জাতীয় রাষ্ট্রের শক্তি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে জাতীয় ক্ষমতা বা জাতীয় শক্তির উপর। বস্তুত জাতীয় শক্তির বা ক্ষমতার উপাদানসমূহের শ্রেণিবিভাজনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সামান্য মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু তারা জাতীয় ক্ষমতার কার্যকর উপাদানসমূহ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে একমত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ই এইচ কার ক্ষমতাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি হল一

  • সামরিক ক্ষমতা (Military Power),
  • অর্থনৈতিক ক্ষমতা (Economic Power),
  • জনমত গঠনের ক্ষমতা (Power Over Opinion)।

[1] সামরিক ক্ষমতা: সামরিক শৃঙ্খলা ও তাদের নির্দেশ ও আদেশের মধ্যে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অবশ্য কোনাে দেশের সর্বাত্মক সামরিক প্রস্তুতি সেই দেশকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার শক্তি জোগায়।

[2] অর্থনৈতিক ক্ষমতা: আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার আর্থিক ক্ষমতার জোরে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। এর ফলে রাষ্ট্রের আর্থিক দিকেরও সমৃদ্ধি ঘটে। একইসঙ্গে সামরিক প্রস্তুতির অঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্র নিজের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্রের আধুনিকীকরণের দ্বারা বিশ্বের দরবারে পৌছে দিয়েছে।

[3] জনমত গঠনের ক্ষমতা: অধ্যাপক ই এইচ কার বলেন যে, কোনো রাষ্ট্রের অনুকুলে জনমত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে সেই রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তাই বর্তমান সময়ে জনমত গঠনকে জাতীয় ক্ষমতার অন্যতম উপাদান বলে চিহ্নিত করা যায়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতাই হল মূলকথা। বলাবাহুল্য যে রাষ্ট্র ক্ষমতাহীন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেই রাষ্ট্র একেবারেই গুরুত্বহীন। তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব কতখানি তা নিম্নে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা হল一

[1] ক্ষমতার তুলনামূলক আলােচনা: জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতা বা শক্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জাতীয় শক্তির গুরুত্ব আলােচনার সময় এ কথা মনে রাখা উচিত যে, জাতীয় শক্তির ধারণা সবসময় কিন্তু আপেক্ষিক। যেমন- কোনাে একটি দেশের জাতীয় শক্তিকে অন্য কোনাে দেশের জাতীয় শক্তির সঙ্গে তুলনা ক্ষমতার ভারসাম্যজনিত বিচার বলে বিবেচিত হয়। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে স্বীকার করি। তাই এককথায় বলা যায় যে, বর্তমানে অন্যান্য দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা অনেক বেশি।

[2] চিরদিন কোনাে দেশ শক্তিশালী নাও থাকতে পারে: কোনাে একটি দেশ এক বিশেষ সময়ে পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বলে গণ্য হতে পারে কিন্তু সেই দেশ চিরদিনই যে বিশ্বে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হয়ে থাকবে তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই।

[3] জাতীয় শক্তির উপাদানের গুরুত্ব পরিবর্তনশীল: জাতীয় শক্তি যেসব উপাদানের উপর নির্ভর করে তার মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়া আর বাকি সব উপাদানেরই পরিবর্তন ঘটে। ভৌগােলিক অবস্থানের গুরুত্বও সব যুগে সমান থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, অতীতে ইংলিশ চ্যানেল যেভাবে ইংল্যান্ডকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে, আধুনিক যুগে উন্নত অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কারের ফলে ইংলিশ চ্যানেলের আর আগের মতাে সেই গুরুত্ব নেই। তাই বলা যায় যে, সব যুগে বিভিন্ন দেশের জাতীয় শক্তির তারতম্য ঘটতেই পারে।

[4] যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে জাতীয় শক্তির পরিবর্তন: এক যুগে যে দেশ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, পরবর্তী যুগে বা সময়ে সেই দেশ অন্যদেশের তুলনায় দুর্বল বা হীনবল হয়ে পড়তে পারে। যেমন, বর্তমানে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর তার পূর্বের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

