এ উক্তিটি নবাব মীরকাসেমের উপপত্নী-দলনী বেগমের। যার সম্পূর্ণ নাম দেলিতউন্নিসা। দলনী বেগম এ কথাগুলি বলেছিলেন তাঁর প্রিয়বাদী কুলসমকে। উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে ‘দলনীর কী হইল’ অংশে উপরিউক্ত কথাগুলি ব্যক্ত হয়েছে।
দলনী বেগম রাতের আঁধারে কুলসমকে সঙ্গে নিয়ে অন্তপুর ত্যাগ করে এসেছিলেন সেনাপতি গুরগন খাঁর নিকট। উদ্দেশ্য ইংরাজদের সঙ্গে নবাবের আসন্ন যুদ্ধকে থামিয়ে দিতে। এই যুদ্ধের ভার ছিল গুরগনের ওপর। গুরগন খাঁর ভগ্নী হলেন দলনী বেগম। দলনীর আশা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য সাধন হবে। কিন্তু গুরগন তাঁকে একেবারেই নিরাশ করে ফেরৎ পাঠালেন। শুধু তাই নয়, তাঁর কথাবার্তায় প্রকাশও করলেন– তিনি নবাবের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন। দলনী দূর্গাভিমুখে যাত্রা করেছিলেন নবাবকে সকল সংবাদ প্রেরণ করবেন। কিন্তু গুরগনের নির্দেশে তার পূর্বেই দূর্গের ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দূর্গে প্রবেশ করতে না পেরে দলনী ও কুলসম রাজপথে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন আর নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবছেন। এইসময় কুলসম শংকা প্রকাশ করে বলেন– নবাবকে না জানিয়ে তাঁরা যে পুরীর বাইরে এসেছেন, নবাব এবার সমস্ত জানলে না জানি তাঁদের প্রতি কী ভাববেন। প্রত্যুত্তরে দলনী বেগম বলেছিলেন– “যাহাই মনে করুন, ঈশ্বর আমার বিচারকর্তা—আমি অন্য বিচার মানি না। না হয় মরিব ক্ষতি কী?”
সমালোচ্য উত্তির ধারা দলনী সম্পর্কে এটুকুই স্পষ্ট হয়েছে, তিনি নবাবের বেগম হলেও ভক্তিমতী এবং প্রবল ঈশ্বর বিশ্বাসী। তিনি পতিগতপ্রাণা। নিজের প্রতি তাঁর প্রবল আস্থা। তিনি রাজপথে দাঁড়িয়ে ইচ্ছা করে ধরা পড়তে চান, এবং প্রভু অর্থাৎ নবাবের নিকট হাজির হয়ে নিজের সকল কথা ব্যক্ত করতে চান। দলনী নিজের মুখেই কুলসমকে বলেছেন– “তিনি যদি আমার বধের আজ্ঞা দেন, তথাপি মরিবার কালে তাঁহাকে বলিতে পাইব যে, আমি নিরপরাধ ধনী।” তিনি সত্যকে প্রকাশ করতে ভয় পান না। নবাবের মঙ্গলার্থে তো আজ এমন করে তার পথে নামা। এর জন্যে তিনি যদি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন সেতো পরম গৌরবের। অবশ্য পরবর্তী জীবনে তিনি তকি খাঁর প্ররোচনায় অপাপবিদ্ধা হয়েও নবাবের নিকট কলঙ্কিনী রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন এবং নবাব তাঁকে বিষপানে মৃত্যুর দণ্ডাদেশ জ্ঞাপন করেন। দলনী প্রভুর আজ্ঞা পালন করতে হাসতে হাসতে বিষের পাত্র মুখে ধারণ করেছিলেন। দলনীর মৃত্যুর পর নবাব নিজের ভুল বুঝতে পেরে যেভাবে দলনীর জন্য আতক্রন্দনে ভেঙে পড়েছিলেন তার মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলনী বেগমের মহত্ব।
Leave a comment