আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ (১২৪২ – ৪৬ খ্রিঃ):
বাহরাম শাহের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তুর্কি-আমিররা যে ঐক্যবোধের জন্ম দিয়েছিলেন, তাতে তাঁদের মধ্যে যে কেউ দিল্লির সিংহাসন দখল করে নতুন রাজতন্ত্রের সূচনা করতে পারতেন। কিন্তু আমিরদের পারস্পরিক ঈর্ষা ও সন্দেহপ্রবণতা তাদের অচিরেই বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যাই হোক, বাহরামকে হত্যা করার পর তুর্কি-অভিজাতগণ ইলতুৎমিসের পৌত্র তথা রুকন্উদ্দিন ফিরুজের পুত্র মাসুদকে দিল্লির সিংহাসনে বসান। অভিজাতবর্গের হাতের পুতুল মাসুদ শাহ নামে মাত্র সুলতান থাকেন। সমস্ত ক্ষমতা বণ্টিত হয় চল্লিশচক্রের (চাহেলগান) তুর্কি-আমিরদের মধ্যে। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল চল্লিশ। আমিরের অন্যতম সদস্য বাহাউদ্দিন বলবনের উত্থান। ক্ষমতালোভী তুর্কি-আমির ও মালিকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতাকামী কর্মকাণ্ডের সুযোগে বাহাউদ্দিন ক্রমশ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। ‘আমির-ই-হাজিব’-পদে আসীন এই তুর্কি যুবক নিজ দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব ও বিচক্ষণতা দ্বারা নায়েব-ই মাললিক কিংবা উজিরের পালের হাওয়া কেড়ে নিতে সক্ষম হন। মোঙ্গলদের আক্রমণ, রাজপুতদের বিদ্রোহ, বাংলা, বিহার, অযোধ্যা, মুলতান, উচ্ প্রভৃতির স্থানীয় প্রশাসকদের স্বাধীন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বলবনের লড়াই তাঁকে চল্লিশচক্রের নেতৃত্বের পথে অনেকটাই এগিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত মাসুদ শাহকে সরিয়ে ইলতুৎমিসের পুত্র নাসিরুদ্দিন মামুদকে দিল্লির সিংহাসনে বসানোর কাজও বলবনের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয় (১২৪৬ খ্রিঃ)।
নাসিরুদ্দিন মামুদ (১২৪৬ – ৬৬ খ্রিঃ) :
তুর্কি অভিজাতদের হাত ধরে নাসিরুদ্দিন সুলতানি মসনদে বসেছিলেন (১২৪৬ খ্রিঃ)। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন দয়ালু, ধর্মপ্রাণ ও সহজ-সরল চরিত্রের অধিকারী। তাঁর জীবনযাপন পদ্ধতি ছিল খুবই অনাড়ম্বর। সময় অতিবাহিত করার জন্য তিনি কোরান নকল করতে ভালোবাসতেন। নাসিরুদ্দিনের সততা, ন্যায়পরায়ণতা প্রসঙ্গে সমকালীন জনৈক ইতিহাসবিদ লিখেছেন যে, একদিন তাঁর স্ত্রী (বলবনের কন্যা) রান্নার সময় আঙুল পুড়িয়ে ফেলেন এবং একজন পরিচারিকা রাখার জন্য নাসিরুদ্দিনকে অনুরোধ করেন। কিন্তু সুলতান তাঁর দাবি নস্যাৎ করে দেন এই যুক্তিতে যে, “তিনি জনগণের অর্থসম্পদের রক্ষক মাত্র, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তা ব্যবহারের অধিকার তাঁর নেই।”অবশ্য আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, এই বক্তব্যে অতিরঞ্জনের ছাপ স্পষ্ট। কারণ যে বলবন ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, তাঁর কন্যার এই সামান্য দাবি অপূর্ণ থাকবে—একথা স্বীকার করা যায় না। যাই হোক, নাসিরুদ্দিন ছিলেন নমনীয় চরিত্রের অধিকারী এবং হস্তাক্ষরবিদ্যায় পারদর্শী। অতি অল্পে সন্তুষ্ট এই যুবক-সুলতান রাজনীতির জটিলতার পরিবর্তে কোরান নকল করে সময় অতিবাহিত করাতেই বেশি আনন্দ পেতেন।
