উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা: বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমান। এই রাজনীতিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উদারনীতিক দর্শনের বাস্তবায়ন। উদারনীতিক ধ্যান-ধারণা বিকাশ ঘটে মোটামুটিভাবে সপ্তদশ শতাব্দীতে। এ হল সাবেকী উদারনীতিক গণতন্ত্র। এর দুটি মূল নীতি হল রাজনীতিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। এ দুটি নীতির স্রষ্টা হিসাবে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের কথা বলা হয়। পরবর্তী কালে উদারনীতিক গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করেন জেমস মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখ দার্শনিকগণ। সাবেকী উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে বিংশ শতাব্দীতে। উদারনীতিক গণতন্ত্রের আধুনিক রূপের ব্যাখ্যাকারক হিসাবে জন ডিউই, এম. আর. কোহেন প্রমুখ চিন্তাবিদের নাম করা হয়।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা: সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয় মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শের উপর ভিত্তি করে। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে বলা হয় যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয় সর্বহারাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে মূলত কমিউনিস্ট দেশসমূহের রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়। তবে সাম্প্রতিককালে কতকগুলি দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সমাজতন্ত্রের মৌলিক আদর্শসমূহকে বাস্তবে কার্যকর করার ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ধারণার কথা এসে পড়ে।
উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা মধ্যে পার্থক্য
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরস্পরের সঙ্গে সাদৃশ্য রহিত। এই দুই রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রকৃতিগত বিভিন্ন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
(১) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সাম্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে জনসাধারণকেই যাবতীয় রাজনীতিক ক্ষমতার একমাত্র উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়। এখানে জনসাধারণের শাসন বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়ে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলেও সরকার পরিচালিত হয় সর্বসাধারণের স্বার্থে।
অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থনীতিক সাম্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এখানে আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ, সর্বপ্রকারের শোষণের অবসান প্রভৃতির উপর জোর দেওয়া হয়।
(২) উদারনীতিক গণতন্ত্রে বহুদলীয় ব্যবস্থা বর্তমান থাকে। এই ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণী ও তাদের বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ ও সমস্যাদি থাকে। বিভিন্ন শ্রেণীর বহুবিধ স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের জন্য উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একাধিক রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত।
অপরপক্ষে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একাধিক শ্রেণী, বহুবিধ শ্রেণী-স্বার্থ, শ্রেণী-শোষণ বা শ্রেণী-দ্বন্দ্ব থাকে না। স্বভাবতই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি মাত্র রাজনীতিক দল থাকে। এ হল দেশের শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতী মানুষের সাম্যবাদী হল। এ হল কমিউনিস্ট দল।
(৩) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় আইনের দৃষ্টিতে সাম্য ও আইনসমূহের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারকে স্বীকার করা হয়।
অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সর্বহারার একনায়কত্ব (dictatorship of the proletariat)। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় একটি মাত্র শ্রেণীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণটি হল। শ্রমিক ও কৃষকের সর্বহারা শ্রেণী।
(৪) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকার করা হয়। তবে সম্প্রতিককালে কোন কোন দেশের উদারনীতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকারের উপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকে। ভারতের সংবিধানে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং এই অধিকারটিকে সাধারণ আইনগত অধিকারে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয় না। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার শোষণের সুযোগ সৃষ্টি করে। সম্পত্তির অধিকার অস্বীকৃত হলে শোষণের সুযোগ অন্তর্হিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধন-সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের উপর জোর দেওয়া হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে সর্বসাধারণের আর্থনীতিক উন্নতি সাধনের চেষ্টা করা হয়।
(৫) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্র, বেতার প্রভৃতি গণসংযোগের মধ্যে স্বাধীনতা স্বীকৃত। গণসংযোগের মাধ্যমসমূহ সরকারের সমালোচনা করতে সমর্থ। সরকার এদের নিয়ন্ত্রণ করে না। বিপরীতক্রমে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় গণসংযোগের মাধ্যমসমূহ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
(৬) উদারনীতিক গণতন্ত্রে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ সরকারী সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং করে। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ গোষ্ঠী স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। বস্তুত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহের উপর কঠোর সরকারী নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতিই হল একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
অপরপক্ষে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গোষ্ঠীস্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সমষ্টিগত নেতৃত্বে সবকিছু পরিচালিত হয়। সামাজিক ও রাজনীতিক নিয়ন্ত্রণ সমষ্টিগত নিয়ন্ত্রণে সম্পাদিত হয়। এই কারণে এই ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী ও স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সকল স্তরে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অনুসরণ করা হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের স্বার্থের পরিবর্তে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
(৭) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। উদারনীতিক গণতন্ত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষ প্রকৃতির হয় না। রাষ্ট্র-যন্ত্রের অন্যতম অংশ হিসাবে আদালতও সমাজতান্ত্রিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে।
(৮) উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী ধ্যান-ধারণাকে স্বীকার করা হয়। এ ধরনের রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় সামরিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এ রকম আশঙ্কা থেকে একেবারে মুক্ত। সমাজতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদের শত্রু হিসাবে সুবিদিত।
(৯) উদারনীতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ভোগের অবাধ সুযোগ পাওয়া যায়। ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচারের অধিকার এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম-বিরোধী প্রচারের অধিকারই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
(১০) উদারনীতিক রাষ্ট্রে রাজনীতিক ক্ষমতাযুক্ত পদ বা চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়।
সমাজতত্ত্বের ভবিষ্যৎ
সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বা একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের চেহারা-চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা অধুনা অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ১৯৮৯-‘৯১ সালে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে প্রতিবিপ্লবী ক্রিয়াকর্মের পরিণামে প্রকৃত প্রস্তাবে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের শেষ চিহ্নগুলিও মুছে যায়। নামেমাত্র সমাজতান্ত্রিক শাসন এখনও টিকে আছে হাতে গোনা গুটিকয়েক দেশে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন, কিউবা ও উত্তর কোরিয়ার নাম করা দরকার। এই সমস্ত দেশের কমিউনিস্ট পার্টি বাজার অর্থনীতির সংস্কারের ব্যাপারে সম্মত হয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যাপারে উদ্যোগ আয়েজন গ্রহণ করে। তার ফলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। অন্যান্য গুটিকয়েক দেশে সংসদীয় সমাজতন্ত্রী দল সাবেকি সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে সরে এসেছে এবং নির্বাচনী বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের ব্যাপারে সক্রিয় ও সচেষ্ট হয়েছে। এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দল বাজার অর্থনীতির প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন-সহানুভূতি প্রদর্শনে বিশেষভাবে ব্যস্ত। যাইহোক অনেকের অভিমত অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটেছে। সমাজতন্ত্রের মৃত্যুতে শোকগাথাও ইতিমধ্যে রচিত হয়ে গেছে। সুতরাং সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। স্বভাবতই একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের চেহারা-চরিত্রের আলোচনাও অপ্রাসঙ্গিক।
সমাজতন্ত্রের অপমৃত্যু নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। এর কারণ অনুসন্ধান সম্পর্কিত আলোচনাও অব্যাহত! কিন্তু একটি বিষয় অবিতর্কিতভাবে সুস্পষ্ট। বিষয়টি হল যে, বর্তমান বিশ্ব বামপন্থা পরিত্যাগ করেছে এবং দক্ষিণপন্থা গ্রহণ করেছে। বিরুদ্ধবাদীদের বিরূপ মন্তব্য হল যে, মানব সভ্যতার ইতিহাস সমাজতন্ত্রবাদকে ইতিহাসের নর্দমায় নিক্ষেপ করেছে। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা এর পিছনে কারণ হিসাবে বিবিধ বিষয়কে চিহ্নিত করে থাকেন। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আবশ্যক।
(ক) সামাজিক-রাজনীতিক চিন্তাবিদ ফুকুয়ামা (F. Fukuyama) The End of History শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে তাঁর অভিমত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। ফুকুয়ামার মত ‘ইতিহাসের অবসান’ সম্পর্কিত মতবাদের প্রবক্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী সকল রকম সমাজতান্ত্রিক মডেলের মধ্যেই অন্তর্নিহিত ত্রুটিবিচ্যুতি বর্তমান। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতানুসারে সমাজতন্ত্রের অপমৃত্যুর আর একটি কারণ হল উদারনীতিক পুঁজিবাদের শ্রেষ্ঠত্বসূচক অভিব্যক্তি।
(খ) আর একদল সমালোচকের অভিযোগ অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের ভিত্তি ক্রমান্বয়ে অধিকতর সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। সাবেকি সমাজতন্ত্রের পিছনে ছিল শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপক গণ-ভিত্তি। এই গণভিত্তি ধীরে ধীরে সরে যায়। তার পরিবর্তে বিচ্ছিন্ন ও অ-রাজনীতিক নিম্নবর্গীয় শ্রেণিসমূহ সমাজতন্ত্রের ভিত্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।
(গ) বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার অধীন অর্থনীতিও সমাজতন্ত্রের অবক্ষয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিশ্বায়িত অর্থনীতির মধ্যে সমাজতন্ত্রবিরোধী একটি প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই প্রবণতা অনুসারে সকল জাতিকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়।
‘সমাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটেছে’—এমন সিদ্ধান্ত সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। এ বিষয়ে উপরিউক্ত আলোচনা সামগ্রিক সত্যের পরিচয় প্রদানে ব্যর্থ। এ প্রসঙ্গে অন্য রকম আলোচনারও অবকাশ আছে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে সমাজতন্ত্র অপ্রতিরোধ্য গতিতে হই হই করে দাপটের সঙ্গে এগোচ্ছিল। সে সময়ে মুক্ত বাজার উদারনীতিবাদকে অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত বলে মনে করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে ঘোষণা করা হয়েছিল সমাজতন্ত্রের অনিবার্য বিজয়াভিযানের কথা। সে ভবিষ্যবাণী নির্ভুল প্রমাণিত হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় উচ্চারিত সমাজতন্ত্রের মৃত্যু সম্পর্কিত ঘোষণাও বিশ্বাস করার সম্যক কারণ নেই। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ সমাজতন্ত্রীরা হতাশার শিকার হতে নারাজ।
একবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদ বিরোধী ধারণা হিসাবে সমাজতন্ত্রের পুনর্জন্মের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। তাত্ত্বিক বিচারে বিশেষভাবে জোরদার না হলেও বিশ্বায়নবিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী একটি শক্তি বা আন্দোলনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবাদে সমাজতন্ত্রবাদের সহায়ক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হতে পারে এবং বিশ্বায়ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। আর্থনীতিক জীবনের অতিজাতিক মাত্রার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার ফলে পুঁজিবাদের রূপান্তর ঘটেছে। অনুরূপভাবে সমাজতন্ত্রেরও রূপান্তর ঘটতে পারে বিশ্বব্যাপী শোষণ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা হিসাবে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বিবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। পুঁজিবাদের এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা অনেকাংশে অনপনেয়। এর মধ্যেই নিহিত আছে সমাজতন্ত্রের বেঁচে থাকার রসদ। সমাজতন্ত্রবাদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আছে। কারণ বাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদ মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পক্ষে শেষ কথা নয়। বাজার-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিধিকে অতিক্রম করে যাওয়ার সামর্থ্য-সম্ভাবনা মানুষের মধ্যে আছে। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী মিলিবান্ড (Ralph Miliband) তাঁর Socialism for a Sceptical Age শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে মিলিবান্ডকে উদ্ধৃত করে বলেছেন: “…the notion that capitalism has been thoroughly transformed and represents the best that humankind can ever hope to achieve is a dreadful slur on the human race.”
উপরিউক্ত আলোচনার পরেও ভাবনার মধ্যে আরও কিছু বিষয় থেকে যায়। প্রশ্ন দেখা দেয় এই নিয়ে যে, পুনরুজ্জীবিত সমাজতন্ত্রের চেহারা-চরিত্র কী হবে? চিন্তাবিদদের কারও কারও মতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থাকবে না; লেনিনবাদ ও স্তালিনবাদের সঙ্গে মার্কসবাদ জট পাকিয়ে গেছে। অতঃপর এই জটপাকানো অবস্থা থেকে জট ছাড়িয়ে মুক্ত মার্কসবাদের উত্তরসূরী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য হয়ে পড়বে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার বলে প্রতিপন্ন হয় যে, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ ভবিষ্যতে অনুসৃত হবে না। সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা সঞ্চারিত হবে। মৌলবাদী নয়া উদারনীতিবাদকে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। তবে এর ভিত্তিতেই সমাজতন্ত্রবাদের পুনর্জন্ম সুনিশ্চিত এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তবে নতুন ধরনের সমাজতন্ত্রের অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে। রাজনীতিক এবং নির্বাচনমূলক বিচারে বাজার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য বিকল্প অদ্যাবধি অধরা। সংসদীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কারসাধন সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরও চলবে। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের কারো কারো অভিমত অনুযায়ী ‘আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ’ সম্পর্কিত বিংশ শতাব্দীর মার্কসীয় ধ্যান-ধারণার অব্যাহত অস্তিত্ব সম্পর্কে আশঙ্কা আছে। তবে মানবতাবাদী সমাজতান্ত্রিক মার্কসের জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকবে। এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু হেউডের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Marxism-Leninism might indeed be dead, and few socialist tears would be shed at its passing. One of the consequences of this may be a re-examination of Marx’s legacy, now disentangled from the experience of Leninism and Stalinism. However this more likely to be Marx the humanist socialist than the more familiar twentieth-century image of Marx as an economic determinist.”
Leave a comment