রবীন্দ্রনাথ ‘সৌন্দর্যবোধ’ প্রবন্ধে সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে সংযমের অচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা বলেছেন। তিনি বিস্তৃত আলোচনার সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে, সংযতচিত্ত ব্যক্তি ছাড়া অপর কারও পক্ষে সৌন্দর্য সৃষ্টি কিংবা সৌন্দর্য উপলব্ধি সম্ভবপর নয়। তারপর নিজেই একটি সম্ভাব্য কূট প্রশ্নের অবতারণা করে বলেছেন যে, কোনো কোনো গুণী কলাকুশলী ব্যক্তির জীবনচর্যায় যে অসংযমের পরিচয় পাওয়া যায়, তা থেকে হয়তো কেউ কেউ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে অসংযত জীবন-যাপনের সঙ্গে সৌন্দর্যসৃষ্টির সহাবস্থান তা হলে সম্ভবপর হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ এই সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করে বলেছেন যে, তবে তো বাঘে গরুতে একঘাটে জল যাবে; এটাও সম্ভব যখন উভয়েরই থাকে অপরিণত অবস্থা। উভয়েই যখন পরিণত অবস্থায় উপনীত হয় আর তাদের সহাবস্থান সম্ভবপর নয়। কলানিপুণ গুণীদেরও অনুরূপ অবস্থা। যে কোনো শিল্পনৈপুণ্য কিংবা সৌন্দর্যবোধের যথার্থ পরিণত ভাব কখনও প্রবৃত্তির বিক্ষোভ বা চিত্তের অসংযমের সঙ্গে একত্র অবস্থান করতে পারে না। তবে আমরা বাইরে থেকে যেটা দেখি, সেটাকেই পূর্ণ। বলে গ্রহণ করতে গিয়েই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। জাগতিক বাস্তবের সঙ্গে মনুষ্য-ঘটিত বাস্তবের একটা পার্থক্য আছে। কারণ বাস্তবের সবই প্রত্যক্ষগোচর বলেই বিশ্বাস, কিন্তু মানুষের ব্যাপারে বাস্তবের বৃহদংশই অপ্রত্যক্ষ। তাই আকবরকে কেউ বলেন প্রজাহিতৈষী, কারও মতে তিনি হিন্দু প্রজার পক্ষে যত নষ্টের গোড়া। মানুষের বিষয়ে আসল সত্যটা যে প্রত্যক্ষের উপরেই ভেসে বেড়ায় তা নয়, তার বৃহদংশই অপ্রত্যক্ষের মধ্যে ডুবে থাকে। এইজন্যই কোন কলাবিদের আংশিক পরিচয়মাত্র জেনেই তার অসংযমটাকে বড়ো করে দেখি, তার সাধনা বা সংযম—যার জন্য তিনি গুণী, তা আমাদের অজ্ঞাত থেকে যায়।

এইভাবেই আমরা খণ্ড ক্ষুদ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি, কারণ আমাদের প্রবৃত্তির উগ্রতা বিধাতার সৃষ্ট জগতের মধ্যেও একটা নিজের জগৎ সৃষ্টি করে নেয়, চারদিকের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই। ফলে আমাদের অহংবোধ এমন বিকার উৎপাদন করে যাতে ছোটো বড়োর বিপর্যয় ঘটে, ক্ষণকালের বস্তুও চিরকালের বলে বোধ হয়। চলমান নদীর ঢেউগুলি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও যদি এক হয়ে সমুদ্রের দিকে না গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পাক খেতে থাকে, তবে যে ঘূর্ণীর সৃষ্টি হবে, তা আর নদীকে এক পা-ও এগুতে দেবে না, নদী-জীবনই হবে ব্যর্থ। ঠিক এমনিভাবেই কোনো একটা প্রবৃত্তি উন্মত্ত হয়ে একটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকলে আমরা নিখিল বিশ্বপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো, এতে নিজেরও অনিষ্ট অপরেরও সব নষ্ট হয়। অথচ এই উন্মত্ততার মধ্যেও কেউ কেউ সৌন্দর্যের সন্ধান পায়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন যে য়ুরোপীয় সাহিত্যে চলছে সেই ঘূর্ণী-উৎসব, যার কোনো পরিণাম নেই, যেখানে কোনো শান্তি নেই। কিন্তু এতে স্বভাবের বিকৃতি প্রকাশ পায় বলে একে শিক্ষার সম্পূর্ণতা বলা যায় না, খণ্ডতার মধ্যে সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে দেখালে অনেক কিছুকেই সুন্দর বলে মনে হাতে পারে, কিন্তু প্রকৃত সুন্দর বলে তাকে গ্রহণ করা যাবে না, যতক্ষণ না এটিকে সমগ্রের সঙ্গে, নিখিলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। চিত্তের শান্তি ও সংযম দ্বারাই সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব।

