উপন্যাস সাহিত্যে রোমান্টিক মনোভঙ্গীর যোগ্যতম প্রতিনিধি স্যার ওয়াল্টার স্কট। তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাসের জনক। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যে একটি প্রাণসূত্রের যোগ আছে, অতীতও যে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, সূক্ষ্মভাবে বর্তমানের মধ্যেই জীবিত— এই চেতনা স্কটের মধ্যে প্রবল ছিল এবং তা-ই তাঁর অতীতের জীবনকাহিনি অবলম্বনে রচিত উপন্যাসগুলির মুখ্য প্রেরণা। তিনি মধ্যযুগকে দেখেছেন উচ্চ আদর্শনিষ্ঠ, জীবনরস ভূয়িষ্ঠ নানা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নরনারীর দ্বারা অধ্যুষিত ও কৌতূহলী জনসাধারণের বিহারভূমি রূপে।

স্কট ইংরাজি ঐতিহাসিক উপন্যাসের জনকরূপে সর্বজনস্বীকৃত। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রাচীন তথ্য ও আধুনিক কল্পনায় মানবতাবোধের সুষ্ঠু সংমিশ্রণে গঠিত এক নূতন সৃষ্টি প্রকরণ। অতীতের মনোহর স্বপ্ন ঐতিহাসিক দুর্জেয় প্রাসাদে শৌর্য ঐশ্বর্যের স্মৃতি, ঘটনার ঘনঘটা তথা চরিত্রের চলমানতা নিয়ে এক পুনর্জীবিত ঐতিহাসিক চলচ্ছবি স্কটের পূর্ববর্তী কোনও রচনায় পাওয়া যায়নি। ইংলণ্ড, স্কটল্যান্ড তথা মহাদেশীয় অতীত ইতিহাসে রোমাঞ্চকর অভিযান, মধ্যযুগীয় দুর্গ, প্রাসাদ, গীর্জা, সমাধিক্ষেত্র তথা গিরি-প্রান্তর পরিখার বিচিত্র চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর উপন্যাসগুলিতে। 

সাহিত্য জগতে স্কট প্রবেশ করেছিলেন কবিরূপে। বাল্যাবস্থা থেকেই ওয়াল্টারের ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। রূপকথা ও রোমান্সধর্মী আখ্যায়িকাতে ছিল তাঁর দুরন্ত আগ্রহ। ইতিহাস ও লোককথার জগতে মগ্ন এই কবি স্কটই নিজের অজান্তে গড়ে তুলেছিলেন ঔপন্যাসিক স্কটকে।

স্কটের প্রথম উপন্যাস ‘ওয়েভারলি’ (Wiverley-1814) বিশাল ও বিশদ ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত এক চমকপ্রদ ও গতিময় কাহিনি। যুবক এডওয়ার্ড ওয়েভারলির একদল জ্যাকোবাইটের সংস্পর্শে আসা এবং স্কটল্যান্ডে সামরিক দায়িত্বে থাকাকালীন তাঁর প্রেম, বীরত্বের এক চিত্তাকর্ষক উপন্যাসগুচ্ছের প্রথম রচনা এটি।

এই পর্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসরূপে ‘দ্য হার্ট অব্ মিউলোথিয়ান (The Heart of Midlothian)-এর নাম করা হয়ে থাকে। এই উপন্যাসে সমাজের বস্তুনিষ্ঠ জীবন, ব্যক্তি চরিত্রের সুগভীর অনন্যতা, বৃহত্তর ঐতিহাসিক পটভূমিকা ও গতিবেগ অপূর্বভাবে সমন্বিত হয়েছে। স্কটল্যান্ডের কৃষকদের জীবনযাত্রা, তাদের গভীর ধর্মবোধ তাদের আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

অন্যদিকে ‘ওল্ড মট্যালটি’ (Old Mortalty) উপন্যাসে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের তীব্র দ্বন্দ্ব ও ধর্মোন্মাদনার বিকার চিত্রিত হয়েছে।

