আদিম যুগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন লিপিপদ্ধতির বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক লিপির উদ্ভব হয়েছে। মানবসভ্যতার প্রথম পর্যায়ে দুধরনের লিপিপদ্ধতির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়-
আলেখ্য-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি: মানবসভ্যতার একেবারে প্রথম যুগে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করত ছবির সাহায্যে। আনুমানিক ৩০,০০০ থেকে ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী পর্যায়ে মানুষ পর্বতের দেয়ালে, মৃত পশুর চামড়ায়, গুহার গায়ে বা গাছের গুঁড়িতে দাগ কেটে ছবি এঁকে উল্লেখযােগ্য বস্তু বা ঘটনাকে প্রকাশ করত। ইউরােপের ফ্রান্স, স্পেন ও সাইবেরিয়ায় এবং আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি মহাদেশে, এমনকি ভারতবর্ষের ভূপালের কাছে ভীমবেটকাতেও এই ধরনের গুহাচিত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের এইসব গুহাচিত্রে রয়েছে। আদিম মানুষের পশু শিকার এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর ছবি। রেড ইন্ডিয়ান এবং অন্যান্য আদিম উপজাতির মধ্যে এখনও ঘটনার ধারাবিবরণী দিয়ে চিত্রমালা অঙ্কনের রীতি অর্থাৎ আলেখ্য চিত্রাঙ্কন পদ্ধতিই প্রচলিত।
স্মারক-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির পরিচয়
প্রাগৈতিহাসিক যুগে মনের ভাব প্রকাশের জন্য কোনাে কোনাে অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন স্মারক-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। পেরুর আদিম মানুষ নানা রঙের দড়ির গুছিতে গিট বেঁধে বিশেষ বিশেষ বিষয়বস্তু ও ঘটনাকে নথিভুক্ত করত। এই জাতীয় স্মারক-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতিকে বলা হত কুইপু (Quipu) বা গ্রন্থিলিখন-পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন গিট, বিভিন্ন ঘটনা বা বস্তুর স্মৃতিবাহী ছিল। আদিম মানব-সমাজের সেই আদিম রীতির উত্তরাধিকারসূত্রেই হয়তাে আমাদের দেশে কোনাে কিছু মনে রাখার জন্য মেয়েরা কাপড়ের আঁচলে এবং পুরুষেরা ধুতির কোচার খুঁটে বা রুমালে গিট বাঁধেন। উত্তর আমেরিকার ইরােকোয়া উপজাতির লােকেরা পুঁতি গেঁথে গেঁথে তৈরি করতেন ‘ওয়ামপুম’ বা কোমরবন্ধ। সেই পুঁতির বিন্যাস ও সজ্জার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হত প্রস্তুতকারীর বক্তব্য। পাথরের নুড়ির বিন্যাসের মধ্য দিয়ে অথবা লাঠির গায়ে দাগ কেটে বা গাছের ডালে ন্যাকড়া জড়িয়েও প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করত। নুড়ির রং বা বিন্যাস, লাঠির গায়ে কাটা দাগের মাপ এবং গাছে ন্যাকড়া বাঁধার ধরনের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হত প্রকাশকারীর বক্তব্য।
সুতরাং, আলেখ্য-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি এবং বিভিন্ন প্রকারের স্মারক-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতিই মানবসভ্যতার প্রথম লিপিপদ্ধতি তবে এইসব পদ্ধতিতে মানুষের মনের ভাব প্রকাশিত হলেও এগুলি মানুষের মুখের ভাষার প্রকাশ নয়। তাই ডেভিড ডিরিঞ্জার এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ভূণলিপি।
প্রাচীন চিত্রলিপি এবং ভাবলিপি
চিত্রলিপি: আলেখ্য-চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি বা স্মারক চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির পরবর্তী যুগেই পৃথিবীতে প্রকৃত লিপির উদ্ভব হয়। এই স্তরে এসে মানুষ কয়েকটি রেখার সাহায্যে কোনাে বিষয় বা বস্তু বা ঘটনার রূপকে প্রকাশ করতে শুরু করে। যেমন, একটি ছােটো গােল বৃত্ত সূর্যকে প্রকাশ করতে লাগল, সূর্যের ছবি আর আঁকতে হত না। পাতা এঁকে গাছ, বাটি এঁকে খাদ্যগ্রহণ, পা এঁকে হাঁটাকে বােঝানাে শুরু হল এই পর্বে এসে। একেই বলে চিত্রলিপি (Pictogram)।
