ইতিবাচক ও নেতিবাচক স্বাধীনতার ধারণা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এই ধারণার এক দীর্ঘ পরম্পরা আছে। স্বাধীনতার ধারণা নিয়ে যখনই ভাবনাচিন্তা বা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে তখনই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এর ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা। সাধারণভাবে নেতিবাচক স্বাধীনতা বলতে বোঝায় বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি। কারণ যে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ মানুষকে পরাধীন করে তোলে। একজন মানুষ তখনই স্বাধীন যখন তার উপর কোন বাধানিষেধ নেই। অন্যভাবে বললে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোন কোন ক্ষেত্রে অপরের বাধা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের ক্ষমতা ও পছন্দ অনুসারে চলতে পারবে তার উপর নির্ভর করবে তার স্বাধীনতা। বেহাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, স্পেনসার, সিজউহক প্রমুখ লেখক স্বাধীনতা বলতে বুঝিয়েছেন ব্যক্তি জীবনের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীনতাকে। এগুলি হল স্বাধীনতার নেতিবাচক ধারণা।
স্বাধীনতার ইতিবাচক ধারণার সন্ধান পাওয়া যায় রুশো, হেগেল প্রভৃতির লেখায়। তবে সাম্প্রতিককালে যিনি এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি হলেন স্যার আইজায়া বেলিন (Sir Isaiah M. Berlin)। তিনি ‘Two Concepts of Liberty’ নামক প্রবন্ধে (১৯৬৯) এ সম্পর্কে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন।
হেনরি হার্ডি মন্তব্য করেছেন ‘বেলিনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক স্বাধীনতার ধারণা স্বাধীনতা সম্পর্কে যে-কোন আলোচনায় তথ্যসূত্র (reference point) হিসাবে কাজ করে। একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় জন স্টুয়ার্ট মিলের পর বেলিন হলেন সেই তাত্ত্বিক যিনি স্বাধীনতা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা ও লেখালেখি করেছেন।
নেতিবাচক স্বাধীনতা, বেলিনের মতে, জবরদস্তি ও ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপের অনুপস্থিতি। তিনি নেতিবাচক স্বাধীনতাকে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে – “আমি তখনই স্বাধীন যখন কোন একজন বা একদল মানুষ আমার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। স্বাধীনতা এই অর্থে হল সেই এলাকা বা ক্ষেত্র যেখানে মানুষ কোনরকম বাধা বা প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আপন ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারে বা নিজের জীবন পরিচালনা করতে পারে।” বেলিন প্রতিবন্ধকতার অনুপস্থিতিকে স্বাধীনতা বলেছেন। ধরা যাক, একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে এবং তখন তাকে অন্য কোন মানুষ বাধা দিচ্ছে না; তাহলে বেলিনের মতে সেই ব্যক্তি স্বাধীন। বেলিন সাধারণভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বাধার অনুপস্থিতিকে স্বাধীনতা বলায় অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মত হল বের্লিন নেতিবাচক স্বাধীনতার উপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এই বক্তব্য বা সমালোচনা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বেলিন স্বাধীনতাকে দ্বিবিধ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন— নেতিবাচক ও ইতিবাচক। ইতিবাচক অর্থে স্বাধীনতা বলতে বোঝায় একজন ব্যক্তি নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন? এই অর্থে নিজের জীবনের উপর স্ব-নিয়ন্ত্রণ হল ইতিবাচক স্বাধীনতার মূলকথা। স্ব-নিয়ন্ত্রণ, বেলিনের মতে, একজন মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে দুটি উপাদানের