গণেশীবংশীয় সামউদ্দিনকে হত্যা করে তাঁর দুইজন ক্রীতদাস ক্ষমতাদখলের দ্বন্দ্বে মত্ত হলে বাংলায় অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। এই অবস্থায় দায়িত্বশীল অভিজাতগণ ইলিয়াস শাহের জনৈক পৌত্র নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহকে সর্বসম্মতিক্রমে সিংহাসনে বসান (১৪৪২ খ্রিঃ)। এইভাবে বাংলায় ইলিয়াস শাহি বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। নাসিরউদ্দিন উদার মনোভাবাপন্ন ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তাঁর আমলে বাংলায় শিল্পকলার যথেষ্ট উন্নতি হয়। তাঁর সুদীর্ঘ শাসনকালে প্রজারা সুখে শান্তিতে বাস করতেন বলে সমকালীন গ্রন্থ থেকে জানা যায়। নাসিরউদ্দিন দু’বার চিনদেশে দূত প্রেরণ করেছিলেন।

পরবর্তী ইলিয়াস শাহি শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন নাসিরউদ্দিনের পুত্র রুকনউদ্দিন বারবক শাহ (১৪৫৯-‘৭৬ খ্রিঃ)। সতেরো বছর শাসনকালের মধ্যে শেষ দু-বছর, অর্থাৎ ১৪৭৪-৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নিজপুত্রের সাথে যুগ্মভাবে রাজ্যশাসন করেন। উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত জটিলতা এড়ানোর জন্যই সম্ভবত এরূপ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। বারবক শাহ ছিলেন সুযোদ্ধা, সুশাসক এবং শিল্প-সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী। বহু নতুন অঞ্চল জয় করে তিনি নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ কাজে তাঁর প্রধান সহায়ক ছিলেন আরবদেশীয় সেনাপতি ইসমাইল গাজি। ফারসি গ্রন্থ ‘রিসালৎ-ই-শুহদা’ থেকে ইসমাইলের জীবনকাহিনি ও কৃতিত্বের বিবরণ জানা যায়। এতে বলা হয়েছে যে, ইসমাইল মান্দারণের বিদ্রোহী রাজা গজপতিকে পরাজিত ও নিহত করে ওই দুর্গ দখল করেন। এক্ষেত্রে ‘গজপতি’ বলতে উড়িষ্যার রাজা গজপতি কপিলেন্দ্রদেবের কোনো সেনাপতিকে পরাস্ত করার কথা বলা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। গড়মান্দারণের দক্ষিণদিকে ‘উড়িয়া মর্দানা’ বা ‘উড়িয়া হত্যাকারী’ নামে একটি বিশাল তোরণ আছে। সম্ভবত, ইসমাইল গাজি উড়িয়াদের বিরুদ্ধে সাফল্যের ঘটনাকে স্মরণীয় করার জন্য এই তোরণ নির্মাণ করেছিলেন। অতঃপর ইসমাইল কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করেন। সম্ভবত এখানেই যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। অন্যমতে, রাজবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বারবক শাহ ইসমাইলকে প্রাণদণ্ড দেন। মোল্লা তকিয়ার বয়াজ অনুসারে বারবক ত্রিহৄত আক্রমণ করে হাজিপুর ও সন্নিহিত অঞ্চল দখল করেন। উত্তরে বুড়ি গণ্ডক নদী পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য সম্প্রসারিত ছিল।

বারবক শাহ শাসক হিসেবে ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দেন। বহু হিন্দুকে তিনি উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন বারবক শাহের চিকিৎসক অনন্ত সেন ও নারায়ণ দাস, দুর্গাধ্যক্ষ ভান্দসী রায়, অন্যতম মন্ত্রী বিশ্বাস রায় প্রমুখ। উচ্চপদস্থ কর্মচারী কুলধরকে বারবক ‘সত্য খাঁ’ ও ‘শুভরাজ খাঁ’ উপাধি দ্বারা সম্মানিত করেছিলেন। বারবকের হিন্দু সভাসদদের মধ্যে সুনন্দ, কেদার খাঁ, গন্ধর্ব রায়, তরুণী, সুন্দর, শ্রীবৎস, মুকুন্দ প্রমুখ ছিলেন বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। মুকুন্দ ছিলেন রাজপণ্ডিত, সুন্দর ও শ্রীবৎস ছিলেন বিচারবিভাগীয় কর্মচারী। কেদার খাঁ বিশেষ প্রতিপত্তিশালী সভাসদ ছিলেন। কেবল হিন্দু নয়, রাজ্যের প্রয়োজনে তিনি বিদেশিদেরও সরকারি কাজে নিয়োজিত করতেন। এদের মধ্যে ছিল আফগান ও আবিসিনীয় হাবশিগণ। বারবক প্রায় ৮০ হাজার হাবশি আমদানি করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেছিলেন। অবশ্য এরাই পরে ক্ষমতা দখল করে ইলিয়াস শাহি শাসনের সমাপ্তি ঘটায়।

শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বরাবক শাহ খ্যাতিলাভ করেন। পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ‘অল-ফাজিল’ ও ‘অল-কামিল’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর শিলালিপিতে এই দুটি উপাধির উল্লেখ আছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের কবি ও পণ্ডিত তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সে যুগের প্রখ্যাত টীকাকার বৃহস্পতি মিশ্র। তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ ‘পদচন্দ্রিকা’। গীতগোবিন্দ, কুমারসম্ভব, রঘুবংশ, শিশুপাল বধ প্রভৃতি বহু গ্রন্থের টীকাকার হিসেবে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। বারবক শাহ তাঁকে পণ্ডিত সার্বভৌম উপাধি দ্বারা সম্মানিত করেন। বিখ্যাত বাংলা কাব্য ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’এর রচয়িতা মালাধর বসুকে বারবক শাহ ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধি প্রদান করেন। বাংলা ভাষায় রামায়ণ-এর রচয়িতা কবি কৃত্তিবাস নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি গৌড়েশ্বরের সভায় গিয়েছিলেন এবং সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। পণ্ডিতদের মতে, এই গৌড়েশ্বর ছিলেন বারবক শাহ। জ্যোতির্বিদ বিশারদ-ও সুলতানের সাহায্যলাভে ধন্য হয়েছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বারবক বহু প্রতিভাবান হিন্দুকে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রশাসনের সাথে সাথে সংস্কৃতিচর্চাও করতেন; যেমন—তাঁর সভাসদ গন্ধর্ব রায় ছিলেন সংগীতজ্ঞ ও সুকণ্ঠের অধিকারী।

বলা বাহুল্য যে, বারবক শাহের দরবারে বহু মুসলমান পণ্ডিত সম্মানের সাথে অবস্থান করেছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘শরফনামা’ নামক শব্দকোষের রচয়িতা ইব্রাহিম ফারুকি। তাঁর রাজকবি হিসেবে আমির জৈনউদ্দিন হরুই খ্যাতিমান ছিলেন। শিল্পকলার প্রতিও তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃত একজন সৌন্দর্যরসিক। তাঁর মুদ্রা ও শিলালিপিগুলির অলংকরণে সুলতানের সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। বারবক শাহের প্রাসাদটিও ছিল অত্যন্ত সুন্দর। ড. মজুমদারের ভাষায় : “এই প্রাসাদটির মধ্যে উদ্যানের মতো একটি শান্ত ও আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করত, এর নীচে দিয়ে প্রবাহিত ছিল একটি পরম রমণীয় জলধারা….।” গৌড়ের বিখ্যাত ও বিশাল তোরণ ‘দাখিল দরওয়াজা’ বারবক শাহের স্থাপত্যকর্মের এক অনবদ্য নিদর্শন।

পরবর্তী শাসক বারবক শাহের পুত্র সামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ প্রায় ছয় বছর রাজত্ব করেন। গৌড়ের বিখ্যাত ‘লোটন মসজিদ’ সম্ভবত এঁর আমলে নির্মিত হয়েছিল। ইলিয়াস শাহি বংশের শেষ সুলতান ছিলেন জালালউদ্দিন ফতে শাহ (১৪৮১-৮৭ খ্রিঃ)। সমকালীন বিভিন্ন গ্রন্থে এঁকে ‘বুদ্ধিমান শাসক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এঁর রাজত্বকালেই নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্ম হয়। ফতে শাহ অসংখ্য হাবশি আমদানি করে সরকারি কাজে নিয়োগ করে নিজের এবং রাজ্যের বিপদ ডেকে এনেছিলেন। ধীরে ধীরে হাবশিরা ক্ষমতার চূড়ায় উপস্থিত হয়ে সুলতানের কর্তৃত্বকেই অগ্রাহ্য করতে শুরু করেছিল। ফতে শাহ দুর্বিনীত বহু হাবশিকে হত্যা করে সুলতানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও, তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ক্ষমতালোভী হাবশি প্রাসাদরক্ষীরা এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিদ্রিত অবস্থায় ফতে শাহকে হত্যা করে। ফতে শাহ’র মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে একশো আঠারো বছর ব্যাপী ইলিয়াস শাহি বংশের শাসনের অবসান ঘটে।

