প্রশ্নঃ ইউরােপের মধ্যযুগ ছিল মূলত অরাজনৈতিক- ব্যাখ্যা কর।

অথবা, মধ্যযুগ বলতে কী বুঝ? মধ্যযুগকে কেন অরাজনৈতিক বলা হয়েছে? আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগের সূত্রপাত ঠিক কখন থেকে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। এ সম্পর্কে দু’ধরনের মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। এক শ্রেণীর মনীষীগণ মনে করেন যে, খ্রিষ্টীয় গির্জার পতনের সময় থেকে এ যুগের সূচনা। দৃষ্টান্তস্বরূপ ম্যাকইলওয়েনের কথা প্রণিধানযােগ্য। অন্য শ্রেণী এ ব্যাপারে ভিন্নমত পােষণ করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, মধ্যযুগের রাষ্ট্রতত্ত্ব এক ঊষর মরুভূমির মতাে এবং তা প্রায়ই সম্রাট ও পােপের কর্তৃত্ব দ্বন্দ্বের ধূলাে ঝড়ে অশান্ত ছিল।

মধ্যযুগঃ রাষ্ট্র দর্শনের ইতিহাসে কোনাে সময়কে মধ্যযুগ বলা যায়, সে বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও মােটামুটিভাবে ইউরােপের ইতিহাসে ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ষােড়শ শতাব্দী কালকেই মধ্যযুগ বলা হয়। বস্তুত বর্বর জার্মান জাতি কর্তৃক রােমান সাম্রাজ্যের পতনের অব্যবহিত পরেই মধ্যযুগের সূচনা হয়। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়।

অরাজনৈতিক বলতে যা বােঝায়ঃ অরাজনৈতিকতা শব্দ দ্বারা সাধারণত এটাই বােঝা যায় যে, রাজনৈতিক প্রবাহ হতে আলাদা কোনাে কর্মকান্ড বা বিষয় অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্মকান্ড বিবর্জিত কোনাে যুগ। মধ্যযুগ মূলত ছিল অরাজনৈতিক- এ মন্তবের অনুকূলে নিম্নোক্ত কারণগুলাে উল্লেখ করা যেতে পারে।

(১) জার্মান জাতির আক্রমণঃ রােমান সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক উৎকৃষ্টতায় সমগ্র বিশ্ববাসী হয়েছিল অভিভূত। রােমানরাও তাতে কম গর্বিত ছিল না। কিন্তু বর্বর জার্মান টিউটন জাতির আক্রমণে তাদের শৌর্য-বীর্য সব নিক্ষেপিত হলাে মহাকালের অন্ধকার গহবরে। ফলে ক্রমান্বয়ে অরাজনৈতিকতা বৃদ্ধি পায় এবং মুক্ত রাজনৈতিক দর্শন সময়ের স্রোতে ভেসে বিলীন হয়ে যায়। যা অরাজনৈকতার সৃষ্টি করে।

(২) খ্রীষ্টধর্মের প্রভাবঃ মধ্যযুগের প্রথমদিকে খ্রীষ্ট ধর্মের প্রভাবে সমৃদ্ধ লেখক ও ধর্মীয় যাজকদের দ্বারা ধর্মীয় ক্ষমতার সমর্থনে জোরাল মত প্রকাশের সাথে সাথে চার্চের প্রধান পােপ এবং রাষ্ট্রীয় প্রধান সম্রাটের সঙ্গে শুরু হয় একের ওপর অন্যের আধিপত্যের ঠান্ডা লড়াই। ফলে মধ্যযুগের রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে।

(৩) প্রশাসনিক দুর্বলতাঃ মধ্যযুগের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিশৃংখলা দেখা দেয়। ইউরােপের পশ্চিমাংশে দেখা যায় সাম্রাজ্যের মধ্যে জার্মানদের প্রশাসনিক দূর্বলতার কারণে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার বিকাশ ঘটেনি। সঙ্গত কারণে মধ্যযুগ অরাজনৈতিকতায় পরিণত হয়। তৎকালীন প্রশাসন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়।

(৪) পােপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধিঃ পােপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি মধ্যযুগের রাজনীতিকে অরাজনৈতিকতায় পরিণত করে। মধ্য যুগে পােপের কথাই ছিল আইন। পােপের প্রাধান্য যেন সমগ্র মধ্যযুগকে গ্রাস করে রেখেছিল। মানুষকে তখন বাইবেল নির্দেশিত পথে চলতে বাধ্য করা হতাে। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র অতিক্রম করে চার্চের প্রধান পােপের জাগতিক বিশেষত সম্রাটদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেলে মুক্ত চর্চার পথ বন্ধ হয়ে যায়।

