নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের মানব জীবনের ‘জীবন’ নামক প্রবাহ সদা প্রবহমান। প্রতিটি জীব এইভাবেই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে জীবননাট্যে নানা রঙের খেলা খেলে আর কোনো এক চুটকি মারা মুহূর্তে টুপ করে ঝরে পড়ে। জীবনের সব খেলা, রঙ, দম্ভ, গরিমা অহংকার ও আমিত্ব ভেসে যায়। এটাই চলমান মানব জীবনের অনন্তকালীন অনন্ত সত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ওরা কাজ করে’ কবিতায় এই কথা ভেবেই লিখেছিলেন—
‘রক্ত মাথা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনিতে থাকে মুখ ঢাকি?
আজকের প্রতাপ-প্রতাপান্বিত রাজা, কালকে তাঁর স্থান খুব বেশি হলে ইতিহাসের জীর্ণ পাতায়।
‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় বাবর একজন ঐতিহাসিক পরাক্রমী সম্রাট। দেশ, রাজ্য, নগর, জনপথ, ভেঙে আসতে আসতে সব কিছুকে নিজের জয়ের অঙ্গীভূত করেছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন মুঘল সাম্রাজ্যের। আমরা রাজ্যজয়ের নেশায় মত্ত বাবরের সম্রাট জীবনে কোনোরকম বড়ো ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটতে দেখি নি। ছলে, বলে, কৌশলে তিনি রাজ্য করেছেন ও কর্মময়, সুশাসিত সাম্রাজ্য স্থাপন করে ইতিহাসে তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন। একজন সম্রাট হিসেবে বাবর ইতিহাস প্রসিদ্ধ বীর ও শ্রেষ্ঠ নৃপতি সন্দেহ নেই।
পাঁচের দশকের অন্তর্মুখী কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ ‘বাবরের প্রার্থনা’র নাম কবিতায় সম্রাট বাবরের এক ট্রাজিক পরিণতিময় দিকটিকে উদ্ভাসিত করেছেন। বাবরের রাজকীয় মহিমা ও প্রতাপ একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তার একমাত্র পুত্র হুমায়ুন মারাত্মকভাবে রোগে আক্রান্ত। তার দেহ বল্লরী থেকে একে একে শুকিয়ে যাচ্ছে যৌবনোচিত দীপ্তি। তার হৃদয় হাড়, অস্থি, মজ্জা, ফুসফুস ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। অস্তমিত সূর্যের মতো হুমায়ুন আজ প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী। পিতা বাবর আর যাই হোন না কেন তার জীবনে পুত্রের জন্য স্থিত স্নেহের জায়গায় বাবর একজন অন্ধ পিতা। তিনি ঈশ্বরের কাছে পশ্চিমদিকে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছেন—যেন তার পুত্র অতিশীঘ্র নিরাময় লাভ করে। এর জন্য তিনি তাঁর রাজ্যের সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু বিনিময়ে তার পুত্রকে চান। শুধু তাই নয় বাবর তার নিজের প্রাণের বিনিময়ে বা তার পরমায়ুর বিনিময়ে যদি পুত্রের যৌবনদীপ্ত শরীর জেগে ওঠে তাতেও তিনি রাজী। সম্রাট বাবরের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে গুটি কেটে বেরিয়ে আসা সাধারণ এক করুণাঘন পিতাকে দেখে আমাদের আশ্চর্য বোধ হলেও—এটাই সত্যি। শঙ্ঘ ঘোষের লেখনীতে কবিতাটি এখানেই বিশ্বানুভূতির মর্যাদা পেয়ে গেছে। কাল, দেশ, সময়, জাত, ধর্ম, ছাড়িয়ে বাবরের পিতৃত্ব ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর কোণে কোণে। কবিতা, যে কবিতা জীর্ণ ইতিহাসের পাতার কোনো এক পর্বের খণ্ডিত ঘটনা দিয়ে শুরু হয়েছিল তা বর্তমানে কবির লেখনীর যাদুস্পর্শে পেয়ে গেল বিরাট ব্যাপ্তি। এখানেই কবি শঙ্খ ঘোষের জিৎ।
ইতিহাসের বা সাহিত্যে ‘ট্র্যাজিডি’ বলতে বুঝি ইতিহাসের সাহিত্যের নায়কের অসাবধানজনিত কোনো কর্ম। সেই নায়কের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কৃতকর্মের শোচনীয় ফল-পরিণাম যখন তার পতনের মূল কারণ হয় তখনই তার ক্ষেত্রে বলা হয় যাকে ট্র্যাজেডি। গ্রিক নেমেসিস বা নিয়তি কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে সেই নায়কের জীবনের চরম ক্ষতিসাধন করে, একে কোনোভাবেই এড়ানো যায় না।
বাবরের যুবকপুত্র হুমায়ুন আজ মৃত্যুপথযাত্রী, রোগ শয্যায় শায়িত, এর রোগের জন্য প্রত্যক্ষভাবে পিতা বাবর দায়ী নন, বা তার পুত্রও দায়ী নয়। তবুও যে রোগে আক্রান্ত—নিঃসন্দেহে এটা বাবরের ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডি।
বাবর প্রত্যক্ষভাবে তার পুত্রের অসুস্থতার কারণের জন্য দায়ী নয় তবুও বাবর পুত্রের প্রতি স্নেহের অতিরেকে তার কৃতকর্মের মধ্যে পাপ বা ভুল খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
‘আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে?
আত্মকথনের এই অনুশোচনাময় কথাগুলোর মধ্যে বাবর নিজেকে ‘পাপী’ সাব্যস্ত করেছেন। রাজ্যজয়ের নেশায় শত শত নর-নারীর বুক খালি করেছেন। রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিয়েছেন—সেই পাপের জন্য তাঁর এক্ষণে অনুশোচনা হচ্ছে। যদিও আমরা জানি ‘যুদ্ধে কোনো পাপ নেই, তবুও বাবরের মতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী, বিশ্ববিজয়ী নায়কের মুখে তার কৃত কর্মের জন্য আফশোস শোনা গেছে। বাবর তাই এবার নিজের জীবনের মূল্যে, তার পরমায়ুর পরিবর্তে পুত্রের জীবনকে ফিরিয়ে দেবার জন্য স্রষ্টা ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছেন। তার সন্তান যেন সুখে থাকে এরকম আকুল আর্তি বিঘোষিত হয়েছে—কবিতার তিনটি স্তবকের (প্রথম, তৃতীয় ও ষষ্ঠ) অন্তিম চরণে—’আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’। এতবড়ো বীর পুরুষের মুখে পুত্রের সুখের বাসনায় এরকম করুণ আর্তি, আমাদের বিস্মিত করে, মথিত করে, সন্তানের প্রতি পুত্র প্রেমের নজির সৃষ্টিকারী এক উদাহরণ যেমন আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে—তেমনি বাবরের মুখ দিয়ে উচ্চারিত শব্দরাজির মধ্যে দিয়ে তার ট্র্যাজেডি ও আমাদের চোখে পড়ে।
এই কবিতায় বাবরের ট্র্যাজেডি বড়ো হয়ে আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলেও বাবরের পিতৃহৃদয়ের পরিচয়টি আরও বড়ো হয়ে উঠেছে। বাবর যত বড়ো বীর যোদ্ধা হিসেবে আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়েছিলেন তার চেয়েও বড়ো হয়ে উঠল তার পিতৃপরিচয়। একদিকে বাবরের জীবনের ট্র্যাজেডি আমাদের শোণিতে অনুরণিত হল ঠিকই কিন্তু পিতৃস্নেহের এই অমলিন নজির আমাদের মানব মণ্ডলের মধ্যে স্নেহ-প্রীতি-প্রেম, ভালোবাসার শিথিল-প্রায় মানবিক গুণগুলিকে আর একবার নতুন করে পরিশ্রুত করে নিতে পারলাম। ভাবী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে আরও একটি বিষয় পিতৃ-প্রেম চিরকালের জন্য বেঁচে রইল।
Leave a comment