ইলতুৎমিস (১২১০/১১-‘৩৬ খ্রিঃ):

ইলতুৎমিস ছিলেন তুর্কি ইলবেরি উপজাতির ইলেতমিস খাঁয়ের পুত্র। তাঁর বাল্য নাম ছিল সম্ভবত ইসেতমি। অতি সুদর্শন, নম্র ও সুমধুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই যুবককে তাঁর ভায়েরা ‘দাস’ হিসেবে বিক্রি করে দেন। পরে বোখারা হাজি নামে জনৈক দাস ব্যবসায়ী তাঁকে কিনে নেন। পরে জালালউদ্দিন চুস্তকুবা নামে জনৈক ব্যবসায়ী তাঁকে ক্রয় করেন এবং গজনীতে নিয়ে আসেন। গজনীর উদার সংস্কৃতি এবং বাগদাদের সুফী সাধক শেখ সুহরাবদির সংস্পর্শে এসে তাঁর চিন্তা চেতনায় বহু রূপান্তর ঘটে। গজনীর দাস বাজারে বিক্রয়ের জন্য আনা হলে মহম্মদ ঘোরী হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাঁকে কিনে নিতে চান। কিন্তু দরদামের প্রশ্নে মতভেদ হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। অবশ্য ক্ষুব্ধ ঘুরি গজনি শহরে ইলতুৎমিসের বিক্রয়ের বিরুদ্ধে এক নির্দেশনামা জারি করেন। গুজরাট বিজয়ের পর কুতুবউদ্দিন আইবক গজনিতে এসে ইলতুৎমিসের বিষয়ে অবহিত হন এবং তাকে ক্রয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শেষ পর্যন্ত মহম্মদ ঘুরির অনুমতিক্রমে ইলতুৎমিসকে দিল্লিতে এনে কুতুবউদ্দিন ক্রয় করেন। নিজের রূপ, কর্মদক্ষতা ও বিশ্বস্ততা দ্বারা ইলতুৎমিস অল্পকালের মধ্যেই কুতুবউদ্দিনের মন জয় করে নেন। মুগ্ধ কুতুব নিজ কন্যাকে ইলতুৎমিসের হাতে অর্পণ করেন। খোক্কর উপজাতির বিদ্রোহ দমনের জন্য মহম্মদ ঘুরি যখন ভারতে আসেন, তখন ইলতুৎমিস তাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেন। ইলতুৎমিসের ব্যবহার ও কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ঘুরি তাঁকে ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। লক্ষণীয় যে, মহম্মদ ঘুরি তখনও তাঁকে প্রবীণ দাস কুবাচা, ইলদুজ বা কুতুবউদ্দিনকে ‘দাসত্ব- মুক্তির আদেশ দেননি। অর্থাৎ কুতুবউদ্দিনের আগেই ইলতুৎমিস একজন মুক্ত মানুষের অধিকার অর্জন করেছিলেন। মধ্যযুগের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা। কুতুবউদ্দিন কর্তৃক গজনি আক্রমণের সময়েও ইলতুৎমিস দক্ষতার পরিচয় দেন। এই কারণেই দিল্লির আমির-ওমরাহ কুতুবের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে ইলতুৎমিসকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।

ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, ইলতুৎমিসের ক্ষমতার উত্তরণ কোনো অলৌকিক ঘটনা ছিল না। তিনি ব্যক্তিগত প্রতিভা ও দক্ষতার দ্বারা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেনঃ “(He) rose to eminence by sheer dint of merit and it was solely by virtue of his fitness that he superceeded the hereditary claimants to the throne.” কোনো কোনো লেখক ইলতুৎমিসকে ‘অন্যায় দখলদার’ বলে নিন্দা করেছেন। কিন্তু ড. ত্রিপাঠী মনে করেন, সেই মুহূর্তে তুর্কি-সুলতানির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কুতুবউদ্দিনের সাম্রাজ্য তুর্কি আমির ও স্থানীয় রাজাদের দখলে চলে গিয়েছিল। তাই দখল করার প্রসঙ্গটাই অবান্তর। তা ছাড়া, নানা দিক থেকে ইলতুৎমিসই ছিলেন যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব। কারণ, 

