মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (বন্দ্যোপাধ্যায়) জন্ম হয়। পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মা ভগবতী দেবী। বাল্যকাল থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র দারিদ্রে জর্জরিত ছিলেন। কিন্তু সেইজন্য কখনও অবনমিত থাকেন নি। ৮ বছর বয়সে গ্রামের স্কুলে পাঠ শেষ করে কলকাতায় আসেন। তারপর সংস্কৃত কলেজে ভর্তি (১৮২৯ খ্রীঃ ১লা জুন) হয়ে ১২ বছর বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করে ১৮৪১-এ কলেজ ত্যাগ করেন। অত্যন্ত মেধাবী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যালাভে অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। ইংরেজিতেও স্বপ্রচেষ্টায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এছাড়া হিন্দু ল-কমিটির পরীক্ষাতেও (১৮৩৯ খ্রীঃ) সফল হন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন :
বিদ্যাসাগরের মুখ্য পরিচয় হল কর্মযোগী। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বুদ্ধি ও সাহস অবলম্বন করে তিনি উনিশ শতকে রামমোহন পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাজীবী ও কর্মী হয়ে ওঠেন। তার কর্মজীবনের এক সংক্ষিপ্ত রূপরেখা স্মরণ করা যায় : ১৮৪১ খ্রীস্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে হেড পণ্ডিত রূপে যোগদান করেন, প্রথম পর্যায়ে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। কিছুকাল সংস্কৃত কলেজের সহ-সম্পাদকের পদে থাকেন। ১৮৪৬-এর জুলাইতে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে দ্বিতীয়বার যোগ দেন। ১৮৫০-এ সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। ১৮৫১-খ্রীঃ জানুয়ারীতে তিনি এই কলেজে নতুন অধ্যক্ষপদ গ্রহণ করেন। এই কাজের অবসরে ‘স্পেশাল ইনসপেক্টর অব্ স্কুলস্’-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৬৪-তে ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল হিন্দু মেট্রোপলিটন স্কুলে রূপান্তরিত হলে তিনি তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৭৯-এ প্রতিষ্ঠানটি তাঁরই নামে বিদ্যাসাগর কলেজ রূপে একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হয়। এছাড়া স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষাদানের জন্য সংস্কৃত কলেজে একটি নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর বেথুন সাহেব স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হলে বিদ্যাসাগর নানা ভাবে তাঁকে সাহায্য করেন। তিনি স্বয়ং মেয়েদের জন্য ৩৫টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বেথুন স্কুলের অবৈতনিক সম্পাদক নিযুক্ত হন।
বিদ্যাসাগরের বৈচিত্র্যময় বহুমুখী কর্মধারার কয়েকটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায় যেমন— (১) শিক্ষা দান ও শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা, (২) সমাজ সংস্কার, (৩) সংবাদপত্র ও পুস্তক প্রকাশে সহায়তা, (৪) পাঠ্য পুস্তক রচনা ও গ্রন্থ অনুবাদ করা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্ম :
