প্রশ্নঃ আইন বিজ্ঞানের ইতিহাসে মধ্যযুগে ইসলামী আইনের গুরুত্ব আলোচনা কর। ইসলামিক আইন ও বিধিবদ্ধ আইন বা পজেটিভ ল এর মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তরঃ আইনবিজ্ঞানের ইতিহাসে মধ্যযুগে ইসলামী আইনের গুরুত্বঃ মুসলিম ব্যবহার শাস্ত্র এবং বিশ্ব ব্যবহার শাস্ত্র বিশেষ করে পাশ্চাত্য ব্যবহার শাস্ত্র প্রায় সমান্তরালভাবে বিকাশ লাভ করেছে। ‘শরিয়া’ বা স্বর্গীয় আইন হচ্ছে মুসলিম ব্যবহার শাস্ত্রের ভিত্তি এবং ‘শরিয়া’র মূল কথা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন। হজরত মুহম্মদ (সঃ) এর জীবদ্দশায় এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ‘শরিয়া’ আইন সম্পর্কে কোন মতবিরোধ ছিল না। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আল-গাজ্জালীর মতে, “একাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন মতবিরোধ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষ করে আব্বাসীয় যুগে বহির্বিশ্বে ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং বিভিন্ন ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ভৌগৌলিক পরিবেশ, ইত্যাদির জনগণ কর্তৃক ইসলাম গ্রহণের পর এই শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়।” বিভিন্ন মতাদর্শের ভিত্তিতে সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে চারটি ‘মাজহাবের’ উৎপত্তি হয়। এগুলো হচ্ছে হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বেলী। এই মাজহাবগুলোর প্রতিষ্ঠাতাগণ এমন ধী শক্তিসম্পন্ন ও ব্যবহারশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন যে, পরবর্তীকালে কেউ তাদেরকে অতিক্রম করতে পারেননি। 

এ সকল শাস্ত্রবিদগণ ইজমাকে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং কিয়াস, ইসতিসান, ইসতিদলাল, ইসতিসলাহসহ নানাবিধ নীতির প্রবর্তন করে শুধু মুসলিম আইনবিজ্ঞানকেই সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করেন নি বরং সমগ্র আইনবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধশালী করেছেন। ইমাম আবু হানিফা সর্বপ্রথম আইনবিধি সম্প্রসারিত করার জন্য ‘কিয়াস’ এর প্রবর্তন করেন যা পরবর্তীকালে খুব বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি বিচার-নীতি হিসেবে ‘ইসতিসান’ এর প্রবর্তন করেন যার আক্ষরিক অর্থ হলো অগ্রাধিকার প্রদান। এটি বহুলাংশে ইংল্যান্ডে প্রবর্তিত ইকুইটির অনুরূপ। আইনের বিধিগুলোকে বিশেষ অবস্থায়, বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যা যথার্থ মনে হতো এই নীতি প্রয়োগ করে তার সমাধান করা হতো। ইমাম আবু হানিফা ইজমার পরিধি সম্প্রসারিত করেন এবং সকল যুগের আইনবিদগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মতবাদকে ইজমা হিসেবে গ্রহণ করেন। ইমাম আবু হানিফাই ছিলেন সর্বপ্রথম ব্যবহার শাস্ত্রবিদ যিনি আইনের রীতিবদ্ধ শিক্ষা প্রণালী প্রবর্তন করে সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণযোগ্য করেন এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সকল প্রকার প্রশ্নের মীমাংসা করার মত উল্লেখযোগ্য আইনের নীতি নির্ধারণ করেন।

