অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ভারতের শাসনক্ষমতা আসার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত কোম্পানি এদেশের জনগণের শিক্ষার বিষয়ে কোনাে প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ওই সময় কোম্পানি ভারতে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেই বিশেষভাবে ব্যস্ত থেকেছে। ফলে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা চরম অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। তবে ইউরােপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পাশাপাশি ওই সময় ভারতবাসীর শিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে একটি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন।
মিশনারিরা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলেও বহুক্ষেত্রে কোম্পানির সহায়তাও লাভ করেন। দেশের বিস্তৃত অংশে ব্রিটিশ অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই কোম্পানিকে দেশীয় শিক্ষার ব্যপারে সরকারি উদ্যোগ এবং অর্থব্যয়ের প্রশ্নটিকে বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হল এবং এর ফলস্বরূপ 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতবাসীর শিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রতিবছর এক লক্ষ টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। এই আইনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ সরকার এদেশের জনসাধারণের শিক্ষার আংশিক দায়িত্ব স্বীকার করে। বাস্তব ক্ষেত্রে পরবর্তী দশ বছর অর্থাৎ 1823 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানি এদেশের শিক্ষার জন্য কিছুই করেননি। তাই এই সময়কালকে ‘ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি নিষ্কিতার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
GCPI গঠন: 1823 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি নিষ্ক্রিয়তার অবসান ঘটানাের জন্য ‘জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (GCPI) গঠন করা হয়। 1823 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে ভারতবর্ষে শিক্ষার অগ্রগতির জন্য কোম্পানি প্রতি বছর দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের কারণে সঠিক শিক্ষা বিকাশ ব্যাহত হয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা: 1835 খ্রিস্টাব্দে ‘মেকলের মিনিট’ অনুযায়ী লর্ড বেন্টিঙ্ক যে সরকারি শিক্ষানীতি ঘােষণা করেন তাতে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ করা হবে বলে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করা হয়। এইভাবে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ঘটলেও সরকার কতখানি দায়িত্ব পালন করবে, তা বিতর্কের পর্যায়েই থেকে যায়।
পার্লামেন্টরি এনকোয়্যারি কমিটি গঠন: পরবর্তীকালে 1853 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ আইনে পুনর্নবীকরণের সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যবৃন্দ মনে করেন ভারতে তাদের শাসনকাল দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে সেখানে একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দরকার। তাই সনদ আইন নবীকরণের পাশাপাশি ভারতবাসীর শিক্ষার জন্য নীতি নির্ধারণের প্রসঙ্গে ভারত সম্পর্কে অভিজ্ঞ কয়েকজন ব্রিটিশ কর্মীকে নিয়ে একটি পার্লামেন্টারি এনকোয়্যারি কমিটি (Parliamentary Enquiry Committee, 1853) গঠন করা হয়। পার্লামেন্টারি এনকোয়্যারি কমিটির সদস্যরা বলেন”শিক্ষিত ভারতবাসীই হবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার স্তম্ভম্বরূপ। কমিটি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার-সহ আরও কতকগুলি বিষয়ে সুপারিশ করেন।
উড-এর ডেসপ্যাচ রচনা: কমিটির রিপাের্টের ভিত্তিতে 1854 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাের্ড অব কনট্রোল’-এর সভাপতি চালর্স উড (Charles Wood) এর নির্দেশে যে বিশেষ শিক্ষা সনদ রচিত হয়, তাই ‘উড-এর ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত| অনেকের মতে, উড-এর ডেসপ্যাচটি রচনা করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিশিষ্ট কর্মী বিখ্যাত দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিল। আবার কারও মতে, এই ডেসপ্যাচ রচনার ক্ষেত্রে মিশনারি ডাফ্-এর সর্বাধিক প্রভাব ছিল। যিনিই ‘উড-এর ডেসপ্যাচ’ রচনা করুন না কেন, একটি বিষয়ে সকলেই একমত ছিলেন যে, ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে উড-এর ডেসপ্যাচ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের শিক্ষাসংস্কারের জন্য গঠিত বিভিন্ন কমিশন ও কমিটির সুপারিশগুলি উড-এর ডেসপ্যাচের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
Leave a comment