সমাজের একেবারে নীচের দিকে ছিল কৃষকদের অবস্থান। মােট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ জনই ছিল কৃষক সম্প্রদায়ভুক্ত।
[1] শ্রেণিবিভাগ: মধ্যযুগের ইউরােপে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষকশ্রেণি তিনভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলি হল一
-
স্বাধীন কৃষক: এরা সামন্তপ্রভুর কাছ থেকে পূর্বনির্ধারিত খাজনার বিনিময়ে স্বাধীনভাবে জমিচাষের অধিকার পেত। এরা ছিল স্বাধীনকৃষক।
-
অর্ধ-স্বাধীন কৃষক বা ভিলেইন: সপ্তাহে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন সামন্তপ্রভুর জমিতে এবং বাকি সময়ে সামন্তপ্রভুর কাছ থেকে প্রাপ্ত জমিতে যারা স্বাধীনভাবে চাষ করত তারা ছিল অর্ধ-স্বাধীন কৃষক বা ভিলেইন।
-
ভূমিদাস বা সার্ফ: সার্ফ বলতে তাদেরই বােঝানাে হত যারা ক্রীতদাস না হয়েও প্রভুর জমিতে চাষ ও বসবাস করত এবং প্রভুর আজ্ঞা মেনে কাজ করত।
[2] অধিকার: সামন্ততন্দ্র কৃষক সমাজের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। একমাত্র জমির ওপরেই তাদের কিছু অধিকার বর্তেছিল। স্বাধীন কৃষকেরা খাজনার বিনিময়ে স্বাধীনভাবে জমিচাষের অধিকার পেত। ভিলেইনরা প্রভুর জমির উৎপাদিত ফসলের অংশবিশেষ ভােগ করার অধিকারী ছিল। আর সারফরা সামন্ত প্রভুর প্রায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলেও ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা যেত না। তবে সারাও নিজে থেকেও প্রভুর জমি ছেড়ে যাওয়ার অধিকারী ছিল না।
[3] স্বাধীনতা: সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কৃষক সমাজের স্বাধীনতাও ছিল জমিকেন্দ্রিক। এদের মধ্যে স্বাধীন কৃষকরা ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন ছিল। ভিলেইনরা সপ্তাহের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন ছাড়া বাকি দিনগুলি স্বাধীনভাবে নিজের জমিতে কাজ করতে পারত। সারা নিজের বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারত। এটুকু স্বাধীনতা ছাড়া সারা ছিল সম্পূর্ণরূপে প্রভুর নিয়ন্ত্রাগাধীন।
[4] জীবনযাত্রা: কৃষকসমাজের জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খড়ের ছাউনি দেওয়া ছােটো ছােটো কুঁড়েঘরে তাদের বসবাস করতে হত। শীতের সময় পরনের বস্তুটুকু ছাড়া অতিরিক্ত গরম পােশাক ও তাদের জুটত না। কৃষক সমাজ, বিশেষত সার্ফ বা ভূমিদাসরা অনেক সময় নিজেদের খাবার পর্যন্ত জোটাতে ব্যর্থ হত।
[5] সামাজিক মর্যাদা: স্বাধীন এবং অর্ধ স্বাধীন কৃষকেরা যতটুকু সামাজিক মর্যাদা পেত, সার্ফরা তার ভগ্নাংশও পেত না। সার্ফের পরিবারের সদস্যদের অনেক সময় প্রভুর জমিতে এবং অন্যান্য কাজে বেগার শ্রম দিতে হত। এর বিনিময়ে তারা শুধু খােরাকি পেত।
[6] করদান: কৃষকদের আয়ের ৮৫ শতাংশই সামন্তপ্রভুরা বিভিন্ন কর চাপিয়ে নিয়ে নিতেন। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষকদের তিনটি শ্রেণিকেই কিছু না কিছু কর দিতে হত, যেমন—ক্যাপিটেশন (প্রভুর প্রতি আনুগত্য প্রদান গত কর), টেইলি (সম্পত্তি কর), টাইদ (ধর্মীয় কর), মরুচুয়ারি (চার্চকে প্রদত্ত সৎকার কর), হেরিয়ট (উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির জন্য প্রদত্ত কর), বানালিতে (সামন্তপ্রভুর বিভিন্ন যন্ত্র ও গ্রামের কূপ ব্যবহারের জন্য প্রদত্ত কর) ইত্যাদি।
ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের বিকাশের পর বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।প্রতিরক্ষা বা সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রয়ােজনে সামন্তপ্রভুরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
[1] দুর্গ নির্মাণ: দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সামন্তপ্রভুরা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে অসংখ্য দুর্গ নির্মাণ করেন। দুর্গগুলি একদিকে যেমন বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ করত অন্যদিকে তেমনি সামন্তপ্রভুদের বাসস্থান ও স্থানীয় শাসনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত।
[2] জনগণকে নিরাপত্তা প্রদান: দুর্গগুলি অসামরিক জনগণকে নিরাপত্তাদানেও ভূমিকা পালন করত। বহিরাগত শত্রু অভিযান চালালে স্থানীয় জনগণ দুর্গে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ রক্ষা করতেন।
[3] দুর্গের নিরাপত্তা বিধান: নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য অনেক দুর্গ উঁচু পাহাড়ে নির্মিত হত। দুর্গুলি প্রাচীর বেষ্টিত হত এবং প্রাচীরকে বেষ্টন করে থাকত জলের গভীর পরিখা। একটি মাত্র টানা সেতুর ওপর দিয়ে দুর্গের ভারী লােহার দরজার মধ্যে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যেত।
[4] দুর্গের গম্বুজ নির্মাণ: দূরের শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য দুর্গের মাথায় যে গম্বুজ থাকত সেখান থেকে শত্রুকে লক্ষ করে তির বা বর্শা ছুঁড়ে তাকে আঘাত করা যেত।
[5] অশ্বারােহী নাইট-বাহিনী গঠন: শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সামন্তপ্রভুরা ‘নাইটাদের দিয়ে শক্তিশালী অশ্বারােহী বাহিনী গড়ে তােলেন। সমগ্র দেহ লৌহ বর্মে আবৃত নাইটরা তীব্রগতিতে ঘােড়া ছুটিয়ে শত্রুকে পর্যুদস্ত করত।
উপসংহার: সামন্ততন্ত্রে কৃষক ও ভূমিদাসদের জীবনে কোনাে আশার আলাে ছিল না।তাই শােষণের চরম মুহূর্তে তারা প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হত।
Leave a comment