ইমাম আবু হানিফার ‘ইসতিসান’ এর মত ইমাম মালিকও একটি মতবাদ প্রবর্তন করেন যাকে ‘ইসতিস্লাহ’ বলা হয়। এই মতবাদের ভিত্তি হলো জনগণের মঙ্গল বা কল্যাণ। তিনি ‘ইসতিদলাল’ নামে একটি যুক্তিতর্কবাদ প্রবর্তন করেন। অষ্টম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম আইন শাস্ত্রবিদ ইমাম শাফী আইনবিজ্ঞানের ক্লাসিক রীতি প্রবর্তন করেন। এই সময়কালের আর একজন মনীষী ছিলেন আহমদ ইবনে হাম্বল। আইন সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি গভীরভাবে সুন্নাহ্ ও হাদিসের অনুসরণ করতেন। ভারতবর্ষের মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রবর্তিত ফতোয়া-ই-আলমগীরীও আইনবিজ্ঞানের বিকাশে যথেষ্ট অবদান রেখেছে।

ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম এবং ধর্মের ভিত্তিতে ইসলামী আইন গড়ে উঠলেও এর প্রয়োগ অত্যন্ত ব্যাপক। তাই ইসলামী আইনশাস্ত্রের নীতিগুলোও বিশ্ব ব্যবহারশাস্ত্রে উদারভাবে ব্যবহার করা হয়।

ইসলামী আইন ও পজেটিভ ল’ এর মধ্যে পার্থক্যঃ ইসলামী আইনবিজ্ঞান এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্য বিদ্যমানঃ 

প্রথমতঃ ইসলামী আইন মূলতঃ ঐশ্বরিক। আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলের উপদেশ ছাড়া মানুষের তৈরী আইনের কোন স্বীকৃতি এতে নাই।

কিন্তু আধুনিক আইন ধর্ম নিরপেক্ষ। মানব সমাজে প্রচলিত সকল আইনই এর বিষয়বস্তু। কাজেই এখানে আইন হচ্ছে মানব সৃষ্ট ।

দ্বিতীয়তঃ ইসলামী আইনে নৈতিক বিধান ও আইনগত বিধানের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। কেননা ইহা আল্লাহ্র আদেশ তথা ধর্ম ও ন্যায়নীতির উপর ভিত্তিশীল। 

অপর পক্ষে, আধুনিক আইনতত্ত্বে নৈতিক বিধান ও আইনগত বিধানের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। এখানে শুধু আইনগত বিধানই গ্রহণযোগ্য। তাই আধুনিক আইন বিজ্ঞান পার্থিব আইন ও দর্শন ভিত্তিক।

তৃতীয়তঃ ইসলামী আইনবিজ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-শান্তি বিধান করা। 

পক্ষান্তরে, আধুনিক আইনতত্ত্বের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলার বিধান যা সম্পুর্ণরূপে জাগতিক এবং পরলোকের সঙ্গে সম্পর্ক-হীন।

চতুর্থতঃ ইসলামী আইনতত্ত্ব অনুযায়ী আইন হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কর্তৃক রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত আদেশ ও নিষেধ।

কিন্তু আধুনিক আইনতত্ত্ব মোতাবেক আইন হচ্ছে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের আচরণ বিধি যা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রয়োগ করা হয়।

পঞ্চমতঃ ইসলামী আইন সামাজিক মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল নয়। তাই এই আইনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন কিংবা বাতিলকরণ সম্ভব নয়। কিন্তু ইসলামী আইনবিশারদগণ এর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারেন।

পক্ষান্তরে, আধুনিক আইন সামাজিক মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল বিধায় ইহা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বাতিলযোগ্য।

ষষ্ঠতঃ আধুনিক আইনের বিধান ভঙ্গ করলে আদালতের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু ইসলামী আইনের বিধান ভঙ্গ করলে পারলৌকিক শাস্তির ভয় থাকে৷ অবশ্য যে সকল রাষ্ট্রে ইসলামী আইন চালু রয়েছে সে সকল দেশে এই আইন লংঘনের প্রতিকারও স্বীকৃত আছে।

সপ্তমতঃ ইসলামী আইন কোন রাষ্ট্রীয় গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, সমগ্র মানব সমাজের জন্য ইহা প্রযোজ্য।

কিন্তু আধুনিক আইন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।