সময়ের নিরিখে পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন : নিজের এবং অন্যদেশের শক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা প্রয়ােজন। আজ গ্রেট ব্রিটেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের পরিমণ্ডলে বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় আমেরিকা ও রাশিয়ার মতাে সমান প্রধান শক্তির ভূমিকা পালনের কোনাে দাবি করতে পারছে না। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তন ব্রিটিশ জাতির আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক।

[5] অবৈজ্ঞানিক চিন্তা দূর করে: অনেকসময় জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে কেবলমাত্র একটি উপাদানের উপর জোর দিয়ে জাতীয় শক্তির বিচার করা হয়। কেউ কেউ ভৌগােলিক পরিবেশ, কেউ কেউ জাতীয় চরিত্র ও উৎকর্ষতার উপর গুরুত্ব প্রদান করেন, আবার কেউ বা শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দ্বারাই একটি দেশের জাতীয় শক্তির পরিমাপের চেষ্টা করেন। এই ধরনের চিন্তা অবৈজ্ঞানিক বলে মনে করা হয়। জাতীয় শক্তি বিচার করার সময় পার্থিব (যেমন ভৌগোলিক অবস্থান, ভৌগােলিক পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, শিল্পোন্নতি, জনসংখ্যা, সামরিক শক্তি) এবং অপার্থিব (যেমন জাতীয় চরিত্র, জাতীয় মনােবল) এই সমস্ত উপাদানের উপর সমানভাবে এবং সচেতনভাবে গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।

[6] মিশ্র জাতীয় শক্তির উদ্ভব: জাতীয় শক্তির একটি উপাদানের অভাব অন্য উপাদান দ্বারা পূরণ করা খুবই কঠিন। চিন বা ভারতের লােকসংখ্যা প্রয়ােজনের তুলনায় বেশি, ফলে জাতীয় শক্তি তেমন বৃদ্ধি পায়নি। এত লােকের খাদ্য সংস্থান করাই সরকারের কাছে বড়াে চ্যালেঞ্জ, জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদান যদি সঠিক হারে বা আনুপাতিক হারে বর্তমান থাকে, তবে তার মিশ্রণেই প্রকৃত জাতীয় শক্তিতে বলশালী হওয়া সম্ভব।

[7] জাতীয় শক্তির সঠিক ব্যবহার: কেবলমাত্র জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদানের পরিমাপ করলেই হবে না, সেই উপাদানগুলি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তার উপরও জাতীয় শক্তির গুরুত্ব নির্ভর করে।

[8] জাতীয় শক্তির আপেক্ষিক গুরুত্ব: জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদানের আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়ােজন। আগে বড়ো যুদ্ধজাহাজের যে ভূমিকা ছিল, এখন সাবমেরিন সেই স্থান অধিকার করেছে। আগে যুদ্ধবিমান মানুষই প্রধানত চালনা করত এখন মানুষের জায়গায় উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, আগে কয়লার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এখন সেখানে তেলের গুরুত্ব অনেক বেশি, বিজ্ঞান যেভাবে এগােচ্ছে ভবিষ্যতে হয়তাে তেলের গুরুত্বও কমে যাবে।

[9] শক্তিহীন রাষ্ট্র: ক্ষমতা বা শক্তিকে যেহেতু আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হয়, তাই বলা যায় যে, শক্তিহীন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র কখনােই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না। অনেকসময় স্বার্থান্বেষী ও ধূর্ত জাতীয় নেতারা জাতীয় স্বার্থের কথা বলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আসল উদ্দেশ্য গােপন করার চেষ্টায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অকারণে, কখনাে তুচ্ছ কারণে বা পরােক্ষে অভিযােগ আনেন। এইসব আসলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের দুর্বলতার লক্ষণ।

উপসংহার: উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিভিন্ন উপাদানের আপেক্ষিক গুরুত্ব বিচার না করে কখনােই জাতীয় শক্তির গুরুত্ব বিচার বা সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও এ কথা বলতেই হয় যে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব সকল প্রকার বিরােধ-বিতর্কের উর্ধ্বে।