‘দি ব্রাইড অব ল্যামারমুর’ (The Bride of Lammermoor) উপন্যাসে প্রেম ও হিংসার করুণ কাহিনি চিত্রিত হয়েছে। এই উপন্যাসে র‍্যাভেন্ড প্রণয়াসক্ত হন লুসির প্রতি। কিন্তু প্রণয়ীযুগলের মিলনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় দুই পরিবারের বংশানুক্রমিক শত্রুতা, লুসির মা লুসিকে ভুল বুঝিয়ে তাকে অন্যত্র পাত্রস্থ করেন। এরপর র‍্যাভেউড তা জানতে পেরে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে আসে। লুসি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে খুন করে তার স্বামীকে। এদিকে র‍্যাভেনসউড ঘোড়া ছুটিয়ে যায় লুসির ভাই ও স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধ লড়তে এবং চোরাবালি গ্রাস করে উদ্বেল চিত্ত র‍্যাভেউডকে। উপন্যাসটি অতিনাটকীয় হলেও নায়কের নিয়তি বিড়ম্বিত নিদারুণ অবস্থা, মর্যাদা রক্ষার ব্যর্থ প্রয়াস উল্লেখযোগ্য।

১৮১৯-এ প্রকাশিত ‘আইভ্যানহো (Ivanhoe) ঐতিহাসিক উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা করেছিল। এই উপন্যাসে স্কটের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের প্রতি। উপন্যাসের ঘটনাস্থল ইংলণ্ড, সময়কাল সিংহ-হৃদয় রিচার্ডের রাজত্ব, ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধের যুগ। আইভ্যান হো-র বীরত্বের পাশাপাশি এই উপন্যাসে ত্রিমুখী প্রণয় সম্পর্কের জটিলতা পাঠকদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। এছাড়া এই উপন্যাসের গঠন কৌশল ও চরিত্র চিত্রণের দক্ষতাও বিশেষ প্রশংসনীয়। মধ্যযুগের ইতিহাস এবং অতিকথা ও রোমান্সের সার্থক মিশ্রণে এক সজীব ও চিত্তাকর্ষক উপন্যাস হল ‘আইভ্যানহো।

এই পর্যায়ের আরও কয়েকটি উপন্যাস হল ‘দি মনাস্টরি’ (The Monastery, 1820) — ও ‘কেনিলওয়ার্থ’ (Kenilworth-1821)। প্রথমটিতে প্রথম এলিজাবেথের সময়কাল একটি মঠের পটভূমিতে রচিত প্রেম, বীরত্ব ও দ্বন্দ্বযুদ্ধের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে ইংলণ্ডের সুন্দরী কন্যা আমির দুর্ভাগ্যের তথা করুণ পরিণতির কাহিনি চিত্রিত হয়েছে।

এরপর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একের পর এক উপন্যাস লিখেছিলেন স্কট। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘দি পাইরেট’ (The Pirate-1822), ‘দি ফরচুনস্ অব নাইজেল’ (The Fortunes of Nigel-1822), ‘কোয়েন্টিন ডারওয়ার্ড’ (Quentin Durward-1823), ‘দি ট্যালিসম্যান’ (The talisman-1825) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

‘দি পাইরেট’ জেটল্যান্ড ও সমুদ্রের পটভূমিতে প্রেম বৈরিতা ও দ্বন্দ্বের এক মিলনান্তক উপন্যাস। ‘দি ফরচুনস্ অব নাইজ়েল’ ওলিফন্টের ভাগ্যান্বেষণের কাহিনি। এই উপন্যাসের চরিত্রচিত্রণ প্রশংসনীয়। ‘দি ট্যালিসম্যান’ উপন্যাসটির ঘটনাকাল ধর্মযুদ্ধের যুগ। এটি একটি জনপ্রিয় উপন্যাস।