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনঃ “বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।…তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলা-নৈপুণ্যের অবতারণা করেন।” এই মস্তব্যের মধ্যেই আছে গদ্যশিল্পী বিদ্যাসাগরের যথার্থ পরিচয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠী নবজাত বাংলা গদ্যকে লালন করেছিলেন। রামমোহন তাকে শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ করে শক্তির পরিচয় দিতে শিখিয়েছিলেন আর তাকে যৌবনের গৃহাশ্রমে প্রতিষ্ঠিত করে বিচিত্র প্রাণের স্পর্শে উজ্জ্বল ও শিল্পময় করে তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর। এমনকি কোন মৌলিক রচনার অবকাশ না পেলেও এই কর্মী পুরুষের অনুবাদকর্ম হয়ে উঠেছিল নান্দনিক গুণে ভূষিত।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাসমূহ
(১) অনুবাদগ্রন্থ ও ভাষাশিক্ষা : ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭)– ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৪৮), ‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯), ‘বোধোদয়’ (১৮৫১), ‘শকুম্ভলা’ (১৮৫৪), ‘বর্ণপরিচয়’—দুইভাগ (১৮৫৫), ‘কথামালা’ (১৮৫৬), ‘চরিতাবলী’ (১৮৫৬), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০), ‘মহাভারতের উপক্রমণিকাভাগ (১৮৬০), ‘আখ্যানমঞ্জরী’ (১৮৬৩), ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬৯)।
(২) সাহিত্যসমালোচনা ও বিতর্কগ্রন্থ: ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৩)। ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ (প্রথম ১৮৭১, দ্বিতীয় ১৮৭৩) ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ – দুখণ্ড (১৮৭১, ১৮৭৩)।
(৩) স্মৃতিচারণা ও আত্মজীবনী : আত্মচরিত – দুটি পরিচ্ছেদ (১৮৯১), কয়েকটি পৃষ্ঠার ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ (১৮৯১)।
(৪) কস্যাচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য রচিত ‘অতি অল্প ‘হইল’ (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪) কস্যচিৎ তত্ত্বঘেষিণঃ রচিত “বিধবা বিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্ম রক্ষিণী সভা বা বিনয় পত্রিকা’ (১৮৮৪), কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য প্রণীত ‘রত্নপরীক্ষা’ (১৮৮৬)।
বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমারের ভাষারীতির মধ্যে তুলনা :
বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক তীক্ষ্ণধী জ্ঞানতাপস অক্ষয়কুমার দত্তের আশ্রয়ে বাংলা গদ্যের মধ্যে যুক্তি ও শক্তির সংমিশ্রণ দেখা গিয়েছিল। তার গদ্যের পরিশীলিত চিন্তা, যুক্তিনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা এবং তথ্য-বিন্যাস পারিপাট্য নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। সমাসাড়ম্বর-মুক্ত তার পরিচ্ছন্ন গদ্যরীতি সেই যুগের পক্ষে ছিল প্রায় অভাবনীয়। কিন্তু তার অধিকাংশ রচনাই ছিল তথ্য-ভারাক্রান্ত, রস-ব্যঞ্জনা, মাধুর্য এবং প্রসাদগুণ তার রচনায় বিরলদৃষ্ট। রমেশচন্দ্র দত্ত এঁদের দুজনের ভাষারীতির তুলনা করে বলেছেন ঃ “In Vidyasagar’s style we admire the placid stillness and soft beauty of quiet Lake, reflecting on bosom the gorgeous tints of the sky and the surrounding objects. In Akhaykumar’s style we admire the vehemence and force of the mountain torrent in its wild and rugged beauty.”
সংস্কার মুক্ত আধুনিক যুক্তি শাসিত মন, প্রবল ক্ষাত্র-বীর্য এবং বজ্র কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের গদ্য যে সার্থক ‘শিল্প’ হতে পেরেছে তার কারণ, তার সমস্ত কর্মসাধনার মৌল উৎস-মুখ করুণাঘন স্নেহার্দ্র হৃদয়। ভগবান বুদ্ধের মতো তার হৃদয় বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনায়’ অভিষিক্ত। বাংলা গদ্যসাহিত্যে তিনিই প্রথম মানবতাবাদী গদ্যলেখক।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন :
বাংলার নবজাগৃতি-যজ্ঞের এই সাগ্নিক শ্রেষ্ঠ শুধুমাত্র সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের জন্য সারস্বত সাধনা করেন নি, ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবণিতাকেও রসতীর্থের পথে জানিয়েছেন সাদর আমন্ত্রণ প্রতিভা প্রকাশের বহুমুখী সুযোগ পেয়েও মানবকল্যাণের মন্ত্রোচ্চারণই ছিল তাঁর গদ্যের ধ্রুবপদ। জনশিক্ষার জন্যই তার লেখনীধারণ। তার রচিত পুস্তকের সংখ্যা প্রায় তিপান্ন। এর মধ্যে বত্রিশ খানি বাংলা ভাষায় লেখা এবং দু’চারটি ছাড়া সবগুলিই পাঠ্যপুস্তক জাতীয় ও অনুবাদ গ্রন্থ। কিন্তু শিল্পী-হৃদয়ের সুকুমার স্পর্শে প্রায় সবগুলিই সাহিত্যগুণে ঋদ্ধ।
প্রাক-বিদ্যাসাগরীয় বাংলা ভাষা ছিল “প্রয়োজনের ভাষা”। গদ্যের অন্বয়-রীতি, যতিস্থাপন, শব্দ-অনুপাত সে পর্বে বিরলদৃষ্ট। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাস্টারী-গন্ধী গদ্যরচনায় রসপরিবেশের তাগিদ ছিল উপেক্ষিত। ভাষার বৈচিত্র্য ও গতিশীলতা সেখানে অনুপস্থিত। শুধুমাত্র প্রয়োজনের অঙ্গীকার সেখানে স্বীকৃত। এই অবস্থায় বিদ্যাসাগরের নান্দনিক আবির্ভাবে বাংলা গদ্যে ফুটে উঠল “ছন্দে-গাঁথা সুরে ভরা বাণী।”
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যাপনা কালে ছাত্রদের জন্য ভাগবতের দশম স্কন্ধ অবলম্বনে লেখা “বাসুদেবচরিত” গ্রন্থটি তার সারস্বত যাত্রার প্রথম চিহ্ন বলে তাঁর জীবনীকার স্বীকার করেছেন। অথচ কলেজ কর্তৃপক্ষের সহানুভূতি-বঞ্চিত এই গ্রন্থটি চিরকাল অমুদ্রিত থেকে গেছে। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিহারীলাল সরকারের গ্রন্থে এর যে আংশিক উল্লেখ বিদ্যমান, তার মধ্যেই বিদ্যাসাগরের স্বকীয়তা ছিল স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। গ্রন্থটি যদি মূল গ্রন্থের আক্ষরিক অনুরূপায়ণ হতো তাহলে হয়তো গ্রন্থটি দিকে দিকে বন্দিত হতো না। কিন্তু এর মধ্যে ভাষা-বিন্যাসের যে মৌলিকতা দেখা গেছে সেই গৌরবেই গ্রন্থটি অমুদ্রিত হয়েও স্মরণীয় হয়ে আছে। অনুবাদও যে কল্পনার রূপময় বিশালতায় ও পরিমিতি সচেতনতায় মৌলিক সৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে মধুসূদনের আগে বিদ্যাসাগরের অমর লেখনীর স্পর্শে তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রাচীন গতানুগতিকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার ফলে তাঁর অনুবাদ হয়ে উঠেছে ‘a creation within creation’. (Oscar Wilde) শিল্পপ্রেমের সজাগ প্রকাশ – প্রথম সজ্ঞানে তাঁর যতিস্থাপনের নিয়ম অনুসরণ। প্রথম সৃষ্টির মধ্যেও তার পরিচয় সুস্পষ্ট : “রে দুষ্ট, তুই মাটি খাইয়াছিস!” কৃষ্ণের প্রতি যশোদার এই উক্তিতে ‘জিজ্ঞাসা’ বড় নয়—বড় পুত্রবৎসলা মাতার “বিপন্ন বিস্ময়”। তাই প্রশ্নচিহ্নের (?) বদলে আশ্চর্য চিহ্নের (!) ব্যবহার এখানে লক্ষ্য করা যায়।
সমাসাড়ম্বর থেকে ভাষার সরলীকরণ ঘটেছে। “সৌম অথচ সহজ শব্দগুলি” নির্বাচন করায় তার গদ্য যেন মধুর এক ভাবরসে হয়েছে সুধাসিক্ত। তাঁর ছবি দেখি ‘বাসুদেবচরিতে’–“ওগো কৃষ্ণ মাটি খাইয়াছে। আমরা বারণ করিলাম, শুনিল না।” এ গদ্য সর্বজনবোধ্য, তাই সর্বজনধন্য। তাঁর প্রত্যেকটি অনুবাদেরই বিষয় সুপরিচিত। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম বৃহত্তম জনতার গদ্যলেখক।
হিন্দি “বৈতাল পচ্চিসীর” অনুবাদ “বেতাল পঞ্চবিংশতি” (১৮৪৭) বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ হলেও তা জনগণমন হরণে সক্ষম হয়েছিল। এই কারণে মূল গ্রন্থের অশ্লীল অংশ এখানে দৃঢ়তার সঙ্গে বর্জিত হয়েছে। উনিশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে সুমার্জিত রুচির পরিচয় বিরলদৃষ্ট। কিন্তু কি সমাজবিপ্লবে, কি সাহিত্যসংস্কারে, কি ব্যক্তিজীবনে সর্বত্রই বিদ্যাসাগর রুচির শুচিতা রক্ষা করেছেন। তাই তার পর থেকেই “বিকশিত বিশ্ব-বাসনার অরবিন্দে” আরম্ভ হয়েছে সারস্বত-সাধনা। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা রূপে তার অমূল্য অবদান—চেম্বার্সের ‘Biography’ অবলম্বনে ‘জীবনচরিত’ “Rudiment of Knowledge”, অনুসরণে ‘বোধোদয়’ ঈশপের ফেল্স থেকে “কথামালা”, “আখ্যানমঞ্জরী”, মার্শম্যানের “Outlines of the History of Bengal, Compiled for the use of youths in India.” গ্রন্থটির শেষাংশ অবলম্বনে “বাঙ্গালার ইতিহাস- দ্বিতীয় ভাগ” ইত্যাদি গ্রন্থ। পাঠ্যপুস্তকের সীমানায় আবদ্ধ বলে সাহিত্যসুষমা এখানে আশা করা অসঙ্গত। তবু এই গদ্যানুবাদ প্রাঞ্জল এবং বোধগম্য। আজকের যুগেও এগুলির পাঠ্যপুস্তক হিসাবে মূল্য আছে। আর “বর্ণপরিচয়” তো দোসরহীন! “জল পড়ে পাতা নড়ে” কাব্য নয়, তবু তা রবীন্দ্রনাথের কাছে হয়ে উঠেছিল “শৈশবের মেঘদূত”।
বিদ্যাসাগরের সার্থক অনুবাদকর্মের মধ্যে আছে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে ‘শকুন্তলা’, শেকসপিয়রের ‘Comedy of Errors’-এর গদ্যানুবাদ ‘ভ্রান্তিবিলাস’ এবং ‘সীতার বনবাস’। শেষ গ্রন্থটির উৎস, বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড এবং ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’।
‘‘’শকুন্তলা’ থেকেই আধুনিক শিল্পসম্মত বাংলা গদ্যের সূচনা হয়েছিল। এই প্রথম বাংলা গদ্যে শোনা গেল “যৌবন-জলতরঙ্গ”, এল সংহত হৃদয়বেগ, দেখা গেল অনুপম কান্তি আর প্রসাদগুণ— “ক্রমে ক্রমে, শকুন্তলা দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, অনুসূয়া ও প্রিয়ংবদা উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। মহর্ষি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন অনুসুয়ে! প্রিয়ংবদে তোমাদের সহচরী দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়াছেন; এক্ষণে শোকাবেগ সম্বরণ করিয়া আমার সহিত আশ্রমে প্রতিগমন কর”। শকুত্তলার এই বিদায় দৃশ্য দেখে বুকের মধ্যে অশ্রু উথলে ওঠে। বিদায়লগ্নে মহর্ষির দীর্ঘশ্বাস যেমন রিক্ততপোবনকে বেদনাবিহ্বল করে, তেমনি একালের পাঠক-মনকেও যেন বেদনায় বিলাপমুখর করে তোলে।
বিদ্যাসাগরের গদ্য চিত্রকলাময়। অথচ শুধু সমকালে নয়, আধুনিক তীক্ষ্ণধী সমালোচকের দৃষ্টিতেও যেন সাগরী গদ্যের চিত্রকল্পনার দিকটি উপেক্ষায় অনাদৃত। অথচ ‘শকুন্তলা’ ও সীতার বনবাসের কোন কোন অংশ যেন লেখকের ‘তুলির লিখন’— “শকুন্তলা, আমার অঞ্চল ধরিয়া কে টানিতেছে’ এই বলিয়া মুখ ফিরাইলেন”। —এই বাক্য দুটি এবং শকুন্তলা বিরহে তপোবন প্রাণীদের ম্লান মুখচ্ছবি শুধু চিত্রল নয়, বহু চিত্রশিল্পীর অনন্য প্রেরণা হতে পারে। তাই বিদ্যাসাগর কালিদাসের কাব্যের অদ্বিতীয় অনুবাদক।
“শকুস্তলা”র পর “সীতার বনবাস’ আর এক অসাধারণ অনুবাদ। জনমদুঃখিনী অপাপবিদ্ধা সীতা। সেই দুঃখিনী রানীর কাহিনী পড়তে পড়তে পৌরাণিক পরিবেশে চলে যায় পাঠকমন। ‘সীতার বনবাসে’ সেই নিসর্গের বর্ণনা অপূর্ব আর্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশে আকাশপথে সততসঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত।” পৌরাণিক বেলাভূমির উপর দিয়ে ভাষার উল্লোল গর্জন এখানে গভীর খাতে প্রবাহিত। “প্রসন্ন-সলিলা গোদাবরী তরঙ্গের মতো” এমন ভাষার সাবলীল গতিচ্ছন্দ, শব্দের এখন ধ্বনিময় ব্যবহার পূর্ব অনুবাদে দুর্লভ। বিষয় ও বক্তব্য অনুযায়ী ভাষা এবং পরিবেশ এখানে সম্পূর্ণভাবে শিল্পসম্মত।
‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর গদ্যে শুনি বঙ্কিমের দূরাগত পদধ্বনি। কোন কোন জায়গায় ভাষা আশ্চর্য নিরাভরণ : “বলি, টাকা কোথায়? সে বলিল, আর টাকা কোথায় পাইব? আমার নিকটে যাহা ছিল তাহা দিয়া এই দড়ি কিনিয়া আনিয়াছি।”
তাঁর “বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব” ও “সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব” নামক রচনা দুটি বিতর্কমূলক। এখানে শিল্পসৃষ্টির অবকাশ নেই। শাণিত যুক্তি, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আর অপার করুণা বিধবা প্রস্তাবটির সম্পদ“ধন্যরে দেশাচার! তোর কি অনির্বচনীয় মহিমা।… তোর প্রভাবে অশাস্ত্রও শাস্ত্র বলিয়া গণ্য হইতেছে, ধর্মও অধর্ম বলিয়া গণ্য হইতেছে।” হিমালয় কঠিন পৌরুষ কখনও আবার দ্রবীভূত বেদনায় অভিষিক্ত : “হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে ভারতবর্ষে আসিয়া জন্মগ্রহণ কর বলিতে পারি না।” দ্বিতীয় প্রস্তাবে’ সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যের নষ্ট কোষ্ঠী উদ্ধারের চেষ্টা দেখা যায়।
‘ব্রজবিলাস’ এবং ‘কস্যচিৎ ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে লিখিত “অতি অল্প হইল” “আবার অতি অল্প হইল” বিদ্যাসাগরের অভিনব গদ্যরীতির আর এক প্রয়াস। ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’-এর মনিরত্নখচিত ভাষা-সম্পদ এখানে অনুপস্থিত। অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশীর মতে এগুলির ভাষা, “টাটু ঘোড়ার মত ছুটিয়াছে, চার পায়ের আঘাতে গ্রাম্যশব্দের লোষ্ট্রখণ্ড ছুটিয়া গিয়া প্রতিপক্ষকে আহত করিয়াছে।” স্থানে স্থানে ছড়িয়ে আছে বিদ্যাসাগরের সপ্রসন্ন মনের হাসি“সরাগ্রহণ পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ, তার গলায় গামছা দিয়া মনের সাধে প্রহার করিলেন।”
বিদ্যাসাগরের অনবদ্য সৃষ্টি তাঁর আত্মচরিতে’র কিছু অংশ আর “প্রভাবতী সম্ভাষণ”। প্রথম গ্রন্থে দেখা যায়, কত অল্পে তিনি নিজের দুঃখকে প্রকাশ করেন। কত সহজে তাঁর রচনা ‘সাহিত্যপদবাচ্য’ হয়ে ওঠে। ঠাকুরদাসের দুঃখকাহিনী কোন আবেগের সংযোগ ছাড়াই হয়ে উঠেছে মর্মস্পর্শী। তার আত্মজীবনী সম্পূর্ণ হলে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীবনচরিত হয়ে উঠত।
অবাধ্য-নিয়তির নির্দেশে প্রভাবতী নামে একটি তিন বছরের মেয়েকে (রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে) হারানোর পর সবার অলক্ষ্যে বিদ্যাসাগর এঁকেছিলেন এই স্মরণ সুন্দর আলেখ্য “প্রভাবতী সম্ভাষণ”। শুধু এই রচনাটির জন্যই তিনি বাংলা সাহিত্যে মৃত্যুহীন কৃতিত্বের অধিকারী হতেন। অশ্রুবিধুর ব’লে এর গদ্যে অনমনীয় পৌরুষ নেই, নেই প্রবল গতিচ্ছদ। ছিন্ন মণির মত অশ্রুর ধারায় ভেসে গেছে রাজসিক শব্দসম্পদ। তাই এর গদ্য ক্লাস্ত মুসাফিরের মত ভারাক্রাস্ত
Leave a comment