ইতিহাস কথার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল অনুসন্ধানের মাধ্যমে শিক্ষালাভ।
প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রধান হাতিয়ারগুলি ছিল পাথরের তৈরি মুগুর, কাটারি, হাত-কুঠার, বর্শা, তিরধনুক, বল্লম, সূচ প্রভৃতি। মধ্য প্রস্তর যুগের প্রধান হাতিয়ারগুলি ছিল কুঠার, ছুরি, তির-ধনুক প্রভৃতি। নব্য প্রস্তর যুগের প্রধান হাতিয়ারগুলি। বাটালি, কোদাল, লাঙল, জোয়াল, বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি।
খাদ্য সংগ্রহকারী প্রাচীন প্রস্তর যুগ ও খাদ্য উৎপাদনকারী নব্য প্রস্তর যুগের মধ্যবর্তী সময়কে মধ্য প্রস্তর যুগ বলে। ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা হল মেহেরগড় সভ্যতা।
লিখিত বিবরণের পূর্বে, কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, তা হল প্রাক্ ইতিহাস বা ‘প্রি-হিস্ট্রি।
ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ পল তুর্নাল দক্ষিণ ফ্রান্সের গুহায় প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনগুলির বিবরণ দিতে গিয়ে ১৮৩০-এর দশকে সর্বপ্রথম ‘প্রাক্-ইতিহাস’ কথাটি ব্যবহার করেন।
প্রাক্-ইতিহাস পুনর্নির্মাণের উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম হল—বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, ধ্বংসাবশেষ, সমাধিক্ষেত্র, মানুষের বাসভূমি ইত্যাদি।
প্রাক্-ইতিহাস শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ইতিহাসের প্রাক্কালে বা ইতিহাসের আগে।
রাজনীতির বিবর্তন—শাসনতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা (History-11 Short Q&A)
রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং এর উপাদান (History-11 Short Q&A)
অর্থনীতির বিভিন্ন দিক (History-11 Short Q&A)
সামাজিক ঘটনাস্রোত (History-11 Short Q&A)
দিগন্তের প্রসার (History-11 Short Q&A)
প্রত্নতত্ত্ববিদগণ প্রাক্-ঐতিহাসিক যুগকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই তিনটি যুগ হল- [1] পুরাপ্রস্তর বা প্রাচীন প্রস্তর বা প্রত্নাশ্মীয় যুগ (Palaeolithic Age), [2] মধ্য প্রস্তর বা মধ্যাশ্মীয় বা ক্ষুদ্রাশ্মীয় যুগ (Mesolithic Age), [3] নব্য প্রস্তর বা নবাশ্মীয় যুগ (Neolithic Age)।
ভারতের ক্ষেত্রে প্রাক্ইতিহাস পর্বের সময়কাল ছিল ২০ লক্ষ বছর আগে থেকে সিন্ধু সভ্যতার প্রাক্কাল পর্যন্ত।
প্রাক্-ঐতিহাসিক ভারতের বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরার মূল উৎস হল—অলিখিত বাস্তব কিছু নিদর্শন বা মানুষের তৈরি জড়বস্তুসমূহ। এক্ষেত্রে কয়েকটি উপাদান হল—পাথরের হাতিয়ার, জীবাশ্ম (Fossil), নরকঙ্কাল প্রভৃতি।
প্রাক্-ইতিহাস পর্বে পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষের ধারণা ছিল অস্পষ্ট। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনাকে প্রাকৃতিক শক্তিরূপে দেবতা জ্ঞানে তারা পূজা করত।
মৃতদেহকে সমাহিত করার সময় প্রাক্-ঐতিহাসিক মানুষ মৃতের ব্যবহৃত পােশাক, অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদিও মৃতদেহের পাশে সাজিয়ে রাখত। কেননা তাদের বিশ্বাস ছিল যে পরলােকে যাত্রাপথে এগুলি মৃতের কাজে লাগবে।
যে ঐতিহাসিক যুগে লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, সেই যুগের ইতিহাসকে ‘প্রায় ইতিহাস’ বলে। যেমন-হরপ্পা সভ্যতার যুগে লিপির ব্যবহার ছিল যা বর্তমানে ‘সিঙুলিপি’ নামে পরিচিত। কিন্তু এই লিপির পাঠোদ্ধার করা আজও সম্ভব হয়নি। তাই হরপ্পা সভ্যতা ছিল প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের সভ্যতা।
প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের উপাদানগুলি হল—ধাতুর বিভিন্ন পাত্র, মাটির পাত্র, বাড়িঘর, তামার জিনিসপত্র ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল—ধাতব দ্রব্যসামগ্রী।
ভারতের ক্ষেত্রে প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের সূচনা ঘটে ধাতুর ব্যবহারের সময়কাল থেকে এবং সমাপ্তি ঘটে লৌহ যুগের সূচনাকালে।
শুরুর দিকে ইতিহাসের কয়েকটি উৎস বা উপাদান হল- [1] জীবাশ্ম (Fossil), [2] প্রাচীন মানুষের ব্যবহার্য হাতিয়ার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি, [3] গুহাচিত্র এবং [4] প্রাচীন সমাধি, ঘরবাড়ি এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