  • (১) তুর্কি আমিরগণ তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, 

  • (২) তিনি ছিলেন দক্ষ সামরিক নেতা। ইসলামের নিয়মানুযায়ী সিংহাসনে যোগ্যতম ব্যক্তির অধিকার স্বীকৃত, 

  • (৩) তিনি ইতিপূর্বেই মহম্মদ ঘুরি কর্তৃক ‘দাসত্ব’ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন এবং 

  • (৪) বাগদাদের খলিফা তাঁকে সুলতান-ই-আজম উপাধি দ্বারা সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

ইলতুৎমিসের সমস্যা ও তার সমাধান :

সিংহাসনলাভের সঙ্গে সঙ্গে ইলতুৎমিসকে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত একাধিক সমস্যার সম্মুখীন। হতে হয়েছিল। সেই মুহূর্তে তাঁর তিন প্রধান শত্রু ছিলেন—গজনির শাসক তাজউদ্দিন ইলদুজ মুলতানের শাসক নাসিরউদ্দিন কুবাচা এবং বাংলাদেশের শাসক আলিমদান। ইলদুজ মহম্মদ ঘুরির উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘুরি-বিজিত ভারতীয় ভূখণ্ড দখলের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। মুলতান ও উচের শাসনকর্তা কুবাচা নিজেকে স্বাধীন শাসক রূপে ঘোষণা করে সমগ্র পাঞ্জাব দখলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং আলিমর্দান দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে এবং ‘সুলতান আলাউদ্দিন’ উপাধি গ্রহণ করে বাংলাদেশে স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। ইলতুৎমিসের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল,— হয় এদের দাবিসমূহ মেনে নেওয়া, কিংবা এদের দমন করা। প্রথম কাজটি করলে দিল্লি-সুলতানির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হত, আবার দ্বিতীয় কাজটি সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন ছিল ধৈর্য, বিচক্ষণতা এবং দক্ষতার সুষম সমন্বয়। ইলতুৎমিস দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিই গ্রহণ করেন এবং সাফল্যের সাথে তা সম্পন্ন করে শিশু দিল্লি সুলতানিকে সুদৃঢ় ভিত্তি দেন। এ ছাড়া গোয়ালিয়র, রণথম্ভোর-সহ কয়েকটি রাজপুত রাজ্য তুর্কি অধীনতামুক্ত হয়ে সুলতানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল। এমনকি কিছু তুর্কি-অভিজাতও (মুহজি, কুতবি) ইলতুৎমিসের অধীনতা মেনে নিতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। সর্বোপরি দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খাঁ সসৈন্যে ভারতের উত্তর সীমান্তে উপস্থিত হয়ে ইলতুৎমিসকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করেন। ইলতুৎমিস ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। তাঁর কর্মসুচির প্রেক্ষিতে ইলতুৎমিসের ছাব্বিশ বছরের শাসনকালকে তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা যায় : 

  • (১) ১২১০-২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় যখন তিনি নিজের রাষ্ট্রকর্তৃত্বের বিরুদ্ধে শক্তিগুলির মোকাবিলা করেন, 

  • (২) ১২২১-২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে তিনি চেঙ্গিজ খাঁর উপস্থিতি-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেন এবং 

  • (৩) ১২২৮ ৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল তিনি সাম্রাজ্য সংগঠনের কাজে ব্যয় করেন।

ইলতুৎমিস প্রথমেই দিল্লি, বদাউন, অযোধ্যা, বেনারস, শিবালিক প্রভৃতি অঞ্চলের বিদ্রোহী মুইজি ও কুতবি আমিরদের দমন করে ওই সকল অঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিমধ্যে খারিজম শাহ কর্তৃক গজনি অধিকৃত হলে গজনির শাসক ইলদুজ ভারতে প্রবেশ করেন এবং কুবাচাকে বিতাড়িত করে লাহোর দখল করে নেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত-ভূখণ্ডের ওপর ইলদুজের একটি দাবি ছিল। পাঞ্জাবে তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপিত হলে ইলতুৎমিসের অস্তিত্ব বিপন্ন হত। ইলতুৎমিস দ্রুত ইলদুজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এই সময় ইলদুজ এক পত্র মারফত ইলতুৎমিসকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনিই মুইজউদ্দিনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। প্রত্যুত্তরে ইলতুৎমিস বলেছিলেন, “সময় পাল্টেছে। চালু হয়েছে নতুন নিয়ম। গজনি ও ঘুরিবংশীয়দের ক্ষেত্রে কি ঘটেছে? বংশগত অধিকারের দিন চলে গেছে” (“Times have changed. There is a new order now: What was hapened to the Gaznivides and the Ghurids? The times of hereditary descent are over.”)| ইতিহাসখ্যাত তরাইনের যুদ্ধে (১২১৫-‘১৬ খ্রিঃ) ইলতুৎমিস ইলদুজকে পরাজিত করেন। বন্দি অবস্থায় তাঁকে বদাউনে এনে হত্যা করা হয়। ঐতিহাসিক নিজামী এই সাফল্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “এই বিজয় দুদিক থেকে ইলতুৎমিসের পক্ষে সুফলদায়ী ছিল। প্রথমত, এর মাধ্যমে তাঁর একজন বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাদখলের দৌড় থেকে অপসারিত হয়েছিল এবং দ্বিতীয়ত, ইলদুজের পরাজয়ের ফলে গজনির সাথে ইলতুৎমিসের সম্পর্কের বন্ধন সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়েছিল। এর ফলে দিলিতে গজনির খবরদারিমুক্ত স্বাধীন সুলতানির প্রতিষ্ঠা সহজ হয়েছিল” (“This was a double victory for Iltutmish: the removal of one of the most dangerous rivals to his power and the final break with Ghazni, which ensured an independent status for the kingdom of Delhi.”)

অতঃপর ইলতুৎমিস নাসিরউদ্দিন কুবাচার উচ্চকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীনতাস্পৃহা দমনে অগ্রসর হন। চিনাব নদীর নিকটে মনসুরার যুদ্ধে (১২১৭ খ্রিঃ) তিনি কুবাচাকে পরাজিত করে লাহোর দখল করেন। কুবাচা পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে যান। লাহোরের দায়িত্ব নিজ পুত্র নাসিরউদ্দিন মহম্মদের হাতে অর্পণ করেন। অবশ্য পরবর্তী এক দশকে কুবাচা সিন্ধু-অঞ্চলে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। খারিজ্ম শাহ মঙ্গবরণীর পশ্চাদ্ধাবন করে মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিজ খাঁ ভারতের সীমান্তে উপস্থিত হওয়ার কারণে ইলতুৎমিস ব্যস্ত হয়ে পড়লে কুবাচা আপাতত রক্ষা পেয়ে যান। যাই হোক, ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস উচ্ দখল করে কুবাচাকে রাজ্যচ্যুত করেন। ইলতুৎমিসের কাছে পরাজিত হয়ে পলায়নের সময় সম্ভবত সিন্ধুনদে ডুবে তিনি প্রাণ হারান।

