প্রত্নতত্ত্ব:

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সূত্র হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ; আদি-মধ্যযুগের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য। কারণ সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকীয় ভারত-ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহিত্যসূত্র সর্বাংশে নির্ভরযোগ্য হতে পারেনি। আবার সরকারি স্তরে দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের প্রথাও তখন গড়ে উঠেনি। স্বভাবতই প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য ইতিহাস রচনার কাজে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল সমকালের অসংখ্য লেখ। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের লেখই সমকালের ইতিহাসের সূত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে। লেখগুলির মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ লেখগুলি হল প্রতিহার-রাজ মিহিরভোজের ‘গোয়ালিয়র প্রশস্তি, ধর্মপালের ‘খালিমপুর লেখ’, নারায়ণ পালের ‘ভাগলপুর লেখ’, দেবপালের আমল-সম্পর্কিত ‘মুঙ্গের লেখ’ ও ‘বাদল-প্রশক্তি’, উমাপতি ধর রচিত বিজয় সেনের ‘দেওপাড়া লেখ চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘আইহোল লেখ’ ইত্যাদি। লেখর ওপর ভিত্তি করেই চোলদের আমলে প্রচলিত গ্রামীণ স্বায়ত্ত শাসনব্যবস্থার স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা যায়। এ প্রসঙ্গে দশম শতকে রচিত (৯২১ খ্রিঃ) উত্তর-মেরু গ্রামের মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ লিপিটির নাম উল্লেখ্য। অতিসম্প্রতি (মার্চ ১৯৮৭ খ্রিঃ) মালদহ জেলার জগজ্জীবনপুরে আবিষ্কৃত তাম্র শাসনটি ইতিহাসের নতুন সূত্র প্রদান করে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এই তাম্র লেখটি আবিষ্কারের পর এমন ধারণার জন্ম হয়েছে যে, রাজা দেবপালের পর প্রথম বিগ্রহ পাল সিংহাসনে বসেননি। দেবপালের অব্যবহিত পরেই সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র জনৈক মহেন্দ্রপালদেব। এই তাম্র শাসনে বৌদ্ধদের ভূমিদান সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এই বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিশেষ অনুগত ছিলেন।

সরকারি লেখগুলি অধিকাংশই ভূমিদান-সম্পর্কিত। জমি বিক্রি বা জমিদান-সংক্রান্ত নানা বিষয় এতে উল্লেখ করা আছে। এদের প্রথম অংশটি প্রশস্তিমূলক। এই অংশে রাজার নাম, বংশপরিচয়, রাজ্যের আয়তন ইত্যাদির বিবরণ থাকে। ভূমিদান অংশে দানকৃত জমির পরিমাপ, রাজস্ব-মূল্য ইত্যাদি লিপিবদ্ধ থাকে। সরকারি লেখর তুলনায় বেসরকারি লেখর সংখ্যা অনেক বেশি। গুপ্ত-পরবর্তী যুগের বেসরকারি লেখগুলি প্রধানত সংস্কৃত ভাষায় লেখা এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মবিষয়ক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রাক্ গুপ্ত বেসরকারি লেখগুলির মাধ্যম ছিল প্রাকৃত ভাষা এবং তার কেন্দ্রে ছিল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম। যাই হোক্, বেসরকারি লেখগুলির প্রচারক ছিলেন মূলত উচ্চ সরকারি পদাধিকারী ব্যক্তিগণ। এগুলির বিষয়বস্তু মুখ্যত ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে ‘ব্রহ্মদেয় দান’ কিংবা মন্দিরের উদ্দেশ্যে ‘দেবদান’-সম্পর্কিত। তবে উচ্চপদাধিকারীদের বংশপরিচয়, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মচেতনা ইত্যাদি বিষয়ে ইতিহাসমূলক তথ্য অর্জনে এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

