প্রশ্নঃ আলাওলের পরিচয় দাও৷
উত্তরঃ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যেসব মুসলমান কবি স্মরণীয় হয়েছেন, যাদের প্রতিভায় বাংলা কাব্যে অভিনব বৈচিত্র্যের সঞ্চার হয়েছিল তাদের প্রায় সকলের কাব্য মুসলমান সমাজেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু যে দু’একজন কবির কাব্যের প্রভাব হিন্দু- মুসলমান উভয় সমাজেই ছড়িয়ে পড়েছিল মহাকবি আলাওল তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি যথার্থই বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের কবি। মধ্যযুগে বাংলার বাইরে আরাকানে বাংলা সাহিত্যের চর্চা চলত। সেখানে যে সকল মুসলমান কবি কাব্য রচনা করেছেন আলাওল তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। সৃষ্টির উৎকর্ষ ও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করে তাকে সুধীমহল মহাকবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আলাওলের বিচিত্র কাব্য বিষয়ের মত তার জীবনও বৈচিত্র্যময়। ‘সেকেন্দার নামা’ ও ‘সয়ফুলমুলুক’ কাব্যে কবির বিস্তারিত পরিচয় মেলে। সেখানকার আত্মপরিচয় মোতাবেক ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ কুতুবের অমাত্যপুত্র আলাওল চট্টগ্রামে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে লোকান্তরিত হন। কবি তার পিতার সাথে কার্যোপলক্ষে জলপথে যাওয়ার সময় জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন। পিতা নিহত হন এবং তিনি আহত অবস্থায় আরাকানে নীত হন। অতঃপর সেখানে আরাকান রাজ্যের সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহী সৈনিকের চাকরি গ্রহণ করেন। অচিরেই আলাওলের বিদ্যাবুদ্ধি ও কাব্যজ্ঞানের কথা অভিজাত সমাজে জানাজানি হয়। আরাকানের মুসলমান শাসনকর্তাদের উৎসাহে তিনি আরবি, ফারসি ও হিন্দি কাব্য অবলম্বনে বাংলা কাব্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন। কিছুকাল তাকে আরাকানের কারাগারে বিনাদোষে আবদ্ধ থাকতে হয়েছিল, তখন তিনি দারুণ যন্ত্রণা ও অপমান ভোগ করেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে উচ্চ রাজকর্মচারীদের আনুকূল্যে তিনি পুনরায় পূর্ব মর্যাদা ফিরে পান। আরাকানের প্রধানমন্ত্রী মাগণ ঠাকুর, অর্থমন্ত্রী সুলেমান, প্রসিদ্ধ পণ্ডিত সৈয়দ মুসা, মামুদ শাহ এবং আরাকানরাজ শ্রী সুধর্মার নির্দেশে তিনি অনেকগুলো কাব্য অনুবাদ সৈয়দ করেন। তার মৌলিক রচনা যৎসামান্য দৌলত কাজীর লোরচন্দ্রানীর শেষাংশ সমাপ্ত করা ছাড়া তার স্বাধীন কোন রচনা নেই।
মুসলমান সমাজে তার অত্যধিক জনপ্রিয়তার কারণ তিনি ইসলামী কাহিনী ও ধর্মতত্ত্বের নানা গ্রন্থ মূল আরবি ও ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন।
১. সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল (১৬৫৮-৭০)
২. সপ্ত (হপ্ত) পয়কর ( ১৬৬০ )
৩. তোহফা (১৬৬৩-১৬৬৯)
৪. সেকান্দর নামা (১৬৭২)।
কিন্তু তিনি হিন্দু-মুসলিম সবার কাছে খ্যাতি এবং পরিচিতি পেয়ে নন্দিত হয়েছেন হিন্দি কবি জায়সীর পদুমাবৎ কাব্যানুসারে অনুবাদ কাব্য ‘পদ্মাবতী’র (১৬৪৬) জন্য। এ কাব্য নানা সময়ে মুদ্রিত হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পদ্মাবতীর নতুন সংস্করণ সম্পাদনা করেছেন। পরবর্তীতে সৈয়দ আলী আহসানও সম্পাদনা করেছেন। বস্তুত আলাওল বাংলা সাহিত্যে বেঁচে আছেন তার ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের জন্য।
আলাওল কাহিনী ও চরিত্রের দিক থেকে জায়সীকে মোটামুটি অনুসরণ করেছেন। অনেক স্থান প্রায় ভাষান্তরের মত। কিন্তু কোন কোন স্থানে বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবেশের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কাব্যটির রচনাগুণ দৌলত কাজীর মত উৎকৃষ্ট না হলেও পয়ার ত্রিপদীগুলো অনেক সময় শিল্পসম্মত ও নিখুঁত হয়েছে। আলাওলের অধিকাংশ রচনা অনুবাদমূলক বলে তার প্রতিভার মৌলিকতা সম্বন্ধে হয়ত উচ্চতম প্রশংসা করা যাবে না, কিন্তু প্রতিভার ব্যাপকতায় ও বৈচিত্র্যে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে যে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়েছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
তার সয়ফুলমুলুক ও বদিউজ্জামাল ইসলামী রোমান্টিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। নায়ক সয়ফুলমুলুক ও নায়িকা বদিউজ্জামালের প্রেমকাহিনীই এর মূল উপজীব্য। তবে সে প্রেম মর্ত্য-প্রেমের আদর্শে রক্ষিত এবং মানবিকতার জন্য কাব্যটি নন্দিত।
হপ্তপয়করের কাহিনী ইরানি কবি নেজামি সমরকন্দীর কাব্য থেকে নেয়া। আরবের রাজকুমার বাহরামের যুদ্ধ জয় ও সপ্ত পত্নীর গল্প আরব্য উপন্যাসের কায়দায় বর্ণিত। সেখ রুসুফের ‘তুহফাতুন্নেসা’ নামে ফারসি নীতিকাব্য অবলম্বনে তার ‘তোহফা’ রচিত এটি কাব্য নয়, ইসলামী শাস্ত্র সংহিতার উপদেশে পূর্ণ নীতিগ্রন্থ।
কবি নেজামি সমরকন্দীর ফারসি কাব্য ‘ইসকান্দারনামা’র সরল অনুবাদ তার সেকান্দর নামা। কাব্যটিতে আলেকজান্ডারের বিজয় কাহিনী অনেকটা মুসলমানী কায়দায় সাজানো। যুদ্ধবিগ্রহের সাথে রূপকথার মত অদ্ভুত গল্পকথা এতে রয়েছে।
সর্বোপরি আলাওল আর যা-ই রচনা করুন না কেন, পদ্মাবতীই তার সৃজনকর্মের শ্রেষ্ঠ ফসল। যার মাধ্যমে কবির বেঁচে থাকা
Leave a comment