মধ্য-এশিয়ার এক দুর্ধর্ষ জাতি হল মোঙ্গলগণ। এরা ছিল যেমন হিংস্র, বর্বর এবং রক্তপিপাসু, তেমনি সুদক্ষ যোদ্ধা। চেঙ্গিজ খাঁর নেতৃত্বে ত্রয়োদশ শতকে মোঙ্গলগণ অসামান্য শক্তির অধিকারী হয়। মোঙ্গলগণ ঝড়ের গতিতে পশ্চিম ও মধ্য-এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পদানত করে খরিজম রাজ্য আক্রমণ করে। খারিজম শাহ জালালউদ্দিন মঙ্গবরণী মোঙ্গলদের কাছে পরাজিত হয়ে পাঞ্জাবে চলে আসেন। খোক্কর উপজাতির সহায়তায় মঙ্গবরণী উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাব এবং মুলতান দখল করেন। কুবাচাকেই তিনি সিন্ধু থেকে বিতাড়িত করেন। অতঃপর তিনি দিল্লিতে থাকার জন্য ইলতুৎমিসের সাহায্য ও অনুমতি প্রার্থনা করেন। এদিকে মঙ্গবরণীকে অনুসরণ করে চেঙ্গিজও সিন্ধুর তীরে উপস্থিত হন এবং মঙ্গবরণীকে সমর্থন না করার জন্য ইলতুৎমিসকে অনুরোধ করেন। বিচক্ষণ ইলতুৎমিস যথার্থই উপলব্ধি করেন যে, মঙ্গবরণীকে আশ্রয় দিলে মোঙ্গলদের হাতে দিল্লি বিপর্যস্ত হবে। তাই তিনি মঙ্গবরণীকে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃত হন। অতঃপর চেঙ্গিজ খাঁ আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই মঙ্গবরণী পারস্যে চলে যান। সম্ভবত সেখানেই এক গুপ্তঘাতকের হাতে মঙ্গবরণী নিহত হন।

উত্তর ভারতের সমস্যায় বিব্রত ইলতুৎমিস পূর্ব ভারতের ব্যাপারে তাই নিস্পৃহ ছিলেন। এখন উত্তর ভারতে ক্ষমতা সংহত করার পর তিনি বাংলার দিকে নজর দেন। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আলিমর্দান বাংলায় স্বাধীন শাসন প্রবর্তন করেছিলেন। ইতিমধ্যে আলিমর্দানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হিসামউদ্দিন ইয়াজ ‘গিয়াসউদ্দিন ‘উপাধি নিয়ে বাংলার শাসন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজনামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং খুৎবা পাঠ করে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব জাহির করেন। ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস ইয়াজ-এর বিরুদ্ধে অভিযান পাঠালে ইয়াজ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেন। কিন্তু ইলতুৎমিস বাংলাদেশ ত্যাগ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইয়াজ বিহার দখল করে সুলতানের প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করেন। অতঃপর ইলতুৎমিসের নেতৃত্বে তাঁর পুত্র নাসিরউদ্দিন বাংলা আক্রমণ করে ইয়াজকে হত্যা করেন এবং বাংলাকে দিল্লি-সুলতানির অন্তর্ভুক্ত করেন (১২২৬ খ্রিঃ)। নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুর পর (১২২৯ খ্রিঃ) বাংলার খলজি মালিকগণ জনৈক বন্ধার নেতৃত্বে দিল্লির দ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইলতুৎমিস দ্রুত বাংলাদেশে উপস্থিত হয়ে বন্ধাকে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করেন এবং আধিপত্য সুরক্ষিত করেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজপুত রাজ্যগুলি তাদের হৃত রাজ্যাংশ পুনরুদ্ধারের জন্য সদা সচেষ্ট ছিল। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর দিল্লি-সুলতানির রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে অনেকগুলি রাজপুতগোষ্ঠী তাদের হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করে নিতে সক্ষম হয়। এইভাবে চান্দেল্লরা কালিঞ্জর ও অজয়গড় ; প্রতিহাররা গোয়ালিয়র, নারোর, ঝান্সী; রণথম্ভোরের চৌহানরা যোধপুর ও সন্নিহিত অঞ্চল; জালোরের চৌহানরা নাদোল, মন্দোর, ভারমার, সাঞ্চোর, ঘেরা, রাসসিন প্রভৃতি ; ভাট্টিরা উত্তর-আলোয়ার প্রভৃতি অঞ্চল তুর্কিদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। ইলতুৎমিসের পক্ষে এই ক্ষতি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তিনি উত্তর সীমান্তের সমস্যা সমাধান করে রাজপুত রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি একে একে গোয়ালিয়র, রণথম্ভোর, মাণ্ডু, বেয়ানা, আজমির প্রভৃতি স্থান পুনর্দখল করেন। তবে চান্দেল্ল, গুজরাটের চালুক্য এবং নাগদা’র রাজা ক্ষেত্র সিংহের বিরুদ্ধে ইলতুৎমিস সফল হতে পারেননি। ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মালব আক্রমণ করে ভিলসা ও উজ্জয়িনী ধ্বংস করেন। অবশ্য এসব স্থানের ওপর তিনি কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেননি। ইলতুৎমিসের শেষ অভিযান ছিল সিন্ধু-সাগর দোয়াব অঞ্চলের পার্বত্য রাজ্য বানিয়ানের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই অভিযানের মাঝপথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অসুস্থ অবস্থায় অভিযান অসমাপ্ত রেখে দিল্লি ফিরে আসেন। এর অল্পকালের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয় (২৯ এপ্রিল, ১২৩৬ খ্রিঃ)।