স্কটের উপন্যাসগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে বা পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ‘আইভ্যানহো’-র আগে পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ের উপন্যাসগুলি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের স্কটল্যান্ডের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত। ঘটনার ঘনঘটা, নাটকীয়তা তথা মনস্তাত্ত্বিক গুণ এই উপন্যাসগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে ‘আইভ্যান হো’ এরপর থেকে স্কটের উপন্যাসের মধ্যযুগের তথা ইংল্যাণ্ডের অতীত ইতিহাসের মূর্ত রূপ। আবার ‘কোয়েন্টিন ডারওয়ার্ড ও তার পরবর্তী রচনাগুলিতে স্কটের ঐতিহাসিক কল্পনা ও কাহিনি নির্মাণ বিস্তৃতি লাভ করেছে—মহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে ফ্রান্সে কিংবা ইটালীতে। তবে সব শ্রেণির উপন্যাস সমান না হলেও তাঁর ইতিহাসমনস্কতা তাঁকে ইংরাজি উপন্যাস সাহিত্যে অমরত্ব দান করেছে।

স্কটের উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য :

(১) অতীতচারিতা : ইংলণ্ড তথা মহাদেশীয় ইতিহাসের যুদ্ধ-বিগ্রহ, শৌর্য-বীর্যের নানা কাহিনি সজীবতা লাভ করেছে তাঁর উপন্যাসে।

(২) মানবিকতাবোধ : স্কট বিভিন্ন দেশ ও কালের বহু বিচিত্র ইতিহাসকে গতিময় ও প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন মানবিকতাবোধের দ্বারা।

(৩) ইতিহাসের প্রয়োগ : বাস্তব ও কল্পনাকে সমন্বয় করিয়ে স্কট তাঁর উপন্যাসে ঐতিহাসিক ঘটনা বা তার পরম্পরাকে নতুন করে সাজিয়েছেন। ফলে ঘটনা ও চরিত্র নতুন রূপ পেয়েছে।

(8) গদ্যরীতি : স্কটের গদ্য তেমন সাবলীল না হলেও তা শক্তিশালী ও যথাযথ। স্কটল্যান্ডের ভাষা ও উপভাষার ব্যবহারে স্কট সহজ ও স্বাভাবিক।

স্কট ও বঙ্কিমচন্দ্র : বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র অনেকটা স্কটের ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। স্কটের ‘ওয়েভারলি’ কিংবা ‘আইভ্যানহো’-র সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ কিংবা ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের তুলনা চলে। স্কটের ‘আইভ্যান হো’-র মতো ‘দুর্গেশনন্দিনী’র পটভূমি ষোড়শ শতক। এই উপন্যাসের ত্রিকোণ প্রেমের জটিলতার সঙ্গে (আইভ্যানহো, রাওএনা, রেবেকা) বঙ্কিমের উপন্যাসের (জগৎসিংহ, তিলোত্তমা, আয়েষা) প্রেম রহস্যের সাদৃশ্য নজরে পড়ে।।স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের শৌর্য-বীর্যের প্রতি যেমন স্কটের তেমনি বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল অপরিসীম আগ্রহ ও শ্রদ্ধা। এই প্রসঙ্গে ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘সীতারাম’ উপন্যাসের কথা মনে আসে। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের সীতারাম স্কটের প্রথম রিচার্ডের মতো বাহুবল ও তেজস্বিতার প্রতিভূ।

তবে ঐতিহাসিক চরিত্র সৃষ্টিতে স্কটের চেয়ে বঙ্কিমের সাফল্য প্রশংসনীয়। যেমন, রাজসিংহ, ঔরঙ্গজেব প্রভৃতি চরিত্র। বঙ্কিমের উপন্যাসে ইতিহাস অনেক বেশি কল্পনানুরঞ্জিত ও আদর্শধর্মী। সেখানে ইতিহাসের রোমান্স গৌণ, ভাবাদর্শপ্রসূত রোমান্সই মুখ্য। বঙ্কিমচন্দ্র হয়তো ‘ট্যালিসম্যান’ বা ‘কোয়েন্টিন ডারওয়ার্ড’ লিখতে পারতেন না। কিন্তু তিনি ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘আনন্দমঠ’ প্রভৃতি উপন্যাসে যে গীতি-মূৰ্চ্ছনাময় রোমান্স ব্যবহার করেছেন তা স্কটের পক্ষে কখনও সম্ভব হত না। অবশ্য ঐতিহাসিক তথ্যনিষ্ঠার জন্য নয়, উচ্চাঙ্গের ঐতিহাসিক কল্পনার জন্য স্কট ও বঙ্কিমচন্দ্র স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছেন।