আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ:
দিল্লির সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন বলবন সর্বপ্রথম রাজতন্ত্রের আদর্শ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। বংশকৌলীন্য, রাজার দৈবস্বত্ব, সাধারণ যে-কোনো স্তরের মানুষের থেকে শাসকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও অধিকার ইত্যাদির ভিত্তিতে তিনি রাজার অধিকার ও কর্তব্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। অতঃপর আলাউদ্দিন খলজি রাজাদর্শ সম্পর্কে আরও বিশদ ও স্পষ্টভাবে তাঁর অভিমত জ্ঞাপন করেন। তবে বলবনের বক্তব্যের সাথে আলাউদ্দিনের বক্তব্যের মধ্যে মূলগত মিল থাকলেও প্রকৃতিগত স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। বলবন বাজার স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে সিংহাসনকে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদাদানের চেষ্টা তিনি করেননি। বলবন সুলতানের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও দৈবনির্দিষ্ট প্রতিপত্তির তত্ত্ব প্রচার করেন। কিন্তু আলাউদ্দিন সিংহাসনকে নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব ও মর্যাদাদানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে একটি স্বনির্ভর ও লৌকিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার উদ্যোগ নেন।
বলবনের মতো আলাউদ্দিনও নিজেকে ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরের ‘মনোনীত ব্যক্তি’ হিসেবে সুলতান যে-কোনো মানুষের তুলনায় অধিক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তাই সুলতানের ইচ্ছাই ছিল আইন। “Kingship knows no Kin ship”- এই তত্ত্বানুসারে আলাউদ্দিন মনে করতেন, রাষ্ট্রের সমস্ত মানুষ সুলতানের চাকর কিংবা প্রজা। সুলতান অতুলনীয়। যে-কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করা জার পবিত্র কর্তব্য শুধু নয়; এটি রাজতন্ত্রের মহান অধিকারও বটে। ব্যক্তিগতভাবে আলাউদ্দিন ছিলেন মুসলমান এবং একথা তিনি গর্বের সাথে প্রকাশও করতেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের ওপর ধর্মতন্ত্রের প্রাধান্য কিংবা রাষ্ট্রনীতির ওপর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব স্থাপন করতে দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শের বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য এবং মহানুভবতা হল ধর্ম থেকে রাষ্ট্রনীতির বিচ্ছিন্নকরণ।
মধ্যযুগীয় রীতি অনুযায়ী তখন রাজতন্ত্রের ওপর অভিজাতশ্রেণি এবং উলেমাদের প্রভাব ছিল সর্বময়। আমির, মালিক প্রভৃতি অভিজাতশ্রেণির মানুষ ছিলেন রাজনৈতিক পদাধিকারবলে সুবিধাভোগী শ্রেণি এবং প্রবল কর্তৃত্বের অধিকারী। নবপ্রতিষ্ঠিত দিল্লি-সুলতানির রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উৎসভূমি এই শ্রেণির বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষমতা বা সাহস আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী শাসকদের ছিল না। বলবন সুলতান হিসেবে তাঁর নিজস্ব স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট ছিলেন; কিন্তু শ্রেণি হিসেবে অভিজাতদের মর্যাদা তিনি খর্ব করতে চাননি। অন্যদিকে ইসলামীয় রাষ্ট্রের ধ্যানধারণা অনুযায়ী বিশ্বের যে-কোনো অঞ্চলের মুসলমান রাজতন্ত্র খলিফার অধীন এবং পবিত্র কোরান, হাদিস, শরিয়ত ইত্যাদির ভিত্তিতে শাসিত হতে বাধ্য। এবং ধর্মের রক্ষক ও ব্যাখ্যাকার হিসেবে উলেমা’দের রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন অনিবার্য। কিন্তু আলাউদ্দিন দৃঢ়ভাবে অভিজাতশ্রেণি এবং উলেমাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অস্বীকার করে রাজতন্ত্রকে একটি নতুন মর্যাদা দেন। আলাউদ্দিন অভিজাতদের দমন করার জন্য একাধিক আইন প্রণয়ন করেন এবং কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করেন। অভিজাতদের ‘গোষ্ঠীতন্ত্র’কে ভেঙে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন যে, সুলতানের ইচ্ছানুসারে এবং রাজ্যের প্রয়োজনানুসারে তাঁরাও নিয়ন্ত্রিত হতে দায়বদ্ধ।