ইলতুৎমিসের কৃতিত্বের মূল্যায়ন :

দিল্লির সিংহাসনে ইলতুৎমিসের আরোহণের সাথে সাথে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় এবং তখন থেকেই প্রকৃত অর্থে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে। অধ্যাপক নিজামী লিখেছেন যে, “ইলতুৎমিস অদম্য উৎসাহ এবং যুক্তিনিষ্ঠ নির্দিষ্ট লক্ষ্যের সাহায্যে হিন্দুস্তানের অসংবদ্ধ ঘুর অঞ্চলকে সুগ্রথিত দিল্লির সুলতানি রাজ্যে পরিণত করেছিলেন।“বস্তুত ইলতুৎমিস ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে ক্রীতদাস হিসেবে কুতুবউদ্দিনের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং দু-দশকের কম সময়ের মধ্যেই ভারতস্থ তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত যোগ্যতার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। তিনি যখন সিংহাসনে বসেন, তখন কুতুবউদ্দিন কর্তৃক গঠিত সাম্রাজ্যের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। আরাম শাহের অপদার্থতার ফলে গোটা রাজ্যজুড়ে প্রকটিত হয়েছিল বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা। স্বজাতীয় ‘মুইজি’, ‘কুতবি’ মালিকবর্গ স্ব স্ব অঞ্চলে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। ভারতের রাজপুত গোষ্ঠীগুলি পুনর্দখল করেছিল তাদের হৃত রাজ্যখণ্ড। ইলদুজ, কুবাচা প্রমুখ উচ্চাভিলাষী এবং ঈর্ষান্বিত তুর্কিমালিক এবং চেঙ্গিজ খাঁ নামক দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতার আক্রমণ সম্ভাবনা এক বিরাট অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছিল দিল্লি-সুলতানির ভাগ্যরেখায়। এই বিরাট রাজনৈতিক আবর্তে ইলতুৎমিস ছিলেন একা। কিন্তু অদম্য মনোবল, বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের সাথে সামরিক দক্ষতা ও নেতৃপ্রতিভার সুষম মিলন ঘটিয়ে তিনি মাত্র ছাব্বিশ বছরের মধ্যে যে সুসংগঠিত রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তী ত্রিশ বছরে সেই রাজ্যের অস্তিত্বগত কোনো সংকট দেখা দেয়নি। বলা যায়, খলজি সুলতানদের গৌরবময় রাজত্বকালের ভিত্তি ইলতুৎমিস স্থাপন করে যান। ড. শ্রীবাস্তবের ভাষায় : “He laid the foundation of a military monarchy which reached a high watermark of despotism under the Khaljis.”

ড. হবিবউল্লাহ ইলতুৎমিসের সংগঠনী-প্রতিভার প্রশংসা করে লিখেছেন : “তিনি আইবকের অসমাপ্ত কাজ হাতে নিয়েছিলেন এবং চরম প্রতিকূলতা ও দুর্বল ভিত্তির ওপর গঠিত সেই রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দরকার ছিল গভীর কূটনৈতিক দক্ষতা। ইলতুৎমিসের সেই দক্ষতা ছিল। মোঙ্গল আক্রমণের সম্ভাবনা থেকে ভারতভূমিকে রক্ষা করার জন্য মধ্যযুগের ভারত তাঁর কাছে কম ঋণী নয়। তাঁর দৃঢ় এবং উদ্যমী কর্মসূচি বিচ্ছিন্নতা থেকে রাজ্যকে রক্ষা করেছিল। এই সুদক্ষ সংগঠক দিল্লি-সুলতানির শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করেন। তিনি যে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সূচনা করেন, তাকে ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে খলজিদের সামরিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।” ঐতিহাসিক ত্রিপাঠীও এই কারণে লিখেছেন : “The history of Muslim sovereignty in India begins properly speaking with Iltutmish.”

বাল্যকালে আপন আত্মীয়পরিজনের ষড়যন্ত্রে ভাগ্যবিড়ম্বিত এই সুদর্শন যুবক চরিত্রমাধুর্যে অনাত্মীয় প্রভুদের হৃদয় জয় করেছিলেন খুব সহজেই। তাই মহম্মদ ঘুরি তাঁর দাসের দাসকে প্রথমেই ‘দাসত্বমুক্ত’ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১২২৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বাগদাদের খলিফা তাঁকে ‘সুলতান ই-আজম’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং শিরোপা প্রদান করে বৈধ ও স্বীকৃত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেন। অধ্যাপক শর্মা (S. R. Sharma)-র মতে, “এই কারণে ইলতুৎমিসকে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা উচিত।”

ইলতুৎমিস সমর-দক্ষতা এবং রাষ্ট্রপ্রজ্ঞার দ্বারা কেবল বিদ্রোহদমন বা রাজ্যবিস্তার করেই থেমে যাননি; একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামো প্রবর্তনের দিকেও নজর দেন। এ কাজে তাঁর প্রধান সহায়ক ছিলেন বহিরাগত কিছু তুর্কি ক্রীতদাস এবং অ-তুর্কি মুসলমান। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন বলবন, শের খান এবং মালিক মহম্মদ জুনাইদ ও ফকরউদ্দিন ইসামী/ইলতুৎমিসের প্রশাসনে হিন্দুস্তানি মুসলমান নিয়োজিত ছিলেন কিনা জানা যায়নি। তবে স্থানীয় হিন্দুনায়েকরা আগের মতোই নিজ নিজ দায়িত্বে বহাল ছিলেন। শাসনের সুবিধার্থে তিনি গোটা সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ‘ইতায়’ বিভক্ত করেন। ইক্তার প্রশাসক অর্থাৎ ইতাদার নিজ অঞ্চলে রাজস্ব সংগ্রহ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন। স্থানীয় ব্যয় মেটানোর পর উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রে প্রেরণ করাও ছিল তাঁর প্রধান কর্তব্য। ইতাদারের নিয়োগ ও পদচ্যুতি ছিল সুলতানের ইচ্ছাধীন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ইলতুৎমিস দূরবর্তী অঞ্চলে সুলতানের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সক্ষম হন। নিজামীর ভাষায় : ” (He) used this institution as an instrument for liquidating the feudal order of Indian Society and linking up the far-flung parts of the empire to one centre. “ইলতুৎমিস প্রথম আরবীয় ধারায় ১৭৫ গ্রেনের রূপার মুদ্রা চালু করেন। খলিফার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত এই মুদ্রায় তিনি নিজেকে খলিফার সেনাপতি বলে উল্লেখ করেন।

শিল্প ও সাহিত্যের প্রতিও ইলতুৎমিসের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। মধ্যযুগের দিল্লি নগরীর প্রধান স্থপতি ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক নিজামীর ভাষায়: [lutmish was the real architect of the medieval Delhi….. Its minarates, mosques, madrasas, khanas and tanks rose into prominence under him….” ইলতুৎমিস কুতুবমিনার সৌধনির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, সুলতান কুতুবউদ্দিন বাগদাদের নিকটবর্তী উচের ধর্মগুরু খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী’র স্মৃতিরক্ষার্থে এই সৌধের কাজ শুরু করেছিলেন। অবশ্য উলসী হেগ (W. Haig) মনে করেন, ইলতুৎমিসের প্রভু কুতুবউদ্দিন আইবকের স্মৃতিরক্ষার্থেই এই সৌধের পরিকল্পনা। মিনাজউদ্দিন, ইসামী প্রমুখের রচনা থেকে বোঝা যায় যে, কৈশোরে ইলতুৎমিস কিছুদিন বাগদাদে অতিবাহিত করেছিলেন। এখানে তিনি সেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দী, শেখ আহাদুদ্দিন কিরমানী প্রমুখ মিস্টিক (Mystic) সত্তের সস্পর্শে আসেন এবং প্রভাবিত হন। সমকালীন প্রখ্যাত পণ্ডিত মিনহাজ-উস-সিরাজ, হাসান নিজামী, মহম্মদ আউফি, নুরউদ্দিন প্রমুখ ইলতুৎমিসের সভা অলংকৃত করেছিলেন।

অবশ্য নিজে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও, ধর্মীয় উদারতার অভাব ছিল তাঁর চরিত্রে। নিজে সুন্নি মুসলমান ছিলেন, তাই শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি ছিলেন খুব কঠোর। হিন্দুদের প্রতিও তিনি অনুদার ছিলেন। অ-সুন্নি মুসলমান বা হিন্দুদের ধ্বংসসাধনের একটা বাসনাও তাঁর ছিল। অবশ্য মধ্যযুগীয় পরিস্থিতিতে এরূপ পরধর্মসহিষ্ণুতার অভাব খুব আশ্চর্যজনক বা নিন্দনীয় বিষয় ছিল না।

যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ইলতুৎমিস দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে বশীভূত করে নবগঠিত সুলতানি সাম্রাজ্যকে একটি প্রশাসনিক পরিকাঠামোর মধ্যে স্থাপন করে যে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছিলেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকেরা যেমন ইলতুৎমিসকে দিল্লি সুলতানির ‘প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, তেমনি কেউ কেউ তাঁকে ‘আদিপর্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

স্যার উলসী হেগ লিখেছেন: “তিনি ছিলেন সমস্ত দাস-সুলতানের মধ্যে সর্বোত্তম।” ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন : “Illtutmish may justly be regarded as the greatest ruler of the early Turkish Sultanate of Delhi which lasted till 1290 A.D.” কিন্তু ঐতিহাসিক শৰ্মা (S.R Sharma) মনে করেন, অর্জিত কৃতিত্বের নিরিখে ইলতুৎমিসকে দিল্লি সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়; কিন্তু সর্বোত্তম সুলতান বলা যথার্থ নয়। তাঁর ভাষায়: “It is too much an exaggeration to call him the greatest of all slave kings.”

ড. হবিবউল্লাহও মনে করেন, “ইলতুৎমিসকে দক্ষ শাসক বলা চলে, কিন্তু মহান শাসক বলা যথার্থ নয়।” অবশ্য বৈধ সুলতান হিসেবে তাঁর অস্তিত্ব হবিবউল্লাহ স্বীকার করেন। তিনি লিখেছেন : “Aibak outlined the Delhi Sultanate and its sovereign status ; Illtutmish was unquestionably its king.” যাই হোক্, ইলতুৎমিস আদিপর্বের শ্রেষ্ঠতম সুলতান ছিলেন কিনা—পণ্ডিতদের এই কূট বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও আমরা একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, তিনি আদিপর্বের শুধু নয়, দিল্লির সুলতানদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।