ইবন বতুতা (১৩০৪-১৩৭৮ খ্রিঃ):

ভারত-ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সুপ্রাচীন কাল থেকে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ ভারতভূমিতে উপস্থিত হয়েছেন এই সংস্কৃতির পীঠভূমির দুর্বার টানে। এঁদের অনেকেই অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন সৃষ্টির আনন্দে। ইতিহাসগত উপাদানে ভরপুর অতি নির্ভরযোগ্য একটি ভ্রমণ-বৃত্তান্ত হল ইবন বতুতার ‘কিতাব-ই-রেহালা’। হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে গজনি ও কাবুল হয়ে ইবন বতুতা ভারতে প্রবেশ করেন (১৩৩৩-১৩৪৭ খ্রিঃ)। তখন দিল্লির সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক। সুলতান তাঁকে দিল্লির কাজি হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রায় আট বছর তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। ফলে প্রশাসনের খবরাখবর সরাসরি সংগ্রহ করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল। সুলতানের সাথে সামরিক অভিযানেও ইবন বতুতা মাঝেমধ্যে অংশ নিতেন। ফলে যুদ্ধরত দেশগুলির শাসনপদ্ধতি, আর্থসামাজিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর জানার সুযোগ হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে সুলতানের সাথে মেলামেশার ফলে মহম্মদ তুঘলকের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে তিনি ‘রেহলা’ গ্রন্থে যথেষ্ট আলোকপাত করতে পেরেছেন। কে. এম. আশরাফের মতে, বিদেশিদের অন্যান্য বিবরণের তুলনায় ইবন বতুতার লিখিত বিবরণই সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ। বস্তুত তাঁর আগে বা পরে কোনো বিদেশিই সমুদ্র উপকূল থেকে দূরবর্তী দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা কিংবা দীর্ঘদিন বসবাস করার সাহস দেখাননি। আশরাফের মতে, ইবন বতুতা প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর মেলামেশায় পরিধি যেমন ছিল ব্যাপক, তেমনি আন্তরিকতাও ছিল গভীর। সুতরাং তাঁর দেওয়া বিবরণ হিন্দুস্তানের তৎকালীন জীবনের জীবন্ত ছবি।

ইবন বতুতা বাংলাদেশেও (বঙ্গ) এসেছিলেন। তাঁর বিবরণী থেকে বঙ্গদেশের আর্থিক সমৃদ্ধি ও জনগণের সুখী ও সচ্ছল জীবনধারার কথা জানা যায়। তখন বাংলায় অতি সস্তায় প্রচুর খাদ্যশস্য পাওয়া যেত। তবে তিনি বাংলার আবহাওয়ার সমালোচনা করেছেন। বাংলার অতিরিক্ত বর্ষণ ও স্যাঁতসেতে আবহাওয়া তাঁর পছন্দ হয়নি। একদিকে আর্থিক সচ্ছলতা, অন্যদিকে বসবাসের অযোগ্য পরিবেশ—এই কারণে তিনি বাংলাকে ‘দোজখ-পুর-ই-নিয়ামত’ অর্থাৎ ‘উত্তম জিনিসে পূর্ণ নরক’ বলে উল্লেখ করেছেন। ইবন বতুতা লিখেছেন যে, তাঁর বিবরণীতে এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে, যা সাধারণের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হবে। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন যে, এই গ্রন্থের বিবরণী সম্পূর্ণ সত্য। এই দাবির যৌক্তিকতা পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। কারণ তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা পর্যটক, ভারতীয় শাসকদের অনুগ্রহের প্রতি যেমন তাঁর লোভ ছিল না, তেমনি রাজনৈতিক নিগ্রহকেও তিনি ভয় করতেন না। অবশ্য ফারসি বা হিন্দি ভাষায় তাঁর দখল ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে মনগড়া কথা লিখতে হয়েছে। সাধুসন্তদের অলৌকিক ক্ষমতার ওপর তাঁর গভীর আস্থা ছিল, যা ঐতিহাসিকের নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা বাধাস্বরূপ ছিল। ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ বা শ্রবণ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কোনো মন্তব্য বা বিবরণ লিখে রাখতেন না। ফলে প্রক্ষিপ্তকরণের সম্ভাবনা ছিল। আবার কিছু কিছু ভুল তথ্য তিনি হাস্যকরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। যেমন—তিনি লিখেছেন যে, সুলতান কায়কোবাদ কুতুবমিনার নির্মাণ করেছেন এবং এই মিনারের চূড়া পর্যন্ত যে প্যাঁচানো সিঁড়িপথ আছে, তা ছিল হাতি চলাচলের মতোই চওড়া। এটুকু সীমাবদ্ধতা ছাড়া রেহলা’ গ্রন্থের ইতিহাসগত মূল্য অপরিসীম।