অস্তিত্বের কথা বলে একটি হল শাসকের উপাদান ও অন্যটি হল শাসিত হবার উপাদান। ব্যাখ্যা করে বলা যায় ইতিবাচক অর্থে একজন মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজের জীবন পরিচালনা করবে, সেখানে সে অন্য কারুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। একেই বেলিন Self mastery বা স্ব-নিয়ন্ত্রণ বলেছেন। শাসিত হবার উপাদানের অস্তিত্বের অর্থ হল ব্যক্তি নিজে উপলব্ধি করবে কোন্টা তার নিজের ও সমাজের পক্ষে ভাল। এই বোঝার ক্ষেত্রে সে স্বাধীন এবং এটা বোঝার পর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে, যেটা সমাজের পক্ষে শুভ ও কল্যাণকর তার কাছে সে আত্মসম্পূর্ণ করবে। বেলিন এক্ষেত্রে প্লেটো, কাণ্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। প্লেটোর মতে মানুষের মধ্যে তিনটি প্রাধান্যকারী উপাদান আছে— যুক্তি, সাহস ও ক্ষুধা এবং এই তিনটির মধ্যে যুক্তি হল প্রাধান্যকারী উপাদান যা অন্য সব উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করে।
একই রকম ভাবে ইমানুয়েল কান্টও মন্তব্য করেছেন যুক্তি এবং আবেগ—এই দুই উপাদানের মধ্যে যুক্তিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। প্লেটো, রুশো, হেগেলের মত বেলিনও স্বাধীনতার ইতিবাচক ধারণার উপর জোর দিয়েছিলেন যেখানে ব্যক্তি তার স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে নিজের ইচ্ছাকে পূর্ণ হতে দেখে। তবে এই ইচ্ছা সংকীর্ণ বা স্বার্থপর ব্যক্তির ইচ্ছা নয়, এটা হল তার আসল ইচ্ছা যা কৌম (community) ও সমাজের সামগ্রিক ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত। রুশো এই অর্থেই সাধারণ ইচ্ছার মধ্যেই ব্যক্তির স্বাধীনতার পূর্ণ বাস্তবায়ন হয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। এখানে ব্যক্তির ইচ্ছাকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে— একটি অপরিণত, স্বার্থপর ইচ্ছা—যা শুধু নিজের কল্যাণ চায় তা সে অপরের ক্ষতির বিনিময়ে হলেও। অন্যটি হল পরিণত ইচ্ছা— যা সমষ্টির কল্যাণের মধ্যেই নিজের কল্যাণ দেখে। এককথায় অপরিণত সত্ত্বার উপর পরিণত সত্ত্বার প্রভুত্বই স্বাধীনতার মূলকথা। বেলিন ও অন্যান্যরা স্বাধীনতার নেতিবাচক ও ইতিবাচক ধারণার মধ্যে পার্থক্য করেছেন এইভাবে যে প্রথমটিতে বোঝায় কোন কিছুর থেকে অর্থাৎ বাধা ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তিই স্বাধীনতা (freedom from)। আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কোন কিছু করা বা হবার স্বাধীনতা (freedom to)। কিন্তু নেতিবাচক ও ইতিবাচক স্বাধীনতার মধ্যে এইরকম পার্থক্য করা বাস্তবে যুক্তিসঙ্গত কিনা এবিষয়ে অনেক তাত্ত্বিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে প্রথমটিতে অপরের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়াকে বোঝায় আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে নিজের নিজেকে নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। যদি তাই হয় তাহলে কি সত্যিই এদের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় পার্থক্যটি মৌলিক ও তাত্ত্বিক। একটিতে বোঝায় বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি— যত বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ কম হবে স্বাধীনতার ক্ষেত্র ততই উন্মুক্ত হবে। কিন্তু দ্বিতীয়টিতে নিয়ন্ত্রণ আসে ব্যক্তির নিজের মধ্যে থেকে, সামাজিক কল্যাণের উপলব্ধি থেকে, তাই এই স্বাধীনতা প্রকৃতই ইতিবাচক। কোন বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ মুক্তির প্রভাবে নয়, সমষ্টির কল্যাণের জন্য নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতই মহৎ বিষয়; তাই স্বাধীনতার ইতিবাচক ধারণাই প্রকৃত স্বাধীনতা।
Leave a comment