উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতা আপাত বিচারে একটি স্ববিরোধী প্রত্যয় হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। কারণ নীতিগত বিচারে উদারনীতিবাদীরা জাতীয়তাবাদের মতাদর্শকে বাতিল করার পক্ষপাতী নন। বরং মতাদর্শগত বিচারে উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের কথাই বলা হয়। উদারনীতিবাদী বক্তব্য অনুযায়ী অভিন্ন সংস্কৃতি বা জীবনধারাগত সামঞ্জস্য পরিচিতির সাদৃশ্য বা সমষ্টিগত সংহতির সৃষ্টি করে। জাতিমাত্রেই স্বতন্ত্র সত্তাযুক্ত।

কিন্তু উদারনীতিক জাতীয়তাবাদ বিকৃত জঙ্গী জাতীয়তাবাদে পরিণত হয় না। উদারনীতিবাদে জাতিকে রাজনীতিক কর্তৃত্বের সর্বোচ্চ উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। সীমাহীন ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মতই, অনিয়ন্ত্রিত জাতীয় ক্ষমতার বিবিধ ত্রুটিবিচ্যুতি বর্তমান। স্বভাবতই উদারনীতিবাদী আলোচনায় আন্তর্জাতিকতাবাদী ধ্যান-ধারণাও বর্তমান। উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের বিষয়টি বিভিন্ন দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করা দরকার।

(১) উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, মানবাধিকারের মধ্যে উচ্চতর নৈতিকতা বিধৃত আছে। জাতীয়সমূহের উচিত এই উচ্চতর নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে নিজেদের পরিচালিত করা। জাতিসমূহকে রাজনীতিক একক হিসাবে একেবারে অগ্রাহ্য করার কথা বলা হয়নি। উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী যথার্থ মানবিক অস্তিত্বের জন্য ন্যূনতম কতকগুলি শর্ত পরিপূরিত হওয়া প্রয়োজন। মানবাধিকারের মধ্যে এই সমস্ত অপরিহার্য শর্তাদির কথা আছে। মানবাধিকারসমূহ বিশ্বজীনভাবে প্রযোজ্য।

(২) উদারনীতিবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী মানবাধিকারসমূহের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশ বাঞ্ছনীয়। এই ধারণার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার সম্পর্কিত বিশ্বজনীন ঘোষণা সম্পাদিত হয়েছে। তেমনি আবার ১৯৫৬ সালে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাসমূহের উপর ইউরোপীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

(৩) উদারনীতিবাদে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ধারণাকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। এ কথা ঠিক। কিন্তু এ কথার মানে এই নয় যে, জাতি-রাষ্ট্রগুলি তাদের জনসাধারণের উপর খেয়ালখুশীমত বিধি ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবে। উদারনীতিবাদে ব্যক্তি-মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। জাতীয় সার্বভৌমত্বের দাবির ঊর্ধ্বে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

(৪) উদারনীতিবাদ অনুযায়ী জাতি, জাতীয়তা, সামাজিক পটভূমি নির্বিশেষে সকল মানুষই সমান নৈতিক মূল্যমানযুক্ত। ব্যক্তি-মানুষ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নীতির প্রতি উদারনীতিবাদের অঙ্গীকার অনস্বীকার্য। এ বিষয়ে আশাতিরিক্ত অঙ্গীকারের ভিত্তিতে উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদ বিকশিত হয়েছে। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “… liberal internationalism stems from an overriding commitment to the individual and the principle of individualism.”

(৫) উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইনের অনুশাসনকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। বলা হয় যে, ‘আন্তর্জাতিক আদালত (International Court of Justice) ও ‘আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত’ (International Criminal Court)-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের অনুশাসন কার্যকর হবে।

(৬) পররাজ্য গ্রাস ও লুঠতরাজ প্রতিহত করার কথা উদারনীতিবাদে বলা হয়। এই উদ্দেশ্যে উদারনীতিবাদে জাতিসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর জোর দেওয়া হয়। তা হলে জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতা গড়ে উঠবে। স্বভাবতই উদারনীতিবাদে বরাবরই মুক্ত বাণিজ্য ও আর্থনীতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়েছে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আন্তর্জাতিক সংঘাত-সংঘর্ষ অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল। ব্যয়ের আধিক্যের কারণে যুদ্ধের ভাবনা ভাবা যায় না।

(৭) আর্থনীতিক ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদীদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার নীতি বিশ্বজনীনতার নীতির জন্ম দেয়। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভশীলতার কারণে প্রতিটি দেশে ‘তুলনামূলক সুবিধার নীতি (Comparative advantage)-র পরিপ্রেক্ষিতে কেবল সেই সমস্ত দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদন করবে, যা উৎপাদনে সেই দেশ বিশেষভাবে পারদর্শী বা সুবিধাজনক অবস্থায় অবস্থিত। তার ফলে বিশেষীকরণের মাধ্যমে সকল দেশের সমৃদ্ধি সম্পাদিত হবে। শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির, ধর্মের ও ভাষাভাষী মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসবে। তার ফলে সদ্ভাব-সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠবে।

(৮) উদারনীতিক জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, গণতন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিকতা সামরিক মনোবৃত্তি, সামরিক শাসনের প্রবণতা এবং যুদ্ধের আশঙ্কাকে হ্রাস করে। কিন্তু অনেক সময় সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যবাদী পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের মধ্যে কাজ করে, তখন বিশ্বশান্তির সুরক্ষার স্বার্থে জাতি রাষ্ট্রসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়। তখন আন্তর্জাতিক বিধি-ব্যবস্থা ও সংগঠনের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।

(৯) উদারনীতিবাদীরা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার ও সমর্থন করেন। তাঁদের কাছে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতি আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু এই আশীর্বাদ অবিমিশ্র প্রকৃতির নয়। এই নীতির একটি বিপরীত দিকও আছে। এই নীতিটিকে কার্যকর করলে স্বায়ত্ত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিহত হয়। আবার এই নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রসমূহের সৃষ্টি হয়। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি জাতি স্বাধীনভাবে স্ব স্ব স্বার্থ সাধনের সুযোগ পায়; এমন কি অপর জাতির স্বার্থের হানি করেও আত্মস্বার্থ সংরক্ষণে জাতি-রাষ্ট্রগুলি উদ্যোগী হয়। সংশ্লিষ্ট নীতিটির এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে উদারনীতিবাদীরা অবহিত ছিলেন। স্বভাবতই তাঁরা উদারনীতিবাদকে একটি মিশ্র আশীর্বাদ হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

(১০) উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী জাতিসমূহের প্রত্যাশা লাগামহীন। জাতিগুলির প্রত্যাশায় লাগাম লাগাতে হবে। তার জন্য অতিজাতিক সংস্থা-সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও শান্তি সংরক্ষণ সম্ভব হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক সমাজ অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলায় ভরে যাবে। ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন একটি বিশ্বসরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে তাঁর ভাবনায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। উইলসনের উদ্যোগে ১৯১৯ সালে জাতি সংঘ (League of Nations ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ (United Nations Organisation)। উদারনীতিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে আইনানুসারে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসংবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হবে।

(১১) আন্তর্জাতিক আইনকে বলবৎ করার উপর উদারনীতিবাদীরা জোর দেন। এই উদ্দেশ্যে উদারনীতিবাদীরা ‘সমষ্টিগত নিরাপত্তার নীতি’ (Principle of collective security)-কে স্বীকার ও সমর্থন করেন। সংশ্লিষ্ট নীতিটির মূল কথা হল আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ সংঘবদ্ধভাবে সক্রিয় হবে। এ হল অতি জাতীয়তাবাদী ধারণার বা আন্তর্জাতিকতার অভিব্যক্তি। উদারনীতিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, ‘ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন’ (European Union)-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউরোপ গড়ে তোলা সম্ভব হবে এবং এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতিসমূহের মধ্যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিকশিত হবে। এতদ্সত্ত্বেও প্রতিটি জাতির স্বাতন্ত্র্যসূচক ঐতিহ্যসমূহ ও পরিচয় অব্যাহত থাকবে।

সমালোচনা (Criticism): উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। রক্ষণশীল চিদ্ভাবিরা এবং উন্নয়নশীল দুনিয়ার জাতীয়তাবাদীরা উদারনীতিক জাতীয়তাবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। রক্ষণশীল সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী বিশ্বজনীন মানবাধিকার সম্পর্কিত ধারণাকে উদারনীতিবাদীরা স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। কিন্তু বিশ্বজনীন মানবাধিকারের নীতিতে জাতীয় ঐতিহ্য ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দেওয়া হয় নি। উন্নয়নশীল দুনিয়ার জাতীয়তাবাদীরা উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরূপ সমালোচনা করতে গিয়ে অধিকতর অগ্রবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এই শ্রেণীর জাতীয়তাবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী পশ্চিমী উদারনীতিবাদেরই একটি অভিব্যক্তি হল মানবাধিকার। এই মানবাধিকারের বিস্তার অনেকাংশে প্রচ্ছন্ন পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদেরই সামিল।