অন্যান্য : ইতালির পর্যটক মার্কোপোলো জলপথে চিন থেকে পারস্যে যাওয়ার সময় ভারতে আসেন। ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে তিনি দক্ষিণের করমণ্ডল উপকূলে অবতরণ করেন। দক্ষিণ ভারতের করমণ্ডল উপকূল, পাণ্ড্যরাজ্য এবং মালাবার, গুজরাট, সিংহল ইত্যাদি স্থান ঘুরে পারস্যের পথে এগিয়ে যান। জেনোয়ায় যুদ্ধবন্দি থাকাকালে তিনি এক সহচরের কাছে তাঁর ভ্রমণ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। ইউল (Yule) মার্কোপোলোর বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেন। এই বিবরণী থেকে সমসাময়িক দক্ষিণ ভারতের নানা কথা জানা যায়।

দক্ষিণ ভারতের হিন্দুরাজ্য বিজয়নগরের ইতিহাসের প্রধান উপাদানই হল বিদেশি পর্যটক ও দূতদের বিবরণ। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে একাধিক পর্যটক ও দূত এই রাজ্য আসেন ও অবস্থান করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইতালীয় পর্যটক নিকোলো কন্টি, পারসিক দূত রেজ্জাক (কামালউদ্দিন), পোর্তুগিজ পর্যটক ডোমিনিগো পায়েজ, ফেরনাও নুনিজ, বারবোসা, আলবুকার্ক প্রমুখ। রাজদরবার ও রাজার সাথে এঁদের অনেকেরই খানিকটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। ফলে রাজনীতির উত্থানপতন ও জনগণের আর্থিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে এঁদের পরিচয়ের সুযোগ এসেছিল। তাই দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি ও সমাজজীবন সম্পর্কে এঁদের বিবরণী প্রথম শ্রেণির সূত্র সরবরাহ করে। খুরাসানের সুলতান শাহরুখ খানের দূত রূপে আব্দুর রেজ্জাক বিজয়নগরে আসেন এবং প্রায় দু-বছর (১৪৪২-৪৩ খ্রিঃ) দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করেন। মধ্য-এশিয়া সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটি হল ‘মাতলাউস-সাদাইন-ওয়া-মাজসুল-বাহরিন’ অর্থাৎ ‘দুটি সৌভাগ্যের গ্রহের উত্থান এবং দুই সমুদ্রে মিলন’। দুই খণ্ডে লিখিত এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে লেখক অন্যান্য বিষয়ের সাথে তৈমুর লঙ-এর ভারত আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। দ্বিতীয় খণ্ডে তৈমুরের বংশধরদের কীর্তিকলাপের পাশাপাশি বিজয়নগর রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা, রাজপরিবারের ব্যক্তিগত জীবনধারা এবং দক্ষিণ ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত বিজনয়গর রাজ্যের ইতিহাসচর্চার প্রাথমিক উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। ভেনেসীয় (ইতালি) পর্যটক নিকোলো-ডি-কন্টি দেশভ্রমণের নেশায় বহু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ভারত, সিংহল, সুমাত্রা, চিন প্রভৃতি বহু রাজ্য পর্যটন করেন। তাঁর প্রাচ্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পোপের সচিব পোজিও ব্রাসিওলিনি ল্যাটিন ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দক্ষিণ ভারতের নানাস্থান পরিভ্রমণ করেন। এই বৃত্তান্ত থেকে বিজয়নগর রাজদরবার ও দক্ষিণ ভারতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি জানা যায়।

