সূচনা: পঞ্চদশ শতক থেকে নানান ইউরােপীয় নাবিকের প্রচেষ্টায় বিশ্বের ভৌগােলিক আবিষ্কার সম্ভব হয়। এর ফলে ইউরােপের দেশগুলি বহিঃইউরােপেও ব্যবসাবাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের সুযােগ পায়। উনিশ শতক থেকে ব্রিটিশ, ফরাসি, পাের্তুগিজ, স্পেনীয়, ডাচ বা ওলন্দাজদের প্রচেষ্টায় একের পর এক উপনিবেশ গড়ে উঠতে শুরু করে। পরে এই ঔপনিবেশিক প্রতিযােগিতায় জার্মানি, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শামিল হয়।

[1] ব্রিটিশদের উপনিবেশ: ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটিয়েছিল।

  • অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে: ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপটেন কুক অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বােটানি হ্রদ-এ সর্বপ্রথম ব্রিটিশ পতাকা ওড়ান। ওয়েক ফিল্ড এর নেতৃত্বে বহু ইংরেজ নিউজিল্যান্ডে এসে বসবাস শুরু করেছিল।

  • কানাডায়: কানাডায় প্রথম দিকে ফরাসিদের অনুপ্রবেশ ঘটলেও এখানে ব্রিটিশরা সুযােগ বুঝে প্রবেশ করে এবং বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে এখানকার কুইবেক অঞ্চলকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে।

  • ভারতে: বাণিজ্যের লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে পা রাখে। পরবর্তীকালে পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধে জিতে এবং দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে ব্রিটিশ বণিক কোম্পানি এদেশের শাসন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই আলাদা রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।

  • দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সিংহল, সিঙ্গাপুর, মালাক্কা ও ফিজি দ্বীপপুঞ্জ ব্রিটিশ সরকার নিজের দখলে আনে। দক্ষিণ আফ্রিকায় নাটাল, অরেঞ্জ, ট্রান্সভাল, সুদান, উগান্ডা, বেচুয়ানাল্যান্ড, রােডেশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলের ওপর ইংল্যান্ড নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

[2] ফরাসিদের উপনিবেশ: সপ্তবর্ষব্যাপী (১৭৫৬-৬৩ খ্রি.) যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় এবং নেপােলিয়নীয় যুদ্ধের (১৮০৩-১৫ খ্রি.) কারণে আরও কিছু অধিকৃত অঞ্চল ফ্রান্সের হাতছাড়া হয়। পরবর্তীকালে তৃতীয় নেপােলিয়ানের আমলে নতুনভাবে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে। ফ্রান্স দূরপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার নতুন নতুন অঞ্চল দখল করতে শুরু করে। আফ্রিকার আলজিয়ার্স ও টিউনিস অঞ্চল, পশ্চিম উপকূল এবং সেনেগল ফরাসি সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। আন্নাম, কম্বােজ, টংকিং প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের নিউ-কেলিডােনিয়া অঞ্চলটিও ফ্রান্স অধিকার করে নেয়।

[3] ওলন্দাজদের উপনিবেশ: জাভা, সুমাত্রা, বাের্নিয়াে এবং বালি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ইন্দোনেশিয়া (ইস্ট ইন্ডিজ)-তে ওলন্দাজরা ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ওলন্দাজরা আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ (কেপ কলােনি ও কেপ অব গুড হােপ) দখল করেছিল। পরে ওলন্দাজরা কেপ কলােনি ইংরেজদের বিক্রি করে দেয়। আফ্রিকায় প্রথমদিকে ওলন্দাজ শক্তির উপনিবেশগুলি ছিল নাটাল, অরেঞ্জ নদী উপত্যকা অঞ্চল এবং ট্রান্সভাল ইত্যাদি। ওলন্দাজ বণিকশক্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সিংহল বা শ্রীলঙ্কায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে অবশ্য সেখানে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ ঘটলে ওলন্দাজরা সিংহল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

[4] পাের্তুগিজদের উপনিবেশ: এশিয়ার মধ্যে ভারত এবং চিনে বাণিজ্যিক লক্ষ্য নিয়ে পাের্তুগিজরা প্রবেশ করেছিল। তারা ম্যাকাও বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে এবং সেখানে বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার মালয় আফ্রিকার গিয়ানা উপকূল, শােফালা এবং অ্যাঙ্গােলােতে পাের্তুগিজরা উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। এ ছাড়াও তারা আফ্রিকার পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলের মধ্যে এক যােগসূত্র গড়ে তােলারও প্রচেষ্টা চালায়।

[5] মার্কিনিদের উপনিবেশ: উপনিবেশ দখলের প্রতিযােগিতায় মার্কিনিরা এশিয়ার চিন এবং জাপানে সাম্রাজ্যবাদ কায়েমের উদ্যোগ নেয়। চিনে আফিম যুদ্ধের পরে মার্কিনিরা এবং জাপানে সর্বপ্রথম মার্কিন সেনাপতি কমােডাের ম্যাথু পেরি পদার্পণ করেন (১৮৫৪ খ্রি.)। এ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফিলিপিনস দ্বীপপুঞ্জ এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ মার্কিনিরা নিজেদের সাম্রাজ্যভুক্ত করে।

[6] রুশদের উপনিবেশ: চিনে বিদেশিদের অনুপ্রবেশ শুরু হলে সেই সুযােগে রাশিয়াও চিনে প্রবেশ করে। উনিশ শতকে মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য দখলকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ রুশ দ্বন্দ্ব বাধে। মধ্য এশিয়ার মার্ভ, পাঞ্জুদেহ দখল করে এবং হিরাট অভিযান চালিয়ে রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় নিজের বিস্তার নীতি অব্যাহত রাখে। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে রাশিয়া ভ্লাডিভস্টক নামে এক নৌবন্দর প্রতিষ্ঠা করে।

উপসংহার: নৌশক্তিতে শক্তিধর ইউরােপীয় দেশগুলি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ গড়ে তুলে নিজ নিজ আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিল।