প্রশ্নঃ সেন্ট অগাস্টিনের ঈশ্বরের রাজত্রের রূপরেখা আলােচনা কর।

অথবা, ঈশ্বরের রাজত্ব সম্পর্কে সেন্ট অগাস্টিনের ধারণা ব্যক্ত কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ সেন্ট অগাস্টিন তার অমর গ্রন্থ “The city of God” বা ঈশ্বরের নগরী বা ঈশ্বরের রাজত্ব রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি মূলত খ্রিষ্ট ধর্মের বিরূদ্ধে প্যাগান কর্তৃক যে অভিযােগ করা হয়েছিল অর্থাৎ রােমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য খ্রিষ্টধর্ম দায়ী- এ যুক্তি খন্ডন করে এর পতনের কারণ সম্পর্কে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে অগ্রসর হন। রােম সাম্রাজ্যের পতনের জন্য খ্রিষ্টধর্ম কোন ক্রমেই দায়ী নয়। এটাই ছিল তার মূল বক্তব্য।

ঈশ্বরের রাজত্বের সংক্ষিপ্ত রূপরেখাঃ নিম্নে ঈম্বরের রাজত্বের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তলে ধরা হলাে-

(১) শান্তি ও মুক্তিঃ ঈশ্বরের রাজ্যের ভিত্তি হলাে স্বর্গীয় শান্তি ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। শয়তানের রাজত্ব শুরু হয় অভিশপ্ত দেবতার অবাধ্যতা থেকে এবং তা মূর্ত হয়ে ওঠে নিঃধর্মীয় ও রােম সাম্রাজ্যে। যীশুর রাজ্য শুরু হয় হিক জাতির আধিপত্যে। আত্মিক শক্তিসত্তায় ও আত্মার মহিমায় এর সমাপ্তি ঘটবে যখন সবকিছু ঈশ্বরের রাজত্বে মিলিয়ে যাবে।

(২) রঙ্গমঞ্চঃ ইতিহাস হচ্ছে ঐশ্বরের ইচ্ছা পূরণের এক বিরাট রঙ্গমঞ্চ। অগাস্টিনের মতে এ রঙ্গমঞ্চের দুটি নায়ক-ভালাে ও মন্দ। প্রকৃতি মানবের আত্মা অধিকারের জন্য নিয়ত সংগ্রামরত। ভালোর প্রতি যাদের আকর্ষণ তারা ঈশ্বরের রাজত্বে প্রবেশ করবে এবং অনন্তকাল শান্তিতে থাকবে। এবং যারা মন্দের প্রতি আকৃষ্ট তারা চিরকাল অভিশপ্ত এবং অনন্তকাল ধরে শাস্তি ভােগ করবে। সৃষ্টির পর থেকে প্রত্যেক মানুষের গতি এ পরিণতির দিকে। পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব কায়েম করার জন্য বিশ্বের সবকিছুই এক নিরবচ্ছিন্ন গতিতে ধাবিত হচ্ছে।

(৩) স্বর্গীয় প্রেমঃ অগাস্টিনের মতে, ঈশ্বরের রাজ্য হলাে স্বর্গীয়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেমই হলাে তার বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বরের প্রেম আত্মবিস্মৃতির নামান্তর। এতে আত্মপ্রীতি, ক্ষমতার লােলুপতা ও কামনার লেলিহান শিখার কোনাে অস্তিত্ব নেই। ঈশ্বরের রাজত্ব গড়ে ওঠে ঈশ্বর প্রেমের ফলে- যে প্রেম আত্মপ্রেমকে ঘৃণা করে। এটা ঈশ্বরের গৌরব এবং ঈশ্বরকে ডেকে বলে তুমি আমার গর্ব, আমার মাথা উন্নতকারী।

(৪) মহিমা ও ত্যাগঃ অগাষ্টিনের মূল বক্তব্য হলাে ঈশ্বরের প্রতি উৎসাহ ও ত্যাগের মহিমা। তাই তিনি রূপক চার্চকে তার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

(৫) সদাচার ও সংযমঃ ঈশ্বরের রাজত্বের আর একটি উল্লেখযােগ্য দিক হলাে সদাচারী ও সংযমীদের এক সমাজব্যবস্থা। যার মধ্যে রাষ্ট্রের উন্নতমনা, সদাচার ও উদার মনের মানুষেরাই অন্তর্ভুক্ত।

(৬) অভিশপ্ত রাজ্যঃ অগাস্টিনের মতে, পার্থিব রাজ্য অনন্তকাল ধরে অভিশপ্ত। ঈশ্বরের রাজত্ব হলাে আলাের রাজ্য, চিরভাস্বর এবং এতে দুর্ভেদ্য কালিমা নেই। এ রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে তাকে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ পেতে হবে এবং তা সম্ভবপর হবে যদি যীশুর প্রতি আস্থা স্থাপন করে।

(৭) সত্য ও মহত্ত্বঃ বিধাতার রাজত্ব হলাে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মহত্ত্বের প্রতীক। কিন্তু পার্থিব রাজ্য হলাে স্বার্থপরতা, নীচতা ও হিংস্রতার প্রতীক। স্বর্গরাজ্য আত্মার; দেহের নয়।

(৮) সার্বজনীনতাঃ সেন্ট অগাস্টিনের মতে, ঈশ্বরের রাজ্য স্টয়িক মতবাদের সর্বজনীন রাষ্ট্রের সাথে তুলনীয়। যা শ্ৰেণী বা অবস্থার প্রতিবন্ধকতার বন্ধনে আবদ্ধ নয়। যা মানুষের মনুষ্যত্বের সনাতন গুণের ভিত্তিতে সর্বজনের এবং সর্বকালের জন্য উন্মুক্ত।

(৯) ইতিহাসতত্ত্বঃ সেন্ট অগাস্টিনের ইশ্বরের রাজত্ত্বে ইতিহাসতত্ত্ব বিশেষ স্থান দখল করেছে। রােমান সম্রাজ্যের পতন খৃষ্টান ধর্মের বিরুেদ্ধে আনীত অভিযোগ তিনি তার ঈশ্বরের রাজত্বে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। গ্রীক দার্শনিকের ন্যায় ইতিহাসের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যার বদলে তিনি খ্রিষ্টান ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের ব্যাখ্যা দেন।

(১০) গির্জাঃ অগাস্টিন গির্জাকে তার ইশ্বরের রাষ্ট্রের একটি উত্তম সংস্থা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে রাষ্ট্রের একমাত্র সংস্থা হলাে চার্চ বা গির্জা যা মানুষের ভালাে দিকটা বিবেচনা করে থাকে। তার ইশ্বরের রাজত্তে ধর্মযাজকদের উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা লাভের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তার মতে গির্জার প্রতি রাষ্ট্রের আনুগত্য প্রকাশ, খ্রষ্টীয় ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের প্রচলিত প্রথা। তিনি মনে করেন গির্জাকে উপেক্ষা করা রাষ্ট্রের উচিত নয়।

সমালােচনাঃ অগাস্টিনের বিধাতার রাজ্য নানাভাবে সমালােচিত হয়েছে।

(১) বিধাতার রাজ্য সীমাহীন, সর্বজনীন ও সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। সকল আদর্শ সন্তান এই রাজ্যের নাগরিক হওয়ার যােগ্য। কিন্তু অগাস্টিনের মতে, সকল সন্তান আদর্শ বিধাতার নগরের সদস্য হতে পারে না। এর কোনাে ব্যাখ্যা তিনি দেখাননি।

(২) ঈশ্বরের রাজ্যে শুধু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা পুরস্কৃত হবেন। কিন্তু অন্য কোনাে ধর্মের লােকেরা পুরস্কার পাবেন না। অগাস্টিনের এই ধারণা কোনােভাবেই গ্রহণযােগ্য হতে পারে না, কারণ ঈশ্বর কোনাে একটি বিশেষ ধর্মের লােকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, অগাস্টিনের রাষ্ট্রচিন্তা মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক বিশেষ সংযােজন। অগাস্টিন তার সময়ে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন তার প্রেক্ষাপটেই তিনি তার রাষ্ট্রদর্শন তথা ঈশ্বরের রাজত্বের রূপরেখা অঙ্কন করেছেন। তার মতে, সমগ্র মানবসমাজ একটি একক পরিবারভুক্ত, কিন্তু তা পার্থিব জগতে নয় বরং ঐশ্বরিক জগতে। ঐশ্বরিক জগৎই মানুষের সর্বশেষ গন্তব্যস্থল।