(৫) স্টোয়িকবাদের প্রভাবঃ মধ্যযুগের অরাজনৈতিকতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলাে স্টোয়িকবাদের প্রভাব। স্টোয়িকবাদ মধ্যযুগের সমস্ত রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করত। এ সময়ে স্টোয়িকবাদের ন্যায় মধ্যযুগের রাজনৈতিক দর্শনও প্রাকৃতিক আইন ও ঈশ্বরের আইনে বিশ্বাসী ছিল। সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান এই ধারণায় মধ্যযুগের মানুষ আস্থাবান ছিল।

(৬) চার্লসের নেতৃত্বঃ চার্লসের নেতৃত্ব মধ্যযুগের রাজনীতির সুষ্ঠু গতিধারাকে ব্যাহত করে। নবম শতকে সম্রাট চার্লসের নেতৃত্বে সাময়িকভাবে সাম্রাজ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। কিন্তু রাজনীতিতে কোনাে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। কিছুকাল পর মহান পােপের আবির্ভাবের সাথে সাথে চার্চের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর কারণে রাজনৈতিক সমাজে রাষ্ট্রীয় অধিকারও লােপ পায়।

(৭) পুস্তকের স্বল্পতাঃ মধ্যযুগে পুস্তকের স্বল্পতা রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা দেয়। উল্লেখযােগ্য যে, সেন্ট অগাস্টিন হতে সেন্ট টমাস এ্যাকুইনাস পর্যন্ত এমন কোনাে রচনা প্রকাশিত হয়নি যা রাষ্ট্রদর্শনের বিশেষ উপযােগী। মধ্যযুগে যেসব পুস্তক রচিত হয়েছিল তা ছিল মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। দু’একটা মূল্যবান পুস্তক যা প্রকাশিত হয় তাও প্রাচীন রচনার পুনরাবৃত্তি মাত্র।

(৮) ধর্মীয় চেতনার প্রভাব বিস্তারঃ মধ্যযুগে ইউরােপে ধর্মীয় চেতনার প্রভাব বিস্তার হতে থাকে। মধ্যযুগের শুরু হতেই রাজনৈতিক দর্শন মুক্ত চর্চার অবক্ষয়ের কোলে চলে যেতে থাকে। দিন দিন সমগ্র ইউরােপ ধর্মের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে ওঠে।

(৯) দুই তরবারি তত্ত্বঃ মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য দুই তরবারীতত্ত্ব। এ তত্ত্বের মূল বিষয় হলাে জাগতিক বিষয়ের অধিকর্তা রাজা এবং আধ্যাত্মিক জগতের অধিকর্তা হলেন পােপ। এই তত্ত্বকে উভয়ের মধ্যকার মীমাংসার উপায় বলে অনেকে মনে করতেন। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকরি ছিল না। তাই সমগ্র মধ্যযুগজুড়ে পােপও রাজার সংঘর্ষের কারণে অরাজকতা ও অরাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করে।

(১০) অরাজনৈতিক ও অসৃজনশীলঃ মধ্যযুগের প্রথম অংশে রাষ্ট্রচিন্তা কেবলমাত্র ধর্মীয় চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি এ যুগের দ্বিতীয়াধেও রাষ্ট্রচিন্তা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় প্রভাবের বাইরে ছিল না। পার্থিব জগৎ ও রাজনৈতিক বিষয়াদির ব্যাপারে মধ্যযুগ কখনাে মনােনিবেশ করেন। দর্শন বা রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত বিষয়াদি এ যুগের চিন্তাধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

(১১) অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীন জীবনঃ বস্তুত রােম সাম্রাজ্যের পতনের ফলে পশ্চিম ইউরােপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্ট হয় তা টিউটন বর্বরদের আদিম প্রকতির গােত্রীয় সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার দ্বারা তা পূরণ করা একান্ত অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের জীবনে নেমে আসে অব্যবস্থা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগ সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনার স্পর্শ পায়নি। এ ছাড়া মুক্ত রাজনীতির চর্চার দ্বার কখনাে উন্মােচিত হতে পারেনি। সুতরাং সার্বিক বিশ্লেষণে Prof. Dunning-এর ভাষায় বলতে দ্বিধা নেই যে, “The Middle age was unpolitical, its aspirations and ideals centered around the form and content of religious belief.”