সুলতান ইলতুৎমিসের আমলে The Forty বা ‘বন্দেগান-ই-চাহেলগান’ নামে খ্যাত চল্লিশ জন তুর্কি-আমিরের যে কর্তৃত্বের সূচনা হয়েছিল, রাজিয়ার মৃত্যুর পরবর্তীকালে তা চূড়ান্ত আকার পায়। স্বভাবতই নাসিরুদ্দিনের মতো অল্পবয়সী এবং সাদাসিধে সুলতানের পক্ষে ‘চল্লিশ-আমির’কে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। এই গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে বাহাউদ্দিন বলবন নাসিরুদ্দিনের আমলে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হন। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে নিজকন্যার সাথে সুলতান নাসিরুদ্দিনের বিবাহ দিয়ে নিজকর্তৃত্বকে বলবন আরও মজবুত করেন। একই বছরে বলবন ‘নায়েব-ই-মামলিকাত্’ পদে আসীন হন। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে নিজআত্মীয় ও একান্ত বিশ্বস্ত তুর্কি-আমিরদের বসিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই বলবনের প্রতি ক্ষুব্ধ এবং ঈর্ষান্বিত তুর্কি আমিরদের সহায়তায় নাসিরুদ্দিন নিজক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার একটা উদ্যোগ নেন (১২৫৩ খ্রিঃ)। বলবনকে নিজরাজ্য হাসিতে ফিরে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁর পদে বসানো হয় ইতমাদউদ্দিন রাইহানকে। আবুবকরের পরিবর্তে উজির পদে বসানো হয় জুনাইদিকে। বলবনের ভাই এবং ভ্রাতুষ্পুত্র প্রমুখকেও পদচ্যুত করে প্রদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কারণ হিন্দুস্তানি মুসলমান রাইহানের ক্ষমতাবৃদ্ধি অচিরেই তুর্কি-আমিরদের মর্যাদায় আঘাত করে। বলবনের নেতৃত্বে তুর্কি-আমিররা নাসিরুদ্দিনের ওপর চাপসৃষ্টি করে রাইহানকে পদচ্যুত করে বলবনকে পুনরায় নায়েব-ই-মামলিকাত পদে প্রতিষ্ঠিত করতে সুলতানকে বাধ্য করেন। এই নীরব প্রাসাদবিপ্লবের (১২৫৪ খ্রিঃ) পর বলবন আমৃত্যু দিল্লি-সুলতানির প্রধান ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত থাকেন।
১২৫৪ থেকে ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাসিরুদ্দিন সুলতান থাকলেও সমস্ত সুলতানি নিয়ন্ত্রিত হত বলবনের নির্দেশে। বস্তুত এই পর্বে বলবন তাঁর সংগঠনীশক্তির সফল প্রয়োগ দ্বারা দিল্লি-সুলতানির ভিত্তিকে মজবুত করে তোলেন। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহদমন, বহিরাগত মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ এবং তুর্কি-অভিজাতদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে স্থাপন করে বলবন অনন্য শক্তি ও আস্থা অর্জন করেন। ফলে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করলে (১২৬৬ খ্রিঃ) বলবন স্বয়ং দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ফিরিস্তি, ইসামী প্রমুখ মনে করেন, ক্ষমতালোভী বলবন অপুত্রক নাসিরুদ্দিনকে হত্যা করে মসনদ দখল করেছিলেন। অধ্যাপক নিজামীও এঁদের সাথে সহমত পোষণ করেন। কিন্তু ড. হবিবউল্লাহ্, উলসী হেগ প্রমুখ মনে করেন, নাসিরুদ্দিনের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক এবং আকস্মিক। যেহেতু তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী ছিল না, তাই বলবন স্বয়ং মসনদে বসে সাম্রাজ্য রক্ষার দায়িত্ব নেন।
নাসিরুদ্দিন মামুদের রাজত্বকালের বিস্তৃতি ছিল কুড়ি বছর। এমন একজন নমনীয়, ব্যক্তিত্বহীন, সাদাসিধে ব্যক্তির পক্ষে যুদ্ধপ্রিয় তুর্কিজাতির প্রধান হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে দীর্ঘ দু-দশক টিকে থাকা অবশ্যই বিস্ময়কর। এই বিস্ময়কর অবস্থার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ড. হবিবউল্লাহ’র বক্তব্যে। তিনি লিখেছেন, “মামুদ রাজত্ব করতেন কিন্তু শাসন করতেন না। তথাপি তিনি টিকেছিলেন কারণ তুর্কি অভিজাতদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি যথার্থ শক্তির ওপর আস্থাবান ছিলেন। তাঁর নমনীয়তা এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অভাব অবশ্যই যুগোপযোগী ছিল না। কিন্তু বাহাউদ্দিন বলবনের সুনেতৃত্বে নাসিরুদ্দিনের রক্ষাকবচের কাজ করেছিল।” ড. হবিবুউল্লাহ’রভাষায় : “A change on the throne became necessary even in his own times but Mahmud escaped his brother’s fate because of the loyal and devoted service of his naib Bahauddin Balban, the Ulugh Khan.”
Leave a comment