শিখনের সঙ্গে স্মৃতির একটি উত্তম সম্পর্ক রয়েছে। শিখন, সংরক্ষণ, পুনরুদ্রেক ও প্রত্যভিজ্ঞা। সাধারণ স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। উত্তম স্মৃতি বলতে বােঝায় স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত উপাদানসমুহ, যথা— অভিজ্ঞতা অর্জন, সংরক্ষণ বা ধারণ, পুনরুদ্রেক এবং প্রত্যভিজ্ঞ এই চারটি স্তরের উৎকর্ষসাধন। উত্তম স্মৃতির শর্তাবলিগুলি নিম্নরূপ—
(1) আগ্রহ: উত্তম স্মৃতির একটি বিশেষ শর্ত হল আগ্রহ। বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহ শিখনকে সহজতর করে। ফলে শিখনলব্ধ অভিজ্ঞতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাই আগ্রহ সহকারে বিষয়বস্তুর অর্থ বুঝে শেখা উচিত।
(2) শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা : উত্তম স্মৃতির অন্যতম শর্ত হল ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা। অর্থাৎ দৈহিক ও মানসিক অসুস্থতা শিখন প্রক্রিয়াকে ভঙ্গর করে ফলে বেশিদিন মনে থাকে না।
(3) স্মৃতির সংরক্ষণ : বিভিন্ন কৌশলের সহায়তায় বিষয়সমূহের শিখন ও তাকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা উত্তম স্মৃতির অন্যতম শর্ত।
(4) বুদ্ধি : বুদ্ধি উত্তম স্মৃতির একটি শর্ত। যে শিক্ষার্থীর বুদ্ধি যত বেশি সেই শিক্ষার্থীর স্মৃতিশক্তি তত শক্তিশালী। বুদ্ধিমান শিক্ষার্থীরা অল্প সময়ে অতীতের শেখা বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন করতে পারে।
(5) উদ্দীপক : উদ্দীপকও উত্তম স্মৃতির আরও একটি শর্ত। উদ্দীপক সুনির্দিষ্ট হলে এবং উদ্দীপকের তীব্রতা যথাযথ হলে তার দ্বারা অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে দীর্ঘদিন স্মৃতিতে ধরে রাখা যায়।
(6) পুনরূদ্রেক ও প্রত্যভিজ্ঞা : উত্তম সংরক্ষণের মাধ্যমে সঠিক পরিবেশে উত্তম স্মৃতিবাহক কোনাে বিষয়কে পুনরুদ্রেক ও প্রত্যভিজ্ঞার মাধ্যমে যুক্ত করা যায় নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে।
শিখনের সহজ উপায় বা স্মরণের প্রশিক্ষণ
স্মরণশক্তিকে ঠিকমতাে কাজে লাগানাের জন্য কতকগুলি উপায়ের কথা মনােবিজ্ঞানীগণ বলেছেন। এগুলিকে স্মরণক্রিয়ার প্রশিক্ষণ বলে। এর উপায়গুলি হল—
(1) অতি শিখন : উত্তম স্মৃতির অন্যতম সহায়ক উপাদান হল অতি শিখন বা Over Learning৷ ‘অতি শিখন’ হল কোনাে শিখন সম্পূর্ণ হওয়ার পর আরও কয়েকবার শেখা।
(2) আংশিক পদ্ধতি ও সামগ্রিক পদ্ধতি বা অবধারণ পদ্ধতি : বিষয়বস্তুর প্রকৃতি এবং দৈর্ঘ্য অনুযায়ী আংশিক পদ্ধতি কিংবা সামগ্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে শিখলে সংরক্ষণ ভালাে হয় অর্থাৎ অনেকদিন মনে থাকে। বিষয়বস্তু যদি দীর্ঘ এবং নীরস হয় তাহলে আংশিক পদ্ধতি অবলম্বন করা যুক্তিসংগত। আর বিষয়বস্তুর দৈর্ঘ্য কম হলে সামগ্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত।
(3) রুটিন পদ্ধতি : কোনাে বিষয়কে নিয়মমাফিক করলে তা স্মৃতিতে দীর্ঘস্থায়ী হয়।