ছবি-বিষয়ে যার প্রকৃত শিক্ষা নেই, সেই ব্যক্তি একটা পটের উপর কিছুটা বর্ণ বৈচিত্র্য দেখতে পেলেই মুগ্ধ হয়। তার দর্শন সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে নিবন্ধ এবং বিচারবুদ্ধি রহিত বলেই এমনটি হয়ে থাকে। যেমন গ্রাম্য লোক দেউড়ির দারোয়ানের চাপরাশ আর চাপ দাড়ি দেখেই মুগ্ধ হয়, রাজার মহিমার মধ্যে যে শক্তি, শান্তি ও গাম্ভীর্য রয়েছে, তা কখনও তাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু ছবির ব্যাপারে যিনি প্রকৃত সমঝদার তিনি কেবল চোখের দেখাতেই তৃপ্ত নন, বর্ণবৈচিত্র্য তারও চোখে পড়ে, তিনি তার মধ্যে দেখতে পান সামঞ্জস্যের সুষমা যার জন্য প্রয়োজন মনের। অতএব দেখা যাচ্ছে, শুধু চোখের দৃষ্টি নয়, তার পিছনে মনের দৃষ্টি না থাকলে সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা যায় না। এই মনের দৃষ্টি লাভ করাটাই শিক্ষা-সাপেক্ষ ব্যাপার। যথার্থভাবে মনকে তৈরি করতে পারলেই শিক্ষার সম্পূর্ণতা আসে এবং একমাত্র সেইক্ষেত্রেই সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভবপর।

আমাদের মনের দৃষ্টি-ব্যাপারেও তর-তম ভেদ রয়েছে। প্রাথমিক স্তরে আমরা চোখের দেখায় অতিরিক্ত বুদ্ধির সাহায্যে বিচার করে থাকি। এর সঙ্গে যদি আবার হৃদয়ভাব যুক্ত হয়, তবে তার ক্ষেত্র আরও বেড়ে যায়। আবার যদি এর সঙ্গে ধর্ম-বুদ্ধিকে যোগ করা যায়, তবে দৃষ্টি আরও অনেকটা প্রসারিত হয় ; সর্বোপরি যদি অধ্যাত্মদৃষ্টি খুলে যায়, তাহলে দৃষ্টিক্ষেত্রের সীমা অলক্ষ্যগোচর হয়ে যায়। এই কারণেই ফুলের সৌন্দর্যের চেয়ে মানুষের মুখের সৌন্দর্য অনেক বেশি আকর্ষণযোগ্য বিবেচিত হয়: ফুলের সৌন্দর্য মাধুর্য শুধু ইন্দ্রিয় দ্বারাই গ্রহণযোগ্য, কিন্তু মানুষের মুখে আকৃতির সুষমার অতিরিক্ত রয়েছে চেতনার দীপ্ত, বুদ্ধির স্ফূর্তি এবং হৃদয়ের লাবণ্য—যা আমাদের চৈতন্য, বুদ্ধি ও হৃদয়কেও অধিকার করে।