প্রশ্নঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে ইবনে খালদুনের অবদান মূল্যায়ন কর।

অথবা, ‘ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।’ উক্তিটি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলােতে যে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা প্রবহমান ছিল তা নিঃসন্দেহে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরবজনক অধ্যায়গুলাের অন্যতম বলে বিবেচিত হতাে। একদল যুক্তিবাদী মননশীল ব্যক্তি নিজেদের উদ্যোগে চিন্তার জগতে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করেন। অতীতের এই গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায় ও হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের হিসাব-নিকাশ করতে গেলে যে অমর ব্যক্তির কীর্তিসৌধ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তিনি হলেন সমাজবিজ্ঞানের সত্যিকার জনক বলে খ্যাত প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুন।

জন্ম ও পরিচিতিঃ সর্বকালের স্মরণীয় প্রতিভা ও ঐতিহাসিক দর্শনের জনক ইবনে খালদুন ১৩৩২ সালের ২৭ মে তিউনিসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরাে নাম ওলীউদ্দিন আবু যায়েদ আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ খালদুন আল হায়রামী। ‘ওলীউদ্দিন’ তার পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাপ্ত উপাধি। তিনি পারিবারিকভাবে ইবনে খালদুন নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। যিনি ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন।

সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশে ইবনে খালদুনের অবদানঃ সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে ইবনে খালদুনের অবদান অপরিসীম। নিম্নে তা তুলে ধরা হলােঃ

(১) আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাঃ ইবনে খালদুন সর্বপ্রথম আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজবিজ্ঞান যখন কেবল একটা অস্পষ্ট বিষয় এবং কিছুটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল, তখন তিনিই প্রথম ‘উমরান’ ধারণা ব্যবহার করে। মানুষের সমাজ ও তার সভ্যতা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অর্জিত উন্নতিকে এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেন।

(২) সমাজের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণঃ ইবনে খালদুন সেই মননশীল ব্যক্তি, যিনি সমাজকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আওতায় এনে উন্নত করার চেষ্টা করেছিলেন। সমাজকে এক বিশেষ পঠন-পাঠনের বিষয়বস্তু বিবেচনা করে ইবনে খালদুন সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় বিশ্লেষণ করেছেন।

(৩) সমাজের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানঃ ইবনে খালদুন বিশ্বাস করতেন যে, সমাজের সত্যিকার অবস্থা সম্পন্ন জ্ঞান অভিজ্ঞতালব্ধ হতে হবে এবং প্রতিটি সংস্কার বা পরিবর্তনের ভিত্তি হতে হবে সামাজিক ঘটনার বাস্তবতার ওপর নির্মম এই প্রথমবারের মতাে তিনি সমাজকে নিয়ে এসেছেন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কাছে।

(৪) আল-মুকাদ্দিমা রচনাঃ সাধারণ সমাজবিজ্ঞান বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হলাে ‘আল-মুকাদ্দিমা’ (The Prolegomena) বা “সর্বজনীন ইতিহাসের ভূমিকা’। এই মুকাদ্দিমাই ইবনে খালদুনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

(৫) সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের যােগসূত্র স্থাপনঃ ইবনে খালদুন তার ‘কিতাবুল ইবরার’ গ্রন্থের ভূমিকা আল-মুকাদ্দিমাতে সমাজ-সভ্যতা ও ইতিহাসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এদের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপনের প্রয়াস পান।

(৬) সামাজিক সংহতির ধারণাঃ সামাজিক চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনের সবচেয়ে চমকপ্রদ ও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য অবদান হলাে ‘আসাবিয়া’ তথা সামাজিক সংহতির ধারণা। তিনি মনে করেন সামাজিক সংহতি তথা গােত্রপ্রীতির শক্তি যে পরিমাণে সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় হয়েছে, সভ্যতা বিনির্মাণে তার প্রভাবও হয়েছে তত স্থায়ী।

(৭) সামাজিক পরিবর্তনের ধারণাঃ ইবনে খালদুন বিশ্বাস করেন যে, সমাজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, তা সদা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন ঘড়ির কাটার নিয়ম মেনে চলে। বেড়ে ওঠা, উন্নতির দিকে ধাবমান ও ধ্বংস এভাবেই সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজের এই পরিবর্তনের শক্তি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

(৮) ক্রমবিবর্তনের ধারাঃ ইবনে খালদুন সমাজকে দেখেছেন জীবন্ত বস্তুর মতাে, যেখানে ক্রমবিবর্তন কাজ করে চলেছে। তার মতে, রাষ্ট্রেরও জীবন চলতে থাকে ব্যক্তির মতাে, যৌবন, বার্ধক্য, অধঃপতন ও অবশেষে মৃত্যু। ইবনে খালদুনের এই ধারণাই পরবর্তীকালে স্পেনসারসহ অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীর লেখায় পাওয়া যায়।

(৯) “বাদওয়া’ ও ‘হারদা’ ধারণার জন্মঃ ইবনে খালদুন ‘বাদওয়া’ ও ‘হারদা’ ধারণা দুটির জন্ম দেন। আর এর ফলেই সমাজবিজ্ঞানের বিশেষ দুটি ধারা- ‘গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান’ ও ‘শহুরে সমাজবিজ্ঞানের’ ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছিল।

(১০) দার্শনিক মতবাদঃ মুকাদ্দিমায় কয়েকটি বিক্ষিপ্ত খণ্ডে রচিত যুক্তিবিজ্ঞান ‘দ্বান্দ্বিকবাদ’, ‘দর্শনের বিপদ ও অনুপত্তিসমূহ’, ‘অধিবিদ্যা’ প্রভৃতি শিরােনাম থেকে ইবনে খালদুনের দার্শনিক মতবাদ ও দর্শন সম্বন্ধে তার মনােভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি জানা যেতে পারে। ইবনে খালদুন যুক্তিবিদ্যার ভূমিকাকে অত্যন্ত গৌণ মনে করেছেন। তিনি যুক্তিবিদ্যাকে কেবল সহায়ক বিদ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

(১১) রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বঃ তিনি রাষ্ট্র প্রক্রিয়া থেকে চলতে চাচ্ছেন, সব সংগতির সর্বোচ্চ প্রকাশ হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। এখানে তিনি যে কথাটি বলতে চাচ্ছেন তা নিয়ম-কানুন দ্বারা পরিচালিত এবং বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা তা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সভ্য সমাজে আইন রয়েছে কিন্তু গােত্রবদ্ধ কিছু অনুশাসনের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।

(১২) আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে ইবনে খালদুনের মতামতঃ সমাজবিজ্ঞানের সূত্র ধরে ইবনে খালদুন বলেছেন যেকোনাে দেশের সমাজ রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর সে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগােলিক অবস্থানের প্রভাব বিদ্যমান। তিনি এ সম্পর্কে বলেন- পৃথিবীর যে অংশ নাতিশীতােষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত সেখানে প্রধান প্রধান বিজ্ঞান ও কলার উদ্ভব হয়। এজন্যই ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যক্তিগণ সেখানে জন্মলাভ করেছেন।

(১৩) ইবনে খালদুনের তত্ত্বগত পর্যালােচনাঃ ইবনে খালদুন যে তত্ত্বটি প্রদান করেছেন তার মধ্যে সূক্ষ্মভাবে হলেও চক্রকারের একটি তথ্য প্রদান করেছেন। একটি রাষ্ট্র থাকলে তার স্বাভাবিক পরিবর্তন রয়েছে। এ ছাড়াও আরােকিছু কারণও তিনি নির্দেশ করেন। ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের মাত্রাকে তিনি কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। সাধারণত সাম্রাজ্য বিস্তৃতির মাধ্যমে এটা সূচিত হয়েছে অথবা কখনাে কখনাে শাসনের কারণে। অনেক সময় অত্যধিক শাসনের ফলে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় বলে মনে করেন। যদি আসাবিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে কেন্দ্রের মাধ্যমে সবল করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কেন্দ্রিকরণ প্রক্রিয়ার সাথে বিলাসের একটা সম্পর্ক রয়েছে। সাম্রাজ্য বিস্তৃতির সাথে আমলাতন্ত্রের একটা সম্পর্কও দেখতে পাওয়া যায়।

পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, ইবনে খালদুন সামাজের প্রত্যেকটি দিককে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রত্যক্ষ করতে চেষ্টা করেছেন। সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন দিক থেকে সমাজকে পর্যবেক্ষণ, এর গতি-প্রকৃতি, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং এর ক্রমবিকাশের নিয়মগুলাে পর্যালােচনা করে এই সত্য তিনি উদ্ভাবন করেন। তিনি সমাজবিজ্ঞানকে একটি বিজ্ঞান হিসেবে দেখেছেন এবং প্রমাণ করেছেন। এ জন্য তাকে খুব সহজেই সমাজবিজ্ঞানের উদ্গাতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তাই বলা যায়, সমাজ ও ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ইবনে খালদুনকে সমাজবিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।