প্রাচীন গুহামানব বিশ্বাস করত যে চিত্রে যা আঁকা হবে বাস্তবেও তাই ঘটবে। জঙ্গলের মধ্যে জীবজন্তু শিকারে সফল হবে, এমন কল্পনা করেই তারা শিকারের ছবি আঁকত। ধর্ম বা জাদুবিদ্যার বশে তারা গুহার গভীরে লােকচক্ষুর আড়ালে কোনাে অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে এই চিত্র আঁকত।
পুরাকীর্তি শব্দের অর্থ হল পুরাতন দ্রব্যাদি সম্পর্কিত জ্ঞান। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে পুরাকীর্তি বলতে বােঝায় পুরাতন দিনের মানুষের উদ্ভাবিত যাবতীয় বস্তু বা বস্তুজাত নিদর্শন। আধুনিক ধারণায় পুরাকীর্তি বলতে অতীতকালে মানুষের ব্যবহার করা দ্রব্যাদি এবং নিদর্শনগুলির বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দান ও সেগুলির সংরক্ষণের পদ্ধতি।
ব্যাবিলনের সম্রাট নেবােনিডাস (Nabonidus) তাঁর রাজ্যের সিপুর (Sippur) অঞ্চলে অবস্থিত স্যামাথ (Shamath) নামে এক ভগ্নপ্রাপ্ত মন্দিরের নির্মাতার পরিচয় লাভের লক্ষ্যে খননকার্য চালান। খননকার্য থেকে প্রাপ্ত নানা নিদর্শনগুলি হল বিশ্বের সর্বপ্রাচীন পুরাকীর্তি। এই পুরাকীর্তিগুলি নিয়ে সম্রাটের কন্যা এননিগালডি নান্না (Ennigaldi Nanna) এক প্রদর্শনশালা গড়ে তােলেন, যা হল বিশ্বের সর্বপ্রাচীন পুরাকীর্তি।
খ্রিস্টীয় ষােড়শ শতক থেকে নানান পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি লুষ্ঠিত হতে শুরু হয়। পুরাতত্ত্বের আবির্ভাবের ইতিহাসে এই পর্ব তাই ঐশ্বর্য লুণ্ঠন পর্ব নামে পরিচিত। আসলে প্রাচীন পুরাকীর্তিগুলি ক্রমশ মূল্যবান পণ্য হয়ে ওঠে, তাই ইটালি, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের বাজারগুলিতে ওই লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি পণ্য হিসেবে স্থান পেয়েছিল।
যে পুরাতত্ত্বচর্চায় বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নিয়ে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সেগুলির ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গুরুত্ব নির্ণয় করা হয় তাকে বলা হয় নব্য পুরাতত্ত্ব।
এল, আর. বিনফোর্ড এবং এস. আর. বিনফোর্ড নামে দুই গবেষক বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক প্রতিকূল (Contrary) পদ্ধতির সিদ্ধান্তগুলির সঙ্গে ইতিহাসের অনুকূল (Non contrary) পদ্ধতির সিদ্ধান্তগুলির সমন্বয় ঘটান। তাদের সাংস্কৃতিক রূপান্তরের নানান দিকগুলির অনুসন্ধান পদ্ধতি হল প্রসারণ তাত্ত্বিক পুরাতত্ত্ব।
বিভিন্ন ধরনের স্থাবর বা ইমারতজাতীয় নির্মানকীর্তিপুলি হল বাস্তুজাত বা প্রত্নস্থাপনা পুরাকীর্তি। যেমন, আবাসিক ভবন, উপাসনালয়, দুর্গ, বিনােদন কক্ষ, স্মৃতিসৌধ, সমাধি, সেতু, রাস্তা, কৃত্রিম ঝরনা প্রভৃতি।
প্রাচীন সুমেরের প্রতিটি নগরে একটি করে সুবিশাল মন্দির থাকত। এগুলিকে ‘জিগুরাত’ বলা হত।
যে যুগে লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন হয় এবং ইতিহাসের লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়, তাকে ঐতিহাসিক যুগ বলা হয়।
কোনাে দেশের যে সমস্ত ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, যেমন—পর্বত, নদনদী, মাতৃভূমি, সমভূমি, সমুদ্র ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট দেশের ইতিহাসকে প্রভাবিত করে সেগুলিকেই ইতিহাসের ভৌগােলিক উপাদান বলা হয়।
সুদূর অতীত থেকে প্রায় আধুনিক যুগ পর্যন্ত সময়কালে চালানাে অনুসন্ধান ও খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত এবং মাটির নীচে থেকে প্রাপ্ত বস্তুসামগ্রী বা স্থাপত্যকীর্তি হল প্রত্নতত্ত্ব।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই তিনটি পদ্ধতি হল—সমীক্ষা (Survey), উৎখনন (Excavation) ও বিশ্লেষণ (Analysis)।
পিরামিড হল এক ধরনের শঙ্কু-আকৃতিবিশিষ্ট অট্টালিকা যেখানে প্রাচীন মিশরীয় রাজাদের সমাধি দেওয়া হত। প্রাচীন মিশরীয় রাজাদের মৃত্যুর পর মৃতদেহে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মাখিয়ে পিরামিডের অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করা হত। এই মৃতদেহকে মমি বলা হয়।
জীবাশ্ম বলতে প্রাক্-ঐতিহাসিক যুগে বা যুগের পর ধরে মাটির নীচে চাপা পরে পাথরে পরিণত হওয়া প্রাণী বা উদ্ভদ দেহাবশেষকে বােঝায়।
প্রাচীন মিশরের রাজাদের ফ্যারাও বলা হত। ফ্যারাওগণ নিজেদের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে পিরামিড নির্মাণ করতেন।
ব্রিটিশ পণ্ডিত উইলিয়াম কামডেন ব্রিটেনে জমিপিঠ বিবরণ বিষয়ক অনুসন্ধান চালান। এই অনুসন্ধানে প্রাপ্ত পুরাতন স্থাপনাগুলির বিবরণ লিখে রাখেন (১৫৮৬ খ্রি.)। এই লিখিত বিবরণগুলিকেই ব্রিটানিয়া তালিকা বলা হয়।
ইতিহাস রচনা করার জন্য যে সমস্ত সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় তাদের ইতিহাসের উপাদান বলা হয়। শিলালিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, সাহিত্য প্রভৃতি হল ইতিহাসের উপাদান।
যে সমস্ত লিখিত সূত্র থেকে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করা যায় তাকেই ইতিহাসের লিখিত উপাদান বলে। ইতিহাস রচনার মূল ভিত্তি হল তার লিখিত উপাদান।
লিখিত ইতিহাসের মূল উপাদান দুটি- [1] প্রত্নতাত্ত্বিকযার আবার তিনটি ভাগ, লিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য। [2] সাহিত্যিক উপাদান।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত ইট, পাথর, বিভিন্ন ধাতু প্রভৃতির ফলকে খােদিত বিভিন্ন লিপি প্রাচীন কালের ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। লিপি-সহ এইসব ফলকগুলিকে লেখমালা বলা হয়। সমুদ্রগুপ্তের ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ একটি লেখ-এর উদাহরণ।
প্রাচীন সুমেরীয়রা লিখন পদ্ধতি জানত। তারা প্রথমে ডানদিক থেকে বাঁদিকে লিখত। এটি কিউনিফর্ম লিপি নামে পরিচিত।পরে ধীরে ধীরে বাঁদিক থেকে ডানদিকে লেখারদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে লিপিগুলি বা লেখগুলি [1] সমকালীন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থান জানানাের পাশাপাশি সমকালীন ধর্ম বিশ্বাসেরও পরিচয় দেয়, [2] লিপি থেকে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেনের কথা জানা যায়।
[1] মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু থেকে সমকালীন যুগের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানা যায়। [2] শাসকদের ব্যক্তিগত কৃতিত্বের পরিচয় ছাড়াও মুদ্রায় খােদিত সাল ও তারিখ দেখে কাল পরম্পরা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
[1] পাঠোদ্ধারের সমস্যা: দুর্বোধ্য অক্ষরে খোদাই করা লিপিতে অনেক সময় সন-তারিখের স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য বােঝা যায় না। [2] বর্ণনার অমিল: অনেকসময় লিপিগুলির বর্ণনায় অসম্পূর্ণতা, অসামঞ্জস্যতাও বিভ্রান্তি ধরা পড়ে।
[1] সম্যক তথ্যের অভাব: প্রাপ্তিস্থান থেকে সেই দেশের সামাজিক ও সংস্কৃতির আভাস মেলে না| [2] ব্যাখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য: অনেক সময় মুদ্রার যে ছবি উৎকীর্ণ থাকে তার ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়।
[1] প্রাচীন কালে মূলত ধর্মীয় উদ্দেশ্য গড়ে তােলা স্থাপত্য ও ভাস্কর্য থেকে শিল্প ও ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস জানা যায়। [2] সৌধের স্তর বিন্যাস, নির্মাণ পদ্ধতির বা আঙ্গিকের পরিবর্তন।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হল মাটির ওপর থেকে বা উৎখননের ফলে মাটির তলা থেকে আবিষ্কৃত অতীতকালে তৈরি বা অতীতে ব্যবহৃত জিনিসপত্র। দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হল[1] শিলালিপি (উদাহরণ—এলাহাবাদ প্রশস্তি) ও [2] মুদ্রা (উদাহরণ সমুদ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা)।
লিপির বিষয়বস্তু অধ্যয়নকে ‘প্যালিওগ্রাফি’ বলে।
শিলালিপি উৎকীর্ণ বিষয়ক পঠনপাঠনকে ইংরেজিতে এপিগ্রাফি বলে।
প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাস নামে শর জাতীয় গাছের ছালে লিখত। এই ছালকে প্যাপিরাস বলে।
হায়ারােগ্লিফিক শব্দের সাধারণ অর্থ হল দেবভাষা বা পবিত্র ভাষা। এগুলি ছিল মূলত চিত্রলিপি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তারা সূর্য বােঝাতে একটি বৃত্ত এঁকে তার মাঝে একটি বিন্দু বসাত বা জল বােঝাতে ঢেউয়ের মতাে ছবি আঁকত।
বিশিষ্ট ফরাসি পণ্ডিত শাঁপাের্লিয় হায়ারােল্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করেন। এই লিপির দ্বারা মিশরীয় সভ্যতার পরিচয় মেলে।
ফরাসি সেনাপতি নেপােলিয়নের মিশর আক্রমণকালে তাঁর সঙ্গী এক ফরাসি পণ্ডিত মিশরের রােজেটা নামক স্থান থেকে লিপি খােদিত একটি প্রস্তরখণ্ড আবিষ্কার করেন। এটি ‘রােজেটা প্রস্তর নামে পরিচিত।
মুদ্রার পঠনপাঠন বিদ্যাকে ‘নিউমিসমেটিকস’ বলা হয়। এর দ্বারা বিভিন্ন ধরনের মুদ্রার পরিচয় জানা যায়।
জরাখুস্ট্রের উপদেশাবলি ‘জেন্দ-আবেন্তা নামক ধর্মগ্রন্থে সংকলিত রয়েছে।
প্রাচীন ইজুদিদের কথা জানতে গেলে প্রাচীন ‘হিব্রু বাইবেল গ্রন্থটি অপরিহার্য।
‘রাজতরঙ্গিণী’ গ্রন্থটি রচনা করেন কলহন। ইন্ডিকা’ গ্রন্থটি রচনা করেন গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস।
কলহনের লেখা ‘রাজতরঙ্গিনি গ্রন্থ থেকে কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায়।
‘ফো-কুয়াে-কি’ গ্রন্থটি রচনা করেন চিনা পর্যটক ফা- হিয়েন। ‘সি-ইউ-কি গ্রন্থটি রচনা করেন চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ।
অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের লেখক হলেন পানিনি।
একটি আটকোপা পাথরের ওপর কোপাক্ষর বা কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা হামুরাবির আইন সংহিতা পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন সংহিতা। হামুরাবি ছিলেন পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন রচয়িতা। ২৮২টি সূত্রাকারে লেখা এই আইন সংহিতা থেকে ব্যাবিলনের সমাজ, রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ কথা জানা যায়।
একটি আটকোপা পাথরের ওপর কিউনিফর্ম লিপিতে হামুরাবির লেখা ‘আইন সংহিতা হল পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন সংহিতা।
প্রাচীন মেসােপটেমিয়ার মহাকাব্যের নাম হল গিলগামেশ প্রাচীন গ্রিসের দুটি মহাকাব্য হল ‘ইলিয়াড’ ও ওডিসি’।
হর্ষচরিত’ গ্রন্থটি রচনা করেন হর্ষবর্ধনের সভাকবি বানভট্ট। বিক্রমাঙ্কদেবচরিত’ গ্রন্থটি রচনা করেন কাশ্মীরের কবি বিলহন। রামচরিত গ্রন্থটি রচনা করেন সন্ধ্যাকর নন্দী।
বৌদ্ধদের প্রধান গ্রল্থপুলি হল ‘ত্রিপিটক’, জাতক প্রভৃতি। জৈনদের প্রধান গ্রন্থগুলি হল ‘ভগবতীসূত্র’, ‘আচারঙ্গ সূত্র’, ‘কল্পসূত্র’ প্রভৃতি।
‘পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সি’ হল প্রাচীন ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যসংক্রান্ত একটি বিবরণ। এক অজ্ঞাত পরিচয় গ্রিক নাবিক এটি রচনা করেন।
ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে শুধু রাজাদের কাহিনি স্থান পায় না বা কোনাে একক ব্যক্তিবিশেষও ইতিহাসে স্থান পায় না। যদি কোনাে ব্যক্তির কীর্তি সমাজ বা সভ্যতাকে প্রভাবিত করে তবেই সেই ব্যক্তি ইতিহাসের আওতায় আসে।
ঐতিহাসিকরা যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঐতিহাসিক সত্যের সন্ধান করেন এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে তা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তা হল প্রত্যক্ষবাদ। প্রত্যক্ষবাদের অন্যতম প্রবক্তা হলেন জন বাগনেল বিউরি।
অ্যানালগােষ্ঠীর কয়েকজন সদস্য তথা ঐতিহাসিকরা হলেন লুসিয়েন ফেবর, মার্করখ, লাদুরি ব্রন্দেল, লেফেভর প্রমুখ।
জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কয়েকজন সমর্থক হলেন জারভিনাস, ডলম্যান, থিয়েরি, মেকলে প্রমুখ। সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কয়েকজন ঐতিহাসিক তথা সমর্থক হলেন হােল্ডেন ফারবার, এরিক স্টোকস, হেনরি মেইন, উইলিয়াম উইলসন হান্টার প্রমুখ।
ঐতিহাসিক ফ্রাসােয়া সিমিয়ান্দ বলেছেন ঐতিহাসিক ঘটনার কারণগুলি প্রাকৃতিক ঘটনার কারণগুলির মতাে একইরকম নয়। তার ধারণায় সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ প্রভৃতি কোনাে সুনির্দিষ্ট কারণের দ্বারা ব্যাখ্যা করা গেলেও ইতিহাসের ঘটনাকে তেমনভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই কার্যকারণ তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে নিমিত্তবাদ (Determinism) এবং আকস্মিকতা (Accident)। হেগেল, মার্কস থেকে শুরু করে ই. এইচ. কার হয়ে ফুকো পর্যন্ত সকলেই ইতিহাসে এই ধরনের নতুন তথ্যের দিশা দেখিয়েছেন।
পােস্ট মডার্ন ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসে প্রগতির তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তারা মার্কসবাদ বা উদারনৈতিক মানবতাবাদের পরিবর্তে উদারনীতিকে গ্রহণ করেছেন। মিশেল, ফুকো ও জাক দেরিদা, নীৎসে ও হাইডেগার প্রমুখের দর্শন তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে পােস্ট-মডার্ন ঐতিহাসিকগণ নতুন ডি কনস্ট্রাকশন তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন।
জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক কয়েকজন ঐতিহাসিক হলেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, আচার্য যদুনাথ সরকার প্রমুখ। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক কয়েকজন ঐতিহাসিক হলেন রজনী পামদত্ত, সুশােভন সরকার, ডি.ডি. কোশাম্বী, রামশরণ শর্মা প্রমুখ।
পুরাণ বা মহাপুরাণগুলি ছাড়াও ভারতের ইতিহাসে আরও কিছু ক্ষুদ্র পুরাণ রয়েছে, যেগুলি উপপুরাণ নামে পরিচিত। উপপুরাণগুলিও ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পুরাণে সাধারণত এই বিশ্বব্রয়াণ্ডের সৃষ্টি ও প্রলয়রহস্য, মন্বন্তর, দেবতা ও মুনিঋষিদের বংশ পরিচয়, বিভিন্ন রাজবংশ ও তাদের কৃতিত্বের বিবরণ থাকে। কিন্তু পুরাণগুলিতে কিংবদন্তি ও ঐতিহাসিক তথ্য এমনভাবে মিশে রয়েছে যে সেগুলি ভালােভাবে বিচার বা যাচাই না করে গ্রহণ করলে ভুল তথ্যের ব্যবহার হয়ে যেতে পারে। তাই পুরাণের তথ্যগুলি সতর্কভাবে গ্রহণ করা উচিত।
সুপ্রাচীন পুরাণগুলির সত্যতা ও মান্যতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই পুরাণগুলির রচয়িতা হিসেবে ঋষিদের নাম উল্লেখিত হয়েছে। তবে পুরাণগুলিতে পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনা সংযুক্ত হওয়ার সময়ে পুরােহিত এবং শাসক শ্রেণির হস্তক্ষেপ ঘটে বলে মনে করা হয়।
পুরাণ বলতে মূলত পুরাকাহিনী বিষয়ক গ্রন্থসমূহকে বােঝায়। পুরাণ কোনাে ইতিহাস নয়, ইতিহাসের কাল্পনিক উপাদান মাত্র। পুরাণের অন্যতম কয়েকটি শাখা হল—অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ ইত্যাদি।
প্রাচীন ভারতীয়, গ্রিক-সহ বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন ‘পুরাণ” অর্থাৎ পৌরাণিক কাহিনীর প্রচলন রয়েছে। এসব কাহিনীতে সমকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক উপাদান-সমৃদ্ধ এসব পুরাপকে ‘ইতিহাস- পুরাণ বলা হয়। অবশ্য ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ইতিহাস পুরাণের তথ্য সর্বদা সঠিক নয় বলে অনেকে মনে করেন।
প্রাচীন ভারতের অঞ্চলভিত্তিক রচিত ইতিহাস ঐতিহ্য হল পুরাণ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হল—রাজবংশাবলির কাহিনি ও তার সংশ্লিষ্ট নানান কল্পকথা (Myths)।
পুরাণের মােট সংখ্যা আঠারােটি। এগুলি হল— [1] বিষ্বুপুরাণ [2] ব্রহ্পুরাগ [3] পদ্মপুরাণ [4] ভগবদ্পুরাপ [5] শৈবপুরাণ [6] মার্কন্ডেয়পুরাণ [7] নারদীয়পুরাণ [৪] ভবিষ্যপুরাণ [9] ব্রহ বৈবর্তপুরাপ [10] অগ্নিপুরাপ [11] বরাহপুরাণ [12] স্কন্দপুরাপ [13] লিঙ্গপুরাণ [14] বামনপুরাণ [15] মৎস্যপুরাণ [16] রুড়পুরাণ [17] কূর্মপুরাণ [18] ব্ৰহ্মাণ্ডপুরাণ।
ভারতের উল্লেখযােগ্য চারটি পুরাণ হল— “বিষ্ণুপুরাণ’, ‘বায়ুপুরাণ’, ‘মৎস্যপুরাণ’, ‘ব্রম্মপুরাণ’।
বায়ুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, অমরকোষ ইত্যাদি অনুসারে পুরাণের লক্ষণ হল—পাঁচটি। এই লক্ষণগুলি হল—[1] স্বর্গ (সৃষ্টি) [2] প্রতিসর্গ (প্রলয়ের শেষে নতুন সৃষ্টি) [3] বংশ (দেবতা ও ঋষিদের বংশতালিকা) [4] মন্বন্তর (১৪ জন মনুর শাসনের বর্ণনা) [5] বংশ-চরিত (রাজাদের বংশের ধারাবাহিক বিবরণ)।
পুরাণে ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “ইতিহাস প্রদীপেন মােহাবরন মাতিনা, লােকগর্ভগৃহং কৃৎস্নং যথাবৎ সম্প্রকাশিতম”। এর বাংলা অর্থ হল ইতিহাস এমন একটি জ্ঞান যা প্রদীপের আলাের মত মানুষের মােহের অন্ধকার সরিয়ে মনলােকে সত্যের আলাে জ্বালায়।
মধ্যযুগের সুলতানি শাসনকালে ইতিহাসচর্চায় উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন এমন দুজন ঐতিহাসিক হলেন আলবিরুনি এবং জিয়াউদ্দিন বরনি। আলবিরুনির লেখা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল ‘তহকক-ই-হিন্দ’ বা কিতাব-উল-হিন্দ’। জিয়াউদ্দিন বরনির লেখা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল ‘তারিখ-ই-ফিরােজশাহি’।
