পরিবর্তনের ইতিহাস:

মার্কসীয় দর্শন অনুসারে প্রতিটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় ক্রমাগত শ্রেণী বিরোধের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। মার্কসীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিধি ব্যবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় স্বতন্ত্র সমাজ ও সভ্যতার। এ হল মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এবং এইভাবেই এক যুগ থেকে অন্য যুগে ইতিহাস উপনীত হয়। সুতরাং মানবসমাজের ইতিহাস হল মূলত পরিবর্তনের ইতিহাস। এ হল ক্রমবিকাশের এক প্রবহমান ধারা। এই ধারায় চিরন্তন বা শাশ্বত বলে কিছু নেই। মানবসমাজের মধ্যে পরিবর্তনের এই ধারা সাধারণত ধীর গতিসম্পন্ন। এই ধীর গতির পরিবর্তনকে বলা হয় ক্রমবিবর্তন (evolution)। আবার বিপুল বেগে উত্তাল ও আকস্মিকভাবেও পরিবর্তন ঘটতে পারে। তখন যুগান্তর ঘটে। একে বলে বিপ্লব (revolution)। অর্থাৎ মানবসমাজের ক্রমবিকাশের গতি সমান নয়, অসমান।

মানবসমাজের পরিবর্তন এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের অবশ্যম্ভাবিতা:

মার্কসবাদী ব্যাখ্যা অনুসারে মানবসমাজের ইতিহাসের স্বাভাবিক ক্রমবিকাশের ধারায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করা হয়। কারণ মানবসমাজের ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের গতি হল শ্রেণীহীন সমাজের দিকেই। মানবসভ্যতার ইতিহাসের ধারায় শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ইতিহাস হল একটি অন্তর্বর্তীকালীন ইতিহাস মাত্র। শ্রেণীসমাজের ইতিহাস শাশ্বত-সনাতন নয়। একটি সমাজব্যবস্থা অপসারিত হয় অন্য আর একটি সমাজব্যবস্থার দ্বারা। নতুন একটি সমাজব্যবস্থার উদ্ভব হয় পূর্ববর্তী পুরাতন সমাজব্যবস্থার গর্ভ থেকেই। এমিল বার্নস ‘মার্কসবাদ’ শীর্ষক রচনায় এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন: “আগেকার সকল সমাজরূপের ন্যায় বাস্তবের সমাজতান্ত্রিক সমাজও গড়ে উঠবে তার ঠিক আগেকার অবস্থার ভিত্তিতে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ হবে পুঁজিবাদী সমাজের গর্ভ থেকে সদ্য উদয়মান সমাজ। আর্থনীতিক, নৈতিক ও মৌলিক সকল দিক থেকেই তার সঙ্গে জন্ম-চিহ্ন হিসাবে আঁকা থাকবে গভীধারিণী পুরাতন সমাজের চিহ্ন।” ইতিহাসের বিবর্তনের এই ধারাকে অব্যাহত রাখে মানুষের সচেতন কর্মকাণ্ড। মানুষই পরিবর্তিত অবস্থার চাপে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে। এবং এইভাবে পুরাতন সমাজব্যবস্থার জায়গায় সৃষ্টি হয় নতুন সমাজব্যবস্থার। মানবসমাজের পরিবর্তনের এই গতি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার দিকেই। মানবজাতির ইতিহাসের ধারার মূল গতি হল আদিম প্রাক্‌-সভ্য শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ থেকে সভ্য শ্রেণী-সমাজে। এবং তারপর আধুনিক সুসভ্য শ্রেণীহীন সাম্যতন্ত্রের দিকে। মানবসমাজের ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটেছে আদিম প্রাক্-সভ্য শ্রেণীহীন সমাজ হিসাবেই। তারপর সমাজ বিকাশের ধারায় এসেছে তিন ধরনের শ্রেণী-সমাজ। এই তিন ধরনের শ্রেণী-সমাজ হল দাসতন্ত্র, সামস্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্র। ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ হল মানবসমাজের ইতিহাসের শেষ শ্রেণী সমাজ। পুঁজিবাদী সমাজের অন্তর্নিহিত স্ব-বিরোধ ও সংকট পুঁজিবাদের অবসান ও সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবকে অনিবার্য করে তোলে।

সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া:

মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সামাজিক প্রগতির মান নির্ধারণের মাপকাঠি হল উৎপাদন-সম্পর্কের প্রকৃতি। অনুরূপভাবে সমাজ-বিপ্লবের আর্থনীতিক ভিত্তি হল উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সমকালীন উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে গড়ে উঠে উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন শক্তি হল সর্বাধিক প্রগতিশীল উপাদান। এই উৎপাদন শক্তি ক্রমশ উন্নত ও বিকশিত হতে থাকে। বিকশিত হওয়ার পথে একটি পর্যায়ে উন্নত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের সামঞ্জস্যের অভাব ঘটে। তখন বিদ্যমান উৎপাদন-সম্পর্ক উন্নত উৎপাদন শক্তির বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, সমকালীন উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন শক্তির বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তারফলে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে বিকশিত উৎপাদন শক্তির বিরোধ বাধে। বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ব্যতিরেকে এই বিরোধের অবসান অসম্ভব। তখন সমকালীন উৎপাদন সম্পর্কের সামগ্রিক পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু তা সহজে সম্ভব হয় না। কারণ প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সমকালীন শাসক-শ্রেণীর স্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকে। শাসক-শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীন এই রাষ্ট্রযন্ত্র বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ককে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে। প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে আধুনিক ও উন্নত উৎপাদন শক্তির বিরোধের অবসান বিপ্লব ব্যতিরেকে অসম্ভব প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ এই বিপ্লব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমেই এই বিপ্লব মূর্ত হয়ে উঠে। এই বিপ্লবের পরিণতি হিসাবে উদ্ভব হয় এক নতুন সমাজব্যবস্থার। তখন পূর্ববর্তী শাসকশ্রেণীর পরিবর্তে নতুন একটি শ্রেণীর শাসন কায়েম হয়। এঙ্গেলস্ Socialism: Utopian and Scientific শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “Modern socialism is, in its essence, the direct product of the recognition, on the one hand, of the class antagonism existing in the society of today between proprietors and non-proprietors, between capitalists and wage workers; on the other hand, of the anarchy existing in production.”

মানবসমাজের ক্রমবিকাশের গতিপথ:

মানবসমাজের ক্রমবিকাশের গতিপথ অনিবার্যভাবে একটি বিশেষ ধারায় বা পথে পরিচালিত হয়। এই অনিবার্য গতিপথটি শুরু হয় আদিম সাম্যতন্ত্র থেকে, আদিম সাম্যতন্ত্র থেকে দাসতন্ত্রে, দাসতন্ত্র থেকে সামন্ততন্ত্রে, সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে এবং ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে। প্রকৃত প্রস্তাবে পূর্ববর্তী সমাজব্যবস্থার ভিতরেই পরবর্তী উন্নততর সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদান পরিপুষ্টি লাভ করে। মানবসমাজের পরিবর্তনের ভিত্তি হল বৈষয়িক উৎপাদনের অগ্রগতি। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে মানবসমাজের সামগ্রিক উৎপাদন শক্তি ক্রমাগত উন্নত ও বিকশিত হচ্ছে। এক সময় এই উন্নত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের বিরোধ বাধে। তখন উৎপাদন শক্তির বিকাশের ধারায় বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তখন প্রচলিত সমাজব্যবস্থা অনপনেয় সংকটের মধ্যে হাবুডুবু খায়। এই সমাজব্যবস্থা কার্যত জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। তখন বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার অবসান এবং নতুন এক সমাজব্যবস্থার আবির্ভাব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই সময় মেহনতী শ্রেণীগুলি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে এবং সংগ্রামের মাধ্যমে অভিপ্রেত নতুন সমাজব্যবস্থার উদ্ভবকে সম্ভব করে তোলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, মেহনতী শ্রেণীগুলি হল প্রগতিশীল এবং বিপ্লবী শ্রেণী। বিপ্লবী শ্ৰেণী বলতে সেই শ্রেণীকেই বোঝায়, যে শ্রেণী তার ভবিষ্যতের অগ্রগতিকে উৎপাদন শক্তির বিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে। তেমনি প্রগতিশীল শ্রেণী বলতে সেই শ্রেণীকেই বোঝায়, যে শ্রেণী তার ভবিষ্যতের অগ্রগতিতে উৎপাদন-শক্তির বিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে। অপর দিকে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী বলতে সেই শ্রেণীকেই বোঝায়, যে শ্রেণী পুরাতন উৎপাদন-সম্পর্ককে অব্যাহত রাখতে চায়।

পুঁজিবাদী উৎপাদনের সামাজিকীকরণ এবং ব্যক্তিগত মালিকানার মধ্যে বিরোধ:

পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত স্ব-বিরোধ ও আর্থনীতিক সংকটের জন্য এক সময় উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে এই বিরোধ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল অন্তর্বিরোধটি উল্লেখ করা দরকার। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মিলিত সংঘবদ্ধ শ্রম ক্রমশ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু উৎপাদিত দ্রব্যবসামগ্রী মুষ্টিমেয় মালিক ব্যক্তির সম্পত্তি হিসাবে কেন্দ্রীভূত হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে এই মালিকী-প্রথা কালক্রমে উৎপাদন শক্তির উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়; উৎপাদন শক্তির বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা করে। বিষয়টি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা দরকার। পুঁজিবাদ বিকাশের ফলে কলকারখানাগুলির আয়তন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুঁজিবাদের উৎপাদন-প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমশ বৃহদায়তনবিশিষ্ট হয়ে পড়ে। তখন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিকীকরণ ঘটে। পুঁজিবাদী উৎপাদন সামাজিক রূপ ধারণ করে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্রমশ অধিক সংখ্যক মানুষ একত্রে কাজ করে। পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালী অসংখ্য মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র ও নির্ভরশীলতার সম্পর্ক সৃষ্টি করে। অগণিত মানুষের কল্যাণ এই বৃহদায়তনবিশিষ্ট পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদের বিশেষত্ব হল উপাদানগুলিকে একত্র করে একসঙ্গে যুক্তভাবে অনেকের পরিশ্রমে পণ্য উৎপাদন করা। বস্তুত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিককে সংঘবদ্ধ করে এবং উৎপাদনকে সামাজিক প্রকৃতি প্রদান করে। পুঁজিবাদী উৎপাদন নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্রমশ এগিয়ে চলে। এইভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যত দ্রুত বিকশিত হতে থাকে শ্রমের সামাজিকীকরণের মাত্রাও তত বাড়তে থাকে। তখন উৎপাদনের সামাজিক চরিত্রের সঙ্গে শ্রমের ফসলের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার এক আপসহীন সংঘাতের সৃষ্টি হয়। সমাজের সমবেত শ্রমে উৎপন্ন সম্পদ-সামগ্রীর উপর সমাজের বা সমাজের অধিকাংশ লোক যারা এই কাজে খাটছে, তাদের কোন মালিকানার অধিকার থাকে না। কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পত্তি হিসাবে তা কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে পুঁজিবাদী উৎপন্ন ব্যবস্থা হল মালিক শ্রেণীর মুনাফা শিকারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত উৎপাদন-উপাদানের ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক উৎপাদন-সম্পর্ক এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যেখানে উৎপাদন শক্তির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। উৎপাদনের ব্যক্তিগত মালিকরা উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদনের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা করে। সেই অবস্থায় উৎপাদন শক্তি থাকে, কিন্তু তাকে আটকে রাখা হয়। আটকে রাখে বিদ্যমান উৎপাদনসম্পর্ক। মালিক শ্রেণীর অস্তিত্ব ও মুনাফার সন্ধান এ ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক উন্নত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে আর কিছুতেই খাপ খায় না। এই উৎপাদনশক্তির বিকাশের পথে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক শৃঙ্খল হিসাবে প্রতীয়মান হয়। এই শৃঙ্খলকে ভাঙ্গা জরুরী হয়ে পড়ে। তা না হলে সমাজের অগ্রগতি অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাস্তবে বিকশিত উৎপাদনের উন্নত ও নতুন শক্তিকে স্বীকার করে নিতে হয়। এবং অবশেষে উৎপাদনের পূর্ববর্তী সম্পর্ককে পরিবর্তন করতে হয় ও পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তনের স্বার্থে পুঁজিপতি মালিক শ্রেণীর উচ্ছেদ করা হয়। তখন উৎপাদনের সকল উপায় বা উপাদানের উপর সমাজের সাধারণ মালিকানা কায়েম হয়। উৎপাদন-উপাদানসমূহ সমাজের সকলের সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় এই ব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবী। এবং এই ব্যবস্থার নাম হল সমাজতন্ত্র।

পুঁজিবাদের অবসান ও সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব:

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বাস্তব অবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। এই অগ্রগতি সমাজতন্ত্রের আগমনের পথকে প্রশস্ত করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ভিতরেই সমাজতন্ত্রের উপাদানগুলি পরিপুষ্ট হতে থাকে, সমাজতন্ত্রের শক্তি দানা বাঁধতে থাকে। কালক্রমে পুঁজিবাদ স্ব-বিরোধ ও সংকটে হীনবল হয়ে পড়ে। এই সময় মেহনতী মানুষের সচেতন ও সক্রিয় উদ্যোগ-আয়োজনের মাধ্যমে পুঁজিবাদের ব্যক্তি-মালিকানার অবসান ঘটে। এবং অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এঙ্গেলস্ যথার্থই বলেছেন: “…বিপ্লবকে জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদ তাকে নিজের গর্ভে ধারণ করে আছে। আর এই বিপ্লবের লক্ষ্য হল উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর থেকে পুঁজিবাদী মালিকানার উচ্ছেদ সাধন এবং সমাজতান্ত্রিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা।”

সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পুঁজিবাদের পতন ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা:

মার্কস-এঙ্গেলসের তিরোধানের পর বিকশিত পুঁজিবাদ আবার এক নতুন স্তরে উন্নীত হয়। লেনিনের অভিমত অনুসারে এই স্তর সাম্রাজ্যবাদ’ নামে পরিচিত। সাম্রাজ্যবাদকে লেনিন পুঁজিবাদের সর্বশেষ স্তর বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাম্রাজ্যবাদ হল মুমূর্ষু পুঁজিবাদ। সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উপনীত হওয়ার পর পুঁজিবাদের স্ব-বিরোধ ও সংকট আরও বৃদ্ধি পায়। সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ে পুঁজিবাদ সাধারণত তিন ধরনের সংকটের সম্মুখীন হয়। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের এই তিন ধরনের সংকট সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক। (ক) সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রতিষ্ঠানগুলিতে উন্নততর আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থায় উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রম একত্রিত ও কেন্দ্রীভূত হয়। সাম্রাজ্যবাদী অবস্থায় পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রম অধিকতর সংঘবদ্ধ হয় এবং সামাজিক চরিত্র লাভ করে। শ্রমের ও উৎপাদনের সামাজিকীকরণ সত্ত্বেও উৎপন্ন পণ্যের মালিকানার অধিকার আরও অল্পসংখ্যক বা মুষ্টিমেয় মহাধনীর হাতে কুক্ষিগত হয়। (খ) সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অতি উৎপাদনের সমস্যা ও আর্থিক সংকট প্রবলভাবে প্রকট হয়ে উঠে। কারণ এই অবস্থায় পুঁজিপতিদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। কলকারখানাগুলির উপর মালিকশ্রেণীর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। পুঁজিপতি মালিকশ্রেণীর অতি মুনাফার লোভে উৎপাদন ব্যবস্থা অপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়। এবং তারফলে অতি উৎপাদনের সংকটকে এড়ান যায় না। (গ) সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের পরিণত পর্ব। পুঁজিবাদের এই পর্বে শ্রেণীবৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং প্রকট হয়ে পড়ে। এই সময় মালিক শ্রেণী ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ আপস-মীমাংসার অতীত ও তীব্রতর রূপ ধারণ করে। এই অবস্থায় পুঁজিবাদ হীনবল হয়ে পড়েছে। এবং অবশেষে তার অবসান আসন্ন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় শোষিত শ্রমজীবী শ্রেণী পুঁজিবাদের পতন সম্পন্ন করে এবং সমকালীন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে। তখন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে স্ট্যালিনের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: ‘এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, রাত্রির অবসানে দিন আসে, অনুরূপভাবে পুঁজিবাদের পতনের পর অবশ্যই আসবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ইতিহাস এইভাবে মার্কসের প্রলেতারীয় সমাজতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবিতাকে প্রমাণ করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটে, মালিক শ্রেণী বিদায় নেয় এবং শোষণ শেষ হয়। উৎপাদনের যাবতীয় উৎপাদনের উপর সমাজের সকলের সাধারণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সকলেই হল সামাজিক সম্পত্তির অংশীদার। এখানে প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ ব্যক্তিমাত্রেই হল কর্মী। সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। সমাজের সকলেই পরিশ্রম করে। দ্রুতগতিতে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদ বৃদ্ধি পায়। এবং এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান যথেষ্ট উন্নত হয়।

মূল্যায়ন

(ক) সকল দেশের সমাজব্যবস্থার সমাজতন্ত্রে উত্তরণ একইভাবে হয় না: মার্কসীয় দর্শনে সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতার কথা বলা হয়েছে। লেনিনও সমাজতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবিতার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হবে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার ঐক্যের মাধ্যমে এই সাফল্য আসবে। সকল দেশের সমাজব্যবস্থাই সমাজতন্ত্রে উন্নীত হবে। এই উত্তরণ অনিবার্য। কিন্তু সকল দেশে এই উত্তরণ অভিন্নভাবে হবে এমন নয়। সকল দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আর্থ-সামাজিক বিকাশের মান সমান নয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত বিষয়ে প্রতিটি দেশের নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্য আছে। এই কারণে সকল দেশের সমাজতন্ত্রে উত্তরণ একইভাবে হতে পারে না। উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহে পার্থক্যের কারণে কোন একটি বা কয়েকটি দেশে স্বতন্ত্রভাবে সমাজতান্ত্রিক বিজয়ের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। এ প্রসঙ্গে লেনিন আরও বলেছেন যে পৃথিবীর সকল দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ সমানভাবে হয়নি। পুঁজিবাদের বিকাশের এই অসমতার কারণে সকল দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় একই সময়ে হতে পারে না। কোন দেশে এই বিজয় বিলম্বিত হতে পারে, আবার কোন দেশে তা সত্বর সম্পাদিত হতে পারে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন দেশের আর্থ রাজনীতিক বিকাশের ক্ষেত্রে অসাম্য বা বৈষম্য। এই কারণের জন্যই পৃথিবীর সকল দেশের একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ অসম্ভব। তবে মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সকল দেশেই সমাজতন্ত্রের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

(খ) নির্ধারণবাদী, নিয়তিবাদী বা অদৃষ্টবাদী হিসাবে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর প্রথম পরিচ্ছেদের শেষে একটি ঐতিহাসিক ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এই ভবিষ্যদ্বাণী পুঁজিবাদী সমাজের ভবিতব্য সম্পর্কে। এখানে মার্কস-এঙ্গেলস্ মন্তব্য করেছেন যে, “বুর্জোয়াদের পতন এবং প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ, দুই-ই সমানভাবে অনিবার্য।” তাঁরা বলেছেন: “What the bourgeoisie, therefore, produces, above all, is its own grave-diggers. Its fall and the victory of the proletariat are equally inevitable.” তারপর বছর কুড়ি বাদে এই বক্তব্যেরই ব্যাখ্যা ও পুররাবৃত্তি করা হয়েছে ‘পুঁজি’ (Capital) শীর্ষক গ্রন্থে। এই ব্যাখ্যা ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও গভীর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আছে পুঁজিবাদের ভিতরকার স্ব-বিরোধ ও সংকটের কথা। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্ব-বিরোধ বর্তমান। এই স্ব-বিরোধ কার্যত উৎপাদন-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে, পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে সংঘাতের রূপ ধারণ করে। এই সংঘাত পুঁজিপতি ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রাম হিসাবে প্রতীয়মান হয়। মনে করা হয় যে, এই শ্রেণী-সংগ্রাম মানুষের ইচ্ছা-নির্ভর নয়, ইচ্ছা নিরপেক্ষ। এই শ্রেণী-সংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল সমাজবিপ্লব। এই সমাজ-বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়াদের বা পুঁজিপতিদের পতন এবং সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েতের বিজয় অনিবার্য।

প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কস-এঙ্গেলস্ মানবসমাজের ক্রমবিকাশের এক সাধারণ রূপরেখা চিত্রিত করেছেন। তাঁরা সমাজবিকাশের এক স্বচ্ছ ও সাধারণ ধারণা দিয়েছেন। সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়ম অনুসারে পুঁজিবাদী সমাজের পরেই সমাজবাদী সমাজের আবির্ভাব ঘটবে। মার্কসবাদীদের মতানুসারে সমাজবিকাশ সম্পর্কিত এই মার্কসীয় ধারণা বস্তুগত ও বৈজ্ঞানিক বিধির উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী। মানবসমাজের ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত এই মার্কসীয় মন্তব্যকে এইভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

মার্কসবাদী নির্ধারণবাদী—একটি মত: সমাজবিকাশের ধারায় সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অনিবার্যতা সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা বিতর্কের সৃষ্টি করে। এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদের বিপরীতধর্মী ব্যাখ্যার সৃষ্টি হয়েছে। সমাজতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবিতা সংক্রান্ত মার্কসীয় মন্তব্যকে দু’দিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই মন্তব্যকে একদিকে মার্কসীয় দর্শনের বস্তুগত ও বৈজ্ঞানিক প্রকৃতি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। অপরদিকে মার্কসবাদকে নির্ধারণবাদী ও নিয়তিবাদী প্রতিপন্ন করে তার দুর্বলতার প্রতি বিরুদ্ধবাদীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কার্ল পপার (Karl Popper), অধ্যাপক আয়ার (Ayer) প্রমুখ সমালোচকরা মার্কসীয় দর্শনকে ইতিহাসবাদী (Historicism) ও নির্ধারণবাদী (Deterministic) হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদূরা মার্কসবাদকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তদনুসারে সামাজিক ও প্রাকৃতিক যাবতীয় ঘটনা সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অনিবার্যতা অনস্বীকার্য। কার্ল মার্কস এক অমোঘ দ্বান্দ্বিক নিয়মের কথা বলেছেন। ভৌত বিজ্ঞানের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মত মার্কসের এই দ্বান্দ্বিক নিয়মও বিজ্ঞানসম্মত, সর্বজনীন ও পরিবর্তনের অতীত। মার্কসীয় এই দ্বান্দ্বিক বিধান অনুসারে মানবসমাজে ও প্রকৃতিতে দ্বন্দ্ব-মীমাংসার এক অপ্রতিরোধ্য প্রক্রিয়া সতত ক্রিয়াশীল আছে। সুতরাং মানবসমাজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঘটনাও মার্কসবাদ অনুযায়ী পুর্বনির্ধারিত। অতএব সমাজবিকাশের ধারায় পুঁজিবাদের পতনের পরেই সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের বিষয়টিও অবশ্যম্ভাবী। মার্কসীয় দর্শনের এই প্রত্যয় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মার্কসবাদের নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার। এই নির্ধারণবাদী ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অনিবার্যতার বিষয়টিকে মার্কসবাদে একটি সাধারণ ও সর্বজনীন নিয়ম হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতা প্রসঙ্গে মার্কসবাদকে যাঁরা নিয়তিবাদী বা অদৃষ্টবাদী বলে অভিযুক্ত করে, সেই সমস্ত সমালোচকদের বক্তব্য সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা দরকার। 

(১) এই শ্রেণীর সমালোচকরা উপরিউক্ত পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদকে নির্ধারণবাদী এবং সঙ্গে সঙ্গে নিয়তিবাদী হিসাবে প্রতিপন্ন করেন। এই সমস্ত সমালোচকরা এটাই প্রমাণ করার পক্ষপাতী যে, মার্কসীয় দর্শন অনুসারে মানুষের ভাগ্য হল পূর্ব নির্ধারিত।

(২) এই শ্রেণীর বিরুদ্ধবাদীদের মতানুসারে মার্কসীয় ধারণায় রাজনীতির ভূমিকা অস্বীকৃত। কারণ মার্কসবাদ হল নিয়তিবাদী। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সমাজে সমগ্র পরিবর্তন প্রক্রিয়াটি পূর্বনির্দিষ্ট। এই কারণে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় মানুষের করার কিছু নেই। এখানে মানুষের ভূমিকা অস্বীকৃত। মানব-সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়মিত নির্ধারিত। এখানে মানুষ হল নীরব দর্শকমাত্র। সুতরাং পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকৃত।

(৩) সমালোচকদের অভিমত অনুসারে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অনিবার্যতা সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা ভ্রান্ত। মার্কস মানবসমাজের দ্বান্দ্বিক বিকাশের ব্যাপারে যে সমস্ত নিয়মের কথা বলেছেন সেগুলিও ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক, কারণ বাস্তব অবস্থার দ্বারা অসমর্থিত। পৃথিবীর অধিকাংশ পুঁজিবাদী দেশেই পুঁজিবাদের পতন বা সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেনি। শুধু তাই নয়, বিকশিত পুঁজিবাদের পতন বা সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের সম্ভাবনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং বেশ কিছু দেশে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। সুতরাং সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতা সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা পরিত্যজ্য।

মানবসমাজের ক্রমবিবর্তনের ধারায় সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অনিবার্যতা প্রসঙ্গে মার্কসীয় বক্তব্যের উপরিউক্ত সমালোচনা মার্কসবাদীরা স্বীকার করেন না। তাঁরা মার্কসবাদকে নির্ধারণবাদী বা নিয়তিবাদী বলে মেনে নিতে নারাজ। এই সমস্ত মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের বক্তব্যগুলি ব্যাখ্যা করা দরকার।

(ক) মার্কসবাদকে যাঁরা নির্ধারণবাদী বা নিয়তিবাদী বলে অভিহিত করেন, তাঁরা মার্কসীয় দর্শনের সারবস্তুটি অনুধাবন করতে অসমর্থ। বিরুদ্ধবাদী সমালোচকরা এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের নিয়ম ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিয়মকে এক সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন এবং অভিন্ন প্রতিপন্ন করেছেন। কিন্তু সমাজ-বিজ্ঞান ও প্রকৃতি-বিজ্ঞানের নিয়ম এক ও অভিন্ন হতে পারে না। প্রকৃতি-বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজ-বিজ্ঞানের মৌলিক ও গুণগত পার্থক্য বর্তমান। কার্ল মার্কস নিজে এই পার্থক্য প্রসঙ্গে অবহিত ছিলেন এবং তিনি এই পার্থক্যকে অস্বীকার করেননি। মার্কসবাদী পণ্ডিত মরিস কর্ণফোর্থ (Maurice Cornforth) এবং মার্কসবাদের এক সুপরিচিত যোদ্ধা জন লুইস (John Lewis) এই পার্থক্যের বিষয়টি বিষদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

(খ) মার্কসীয় দর্শনে সমাজবিকাশের কোন নিয়তিবাদী তত্ত্ব নেই। নিয়তিবাদ সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। এ হল ধনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। ধনতন্ত্রের এই নিয়তিবাদী বৈশিষ্ট্য আর্থনীতিক নিয়মের অনিবার্য ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ধনতন্ত্রের এই অনিবার্য ক্রিয়াগুলি হল মুদ্রাস্ফীতি, মন্দা, সংকট, বেকারী প্রভৃতি। সুতরাং নিয়তিবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে মার্কসবাদ হল সম্পর্ক রহিত। এই দু’য়ের মধ্যে কোন সম্পর্ক-সংযোগ নেই।

(গ) কার্ল মার্কসের অভিমত অনুসারে স্ব-বিরোধ বা দ্বন্দ্ববাদ হল ইতিহাসের ধারায় মানুষেরই বিষয় বা ব্যাপার। সমগ্র মানব-ইতিহাসই হল মানব প্রকৃতির প্রতিনিয়ত রূপান্তরের ইতিহাস। মানুষের সচেতন কর্মপ্রচেষ্টাই সৃষ্টি করে চলমান ইতিহাস। বস্তুত ইতিহাস প্রসঙ্গে এই হল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি এভাবেই ইতিহাসকে দেখেছেন, অন্য কোন ভাবে নয়। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানুষ নিজেই নিজের ইতিহাস সৃষ্টি করে। মানুষের ইতিহাস কোন অজ্ঞাত কারণে সৃষ্টি হয় না। মানুষের সচেতন ও সক্রিয় প্রচেষ্টাই সমাজের পরিবর্তন সাধন করে ও সৃষ্টি করে ইতিহাস। এবং মানুষ নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তা করে। সুতরাং অদৃষ্ট বা নিয়তি নয়, মানুষ নিজেই হল তার ইতিহাসের স্রষ্টা। তবে এ ক্ষেত্রে মানুষের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ। একেবারে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত নয়; তা ঐতিহাসিক ও বস্তুগতভাবে সীমাবদ্ধ। সুতরাং এ কথা একান্তভাবে যুক্তিসঙ্গত যে সমাজ বিকাশের ধারায় সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অনিবার্যতা সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদের মধ্যে নিয়তিবাদী বা অদৃষ্টবাদী ধারণার অস্তিত্ব অসম্ভব।

(ঘ) পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যে বস্তুগত ভিত্তি বর্তমান থাকে তা মোটেই মানবিক নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই বস্তুগত ভিত্তিকে সকল মানুষের স্বার্থে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা অর্থাৎ মানবিক করে তোলা দরকার। তার জন্য সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু আপনা-আপনি সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রবর্তিত হতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন হল সমাজবিকাশের ধারা বা নিয়মগুলিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করা এবং সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করা। সমাজবিকাশের সংশ্লিষ্ট নিয়মগুলিকে প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা বিপত্তি দেখা দিলে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তা দূর করা দরকার। সুতরাং সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে কার্যকর করার জন্য যুক্তিসঙ্গত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অর্থাৎ অভিপ্রেত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য মানবিক সম্পর্ককে সংগঠিত করা দরকার। সুতরাং সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব অনিবার্য হলেও তা কেবলমাত্র আর্থনীতিক নিয়মের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় না অথবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবির্ভূত হয় না। তার জন্য প্রয়োজন হল ব্যাপক ও বিপুল এক রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের, সমাজ-বিপ্লবের। লক্ষ্য-সচেতন শ্রেণী-সংগ্রাম ব্যতিরেকে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব অসম্ভব।

(ঙ) সমাজ-বিপ্লবের সাফল্য এবং সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব শুধুমাত্র অর্থনীতির দ্বারা নির্ধারিত হয় না। এবং তা কোনভাবেই অদৃষ্ট বা নিয়তির দ্বারা নির্ধারিত হয় না। যে-কোন দেশে সমাজবিপ্লব সংঘটিত হওয়া এবং তা সফল হওয়ার ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের নিয়মগুলির যথাযথ অনুধাবন ও যথার্থ প্রয়োগ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় বিশেষত্বের (national specificity) বিষয়টিও তাৎপর্যপূর্ণ।

(চ) পরিশেষে এ প্রসঙ্গে জন লুইসের অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতানুসারে “মার্কসবাদ আর যাইহোক্, কোন মতেই নির্ধারণবাদী নয়।” নির্ধারণবাদীদের সমর্থনে মার্কসবাদে কিছু বলা হয়নি। সুতরাং মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী—মার্কসীয় দর্শনের এই প্রত্যয়কে নির্ধারণবাদী বা নিয়তিবাদী বলে অভিযুক্ত করা চলে না।