(4) SURVEY-Q-3R পদ্ধতি : এই পদ্ধতির স্রষ্টা রবিনসন। 3R হল Read (পড়া), Recite (আবৃত্তি), Review (পর্যালোচনা); Q = Question বা প্রশ্ন করা এবং Survey = পর্যবেক্ষণ করা। এই পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে শিক্ষার্থী সহজে বিষয়কে আয়ত্ত করে। বিষয়টি নিজে পড়ে, আবৃত্তি করে, নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, বিষয়বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষার্থী প্রতিটি বিষয় সহজে মনে রাখতে পারে।
(5) স্বল্পায়াসে আয়ত্তীকরণ : দ্রুত শিখে নেয়া উত্তম স্মৃতির লক্ষণ। যে দ্রুত শিখতে পারে সে উত্তম স্মৃতির অধিকারী হয়।
(6) ছন্দ : ছন্দযুক্ত বিষয় যেমন কবিতা, গান, তাল এগুলি নির্দিষ্ট ছন্দের জন্য মনে থাকে। মনােবিদ মুলার (Mullar) তাই ছন্দবদ্ধ শিখনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
(7) সবিরাম শিখন : কোনাে বিষয় শেখার সময় যদি বিরতি দিয়ে শেখা যায় তাহলে তা অনেক দিন মনে থাকে। এরূপ পদ্ধতিতে উত্তম স্মৃতির বাহক হওয়া যায়। ডিয়ারবাের্ন (Dearborn), জস্ট (Jost), লায়ন (Lion) প্রমুখ মনােবিদ এতে সম্মতি জানিয়েছেন।
(8) সুবিন্যস্তকরণ : অভিজ্ঞতার বিষয়সমূহকে এমনভাবে বিষয়গত মিল রেখে বিন্যস্ত করতে হবে যাতে সংগতি বজায় থাকে। এর মাধ্যমে স্মৃতির সাহায্যে বিষয়টিকে ধরে রাখা যাবে।
(9) অনুষঙ্গ পদ্ধতি : শিক্ষণীয় বিষয়কে পূর্ব অভিজ্ঞতা বা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি (Association) বা অনুষঙ্গ স্থাপন করলে অনেকদিন মনে থাকবে।
(10) প্রসঙ্গক্রম : কোনাে বিষয়কে প্রসঙ্গক্রমে পরবর্তীকালে পুনরুদ্রেক করা সহজ হয়। তাই বিষয়টিকে মনে রাখতে হলে তার প্রসঙ্গ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে।
(11) মিশ্র পদ্ধতি : দীর্ঘ কোনাে বিষয়বস্তুকে মনে রাখার জন্য সামগ্রিক ও আংশিক উভয় পদ্ধতিকে একত্রে অবলম্বন করে মনে রাখা হয়।
(12) মনােযােগ : মনােযােগ প্রত্যক্ষভাবে শিখন প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে। মনােযােগ ছাড়া শিখন অসম্ভব, আর শিখন না হলে স্মরণের কোনাে প্রশ্নই নেই। অর্থাৎ স্মরণ পরােক্ষভাবে মনােযােগের উপর নির্ভরশীল।
উপসংহারে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, উত্তম স্মৃতি শিক্ষার ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়ােজন। উত্তম স্মৃতি গঠনের জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। শিক্ষণীয় বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, মনোেযােগ যাতে বৃদ্ধি পায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। উপযুক্ত উদ্দীপক ব্যবহার করে পাঠ্যবিষয়কে যদি শিক্ষার্থীর সামনে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করা যায়, অর্থবহ করে গড়ে তােলা যায়, তাহলে ওই বিষয়টি শিক্ষার্থীর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করবে এবং বিষয়টি স্মৃতিতে সঞ্জিত হয়ে স্মৃতিভাণ্ডারকে শক্তিশালী করে তুলবে।
স্মৃতি ও স্মরণক্রিয়া কী? এর চারটি স্তরের বর্ণনা করাে।
Leave a comment