন যুগের সাবেকি ধারার পরিবর্তে যুক্তি, বিজ্ঞান, আধুনিকতা ও নগর জীবনের দাবি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এই সব দাবির অভিব্যক্তি ঘটেছে যে দর্শন বা মতবাদের মাধ্যমে তা উদারনীতিবাদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে।

ল্যাক্সিকে অনুসরণ করে বলা যায় উদারনীতিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে দীর্ঘকালীন বিবর্তনের মাধ্যমে। ষোড়শ শতাব্দীতে মূলত নৈতিক বোধবুদ্ধি, জাগরণ ও বিকাশের বক্তব্যই উদারনীতিক দর্শনের মাধ্যমে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে উদারনীতিক মতবাদের বিবর্তনের দ্বিতীয় ধারা হল বৈজ্ঞানিক ও আর্থনীতিক উন্নতি। এই শতাব্দীর উদারনীতিবাদ হল আর্থনীতিক উদারনীতিবাদ। উদারনীতিবাদের প্রতিষ্ঠার যুগ হিসাবে অষ্টাদশ শতাব্দীকে চিহ্নিত করা হয়। উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার সূত্রপাত ঘটেছে ইংল্যাণ্ডে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে উদারনীতিক চিন্তাভাবনার পীঠস্থান হয়ে উঠে ফ্রান্স। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বোম, মিল এবং গ্রীনের হাতে উদারনীতিক মতবাদ পরিশীলিত রাষ্ট্রনীতিক দর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত উদারনীতিক রাষ্ট্রদর্শনের সম্প্রসারণ ও বিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকে। গাউবা তাঁর An Introduction to Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। “The liberal Theory of the state closely corresponds to the mechanistic view of the state. It arose in a particular historical setting when several factors contributed to its development. The growth of the physical sciences in seventeenth century Europe‌ tended to transform men’s ideas about society and the state.”

উদারনীতিবাদীরা ব্যাপক শিল্পায়ন ও বাজার আর্থনীতিক ব্যবস্থার সমর্থক। এ ধরনের আর্থনীতিক ব্যবস্থা সরকারী হস্তক্ষেপের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকবে। ব্যবসা-বাণিজ্য মুনাফামুখী হবে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমী দেশগুলিতে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার প্রসার ঘটে। তারফলে উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার বিজয় ঘোষিত হয়। বস্তুত বিভিন্ন দিক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীকে উদারনীতিক শতাব্দী হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে প্রথমে ইংল্যান্ডে শিল্প পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ইংল্যান্ডে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী কালে উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং তারপর কালক্রমে পূর্ব ইউরোপ, অর্থাৎ সমগ্র ইউরোপে শিল্প পুঁজিবাদ সম্প্রসারিত হয়। তারপর বিংশ শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী কালে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিল্প পুঁজি কার্যকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে সামাজিক রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পশ্চিমী ধারণা অর্থবহ ভূমিকা পালন করেছে। উদারনীতিক ধারণা ও মূল্যবোধসমূহের দ্বারা পশ্চিমী রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহের চেহারা-চরিত্র নির্ধারিত হয়েছে। এই সমস্ত পশ্চিমী রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সাধারণভাবে বলা হয় উদারনীতিক গণতন্ত্র। এই সমস্ত রাজনীতিক ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ সাংবিধানিক সরকার, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, সীমাবদ্ধ সরকারী ক্ষমতা, নাগরিক স্বাধীনতাসমূহের সুরক্ষা প্রভৃতি। অধিকাংশ পশ্চিমী দেশের রাজনীতিক সংস্কৃতি উদারনীতিক পুঁজিবাদী মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। পশ্চিমী সমাজব্যবস্থাসমূহে বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সম্পত্তির মালিকানার অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার উদারনীতিবাদ থেকেই নেওয়া হয়েছে।

উন্নয়নশীল দুনিয়ার দেশগুলিতে পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল পৃথক। সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের রাজনীতিক সংস্কৃতিতে ব্যক্তির পরিবর্তে সমষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতি বা রাজনীতিক সংস্কৃতি পশ্চিমী উদারনীতিবাদের পরিবর্তে সমাজতন্ত্রবাদ বা জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও বিস্তারের পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক। স্বভাবতই উন্নয়নশীল দুনিয়ার রাষ্ট্রসমূহে অনেক সময়েই উদারনীতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ পরিলক্ষিত হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীন অনেক দেশেই পশ্চিমী ধাঁচের উদারনীতিক শাসনকে চালান করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই উদ্যোগ সর্বত্র সমান সাফল্য পায়নি। ভারতে উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থা স্বীকৃতি ও সাফল্য পেয়েছে। ভারত হল বিশ্বের বৃহত্তম উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এশিয়া-আফ্রিকার অন্যান্য দেশে অনেক সময় উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এর পিছনে সাধারণত দ্বিবিধ কারণ পরিলক্ষিত হয় : 