মূলত মুসলমান ঐতিহাসিক এবং বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ মধ্যযুগের নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনায় উপাদান হিসেবে কতটা নির্ভরযোগ্য—এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিশেষ করে লেখকদের অধিকাংশই যখন একটা বিশেষ ধর্মের অনুসারী এবং দরবারের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য হয়ে জীবনযাপন করছিলেন, তখন এ সংশয় স্বাভাবিক। তা ছাড়া লেখকদের ব্যক্তিগত ক্রোধ এবং ধর্মান্ধতা তাদের নিরপেক্ষতাকে অনেকক্ষেত্রেই সন্দেহপূর্ণ করে তুলেছে। এ প্রসঙ্গে কে. এম. আশরাফ লিখেছেন, “মুসলিম ঐতিহাসিক বা সাহিত্যসেবীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে হিন্দু সমাজজীবনের বিকৃত ছবি উপস্থিত করেছেন—এ ধারণা ভুল।.. মুসলমানদের মধ্যে ঐতিহাসিক রচনার সুস্থ ক্রমবিকাশের এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য চলে আসছিল এবং গোঁড়া মতাবলম্বী ঐতিহাসিকদের রচনাতেও বুদ্ধিগত সততার দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে।” তবে সমকালীন লেখকদের অন্যধরনের কিছু ত্রুটি ছিল বলে তিনি মনে করেন। যেমন তাঁদের লেখনী প্রধানত রাজদরবার, অভিজাতবর্গ, শহর এবং ধর্মীয় বিষয়বস্তুতে সীমাবদ্ধ ছিল। ‘মুসলিম-রচিত’ ইতিহাসে সামাজিক বিষয় খুব কমই আলোচিত হয়েছে। সাধারণ হিন্দুসমাজ সম্পর্কে কিছু জানতে বা জানাতে তাঁদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এমনকি নিম্নবর্গীয় মুসলমানদের জীবনধারা সম্পর্কেও তাঁরা উদাসীন ছিলেন। রাজপুত-সংস্কৃতির প্রকাশ-বিমুখতা এই সীমাবদ্ধতাকে আরও প্রকট করেছে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারও ‘Delhi Sultanate” গ্রন্থে মুসলমান লেখকদের এই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগুলিই ছিল সমকালীন ইতিহাসের একমাত্র উপাদান।

আরাম শাহ (১২১০ খ্রিঃ) :

কুতুবউদ্দনের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নে একটা জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় তুর্কি আমির ও মালিকগণ জনৈক আরাম বক্সকে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। লাহোরে আরাম বক্স ‘শাহ’ উপাধি নিয়ে শাসন শুরু করেন। আরাম শাহর পরিচয় সম্পর্কে বিভ্রান্তি আছে। অনেকেই এঁকে কুতুবউদ্দিনের পুত্র বলে মনে করেন। কিন্তু আতামালিক জুয়াইনি ‘তারিখ-ই-জাহান সুমা’ গ্রন্থে পরিষ্কার বলেছেন যে, কুতুবের তিন জন কন্যাসন্তান ছিল, কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। সম্ভবত শূন্য সিংহাসনকে কেন্দ্র করে যে-কোনো গোলযোগের সম্ভাবনা দূর করার জন্যই আরাম শাহকে সিংহাসন দেওয়া হয়েছিল। নিজামী (K. A. Nizami) তাই লিখেছেনঃ “It was availability rather than eminence or competence which led the Turkish officers stationed at Lahore to raise Aram to the throne.” যাই হোক, আরাম শাহের অপদার্থতার সুযোগে দেশের বিভিন্ন অংশে কর্মরত তুর্কি-আমিররা নিজ নিজ অঞ্চলকে মুলতানির কর্তৃত্বমুক্ত ঘোষণা করে স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করেন। কুবাচা উচ, মুলতান ছাড়াও ভাঞ্জার, শিউরান দখল করেন। বাংলায় খলজি মালিকরা বিদ্রোহী হয় এবং কিছু কিছু রাজপুত রাজাও তুর্কিদের অধীনতা থেকে তাদের হৃত রাজ্যাংশ পুনর্দখল করে নেয়।