মূল্যায়ন : ইলিয়াস শাহি বংশের শাসকদের শতাধিক বছরের শাসনকালে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নবতম অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল বলে একাধিক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে তাঁরা বাংলায় দিল্লির কর্তৃত্বমুক্ত শাসন প্রতিষ্ঠার কাজে ইলিয়াস শাহি শাসকদের সাফল্যের কথা বলেছেন। কিন্তু দিল্লি-সুলতানির বাইরে থেকে বাংলার নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব বা যুক্তিসঙ্গত, তা আলোচনার দাবি রাখে। আঞ্চলিক স্বাধীন শাসন কায়েম করার এই প্রবণতাকে বিচ্ছিন্নতাবাদের জনক বলা খুব অসংগত হবে না। পরস্তু এই ধরনের প্রচেষ্টাই ঐক্যবদ্ধ ভারতরাষ্ট্র গঠনের কাজকে জটিল করে তুলেছিল। এজন্য মুঘলদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল একজন আকবরের জন্য। আকবরের পক্ষেও কাজটা খুব সহজ হয়নি। তবে ইলিয়াস শাহি সুলতানদের প্রথম তিনজন শাসক ছিলেন নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান। অন্তত বাংলাদেশের খণ্ডিত তিন অংশকে এক শাসনের অন্তর্ভুক্ত করে তাঁরা বাংলার ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। লক্ষ্মণাবতীর নেতৃত্বে সাতগাঁও একত্রিত হওয়ার ফলে রাজ্যের সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়েছিল। পরস্তু বিহার, উড়িষ্যা, আসাম অঞ্চলে কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত করে তাঁরা বাংলার শক্তি বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন।

ভাষা-সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে ইলিয়াস শাহি শাসকদের অবদান অবশ্যই প্রশংসনীয়। এ কাজে সর্বাধিক অগ্রণী দুজন শাসক ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ এবং রুকনউদ্দিন বারবক শাহ। এঁরা ব্যক্তিগতভাবে সাহিত্যসাধক ছিলেন। কাব্য-প্রতিভার নিদর্শন এঁরা রেখে গেছেন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি এঁদের শ্রদ্ধা ও পৃষ্ঠপোষণ বাংলার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে জোয়ার নিয়ে এসেছে। তুর্কি আক্রমণের পূর্বে গৌড়বঙ্গে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বা দরবারি ভাষা হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছিল সংস্কৃত ভাষা। কিন্তু তুর্কি শাসকেরা বাংলায় বসবাসের সূত্রে বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, বাংলা ভাষা তুর্কি শাসকগোষ্ঠীর কাছে এক প্রকার মাতৃভাষার সমাদর পেয়েছিল। ড. সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, “মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙালি হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা হিন্দু প্রজামণ্ডলী পরিবৃত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মসজিদের পার্শ্বে দেবমন্দিরের ঘণ্টা বাজিতে লাগিল ; মহরম, ঈদ্, সবেবরাত প্রভৃতির পার্শ্বে দুর্গোৎসব, রাস, দোলোৎসব প্রভৃতি চলিতে লাগিল। রামায়ণ, মহাভারতের অপূর্ব প্রভাব মুসলমান সম্রাটগণ লক্ষ্য করিলেন। এদিকে দীর্ঘকাল এদেশে বাসনিবন্ধন বাঙ্গালা তাঁহাদের একরূপ মাতৃভাষা হইয়া পড়িল।” রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাকাব্যকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার কাজে ইলিয়াস শাহি সুলতানদের আন্তরিক প্রয়াসকে তাঁদের বঙ্গভাষা প্রীতির নিদর্শন রূপে উপস্থাপিত করা যায়। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ, বারবক প্রমুখের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতার ফলে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে বাংলা ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে যে জোয়ার এসেছিল, তা সত্যই প্রশংসার।

শিল্পস্থাপত্যের অনুরাগী হিসেবেও ইলিয়াস শাহি বংশের একাধিক শাসক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ইলিয়াস শাহ, সিকন্দর শাহ, আজম শাহ এবং বারবক শাহের রাজত্বকাল উল্লেখযোগ্য। এইসব নিদর্শনের অনেকগুলিই কালের করাল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে কয়েকটি মসজিদ, প্রাসাদ বা দুর্গ আজও দাঁড়িয়ে আছে, তা-ই বাংলার শিল্পীমনের পরিচয় বহন করার পক্ষে কম নয়। পাণ্ডুয়ার ‘আদিনা মসজিদ’, লক্ষ্মণাবতীর ‘লোটন মসজিদ’, ‘বাইশ দরওয়াজা মসজিদ’ প্রভৃতির গঠনশৈলী, অলংকরণ ইত্যাদি শিল্প-সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেছে। এই সকল স্থাপত্যকর্মে এক নতুন শিল্পরীতির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। ইট ও পাথরের সমন্বযে ছোটো ছোটো স্তম্ভযুক্ত গম্বুজ এবং হিন্দুমন্দির ও আটচালার আদলে মসজিদ ও অট্টালিকা নির্মাণের রীতি এই পর্বে গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল। আদিনা মসজিদের নির্মাণশৈলীতে এই রীতির প্রকাশ ঘটেছে।