  • (ক) স্বদেশীয় রাজনীতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি এবং 

  • (খ) শিল্প পুঁজিবাদের অনুপস্থিতি।

রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, উদারনীতিবাদ ও পুঁজিবাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য সম্পর্ক বর্তমান। উদারনীতিবাদের সমালোচকরা ত’ বটেই, এমন কি সমর্থকরাও এই বক্তব্যকে স্বীকার ও সমর্থন করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে শিল্পোন্নত পশ্চিমী দুনিয়াতেই উদারনীতিবাদ প্রাধান্যকারী মতাদর্শ হিসাবে পরিগণিত হয়।

উদারনীতিবাদ কোন স্থিতিশীল বা অনড় মতাদর্শ নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু করে পরবর্তী কালে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার ব্যাপক প্রগতি পরিলক্ষিত হয়। অতঃপর উদারনীতিবাদ বিবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। উদারনীতিবাদের সাবেকি অবস্থার ধ্যান-ধারণার সংশোধন বা পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তা ছাড়া ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিবিধ ঐতিহাসিক বিকাশ ও বিবর্তন ঘটে। তার ফলে উদারনীতিক মতাদর্শের বিষয়াদি ও প্রকৃতি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। এতাবৎকালে উদারনীতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সাফল্য পেয়েছে। এই সমস্ত সাফল্য উদারনীতিবাদের র‍্যাডিক্যাল বা বৈপ্লবিক ধারাকে বহুলাংশে ভোঁতা করে দিয়েছে। ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ যা ছিল র‍্যাডিক্যাল বা বৈপ্লবিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা রক্ষণশীল মতাদর্শ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। বিশেষ রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের, বিশেষত উদারনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সংরক্ষণের ব্যাপারেই উদারনীতিবাদকে অধিকতর আগ্রহী দেখা যায়। উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণিসমূহ তাঁদের আর্থনীতিক ও রাজনীতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ-আয়োজনে সাফল্য অর্জনের পর উদারনীতিবাদের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে।

স্বভাবতই উদারনীতিবাদীরা ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ধারণা ও মূল্যবোধসমূহের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে সক্রিয় হয়। আবার চূড়ান্ত কোন পরিস্থিতিতে এমন প্রশ্নেরও সৃষ্টি হয় যে, সকল সমাজ ও সকল জনসম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদ কার্যকর করা সম্ভব কিনা? ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী বক্তব্য অনুযায়ী জনসাধারণের জীবনধারায় সরকার যথাসম্ভব কম হস্তক্ষেপ করবে। অপরদিকে আধুনিক উদারনীতিবাদীরা বলেন যে, সরকার জনগণকে কল্যাণমূলক সর্ববিধ পরিষেবা প্রদানের জন্য যাবতীয় দায়দায়িত্ব পালন করবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, বৃদ্ধাবস্থায় অবসরকালীন পরিষেবা প্রভৃতি সব রকম পরিষেবা সরকার প্রদান করবে। তা ছাড়া সরকার আর্থনীতিক ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করবে। এই পরিবর্তিত ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে : ধ্রুপদি উদারনীতিবাদ ও আধুনিক উদারনীতিবাদ।

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে উদারনীতিবাদ পশ্চিমী স্বভূমিতে ক্রমবর্ধমান নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যজনিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তাছাড়া ধর্মীয় মৌলবাদ ও অন্যান্য রাজনীতিক বিশ্বাস উদারনীতিক মূল প্রত্যয়সমূহের সম্মুখে বিবিধ প্রশ্ন খাড়া করে দিয়েছে। বিরোধী কোন কোন রাজনীতি বিজ্ঞানীর অভিযোগ অনুযায়ী রাজনীতিক মতাদর্শ হিসাবে উদারনীতিবাদ যথেষ্ট সুসংহত নয়। এই রাজনীতিক মতাদর্শের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বিবিধ বিশ্বাস বর্তমান। বিশেষত রাষ্ট্রের বাঞ্ছিত ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে বিভিন্ন ধারার উদারনীতিবাদীদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।