দার্শনিক Santayana বলেছিলেন— “Those who cannot remember their past are condemned to repeat its errors”, ইতিহাস চর্চার ধ্রুব উদ্দেশ্য এর মধ্যে নিহিত। ইতিহাস অর্থাৎ “ইতি-হ-আস” – এমনটি পূর্বে ছিল। অতীতকালের কথা নিয়েই ইতিহাস। ইতিহাস অতীত মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ সমতায় আবদ্ধ। অন্যদিকে মানুষের উদ্ভব প্রসার ও পরিণতি তার একক বা সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের বিষয় প্রধানত নৃতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞানেরই আলোচ্য। সেই দৃষ্টিতে ইতিহাস নৃতত্ত্বেরও অন্তর্গত। সমাজতত্ত্ব বা অর্থনীতির মতই ইতিহাসকেও সেইজন্য Human Science-এর মধ্যে একটা বড় স্থান দিতে হয়। আবার ঐতিহাসিক সত্যের সন্ধানে সনাতনী এবং সদ্যতন ঐতিহাসিকদের চিন্তা-চারণায়ও এক দূরত্বের দাগ থাকে। প্রাচীন ঐতিহাসিকের কাছে ‘ইতিহাস’ অর্থ রাজা-রাজড়ার কথা, রাজাদের ও অন্য শাসকবর্গের বংশপঞ্জি, তাঁদের কীর্তি ও কৃতিত্ব এবং রাজাদের রাজত্বকালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বড় বড় ঘটনার তারিখ ও বিবরণের বৃত্তান্ত। বহুদিন আগে লেখা কল্হনের ‘রাজতরঙ্গিণী’ (১১৪৯ খ্রীস্টাব্দ) গ্রন্থে ‘ভূতার্থকথন’ শব্দটির মধ্যেও ইতিহাসের মৌলিক উপাদানের পরিচয় পাওয়া যায়।

অন্যদিকে উত্তরবিজ্ঞ ইতিহাসবিদের কাছে সমগ্রভাবে জাতির লোকেদের প্রগতির আলোচনাই সত্যিকারের ‘ইতিহাস’ সাল-তারিখ ইত্যাদির সুষ্ঠু আশ্রয়ে বিস্মৃত জনজীবনের স্বরূপ সন্ধানে আগ্রহী তার সঙ্গে সমকালের সংযোগ স্থাপনে আধুনিক ঐতিহাসিকেরা দায়বদ্ধ। ইতিহাসের সত্যসন্ধানে অতীত জীবনের তাৎপর্য-বিশ্লেষণের প্রাধান্যদানে একালের ঐতিহাসিকেরা নিস্কুণ্ঠ।

এখন ‘সাহিত্যে’র সঙ্গে ‘ইতিহাসে’র স্বরসঙ্গতি প্রয়োজন কেন এবং কোথায় তা দেখা যেতে পারে –

(১) ভাবের সুষ্ঠু রূপায়ণের জন্য বাস্তব সঙ্গতি: সাহিত্য কোন নিরালম্ব শূন্যচরা বিষয় নয়। শিল্পীর অনুভূত সত্য যতই হ্রাদৈকময়ী হোক না কেন, সেই ভাবনার প্রকাশে জাতির চলমান জীবন ইতিহাসের সঙ্গে তার বাস্তব সঙ্গতি প্রয়োজন। কেন-না বাস্তববিমুখী সৃষ্টিবাদী সত্যের বক্তা ক্রোচে পর্যন্ত এ ব্যাপারে একমত: “Feeling is not a particular content, but the whole universe sub-specie intui tion.”

(২) দেশ-কাল-পাত্রের সংযোগ: দেশ-কাল-পাত্রের মুখপত্র ইতিহাস, চৈতন্যচর্চার সার্বজনীন প্রতিফলক সাহিত্য ও শিল্পকলা কোন দেশের ভৌগোলিক অস্তিত্ব, একটি সীমিত কালপ্রবাহের মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ মানুষের পরিচয়, সেকালের রাষ্ট্রীয় সামাজিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে সেই জাতীয় জীবনের নিক্তি-নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও বিবরণ ইতিহাসের প্রতিপাদ্য। কিন্তু সেই জাতির বহুস্তরী ও বহুবর্ষী মানস কর্ষণা অর্থাৎ তার অম্লময় প্রয়োজন সাধনের পর তার আনন্দময় জীবনচর্চার আয়োজন করে ‘সাহিত্য’।

(৩) বহির্জীবনের সঙ্গে গোত্রস্থাপনের জন্য সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান ও কালের স্বরূপ নির্দেশ: মানুষের অনুভবে কালের মাত্রা এক চিরায়ত, আর এক নির্দিষ্ট দেশ এবং পাত্রের প্রসঙ্গে সীমা চিহ্নিত। দার্শনিকদের ‘অখণ্ড দণ্ডায়মান নিরালম্ব ও নিরবয়ব কালের কথায় সাহিত্যকার অকৌতূহলী। সাহিত্য জীবনসম্ভব, জীবনের বহমান আধার হিসাবেই তার মাত্রা নিরূপিত হয়। আবার মানুষ আর প্রকৃতি নিয়েই সাহিত্যের জীবন। এই জীবনের পরিধি হচ্ছে পাত্র এবং দেশ। সময়ের বহতা ধারায় সেই দেশ এবং পাত্রের বিকাশ যে পরিধিতে পূর্ণ, তাই নিয়েই সাহিত্যের কালের সঠিক নিরিখ, সুনিশ্চিতভাবে যা রূপে রেখায়িত। যেমন, কালিদাসের কালে উজ্জয়িনী, কিংবা শেকসপিয়ারের কালে ইংলন্ড বললেই নিরঙ্গ সময় রূপময় হয়ে ওঠে এক অজানা রহস্যে মদির স্বপ্নলোকের বর্ণ-গন্ধ-স্বাদুতায় অথবা সদ্য-উদ্ভিন্ন কোন রেনেসাঁস-চেতনায় মথিত যন্ত্রণায়। এই অনুভব, এই সচেতনতা সুনির্দিষ্ট খণ্ডকাল-সম্পর্কিত। সাহিত্যে কালের চিরায়ত ধারণাও এই খণ্ড-চরিত্রের নিয়ত পরিব্যাপ্তির ধারাসূত্রেই প্রকাশিত, যার মূলে মানবসত্তার নিরস্তর উক্রান্তির বোধ থাকে প্রচ্ছন্ন মানুষের একটা পরিচয় তার ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীগত চরিত্রে আভাসিত, কিন্তু তার গহনে আত্মগোপন করে থাকে সর্বমানবের অধিষ্ঠানভূমি—যে মানুষ আসলে মনোময়। যেমন, মহাভারতের উপাখ্যানে যুধিষ্ঠির এবং ভীম কিংবা অর্জুনের চরিত্রে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য অপার অথবা কুরুপাণ্ডবের গোষ্ঠীগত সংঘাতের এক নিজস্ব চরিত্র রেখায়িত। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর গভীরে স্বজনঘাতী মনুষ্যত্বের যে মর্মান্তিক পরাভব অক্ষরে অক্ষরে মুদ্রিত, আসলে তা সর্বদেশকালে ব্যাপ্ত সর্বমানবের ট্র্যাজিক অনুভবে পরিপূর্ণ।

(৪) ‘ইতিহাসে’র সঙ্গে ‘সাহিত্যে’র গল্পময় সংযোগ:  ইংরেজিতে ‘history’ শব্দটি ‘story’ বা গল্পের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। ফরাসীতে ‘historire’ শব্দটি দ্বৈত অর্থেই প্রযুক্ত। ভারতীয় সাহিত্যেও কোন বিষয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে “অত্রাপাদাহরম্ভী মমিতিহাসং পুরাতনম্” (এ বিষয়ে ইতিহাস-পুরাণ এই উদাহরণ দেয়) বলে মহাভারতকার কথা শুরু করেছেন।

সুতরাং, ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক সন্ধানে একথা সুস্পষ্ট, সমাজের উপায়নে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা। সমাজ তাকে উপাদান যোগায়। শিল্পকলার মাধ্যমে তার শরীর ধারণ, মহাকালের আলোয় তার সূর্যস্নান, আর ব্যক্তিচিত্তের অনুভাবনায় তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা। এইভাবে হয় চতুরঙ্গের সমাহারে ‘ফোর ডাইমেনশনাল’ কাব্যসাহিত্যের ক্রমবিকাশ। কিন্তু চার অঙ্গের যোগফলে নয়, গুণফলে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি উপাদানই বিবর্তন-নির্ভর। তাই স্বাভাবিকভাবেই সমাজের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে হয় সাহিত্যেরও ঋতুবদল। কিন্তু সূর্য থেকে ক্ষরিত আলোয় চাদ শুধু আলোকিতই হয় না, সে আলোর বিকিরণও তার এক গৌরবী কৃতি। সমাজ থেকে উদ্ভূত সাহিত্যেরও তাই কাজ আগামীকালের জন্য ঘুম থেকে জাগরণের সাধনা, জীবন থেকে মহাজীবন রচনার প্রেরণা। তবু সাহিত্যের মধ্যে শুধু পরিবর্তনের নটরাজ-নৃত্যের শোভন সুর অনুরণিত হয় না, নবকাল সৃষ্টির সুরে আসন্নপ্রসবার আর্তনাদও স্পন্দিত হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের জন্মভূমিতে কান পাতলে যেন সেই শব্দ শোনা যায়।