আদি-মধ্যযুগের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মুদ্রার গুরুত্ব অকিঞ্চিৎকর। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর মুদ্রার গুরুত্ব হ্রাস পায়। সম্ভবত, এ সময় মুদ্রার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছিল। পাল, প্রতিহার, রাষ্ট্রকুট রাজারা খুব কম মুদ্রার প্রচলন করেন কিংবা আদৌ করেননি। সপ্তম শতকের পর থেকে একাদশ শতকের মধ্যবর্তী কালে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত সমতট-হরিবেল অঞ্চলে কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে পোড়ামাটির জিনিসপত্র, বুদ্ধমূর্তি, মন্দিরের অবশেষ ইত্যাদি কিছু কিছু পাওয়া যায়, যা সমকালের ইতিহাস রচনায় সাহায্য করে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত বেড়াচাঁপার চন্দ্রকেতুগড়ের ধ্বংসাবশেষ, অজয় নদীর তীরে গড়ে ওঠা ‘পাণ্ডুরাজার ঢিবি’ ইত্যাদি আদি-মধ্যযুগের ইতিহাসের সূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

বাণভট্টের হর্ষচরিত

কনৌজের পুষ্যভূতিবংশীয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের (৬০৭ খ্রিঃ-৬৪৭ খ্রিঃ) সভাকবি ছিলেন বাণভট্ট। বাৎস্যগোত্রভুক্ত ব্রাহ্মণ বাণভট্ট কনৌজের সন্নিকটে শোন নদীতীরবর্তী প্রীতিকূট নামক গ্রামে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষদিকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ও মাতার নাম যথাক্রমে চিত্রভানু এবং রাজ্যদেবী। কৈশোরে তিনি মাকে হারান এবং সদ্য যৌবনে তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। ফলে অভিভাবকহীন অবস্থায় তিনি কিছুটা অস্থির ও অসংযমী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সময় বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে তিনি দেশদেশান্তরে পরিভ্রমণ করেন। তাঁর সঙ্গী-বন্ধুদের মধ্যে কবি, নাট্যকার, বৈদ্য, চিত্রকর, লিপিকার, কথক, সন্ন্যাসী, যাদুকর ইত্যাদি নানা পেশার মানুষ ছিলেন। এঁদের সঙ্গ ও সাহচর্যে তাঁর অন্তর্নিহিত কলাজ্ঞান ও সাহিত্যপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটে।

দীর্ঘকাল দেশভ্রমণ, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং অধ্যয়নের ফলে তাঁর পাণ্ডিত্য গভীরতর হয়। সাহিত্য ও বিভিন্ন শাস্ত্রে বাণভট্টের অর্জিত দক্ষতার ভিত্তিতে সম্রাট হর্ষবর্ধন তাঁকে সভাকবির পদে বরণ করেন। হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি কাদম্বরী নামে একটি আখ্যায়িক এবং হর্ষচরিত নামে হর্ষবর্ধনের জীবনী রচনা করেন। তবে কোনোটিই তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। এই অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে একাধিক মত প্রচলিত আছে। কারও কারও মতে, বৌদ্ধদের প্রতি সম্রাটের সহিষ্ণুতায় বাণভট্ট ব্যথিত হয়ে এটি সম্পূর্ণ করার কাজ বন্ধ রাখেন। আবার অন্য মতে, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে হর্ষবর্ধনের পরাজিত হওয়ার ঘটনায় আশাহত হয়ে তিনি গ্রন্থ রচনার কাজ বন্ধ করে দেন। যাই হোক, হর্ষচরিত গ্রন্থটি আটটি অংশে (উচ্ছ্বাস) বিভক্ত। অধিকাংশ ভাগ গদ্যে রচিত। কিছু অংশে কৃত্রিম কাব্যসৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে বাণভট্ট তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের প্রথম কয়েক মাসের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। স্বভাবতই এই গ্রন্থের ইতিহাসগত মূল্য সম্পর্কে সংশয় ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন ঘটনার বিবরণ আছে সর্বাধিক বারো পৃষ্ঠার মতো। অবশিষ্ট আলোচনায় সম্রাটের গুণকীর্তন ও লেখকের কল্পনা প্রাধান্য পেয়েছে। তাই একে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া যুক্তিহীন। তা ছাড়া, বাণভট্ট এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু হিসেবে বহমান ঘটনাকে যতটা গ্রহণ করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এর সাহিত্যগত মান বৃদ্ধির দিকে। তাই ‘হর্ষচরিত’ যতটা ছিল ঐতিহাসিক গ্রন্থ, তার তুলনায় অনেকগুণ বেশি ছিল একটি কল্পনাধর্মী সাহিত্য।

কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ :

আদি-মধ্যযুগে রচিত একমাত্র স্বীকৃত ইতিহাসমূলক গ্রন্থটি হল রাজতরঙ্গিনী। এটি রচনা করেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান কলহন। কলহনের পিতা চম্পক সম্ভবত কাশ্মীর নৃপতি হর্যের একজন মন্ত্রী ছিলেন। রাজা হর্ষ ১১০১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন। চম্পক অতঃপর সরকারি কাজে যুক্ত ছিলেন না। সম্ভবত, কলহনও কোনো সরকারি পদের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তবে প্রাক্তন উচ্চ রাজকর্মচারীর সন্তান হিসেবে তিনি সমকালীন ঘটনাবলিকে রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে বিচারবিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত, বিশৃঙ্খল কাশ্মীর রাজ্যের ঘটনাবলি তাঁর লেখনীতে উঠে আসে। রাজা জয় সিংহের আমলে তিনি ‘রাজতরঙ্গিনী’ রচনার কাজ সম্পন্ন করেন। আনুমানিক ১১৪৮-‘৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ রচনা সম্পূর্ণ হয়। আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই গ্রন্থে প্রায় আট হাজার সংস্কৃত শ্লোক সন্নিবিষ্ট আছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের বক্তব্য ঐতিহ্য বা পরম্পরাগত লোকশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে পরিবেশন করা হয়েছে। পরবর্তী তিনটি অধ্যায়ে কার্কোট ও উৎপল রাজবংশ দুটির ইতিহাস লিখিত আছে। এর উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছেন মূলত ওই দুটি রাজবংশের কার্যকালে প্রত্যক্ষদর্শী লেখকদের বিবরণ থেকে। শেষে দুটি অধ্যায়ে (সপ্তম ও অষ্টম) তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় লোহার রাজবংশের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। ছয়টি অধ্যায়ের সাথে শেষ দুটি অধ্যায়ের গুণগত প্রভেদ লক্ষণীয়। প্রথম দুটি অধ্যায়ের রচনাশৈলী প্রধানত অলংকারবর্জিত, সহজ-সরল। কিন্তু শেষ অধ্যায় দুটির বর্ণনা আড়ম্বরপূর্ণ। প্রথম অধ্যায়গুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কালানুক্রম রক্ষা করা হয়েছে; কিন্তু সপ্তম-অষ্টম অধ্যায়ে ঘটনার সন-তারিখ প্রায় অনুপস্থিত। যথাযথ পূর্বপরিচয় প্রদান না করেই দীর্ঘ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও গৃহবিবাদ বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি নতুন নতুন চরিত্রের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। সম্ভবত, দেশবাসীর মানসিক চাহিদার ভিত্তিতে তিনি মূলত কল্পনাভিত্তিক কাহিনির অবতারণা করেছেন।

কলহনের রচনায় ধর্ম, কর্মফলবাদ, নিয়তিবাদ, এমনকি ডাকিনীবিদ্যাও স্থান পেয়েছে। তিনি ধর্ম ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তবে কোনরূপ ধর্মীয় গোঁড়ামি তাঁর ছিল না। ধর্ম-চেতনাকে তিনি সমাজের সৎ-চালিকাশক্তি বলে মনে করতেন। কাশ্মীরের গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তিনি ইতিহাসচর্চা করেছিলেন। তাই বহু ক্ষেত্রে তিনি অতিপ্রাকৃত বা আধ্যাত্মিক শক্তির সক্রিয়তার কথা বলেছেন। রাজা হর্যের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে তিনি নিয়তির অনিবার্যতা উল্লেখ করেছেন। রাজার ব্যর্থতা, প্রজাপীড়ন প্রসঙ্গে তিনি ‘দৈব প্রতিশোধ তত্ত্বের উল্লেখ করেছেন। অত্যাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রজাদের ব্যর্থতাকে তিনি দৈব-প্রতিশোধ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আবার এই অতিপ্রাকৃত শক্তির নিরসনের কারণ হিসেবে তিনি ‘দৈব সন্তুষ্টির তত্ত্ব’ (Divine pressure) উপস্থাপনা করেছেন। দৈব সহায়তা লাভের জন্য পুণ্যকর্ম হিসেবে কলহন ব্রাহ্মণদের দান-ধ্যান করার বিধান দিয়েছেন।

কলহন আধুনিক ইতিহাসকারের মতই কাশ্মীরের দূরবস্থার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। রাজা হর্ষের ব্যর্থতার জন্য কলহন হর্ষের ভ্রান্ত রাষ্ট্রনীতিকে দায়ী করেছেন। হর্য যুদ্ধ পরিহার করে চলতেন এবং অন্যের পরামর্শ গ্রহণ করতেন কোন বিচার ছাড়াই। ফলে তিনি বিপথে চালিত হতেন। এছাড়া তিনি সামন্ত (ডমর) শ্রেণির সক্রিয়তাকে কাশ্মীরের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভূমি-নির্ভর এই সামন্তরা সরকারী কর্মচারী হিসেবে নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি ভোগ করতেন। রাজপরিবারের সাথে এদের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এইভাবে সম্পদ ও শক্তির অধিকারী ডমররা রাজার কর্তৃত্বকেই অস্বীকার করতে শুরু করেছিল। হর্ষের মৃত্যুর পর সামন্তদের ক্ষমতা প্রায় অবাধ হলে, রাজ্যে বিশৃঙ্খলা প্রকট হয়। কলহন লিখেছেন যে, ‘উইপোকা যেমন মাকে ধ্বংস করে, কাঁকড়াবিছা যেমন পিতাকে ধ্বংস করে, তেমনি উচ্চাকাঙ্খী আমলাতন্ত্র অবাধ বলে দেশকে ধ্বংস করতে পারে। এজন্য কলহন নিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র ও কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করেছেন।

কলহন নিজেকে ঐতিহাসিক বলে দাবি করেননি। তিনি কবি হিসেবেই নিজেকে চিহ্নিত করেছেন এবং কবিতা রচনার প্রেরণা থেকেই তিনি কাশ্মীরের রাজনৈতিক ঘটনাবলি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। রাজতরঙ্গিনী রচনার উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, এতাবৎকাল কাশ্মীরের কোনো ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত রচিত হয়নি। পূর্ববর্তী রচনাগুলি ছিল ঐতিহ্যাশ্রয়ী এবং বহুক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। তিনি এই গ্রন্থে কাশ্মীরের রাজবংশ ও রাজন্যদের যথাযথ কালানুক্রম তুলে ধরতে প্রয়াসী হন। এজন্য তিনি যেমন পূর্ববর্তী রচনাবলির আশ্রয় নেন, তেমনি সেই সকল তথ্যসূত্রের সীমাবদ্ধতাগুলিও সচেতনভাবে অনুধাবন করেন। কাশ্মীরের ঐতিহ্যভিত্তিক রচনা ‘লীলামত পুরাণ’ বা ক্ষেমেন্দ্রর ইতিবৃত্ত থেকে সাহায্য নিলেও তাদের দুর্বলতা বা অস্পষ্টতা সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় উদ্দেশ্য ছিল যথাক্রমে কাশ্মীরের অতীত ঘটনা তুলে ধরে পাঠকদের আনন্দ বর্ষণ করা এবং পাঠকদের নীতিবোধ জাগ্রত করে মানসিক শান্তরস জাগ্রত করা। অধ্যাপক ব্যাসামের মতে, রাজতরঙ্গিনী রচনার কাজে কলহনের প্রধান লক্ষ্যই ছিল পাঠকদের শান্তরস জাগ্রত করা। সর্বোপরি ছিল জন্মভূমি কাশ্মীরের প্রতি তাঁর আত্মিক ভালোবাসা এবং নিজ লেখনীর মধ্যে দিয়ে সেই ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানোর ইচ্ছা। এজন্য তিনি কবিতার ছত্রে ছত্রে কাশ্মীরের ভূপ্রকৃতির সৌন্দর্যঘন রূপ এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ছবি তুলে ধরেছেন। রাজনীতি ও রাজতন্ত্র সম্পর্কেও তিনি তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কলহন পরম্পরাগত ঐতিহ্যের মাধ্যমে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, একজন শক্তিশালী রাজাই বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিদের দমন করে রাষ্ট্রের মঙ্গল বিধান করতে পারেন।

কলহন তাঁর পূর্বসুরী বা উত্তরসুরীদের বিচারে নতুন ও আধুনিক ইতিহাস চিন্তা ও রচনা পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন। তিনি ‘তোষামোদি ইতিহাস’ (Sycophant’s history) লিখতে প্রয়াসী হন নি। যুক্তি, তথ্য ও বিশ্লেষণ দ্বারা তাঁর ‘রাজতরঙ্গিনী’ সমৃদ্ধ। তাই এককভাবেই এই গ্রন্থ ইতিহাসের মর্যাদায় ভূষিত। রাজ চরিত্র, রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা সবকিছুই তাঁর কলমে উঠে এসেছে। ঐতিহ্যের প্রতি আস্থাবান হলেও, ইতিহাস রচনার কাজে তিনি নিজের মনকে মুক্ত রেখেই এগিয়েছেন। সে কারণে ভারতের প্রাক মধ্যকালীন পর্বে রচিত প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’র নাম উচ্চারিত হয়।

আলবেরুণী

মধ্য-এশিয়ার অন্তর্গত খারাজিম রাজ্যের রাজধানী খিবাতে আলবেরুণীর জন্ম হয় (৯৭৩ খ্রিঃ)। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে গজনির সুলতান মামুদ তাঁকে সভাসদরূপে বরণ করেন। মামুদের ভারত আক্রমণকালে আলবেরুণী ভারতে আসেন। অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী আলবেরুণী এদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করে প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্য ও দর্শন পাঠ করেন এবং গভীর জ্ঞানলাভ করেন। ভারতবর্ষের ওপর লিখিত তাঁর গ্রন্থ ‘তহকক্-ই-হিন্দ থেকে এদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস রচনায় এটি একটি অমূল্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। লেখক হিসেবে তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও বলিষ্ঠ মানসিকতার পরিচয় এই গ্রন্থে পাওয়া যায়।

অলবেরুণী ভারতীয় সমাজ জীবনের এক করুন বর্ণনা দিয়েছেন। তৎকলীন ভারতীয় সমাজ ছিল সার্বিক অসাম্যের কেন্দ্র। তিনি কঠোর বর্ণবিভাগের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন। ব্রাহ্মণ শ্রেণির পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের প্রশংসা যেমন তিনি করেছেন, তেমনি ব্রাহ্মণদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী এবং প্রগতিবিরোধী মনোভাবের নিন্দাও করেছেন। মামুদের আক্রমণের সময় ভারতীয় যোদ্ধৃশ্রেণী ‘ঠাকুর’ নামে অভিহিত হতেন। ‘ক্ষত্রিয়’ কথাটি তখন বিশেষ প্রয়োগ করা হতো না, আবার ‘রাজপুত’ শব্দটির প্রচলন তখনো ঘটেনি। ব্রাহ্মণ ও ঠাকুর এই দুটি শ্রেণীর হাতে ছিল দেশের সকল জমির মালিকানা। জ্ঞান অর্জনের অধিকারী ছিলেন একমাত্র ‘দ্বিজ-বর্ণে’র মানুষেরা। বেদপাঠ, মন্ত্রোচ্চারণ, যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান পরিচালনা ইত্যাদি ক্রিয়াকর্মে ব্রাহ্মণদের ছিল একচেটিয়া অধিকার। বৈশ্য, শূদ্র বা অন্য বর্ণের মানুষ এই সকল কাজে প্রয়াসী হলে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হত। রাজন্য বা শাসকের অনুমতি ছাড়াই ব্রাহ্মণের বিধানে এই ধরনের কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জিভ কেটে ফেলা যেত। চণ্ডাল বা বর্ণচ্যুতদের কেউ এমন অপরাধ করলে আরো নির্মম শাস্তি দেওয়া হতো।