এমতাবস্থায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন তুর্কি অভিজাতগণ বদাউনের শাসনকর্তা সামউদ্দিন ইলতুৎমিসকে সিংহাসন দখলের জন্য আহ্বান জানান। ইলতুৎমিসও সিংহাসন দখলে আগ্রহী ছিলেন। তা ছাড়া কুতুবউদ্দিনের জামাতা হিসেবে সিংহাসনের ওপর তাঁর একটা বৈধ দাবিও ছিল। ইতিপূর্বেই মহম্মদ ঘুরি তাঁকে দাসত্ব-বন্ধন থেকে মুক্তি দেবার ফলে সিংহাসন দখলের ব্যাপারে আইনগত বাধাও ছিল না। যাই হোক, ইলতুৎমিস সসৈন্যে দিল্লিতে উপস্থিত হয়ে নিজেকে ‘সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন। আরাম শাহ সামান্য অনুচরসহ তাঁকে বাধা দেবার একটা চেষ্টাও করেন। কিন্তু ‘জুদ’ নামক স্থানে ইলতুৎমিস আরাম শাহকে পরাজিত ও হত্যা করে সিংহাসন কণ্টকমুক্ত করেন। অধ্যাপক নিজামীর মতে, আরাম শাহ আট মাসের বেশি সিংহাসনে আসীন ছিলেন না।

রুকন্‌উদ্দিন ফিরোজ (১২৩৬ খ্রিঃ) :

১২২৯ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিসের জীবনে একাধারে আনন্দ ও বেদনার কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কারণ ওই বছরে তিনি মহান খলিফার অনুমোদন ও শিরোপা অর্জন করে দিল্লিতে স্বাধীন সুলতানির সূচনা করার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু একই বছরে তাঁর প্রিয়তম পুত্র নাসিরউদ্দিন মহম্মদের মৃত্যু ঘটার ফলে তাঁর ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও পরিকল্পনা অনিশ্চিত হয়ে যায়। কারণ ইলতুৎমিস তাঁর এই সুযোগ্য পুত্রকেই নিজের উত্তরাধিকারী রূপে মনোনীত করে রেখেছিলেন। তাঁর অন্যান্য পুত্ররা ছিলেন অলস, ভীরু এবং অপদার্থ। এমতাবস্থায় ইলতুৎমিস নিজকন্যা রাজিয়াকে পরবর্তী সুলতান হিসেবে মনোনীত করেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তটি ছিল অভিনব। কারণ রাজসিংহাসনে কোনো নারীর মনোনয়নের অভিজ্ঞতা কোনো তুর্কি আমিরের ছিল না। তা ছাড়া, একজন নারীর কাছে মাথানত করা বা তাঁর আদেশ পালন করা তাদের পৌরুষে আঘাত করছিল। তাই তাঁরা ইলতুৎমিসকে তাঁর অন্যান্য জীবিত পুত্রদের যে-কোনো একজনের পক্ষে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ইলতুৎমিস তাঁর পুত্রদের অযোগ্যতা সম্পর্কে এত নিশ্চিত ছিলেন যে, তুর্কি আমিরদের অনুরোধের প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন : “আমার মৃত্যুর পর সবাই উপলব্ধি করতে পারবে যে, আমার পুত্ররা কেউই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে কন্যা রাজিয়ার থেকে যোগ্যতর নয়।” (“Ater my death it will be seen that no one of them will be found more worthy of the heir-apparentship that she-my daughter.”) মুদ্রায় নিজনামের পাশে রাজিয়ার নাম খোদাই করে ইলতুৎমিস তাঁর সিদ্ধান্তকে আইনগত ভিত্তি দেবারও চেষ্টা করেন। এতদসত্ত্বেও ইলতুৎমিসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমির মালিকগণ রাজিয়ার দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইলতুৎমিসের জ্যেষ্ঠ পুত্র রুকন্‌উদ্দিন ফিরোজ শাহ’কে সুলতান পদে মনোনীত করেন (১২৩৬ খ্রিঃ)।

রুকন্‌উদ্দিন সিংহাসনে বসেই প্রমাণ করে দেন, তাঁর পিতার মূল্যায়ন কতটা সঠিক ছিল। অচিরেই তিনি গা ভাসিয়ে দেন বিলাস-বৈভব আর আমোদ-প্রমোদে। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হন তাঁর মা শাহ তুর্কান। উচ্চাকাঙ্ক্ষিণী ও হীনমনা এই মহিলা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ক্ষমতার দত্তে আত্মহারা হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপক অপপ্রয়োগ শুরু করেন। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সত্বর। রুকনউদ্দিনের অন্য ভ্রাতা তথা আযোধ্যার গভর্নর গিয়াসউদ্দিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। একে একে মুলতান, লাহোর, হালী, বদাউনের শাসনকর্তারাও দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করেন। নিরুপায় তুর্কি আমিরগণ তখন রাজিয়াকেই সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী আমিরদের সহায়তায় রাজিয়া শাহ তুর্কানকে বন্দি করে রুকনউদ্দিনকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। (১২৩৬ খ্রিঃ)।

প্রত্নতত্ত্ব :

ইতিহাসের উপাদান হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস প্রধানত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যযুগীয় ভারত-ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব কম নয়। তামা বা পাথরের ওপর উৎকীর্ণ লিপি (Epigraph) এবং মুদ্রা (Coin) সমকালীন শাসক বংশের ধারাবাহিকতা, রাজ্যের বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশেষত বিভিন্ন রাজ্যের শাসনকালের সন, তারিখ জানার ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী। ‘Epigraphica Indo Moslemica Epigraphica Indica’ প্রভৃতি অ্যালবামে মধ্যযুগীয় বহু লিপি ও মুদ্রার ছবি সংকলিত আছে। এগুলি বিশ্লেষণ করে এবং জাদুঘরে রক্ষিত কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখে পণ্ডিতেরা সমসাময়িক ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করতে পারেন। মুদ্রার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ লেনপুল (Lanepool) লিখেছেনঃ “As a rule we may look upon Muhammadan coins as the surest foundation for an exact history of the dynasties by which they were issued.” তিনি লিখেছেন, “এই মুদ্রাগুলি থেকে নির্দিষ্ট কোনো সুলতানের রাজত্বকাল সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনি তাঁর সিংহাসনে আরোহণের বছর, তাঁর রাজ্যসীমা, প্রতিবেশী রাজ্যের সাথে তাঁর সম্পর্ক, তাঁর ধর্মদর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।”

প্রসঙ্গক্রমে সমকালীন শিল্পস্থাপত্যের অবদানও উল্লেখের দাবি রাখে। সুলতানি আমলে বহু প্রাসাদ, মসজিদ, দুর্গ ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। কালের গ্রাস উপেক্ষা করে তাদের অনেকগুলি আজও দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের নির্বাক প্রতীক হিসেবে। সমকালীন সুলতানদের শিল্পভাবনা, শিল্পীদের দক্ষতা এবং সংস্কৃতির ধারা সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এই সকল নিদর্শনের ইতিহাসগত গুরুত্ব অসীম।