উত্তর-মার্কসবাদী আলোচনায় মার্কসবাদী বিষয়াদির থেকে মার্কস-পরবর্তী বিষয়াদির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কমিউনিস্ট শাসন এবং কমিউনিজম বিবিধ সমস্যা সংকটের সম্মুখীন হয়। কিছু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক সংশ্লিষ্ট সমস্যাদি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। এইভাবে উত্তর-মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণা বা মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর মার্কসবাদী অবস্থানকে দুদিক থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। অর্থাৎ উত্তর-মার্কসাবাদী আলোচনার দুটি ভাষ্য আছে।
একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাষ্য অনুযায়ী উত্তর-মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণা উত্তর-আধুনিকতাবাদী বক্তব্য থেকে আহরণ করা হয়। উত্তর-মার্কসবাদী এই ধারণা অনুসারে উত্তর-আধুনিকতাবাদের আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের এক সামগ্রিক মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদ প্রয়োজনাতিরিক্ত হয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কসবাদের আনুষঙ্গিক আলোচনাও অনেকাংশে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপর মার্কসীয় যাবতীয় অভিক্ষেপ বা কর্মপরিকল্পনা নির্ভরশীল। সুতরাং সকল মার্কসবাদী অভিক্ষেপ সহ ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে বাতিল করে দেওয়া দরকার এবং সেই জায়গায় উত্তর আধুনিকতাবাদের ভিত্তিতে বিকল্প ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তার বাঞ্ছনীয়। ফ্রানকোইস লাইওটার্ড (Jean Francois Lyotard) 3 The Postmodern Condition: The Power of Knowledge ac এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উত্তর-মার্কসবাদী এই ভাষ্যটি সনাতন মার্কসবাদ থেকে সরে আসার পক্ষপাতী।
উত্তর মার্কসবাদের একটি বিকল্প ভাষ্য আছে। তদনুসারে উত্তর-আধুনিকতাবাদ (Post modernism) ও উত্তর-কাঠামোবাদ (Post structuralism) -এর বিষয়াদির সঙ্গে মার্কসবাদের বিশেষ কিছু বিষয়ের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়। এইভাবে মার্কসবাদের কিছু মৌলিক ধারণাকে উদ্ধার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রসঙ্গে লাকলাউ ও মুফে (Ernesto Laclau & Chantal Mouffe)—এই দুই রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা তাঁদের Hegemony and Socialist Strategy শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী মার্কসবাদের সাবেকি আলোচনায় সামাজিক পরিবর্তন সাধনের ব্যাপারে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে শ্রমিক শ্রেণীকে। সামাজিক শ্রেণীর আলোচনাও প্রাধান্য পেয়েছে। এই দুই চিন্তাবিদের মতানুসারে সামাজিক শ্রেণী বা শ্রমিক শ্রেণী সম্পর্কিত এই মার্কসীয় ধারণা প্রকৃত প্রস্তাবে বাস্তবসম্মত নয়। এতদ্বারা লাকলাউ ও মুখে মার্কসবাদের মধ্যেই এক প্রশস্ত পরিসরের সৃষ্টি করেছেন। মার্কসবাদের এই নতুন পরিসরের মধ্যে সংগ্রামের অন্যান্য সন্ধিক্ষণ স্বীকৃতি পাবে। এই সমস্ত সংগ্রাম সাধারণত নয়া সামাজিক আন্দোলন হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পরিবেশ আন্দোলন, নারী আন্দোলন, লেসবিয়ান আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন প্রভৃতির কথা বলা যায়। উত্তর-মার্কসবাদী এই ভাষ্যে রাজনীতিকে বহুত্ববাদী প্রকৃতি প্রদান করা হয়েছে। উত্তর-আধুনিক সমাজের ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং বৈচিত্র্য এর মধ্যে জায়গা পেয়েছে।
বিগত কয়েক দশক ব্যাপী বিচিত্র সামাজিক রাজনীতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল, বিভিন্ন-বিচিত্র সামাজিক দ্বন্দ্ব, বিবিধ প্রকারের আধিপত্য এবং সে সবের বিরুদ্ধে নানা প্রকারের প্রতিরোধ আন্দোলন; নতুন নতুন সামাজিক আন্দোলন প্রভৃতি চলে আসা রাজনীতিক হিসেবনিকেশকে অনেকাংশে আমূল বদলে দিয়েছে এবং সাবেকি রাজনীতিক বিন্যাসকে বেশ জোর ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। রাজনীতি চর্চার মার্কসীয় ধারাও অনেকাংশে ওলটপালট হওয়ার সামিল হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক দশক যাবৎ বহু ও বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এ সবের মাধ্যমে এটারই অভিব্যক্তি ঘটেছে যে, সমকালীন বাস্তব পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল অনির্দিষ্ট-অবিন্যস্ত এবং অব্যবস্থাপূর্ণ ও খাপছাড়া। এ রকম এক অস্থির সামাজিক পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের সম্যক পর্যালোচনা ও অনুধাবনের স্বার্থে মার্কসীয় পদ্ধতি-প্রকরণের প্রয়োজনীয় পরিমার্জন অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। তার জন্য দরকার হয়ে পড়ে তাত্ত্বিক উদ্যোগ-আয়োজন। লাকলাউ ও মুফে সে রকমেরই তাত্ত্বিক উদ্যোগ-আয়োজনেরই সামিল হয়েছেন। তাঁরা তাঁদের এই তাত্ত্বিক উদ্যোগকে উত্তর মার্কসবাদ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
সাবেকি মার্কসবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ইতিহাসের বস্তুবাদী পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে আধুনি কালের জনজীবনের বিভিন্ন-বিচিত্র ও জটিল প্রকৃতির সামাজিক দ্বন্দ্ব ও আন্দোলনের অনেক কিছুই অধরা-অজানা থেকে যায়। উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন-সম্পর্কের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, রাজনীতিক অর্থনীতির যুক্তিজাল, শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকা প্রভৃতি নির্ধারিত ছকে বাঁধা পথে সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন-বিচিত্র আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের যথাযথ পর্যালোচনা অসম্ভব প্রতিপন্ন হয়। তার ফলে মার্কসবাদে তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেয়।
লাকলাউ ও মুফের বক্তব্য নয়া সামাজিক আন্দোলনসমূহের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আর্থনীতিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি সম্পর্কেও তাত্ত্বিক আলোচনার এক প্রসারিত পরিসর গড়ে তুলেছেন। তাঁরা পুঁজিবাদী আর্থনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত সাবেকি মার্কসবাদী উদ্বৃতমূল্য আত্মসাৎ ও শোষণ-পীড়নের আলোচনার দিকে যান নি। তাঁরা পুঁজিবাদী আর্থনীতিক ব্যবস্থার আধিপত্য এবং পণ্যীকরণ প্রক্রিয়ার প্রসার প্রসঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে অধিকতর আত্মনিয়োগ করেছেন। লাকলাউ ও মুফের উত্তর-মার্কসবাদী আলোচনা সম্পর্কে অ্যান্ড্রু হেউড মন্তব্য করেছেন: “This Pluralistic style of politics may accord with the increasing individualism and diversity found in postmodern society, but in developing an image of social and personal liberation that is not rooted in economic issues it, arguably, undermines what is distinctive about Marxist thought.”
Leave a comment