ফিরােজ শাহ তুঘলক ৬০০টি সংস্কৃত গ্রন্থ পারসিক ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ভারতীয় সঙ্গীতের ‘রাগদর্পণ’ গ্রন্থটি তিনি পারসিক ভাষায় অনুবাদ করান।
ইরানের পারসিক কবি ফিরদৌসি রচিত একটি কাব্যের নাম ‘শাহনামা। তিনি সুলতান মামুদের সময় ভারতে এসেছিলেন।
জিয়াউদ্দিন বরনি তার লেখা তারিখ ই- ফিরােজশাহি’ গ্রন্থে মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালের বর্ণনা দিয়েছেন। এ ছাড়াও এতে বলবন থেকে ফিরােজ শাহ তুঘলকের আমল পর্যন্ত সময়কালের ইতিবৃত্ত রয়েছে।
ভারতে ইন্দো-পারসিক ভাষাচর্চার দুজন ঐতিহাসিক হলেন আমির খসরু ও জিয়াউদ্দিন বরনি।
আরবি-চাচনামা’ গ্রন্থটি ফারসিতে অনুবাদ করেন মহম্মদ আলিবিন মহম্মদ কুফী। এই গ্রন্থটি নাসিরুদ্দিন কুবাচার নামে উৎসর্গ করা হয়।
ভারতে সুলতানি রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় ইসলামী পদ্ধতি মেনে রচিত প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শজারই অনসবই মুবারক শাহি’। এর রচয়িতা হলেন মুবারক শাহ।
তারিখ-ই-ফিরােজশাহি শিরােনামে জিয়াউদ্দিন বরনিছাড়া আর এক ঐতিহাসিক শামসই-সিরাজ আফিফ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর এই গ্রন্থে সুলতান ফিরােজশাহের রাজত্বের বিবরণ আছে।
সুলতানি আমলে ভারতের একজন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও কবি ছিলেন আমির খসরু। তিনি মূলত ফারসি ভাষায় কবিতা লিখেছেন। তাঁকে ‘হিন্দুসাথানের তােতাপাখি’ বলা হয়।
গজনী ও ঘুরপ্রদেশের বিভিন্ন শাসকগণ ফিরদৌসি, সাদি, মহম্মদ হাপিজ, হামজা শাহ, তাজউদ্দিন প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপােষকতা করেন। তুর্কো-আফগান শাসকগণ এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই ভারতে পারসিক ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপােষকতা করেন।
আমির খসরু রচিত কয়েকটি উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হল [1] ইজাজইখসরুভি’, [2] ‘খাজাইন-উল ফুতুহাত’, [3] ‘তুঘলক নামা’, [4] ‘মেহতাফ-উল ফুতুহ, [5] ‘নুসিপিহর’, [6] ‘কিরান-উস-সাদাইন। আমির খসরু যে নতুন পারসিক কাব্যরীতির প্রবর্তন ঘটান তার নাম হল ‘সুবকই-হিন্দ’।
বাবর রচিত আত্মজীবনীর নাম ‘তুজুকই-বাবরী| এটি প্রথমে তুর্কি ভাষায় রচিত হয় এবং পরে ফারসি অর্থাৎ পারসিক ভাষায় অনুদিত হয়।
পারসিক ভাষায় রচিত তারিখ ই-রশীদী গ্রন্থটিকে তুজুক-ইবাবরী এবং হূমায়ুননামার সংযোগরক্ষাকারী দলিল বলা হয়। এই গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন বাবরের দূর সম্পর্কের ভাই মীর্জা মহম্মদ হায়দার দুঘলাট।
হূমায়ুনের জীবনী ও রাজত্বকাল সম্পর্কিত প্রামাণ্য ইতিবৃত্তটি হল হুমায়ুননামা। গ্রন্থটি রচনা করেন বাবর কন্যা গুলবদন বেগম।
ভারতে ইসলামের সূচনা থেকে আকবরের সময়কাল পর্যন্ত ইতিহাস জানা যায় ‘তবাকত ই-আকবরী গ্রল্থ থেকে। এটি নিজামউদ্দিন আহম্মদ রচনা করেন।
তাজাকিরাত ই-তহস্মাম্প গ্রন্থ থেকে হুমায়ুনের পারস্যে নির্বাসনের কাহিনি জানা যায়। গ্রন্থটি রচনা করেন শাহ তহস্মাম্প।
ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত কয়েক জন ঐতিহাসিক হলেন আমির খসরু, জিয়াউদ্দিন বরনি, ইসামি, আফিফ প্রমুখ। ইন্দো-পারসিক ইতিহাসচর্চা বিষয়ক কয়েকটি প্রন্থের নাম হলতারিখই-ফিরােজশাহি, ফতােয়া ই- জাহান্দারি, খাজাইন-উল ফুতুহা প্রভৃতি।
ঐতিহাসিকদের মতে, ইতিহাসের গতিধারা দুটি, যথা-আবর্তনশীল চক্রাকার ও রৈখিক বা একমাত্রিক।
ভারতীয় ইতিহাস এবং পুরাণ সাহিত্যগুলিতে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারটি যুগ কল্পনা করা হয়েছে। এই চতুর্ুগের ধারণায় কালের গতি চক্রাকারে আবর্তিত, অর্থাৎ সত্যযুগ থেকে সময়কাল ধীরে ধীরে কলিযুগে এবং পুনরায় কলিযুগ থেকে সত্যযুগে আবর্তিত হয়। কালের এই আবর্তন ধারা ‘যুগচক্র’ নামে পরিচিত।
পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের মতে আমাদের ইতিহাসের যেমন সূচনাকাল আছে তেমন এর অবসানকালও রয়েছে। আর এই অতীত ইতিহাসের ভবিষ্যতের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। ইতিহাসের এই একমুখী অগ্রগতি (রৈখিক বা তীঁরবৎ)-কে বলা হয় ইতিহাসের একমাত্রিক ধারণা।
ভারতীয় ধারণায় ও পুরাণ সাহিত্য অনুযায়ী চারটি যুগ (সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি) চক্রাকারে আবর্তিত হয়। অর্থাৎ শেষ যুগ কলির সমাপ্তি ঘটলে পুনরায় সত্যযুগের প্রত্যাবর্তন ঘটে। ইতিহাসের ধারণায় এই যুগের প্রত্যাবর্তনের নিয়মে হল ইতিহাসের চক্রাকার ধারণা।
খ্রিস্টান ধারণায় ইতিহাস হল একমাত্রিক ও রৈখিক যার সূচনা এবং সমাপ্তি রয়েছে। খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসের এই কালধারা অগ্রবর্তী হয় ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে। এই ধারণায় বলা হয় সামগ্রিকভাবে এতে ঈশ্বরের প্রভাব রয়েছে।
গ্রিসের ইতিহাসের আবর্তনশীল ধারায় বলা হয়েছে যে একটি মহান বছর থেকে চারটি যুগের সূচনা ঘটে। যেখানে প্রতিটি যুগ অন্য যুগের থেকে আলাদা এবং যুগগুলি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে এগােতে থাকে। শেষের যুগটি হয় ভালাে মন্দের মিশ্রণ।
ঐতিহাসিক রােমিলা থাপারের মতে, ভারতীয়রা সাধারণত গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানগত আলােচনার ক্ষেত্রে চক্রাকার কালচেতনা ব্যবহার করত এবং রাজ রাজাদের কীর্তিকাহিনি বর্ণনার ক্ষেত্রে রৈখিক কালচেতনা ব্যবহার করত।
সমাজ দর্শন তত্ত্বে বলা হয়েছে যে সামাজিক পদ্ধতির ভিত্তিতেই মূলত ইতিহাসে সময়কালের আবর্তন ঘটে চলে। এই ধারপায় প্রাচীন কালে পুরাতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয়কাল সীমার মধ্যেই এর প্রথম প্রকাশ ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয় ক্যালেন্ডারের আবিষ্কার, শাসন পদ্ধতির প্রবর্তন ইত্যাদির ভিত্তিতে এই কালসীমার আবর্তন ঘটে চলে।
কালপঞ্জি বিন্যাসের সর্বপ্রথম ধারণা দেন প্রাচীন মিশরবাসীরা। তারা সর্বপ্রথম নীলনদের প্লাবন, পূর্ণিমা, অমাবস্যা ইত্যাদির সাহায্যে কালক্রম ঠিক করত। প্রাচীন গ্রিসবাসীরাও প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিক খেলার আয়ােজন করে সময়ের একটা হিসাব রাখত।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ইতিহাসের কাল একটি রৈখিক ধারায় সূচনাপর্ব থেকে সমাপ্তি পর্বের দিকে অগ্রসর হয়। এই ধারণা রৈখিক কালচেতনা নামে পরিচিত।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ইতিহাসের কাল একটি বৃত্তাকার পথে অগ্রসর হয়ে আবর্তিত হতে থাকে। এই ধারণা বৃত্তীয় কালচেতনা নামে পরিচিত।
কাল সম্পর্কিত যে ধারণা অনুসারে মনে করা হয় যে, ইতিহাসের কালের অগ্রগতি একটি সূচনা পর্ব থেকে রৈখিক ধারা একটি সমাপ্তি পর্বের দিকে এগিয়ে যায় সেই কালকে প্রবাহমান কাল বলে।
ইতিহাসের নানা ঘটনাবলির সময়কাল নির্ধারণ করা ছাড়াও কালপর্ব বিন্যাসের ক্ষেত্রে সময় বিশেষ সাহায্য করেথাকে। কোনাে স্থানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রাচীনত্ব বা বয়সকাল নির্ধারণেও সময়কে কাজেলাগানােহয় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়গুলির প্রবর্তনকাল বা সংঘটনকাল নির্ণয়ে সময় বিশেষ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
কালক্রমের দুটি রূপের একটি হল চান্দ্র বছর, অপরটি হল সৌর বছর। পৃথিবীর চারদিকে চাদের ঘােরার ভিত্তিতে বছর গণনার রীতিকে বলা হয় চান্দ্র বছর (Lunar Year)। সাধারণভাবে ঋতুচক্রকালে সূর্যের নিজের অবস্থানে ফিরে আসার সময়সীমাকে পার্থিবদৃষ্টিতে এক সৌর বছর (Solar Year) বলে।
ইতিহাসে পর্ববিন্যাসে বিবেচ্য কয়েকটি বিষয় হল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রবাহ, দুর্যোগ, রাজবংশের ধারণা, সংস্কৃতির পরিচয়, রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবধারা, ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য সমূহ, অর্থনীতির বিবর্তন, দেশভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা প্রভৃতি। এই সমস্ত বিষয়গুলিকে ইতিহাসের পর্ববিন্যাসে মডেল বা নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঐতিহাসিকগণ এই সমস্ত বিষয়গুলিকে মানদণ্ড ধরে ইতিহাসের পর্ববিন্যাস করে থাকেন।
ইউরােপের ইতিহাসকে তিনটি পর্ব বা যুগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- [1] প্রাচীন যুগ: সভ্যতার বিকাশকাল থেকে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত; [2] মধ্যযুগ: 8৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়ে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত; [3] আধুনিক যুগ: ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়েছে এবং আজও চলছে।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে অত্যন্ত ধীর গতিতে সমাজও বদলায়। তাই আপাত দৃষ্টিতে বহুদিন ধরে মানুষের জীবন-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি একই রকমের থাকে। যদি বহুদিন ইতিহাসের দ্রুত ও বড়াে কোনাে পরিবর্তন না হয় তবে কোনােবড়াে পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত সময়কাল ইতিহাসে এক একটি পর্ব বা যুগ হিসেবে স্বীকৃত হয়।
মানবসভ্যতার ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা যায় যথা- [1] প্রাচীন যুগ, [2] মধ্যযুগ ও [3] আধুনিক যুগ।
প্রাচীন যুগকে তিনটি যুগে বিভক্ত করা হয় যথা- [1] প্রাগৈতিহাসিক যুগ, [2] প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ ও [3] ঐতিহাসিক যুগ।
ভারতের ইতিহাসকেও তিনটি পর্ব বা যুগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- [1] প্রাচীন যুগ: সুপ্রাচীন অতীত থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের আগে পর্যন্ত সময়কাল হল প্রাচীন যুগ; [2] মধ্যযুগ: গুপ্ত-পরবর্তী সময়কাল অর্থাৎ ষষ্ঠ শতক থেকে ত্রয়ােদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সময়কাল ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগ নামে পরিচিত। মধ্যযুগটি আবার আদিমধ্য (৬০০-১২০৬ খ্রি.) এবং অন্তমধ্য (১২০৬-১৭৫৭ বা ১৭০৭ খ্রি.) এই দুইভাগে বিভক্ত; [3] আধুনিক যুগ: ১৭৫৭ (অন্যমতে ১৭০৭ খ্রি.) থেকে শুরু হয়ে আজও চলছে আধুনিক যুগ।
আধুনিক ঐতিহাসিকগণ ভারতের মধ্যযুগকে আদিমধ্য ও অন্তমধ্য এই দুই ভাগে ভাগ করে থাকে। আদিমধ্য যুগ হিসেবে রামশরণ শৰ্মা, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় নীহারঞ্জন রায় প্রমুখ গবেষকগণ ৬০০ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে উল্লেখ করেছেন।
ইউরােপের ইতিহাসে প্রধানত মধ্যযুগের সমাপ্তি এবং আধুনিক যুগের সূচনা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বহু ঐতিহাসিকের ধারণা যে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনােপলের পতনকাল ইউরােপে মধ্যযুগের সমাপ্তি এবং আধুনিক যুগের সূচনাকাল। অনেকে আবার ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার আবিষ্কার বা ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপে সংস্কার আন্দোলনের সূচনাকালকে ইউরােপে মধ্যযুগের সমাপ্তি ও আধুনিক যুগের সূচনা হিসেবে ধরে থাকেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিক জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ—এই তিন ভাগে ভাগ করেছেন।
ভারতের ইতিহাসেও মধ্যযুগের সমাপ্তি ও আধুনিক যুগের সূচনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বেশ কিছু ভারতীয় ঐতিহাসিকের ধারণা হল যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহের সময়কাল পর্যন্ত ভারতে মধ্যযুগ এবং তার পর থেকে শুরু হয়েছে আধুনিক যুগ। আবার কোনাে কোনাে ভারতীয় ঐতিহাসিক মনে করেন ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময়কাল পর্যন্ত ভারতে মধ্যযুগ এবং তার পর থেকে শুরু হয়েছে আধুনিক যুগ।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ এবং ব্রিটিশ যুগ এই তিনভাগে ভাগ করেন। ঐতিহাসিক মিল সুপ্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে হিন্দু যুগ। ১২০৬ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে মুসলিম যুগ এবং ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে শুরু হওয়া সময়কে ব্রিটিশ যুগ বলে আখ্যা দেন।
ভারতের ইতিহাসে যুগবিভাগে হিন্দু বা মুসলিম এই সম্প্রদায়ভিত্তিক যুগবিভাগ ঠিক নয়। প্রথমেই বলা যায় হিন্দু যুগ হিসেবে নামকরণ করা হলেও সেই সময়কালে শুধুমাত্র বৈদিক হিন্দুধর্মই প্রচলিত ছিল না বা কবল হিন্দু রাজারাই রাজত্ব করতেন না| এযুগে বৌদ্ধধর্ম, জৈন ধর্মের মতাে অন্যান্য ধর্মও প্রচলিত ছিল বা গুপ্ত মৌর্যের মতাে জৈন অনুরাগী এবং অশােক ও কনিষ্কের মতাে রাজারাও রাজত্ব করেছিলেন। আবার তথাকথিত মুসলিম যুগে মুসলিম শাসকদের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল যথা ওড়িশা, রাজপুতানা, মধ্যপ্রদেশে, দাক্ষিণাত্যের বিজয়নগর ইত্যাদি।
Leave a comment