রাত্রিতে নসীরাম বাবুর বৈঠকখানায় কমলাকান্ত যখন মোসায়েবি ধরনে বসেছিল, তখন বাবু দলাদলির গল্প করছিলেন। সে আফিমের নেশায় ঝিমোচ্ছিল। দলাদলির প্রসঙ্গে চটে গিয়ে সে আফিমের মাত্রা চড়িয়ে ফেলেছিল। সেই অবস্থায় কমলাকান্ত দেখতে পেল, একটা পতঙ্গ ফানুসের চারপাশে চোঁ-ও-ও-বোঁ শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আফিমের প্রসাদে সে দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে আলোর উদ্দেশে পতঙ্গের এই ভাষণ শুনতে পেল : অতীতে পেতলের পিলসুজের ওপর মেটে প্রদীপে আলো যখন শোভা পেত, তখন তারা স্বচ্ছন্দে পুড়ে মরতে পারত। এখন আলো সেজের মধ্যে ঢোকার জন্য তারা চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, প্রবেশের পথ পায় না, পুড়ে মরতে পায় না। তাদের পুড়ে মরার অধিকার চিরকালের, পতঙ্গজাতি আবহমানকাল আলোয় পুড়ে মরে আসছে। সেও স্বাভাবিকভাবে সেই জাতির অন্যতমরূপে পুড়ে মরতেই জন্মগ্রহণ করেছে। এই আলো কি, তা এই পতঙ্গ জানে না। সে শুধু জানে, এই আলো তার বাসনার বস্তু, জাগ্রতের ধ্যান, নিদ্রার স্বপ্ন, জীবনের আশা, মরণের আশ্রয়। তাকে সে কোনোদিন জানতে পারবে না, জানতে চায়ও না, যেদিন জানবে, সেইদিনই তার মুখ যাবে; কাম্যবস্তুর স্বরূপ জানলে কার সুখ থাকে?
অতঃপর কমলাকান্ত উপলব্ধি করেছে, প্রতিটি মানুষই পতঙ্গ। প্রত্যেকেরই এক একটি বাসনার বহ্নি আছে, সকলেই তাতে পুড়ে মরতে চায়, ভাবে, সেই বহ্নিতে পুড়ে মরার অধিকার তাদের আছে। জ্ঞান, ধন, মান, রূপ, ধর্ম, ইন্দ্রিয়—এই সংসারের চারদিকেই বহু বাসনার অগ্নিই প্রজ্বলিত। সেজের কাচের মতো সংসারের চারপাশে আবরণ তথা ভয়-ভীতি সংশয়-দ্বিধা ইত্যাদি নানা বাধা ও পিছুটান আছে। তাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অনেকে তাদের সেইসব বাসনা-বহ্নিতে আত্মবিসর্জন দিতে পারে না। আমরা আমাদের বাসনার যে আলো দেখে মোহিত হয়ে তাতে ঝাঁপ দিতে চাই, কাচের মতো সেইসব বাধায় ঠেকে গিয়ে ফিরে আসি, আবার ফিরে এসে তার চারদিকে পতঙ্গের মতোই ঘুরে বেড়াতে থাকি।
চৈতন্যদেব ধর্ম মানস প্রত্যক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন বলেই সংসার ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু সকল ধর্মবিদ সেইভাবে ধর্মকে প্রত্যক্ষ করে তার জন্য নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতে পারেন না। জ্ঞানের নেশায় অনেকেই অস্থির হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তারা কেউ সক্রেটিস ও গ্যালিলিও-র মতো জ্ঞান-বহ্নিতে পুড়ে মরে না। মানের আকাঙ্ক্ষা অনেকেরই থাকে, কিন্তু ক’জন আর তার জন্য মহাভারতের দুর্যোধনের মতো ধ্বংস যজ্ঞের আয়োজন করে তার লেলিহান আগুনে প্রাণ দেয়! ভোগতৃষ্ণায় অনেক নারী-পুরুষই উন্মত্ত হয়, কিন্তু তারা অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রার মতো তার আগুনে আত্মাহুতি দেয় না। রূপও অনেককে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে, কিন্তু তারা কেউ রোমিও ও জুলিয়েটের মতো তার আগুনে নিজেদের নিঃশেষিত করে ফেলে না। ঈর্ষায় অনেকে কাতর হয়, কিন্তু আমরা কেউ তাদের ওথেলোর মতো নিজেদের ঈর্ষা-বহ্নিতে দগ্ধ হতে দেখি না।
বহ্নি তথা এই সমস্ত বাসনা-কামনার স্বরূপ কি আমরা জানি না। তার ব্যাখ্যায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মপুস্তক ব্যর্থ। ঈশ্বরের বা ধর্মের স্বরূপ কী, কেন, কী কারণে মানুষ ঈশ্বরকে লাভের জন্য ব্যাকুল হয়, ধর্মের জন্য সংসার ত্যাগ করে, আমরা জানি না। জ্ঞান কী, তাও আমরা জানি না, তা আমাদের কাছে অনস্ত রহস্যই থেকে গেছে। বিজ্ঞান মানুষের জ্ঞেয় বস্তু বা জ্ঞানের প্রকৃতি সম্বন্ধে এমন কোনো চরম কথা বলতে পারেনি যাতে চিরকালের মতো সব প্রশ্ন ও সমস্যার মীমাংসা হয়ে গেছে। স্নেহ কী, তাও আমাদের অজানা। আমাদের এই সমস্ত কাম্যবস্তু অলৌকিক ও অপরিজ্ঞাত পদার্থের মতোই দুর্জেয় ও রহস্যময়। আমরা শুধু তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াই, তাদের জন্য আকুল হই। আমরা পতঙ্গ ছাড়া আর কি।
Leave a comment