একইভাবে আলাউদ্দিন রাষ্ট্রনীতির ওপর থেকে উলেমাদের মৌরুসীপাট্টার অবসান ঘটান। কোরানে উলেমাদের স্থান নির্দিষ্ট করা আছে। কে. এম. আসরাফ লিখেছেন : “উলেমাদের দায়িত্ব ছিল কর্মাদর্শের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ধর্মপথে আকৃষ্ট করা।” কিন্তু কোরানের ব্যাখ্যাকার হিসেবে ভারতে সুলতানি শাসনের সূচনা থেকেই উলেমারা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভোগ করতে শুরু করেন।
এমনকি বলবনের আমলেও রাষ্ট্রনীতির ওপর উলেমাদের প্রভাব অব্যাহত ছিল। কিন্তু আলাউদ্দিন দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, ‘রাষ্ট্রনীতি’ এবং ‘ধর্মনীতি’ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুটি দিক। উলেমাদের কাজ ধর্মনীতি চর্চা করা, রাজনীতি করা নয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের ন্যায়বিধান সম্পর্কে উলেমাদের তুলনায় সুলতানের জ্ঞান অনেক বেশি। বেয়ানার কাজি মুখিসউদ্দিন উলেমাদের কর্তৃত্বের প্রশ্নে সুলতানের সাথে একমত ছিলেন না। তাই তিনি পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর ধর্মের প্রভাবকে স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আলাউদ্দিন তাঁর সঙ্গে কথোপকথন প্রসঙ্গে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, “আমি জানি না কোন্টি আইনসম্মত এবং কোন্টি বেআইনি। রাষ্ট্রের পক্ষে যা মঙ্গলজনক কিংবা আপৎকালে যা জরুরি বলে মনে করি, আমি তাই বাস্তবায়িত করি; এবং সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারের দিন আমার কী হবে সে চিন্তা আমি করি না” (“I do not know whether this is lawful or unlawful; whatever I think to be for the good of the state or suitable for the emergency that I decree, and as for what may happen to me on the approaching day of judgement that I know not. “)। আলাউদ্দিন কথা প্রসঙ্গে কাজিকে বলেন, “সাধারণ মানুষ একরোখা এবং রাজাদেশ অগ্রাহ্য করার প্রবণতাই তাদের বেশি। তাই সুলতানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি তাদের ওপর কঠোরতম শাস্তি চাপিয়ে দিতে বাধ্য।” ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদের মতে, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আলাউদ্দিনের এই ধারণা হল ঘটনাপ্রবাহের অনিবার্য পরিণতি। মোঙ্গলদের আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা থেকে আলাউদ্দিন যেভাবে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলেন; তাতে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত ব্যক্তিত্ব হিসেবে আলাউদ্দিনকে গ্রহণ করার ব্যাপারে প্রজাদের মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। নিজের এই ভিত্তি সম্পর্কে আলাউদ্দিন সচেতন ছিলেন বলেই ত্রয়োদশ শতকের এত বড়ো একটা ঐতিহ্যকে ভেঙে বেরিয়ে আসার সৎ সাহস দেখিয়েছিলেন।
সুলতানের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠান জন্য খলিফার অনুমোদন একান্ত আবশ্যিক বলে আলাউদ্দিন মনে করতেন না। তাই তিনি কখনোই খলিফার অনুমোদনলাভের চেষ্টা করেননি বা নিজেকে ‘খলিফার ভৃত্য বলে অভিহিত করেননি। অবশ্য তিনি নিজেকে খলিফার সহকারী হিসেবে প্রতিভাত করার জন্য ‘ইয়ামিন-উল্-খলিফা’ উপাধি গ্রহণ করেন। শ্রীবাস্তবের মতে, আলাউদ্দিন রাজনৈতিক প্রভু হিসেবে খলিফাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এই উপাধি নেননি। আসলে আলাউদ্দিন খিলাফতের তত্ত্বীয় ঐতিহ্য ও ঐক্যকে রক্ষা করার জন্যই এই উপাধি ধারণ করেছিলেন।
আলাউদ্দিন রাজনীতিকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করলেও, তাঁর রাজাদর্শ কতখানি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, তা বলা কঠিন। নাসিরুদ্দিন চিরাগ বা আমির খসরু তাঁদের গ্রন্থে যথাক্রমে ‘খয়ের উল্-মজলিস’ এবং ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’তে আলাউদ্দিনের চরিত্রের যে চিত্র এঁকেছেন, তাতে তাঁকে ‘মুসলমান শাসক’ বলা চলে কিন্তু ‘মুসলমানের শাসক’ নয়। ‘খয়ের-উল্-মজলিসে’ সুলতানের একটি উক্তিতে শাসক হিসেবে প্রজাসাধারণের প্রতি তাঁর কর্তব্যবোধ এবং তাকে রূপায়িত করার আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে। সুলতান আন্তরিকভাবে বলছেন, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সৃষ্ট অসংখ্য জীব আছে। কিন্তু তিনি আমাকে তাদের ওপরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং এখন তাদের মঙ্গলার্থে আমার এমন কিছু করা উচিত যার সুযোগ সকলের কাছে পৌঁছাতে পারে।
আমির খসরু লিখেছেন : “The Sultan’s fostering care for the sons of Adam is greater than that of the sun for the moon and stars.” অর্থাৎ আলাউদ্দিন সামগ্রিকভাবে প্রজাদের মঙ্গলবিধান করা সুলতানের অন্যতম কর্তব্য বলে মনে করতেন। আধুনিক কোনো কোনো লেখকও এই মত পোষণ করেন। কিন্তু ড. শ্রীবাস্তবের মতে, আলাউদ্দিন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শে আদৌ আস্থাবান ছিলেন না। হিন্দুদের ওপর দমনমূলক আইনপ্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। তাই হিন্দুদের অধিকার সম্পর্কে কাজি মুঘিসউদ্দিন যখন বলেন যে, “রাজস্ব-সংগ্রাহক হিন্দুদের কাছে রৌপ্যমুদ্রা দাবি করলে তাদের স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া উচিত, কিংবা ‘ঈশ্বর স্বয়ং তাদের লাঞ্ছিত করার বিধান দিয়েছেন, তখন আলাউদ্দিন প্রতিবাদ না করেই হৃষ্টচিত্তে তা অনুমোদন করেন।” অথচ ইমাম আবু হানিফা পরিষ্কার ব্যাখ্যা করেছেন যে, “জিজিয়া প্রদানের পরিবর্তে হিন্দুরা রাজনৈতিক অধিকার ও নিরাপত্তা ভোগের অধিকারী।” আসলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়; আলাউদ্দিনের লক্ষ্য ছিল তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার ও কর্তৃত্ব যাতে উলেমাদের হস্তক্ষেপের দ্বারা বিঘ্নিত না হয়, তা সুনিশ্চিত করা। তাই ড. আর. পি. ত্রিপাঠী বলেছেন : “যে অর্থে আব্বরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায়, সেই অর্থে আলাউদ্দিনকে বলা চলে না। কারণ আলাউদ্দিনের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ছিল প্রয়োজনভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক নয়।”
ড. শ্রীবাস্তব মনে করেন, আলাউদ্দিন সচেতনভাবেই হিন্দুদের ওপর নিষ্পেষণ চালান এবং তা ধর্মের জন্যই। তিনি লিখেছেনঃ “His policy which was one of repressing them completely, was not due to a momentory vagary, but formed part of his settled ideology.” ড. কে. কে. দত্ত মনে করেন, উদারনৈতিক প্রজাকল্যাণমূলক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ গড়ে উঠলে, তা স্থায়ী হত। কিন্তু রাজনৈতিক চোরাবালির ওপর গড়ে ওঠা তাঁর সাম্রাজ্য তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বসে পড়ে।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আলাউদ্দিনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ নতুন পথের দিশারী হিসেবে স্মরণীয়। মধ্যযুগীয় পরিমণ্ডলে তিনি প্রবল প্রতাপশালী অভিজাত এবং উলেমাদের প্রভাব থেকে রাজতন্ত্রকে মুক্ত করার যে উদ্যোগ নেন, তা অভূতপূর্ব। এইভাবে আলাউদ্দিন সিংহাসনকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে মর্যাদাদানের যে কাজ শুরু করেন, মহম্মদ-বিন-তুঘলক তাকেই পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করেন।
খলজি শাসনের অবসানের কারণ :
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে খলজি শাসনের গুরুত্ব বর্ণনা প্রসঙ্গে মহম্মদ হাবিব লিখেছেন : “খলজিবংশের ক্ষমতালাভের ফলে যে ধারাবাহিক পরিবর্তন ও পরীক্ষানিরীক্ষা ঘটে, তাকে প্রায় বৈপ্লবিক বলা যায়” (“The successive changes that coincided with the Khalji ascendency to prower and the various experiments…. may be dubbed as nothing short of revolutionary.”)। ড. কে. এস. লাল মন্তব্য করেছেন : “অবিরাম রাজ্যবিস্তার, রাষ্ট্র পরিচালনার নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে তাঁরা এক নবযুগের সূচনা করেন।” মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করে সীমান্তের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, অভিজাতদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে ধ্বংস করা, উলেমাদের প্রভাব থেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে মুক্ত করা, নতুন নতুন রাজ্য জয় করে দিল্লি সুলতানিকে প্রকৃত সাম্রাজ্যের মর্যাদায় উন্নীত করা ইত্যাদি নানাক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন দ্বারা আলাউদ্দিন খলজিবংশের শাসনকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তথাপি খলজিবংশের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাম্রাজ্যের অবক্ষয় সূচিত হয় এবং চার বছরের মধ্যেই দিল্লির রাজপ্রাসাদ থেকে খলজিবংশের কর্তৃত্ব চলে যায়। বিরাট সাড়া জাগিয়ে খলজি-শাসনের এমন দ্রুত অবসানের জন্য ঐতিহাসিকেরা একাধিক কারণের অবতারণা করেছেন।
প্রথমত, খলজি সাম্রাজ্যবাদ গড়ে উঠেছিল আলাউদ্দিন খলজির ব্যক্তিগত প্রতিভা ও উদ্যোগকে ভিত্তি করে। প্রতিভাবান উত্তরাধিকারীর মাধ্যমে সেই ধারা অব্যাহত থাকা সম্ভব ছিল। কিন্তু আলাউদ্দিনের উত্তরাধিকারীরা ছিলেন সম্পূর্ণ অদক্ষ এবং অপদার্থ। নিজ বংশধরদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে সাম্রাজ্যের ভারবহনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। ফলে তাঁর পুত্রদের মধ্যে বিলাস-ব্যসন ও অনাচার এমনভাবে বাসা বেঁধেছিল যে, মসনদে বসার পরেও সেই অভিশপ্ত জগতের দুর্বার আকর্ষণ থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসতে পারেননি। সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হবার ফলে আলাউদ্দিন যতক্ষণ সক্ষম ও সবল ছিলেন, ততক্ষণ কাউকেই, এমনকি নিজের পুত্রদেরও ক্ষমতার কেন্দ্রে আসার সুযোগ দেননি। স্বভাবতই সাধারণ গুণসম্পন্ন মুবারক খলজি বা অন্যদের পক্ষে এতবড়ো দায় বহন করা সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয়ত, খলজিদেরও কোনো নির্দিষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না। ফলে ক্ষমতাদখলের জন্য দলাদলি, ষড়যন্ত্র এবং গুপ্তহত্যা প্রভৃতি এসেছিল অনিবার্যভাবে। ক্ষমতাবান মালিক ও আমিরগণও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেন। ফলে কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং মাথাচাড়া দিয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ ও স্বাধীনতাকামিতা।
তৃতীয়ত, আলাউদ্দিন যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তার ভিত্তি ছিল সামরিক শক্তি। এর পেছনে কোনো গণ-সমর্থন ছিল না। এ ধরনের সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করে সুলতানের ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা ও দক্ষতার ওপর। আলাউদ্দিন ছাড়া তাঁর বংশের অন্য কারও সেই গুণাবলি ছিল না। পরস্ত আলাউদ্দিন বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি দ্বারা আলাদা আলাদা ভাবে প্রায় প্রতিটি শ্রেণির মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছিলেন। স্বাধীনভাবে মেলামেশা নিয়ন্ত্রিত করার ফলে ক্ষুব্ধ ছিলেন তুর্কি অভিজাতরা। হিন্দুদের প্রতি সুলতানের ব্যবহার ছিল বিমাতৃসুলভ। বাজার নিয়ন্ত্রণের ফলে উৎপাদক ও ব্যবসায়ীশ্রেণি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ‘নব-মুসলমান’ নামে পরিচিত মোঙ্গলগণ অধিক অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে সর্বদাই ছিল সোচ্চার এবং প্রতিষ্ঠিত শাসনের বিরোধী। অর্থাৎ প্রায় সমস্ত শ্রেণির নাগরিক খলজি শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য ছিল উন্মুখ। এই কারণে ড. কে. কে. দত্ত বলেছেন : “The foundation of the military monarchy that Alauddin tried to build up was laid upon sand.”
Leave a comment