ভাবলিপি: চিত্রলিপির পরবর্তী সময়ে এল ভাবলিপি (Ideogram)। এই যুগে রেখার সাহায্যে বস্তুর বদলে বিশেষ ভাব বােঝানাে হতে লাগল। যেমন— একটি চোখ ও তা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার ছবি চিত্রলিপির যুগে চোখ ও অশ্রুকে বােঝালেও ভাবলিপির যুগে তা দুঃখকে প্রকাশ করতে লাগল। চিত্রলিপির যুগে একটি গােল বৃত্ত সূর্যকে প্রকাশ করত, ভাবলিপির যুগে তা আলাে বা আলাের দেবতাকে নির্দেশ করত। ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রাচীন ভাবলিপির নিদর্শন পাওয়া যায়। উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা ও ওশিয়ানিয়া মহাদেশের কয়েকটি আদিবাসীর মধ্যে এই দুই লিপিপদ্ধতি এখনও প্রচলিত।
প্রাচীন চিত্রপ্রতীকলিপি
প্রাচীন চিত্র প্রতীকলিপিতে রেখাচিত্র বিষয়বস্তু বা ভাবকে না বুঝিয়ে সেই বিষয়বস্তু বা ভাব প্রকাশকারী শব্দ বা ধ্বনিগুচ্ছকে প্রকাশ করতে লাগল। যেমন, প্রাচীন মিশরের চিত্রপ্রতীকলিপি (Hieroglyph)-তে মাথার ছবি ‘tp’ ধ্বনিগুচ্ছের তথা শব্দের প্রতীক ছিল, অর্থাৎ এই ধ্বনিগুচ্ছ দিয়ে মাথা’কে বােঝাত। অন্য একটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি বসে থাকা মানুষ মুখের কাছে হাত নিয়ে এসেছে। এই ছবিটি ‘wnm’ শব্দের প্রতীক, যার অর্থ খাওয়া। সুতরাং এখানে ধ্বনিগুচ্ছটি বা শব্দটি যে বিষয়বস্তু বা ভাবকে বােঝায়, রেখাচিত্রটি তারই ছবি। এরপর রেখাচিত্রের সঙ্গে বিষয়বস্তু বা ভাবের সম্পর্ক আর প্রত্যক্ষ রইল না। ক্রমশ রেখাচিত্র অঙ্কিত ছবির বিষয়বস্তু বা ভাবকে না বুঝিয়ে অন্য কোনাে কিছুকে বােঝাতে লাগল। যেমন একটা বাজপাখির ছবি ‘nsw’ ধ্বনিগুচ্ছের প্রতীক ছিল। কিন্তু সেই ধ্বনিগুচ্ছ বাজপাখিকে আর বােঝাল না, বােঝাতে লাগল ‘রাজা’কে।
এইভাবে লিপি যখন অর্থের প্রতীক না হয়ে শুধুমাত্র ধ্বনির প্রতীক হয়ে উঠল, তখন তার নাম হল শব্দলিপি (Logogram)। প্রাচীন মিশরের চিত্রপ্রতীকলিপি এবং প্রাচীন চিনের শব্দলিপি এই স্তরের লিপির উদাহরণ। প্রাচীন মিশরীয় শব্দলিপিতে ‘খেসতেব’ শব্দের অর্থ ছিল ‘গাঢ় রঙের নীলা’। ‘একটি লােক শুয়ােরের ল্যাজ ধরে টানছে’— এই চিত্র দ্বারা চিত্রলিপিতে ‘আটকানাে শুয়াের’-এর অর্থ প্রকাশিত হত। পরবর্তীতে ‘আটকানাে’ অর্থপ্রকাশে ‘খেস্’ ধ্বনিগুচ্ছ এবং ‘শুয়াের’ অর্থ প্রকাশে ‘তেব্’ ধ্বনিগুচ্ছ তৈরি হয়।
ধ্বনিলিপি বা বর্ণলিপি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।
কীলক লিপি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।
মিশরীয় হিয়েরােগ্নিফিক সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।
এশিয়ার দুই প্রাচীন লিপি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।
খরােষ্ঠী লিপি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করাে।
প্রত্ন-বাংলা লিপি থেকে আধুনিক মুদ্রণ-যুগের বাংলা লিপির ক্রমবিবর্তন আলােচনা করাে।
ব্রাহ্মী লিপি থেকে কীভাবে বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় এবং বহির্ভারতীয় লিপি উদ্ভূত হয়েছে, তা আলােচনা করাে।
আধুনিক পৃথিবীর যাবতীয় বর্ণমালা সৃষ্টি হয়েছে কোন আদি বর্ণমালা থেকে? পৃথিবীতে বর্ণমালার উদ্ভব ও বিবর্তন সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপি বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়গুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
সিন্ধুলিপি ও কীলক লিপি সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
ব্রাহ্মী লিপির উৎস সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে, তার বিবরণ দাও।
Leave a comment