উচ্চবর্ণের মানুষেরা দুর্গ-সংরক্ষিত নগর ও শহরে বসবাস করতেন। বর্ণাশ্রিত অবশিষ্ট জনতা দূর্গ প্রাকার ঘেরা গ্রাম বা ‘মওয়া’তে বসবাসের অধিকারী হতেন। ‘বর্ণচ্যুত’ মানুষদের অলবেরুনী দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। উচ্চস্তরের বর্ণচতদের বলা হত ‘অন্ত্যজ’। আর নিম্নস্তরের লোকেদের বলা হত স্নেচ্ছ বা অচ্ছুৎ। অন্ত্যজ শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিল ধোপা, মুচি, জেলে, নাবিক, তাঁতি, পশু-শিকারী, ঝুড়ি নির্মাতা প্রমুখ। নিম্নতর অচ্ছ্যুৎ শ্রেণীতে ছিলেন হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, বধতু প্রমুখ। এই উভয় বর্ণচ্যুতদের বাস করতে হত দুর্গ-প্রাকারের বাইরে। এরা দিনের বেলায় কেবল শ্রমদান বা উচ্চবর্ণের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের জন্য প্রাকারের মধ্যে প্রবেশের অধিকারী হতেন। অলবেরুণী একটি কাহিনীর মাধ্যমে। সেকালের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, রামের রাজত্বকালে কোন পিতার মৃত্যুর আগে পুত্রের মৃত্যু ঘটতো না। অকস্মাৎ এক ব্রাহ্মণ পুত্র মারা গেলে রাজা অনুসন্ধান করে দেখেন যে জনৈক চণ্ডাল ঈশ্বর-উপাসনা করার অপরাধে এহেন অঘটন সম্ভব হয়েছে। তৎক্ষণাৎ সেই চণ্ডালকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়।

অলবেরুণী স্পষ্ট ভাষায় ভারতীয় রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার কথা উল্লেখ করেছেন। সারা দেশে তখন বিবদমান একাধিক ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সেই অনৈক্য ও অভ্যন্তরীণ বিবাদ বহিরাগত আক্রমণকারীদের (মুসলমান) সাফল্য সহজ করেছিল। অবশ্য সুলতান মামুদের ভারত অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বিরূপ মন্তব্য করেছেন। অলবেরণী দুঃখের সাথে বলেছেন যে, সুলতান মামুদের ভারত অভিযান হিন্দুদের মনে এতটাই ঘৃণা উদ্রেক করেছিল যে, দুটি গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক মিলনের সম্ভাবনা অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছিল। ভারতের বিচারব্যবস্থাও ছিল অসাম্যে ভরা। ব্রাহ্মণরাই ছিলেন আইন প্রণেতা এবং বিচারক। নিম্নবর্ণের ন্যায়-বিচার প্রাপ্তির কোন সুযোগ প্রায় ছিলই না। কৃষক ও কারিগরশ্রেণী আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল, যা ভাগ্যের বিধান বলেই তারা বিশ্বাস করত।

আল হুজিরী :

শেখ সৈয়দ আলি আল হুজিরি (১০০৯-১০৭২/৭৭ খ্রিঃ) ছিলেন বিশিষ্ট পারসিক সুন্নী অতিন্দ্রীয়বাদী তাত্ত্বিক ও ধর্মবিদ। গজনীর সন্নিকটে হাজাবারে নামক স্থানে তাঁর জন্ম হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি ‘দাতা গঞ্জ বক্স’ নামেই বেশি পরিচিত। পারসিক সুফিবাদের ওপর তাঁর বিখ্যাত রচনাটি হল ‘কাসভ-অল-মাহজুব (অজানাকে প্রকাশ)। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামিক মতাদর্শের সম্প্রসারণের কাজে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। বর্তমান পাকিস্তানে তিনি একজন মহান সাধক হিসেবে বন্দিত হন। লাহোরে অবস্থিত তাঁর স্মৃতি-সৌধটি আকৃতিতে যেমন বিশাল, তেমনি প্রত্যহ অগণিত ভক্তের সমাবেশে সদা মুখরিত থাকে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার এই স্মৃতিসৌধ অধিগ্রহণ করে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাঁর অসংখ্য রচনাবলীর মধ্যে কেবল ‘কাসভ-অল-মহাজব’ গ্রন্থটি এখনো অটুট আছে। এই গ্রন্থে তিনি সনাতন সুফিবাদের তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন এবং ইসলাম ধর্মের মহান সাধকদের জীবনী ও মতাদর্শ বর্ণনা করেছেন।