আলাউদ্দিন খলজির দক্ষিণ ভারত অভিযান: প্রকৃতি

আলাউদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান শাসক যিনি দক্ষিণ ভারত বিজয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে উপর্যুপরি সাফল্য তাঁর মনে গভীর আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং উত্তর ভারতকে সুলতানি শাসনের অধীনে এনে তিনি প্রকৃত অর্থে ‘ভারত-সাম্রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। তবে আলাউদ্দিনের দক্ষিণ ভারত অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, অযোধ্যার শাসক হিসেবে (সুলতান জালালউদ্দিনের আমলে) দেবগিরি অভিযান করে আলাউদ্দিন যে বিশাল পরিমাণ সম্পদ সংগ্রহ করেছিলেন, তা তাঁর মনে গভীর প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল। তাই সুলতান হওয়ার পর তিনি দক্ষিণ ভারতের বিরুদ্ধে অভিযানে লিপ্ত হন। অর্থাৎ দক্ষিণ ভারত জয় করে আলাউদ্দিন তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

সমসাময়িক লেখক আমির খসরু মনে করেন, দক্ষিণ ভারত অভিযানে আলাউদ্দিনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামের প্রসার। উত্তর ভারতে সাফল্য অর্জনের পর দক্ষিণ ভারতে ধর্মের প্রসার ঘটানো তিনি সুলতানের নৈতিক কর্তব্য বলে বিবেচনা করেন। তাই দক্ষিণ ভারতে তিনি সরাসরি সুলতানি শাসন করেননি। পরত্ত দাক্ষিণাত্যের মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ কর্মসূচি আলাউদ্দিনের ধর্মীয় অনুপ্রেরণার সাক্ষ্য দেয়।

ড. কে. এস. আয়েঙ্গার, কে. এস. লাল প্রমুখ খসরুর বক্তব্যের বিরোধিতা করে লিখেছেন যে, দক্ষিণ ভারতে অভিযানে আলাউদ্দিনের আদৌ ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল না। সুলতানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দক্ষিণের অপরিমেয় ঐশ্বর্য-সম্পদ লাভ করা। ড. আয়েঙ্গার লিখেছেন: “Ala-ud-din’s object in these various invasions of the Deccan and further South, appears to have gone on further than making them milch cows for the gold that he was often much in need of.”ড. লাল মনে করেন, গজনির সুলতান মামুদ যেমন অর্থের জন্য উত্তর ভারত বিধ্বস্ত করেছিলেন, একইভাবে আলাউদ্দিন ধনসম্পদের লোভে দক্ষিণ ভারত অভিযান করেন। তিনি লিখেছেন: “Really speaking the motives behind the campaigns of Kafur in the South were the same as those of Mahamud (of Ghazni) in the North. ”

আমির খসরুর যুক্তি খণ্ডন করে ড. লাল লিখেছেন, আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারতে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটানোর জন্য মন্দির ধ্বংস করেননি। তিনি মন্দির ধ্বংস করে সম্পদ সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন, কারণ দাক্ষিণাত্যে মন্দিরগুলিই ছিল সম্পদের সংগ্রহশালা। কিংবদন্তীর আলিবাবার মতো বিশাল ধনসম্পদ সংগ্রহ করাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। ড. জে. এল. মেহতা লিখেছেন: “Deogiri to Alauddin Khalji was a gateway to the treasure-trove of the legendary forty thieves’ and the Sultan was ever eager to posses the treasury by playing the role of ‘Ali Baba’. ” আর মসজিদ নির্মাণ করে তিনি ইসলামের প্রসার নয়। নিজের সামরিক সাফল্যের কীর্তি স্থায়ী করতে চেয়েছিলেন।

একথা অনস্বীকার্য যে, দক্ষিণী রাজ্যগুলির অপরিমেয় ঐশ্বর্য আলাউদ্দিনকে দক্ষিণ ভারত অভিযানে প্রলুব্ধ করেছিল। তবে এই অভিযানগুলিকে শুধুমাত্র অর্থের জন্য নিছক লুণ্ঠন-অভিযান বলা সঠিক হবে না। এখানেই সুলতান মামুদের সাথে আলাউদ্দিনের অভিযানের প্রকৃতিগত প্রভেদ। দক্ষিণ ভারতের হিন্দু রাজাদের পরাজিত করে সেখানে সুলতানি শাসন কায়েম করার একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আলাউদ্দিনের ছিল। কিন্তু তীক্ষ্ণ বাস্তববোধ তাঁকে এ কাজ থেকে বিরত করে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, দিল্লিতে বসে সুদূর দাক্ষিণাত্যে সুলতানি কর্তৃত্ব বজায় রাখা অসম্ভব। তাই তিনি হিন্দু রাজাদের আনুগত্য ও বার্ষিক কর প্রদানের শর্তে তাঁদের স্ব স্ব রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। দেবগিরি রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম অভিযান (১২৯৬ খ্রিঃ) এবং তার পরিণতি থেকে এই সিদ্ধান্ত সমর্থিত হয়। দেবগিরির বিপুল সম্পদ ও রাজা রামচন্দ্রদেবের আনুগত্যলাভের পর তিনি ওই রাজ্যে সরাসরি দিল্লির শাসন কায়েম না করে তা রাজা রামচন্দ্রদেবকেই ফিরিয়ে দেন। অবশ্য বাৎসরিক কর হিসেবে ইলিচপুর পরগনার রাজস্ব সুলতান পাবেন, এই শর্ত রামচন্দ্রদেব মেনে নেন।

ড. ইউ. এন. দে লিখেছেন : “Ala-ud-din was following a calculated policy of reducing the kingdoms of Deccan and the South as tributory states which would accept his sovereignty, pay annual tribute and act in all manners as his subordinates.” উত্তর ভারতে সুলতানি বাহিনীর সামরিক সাফল্য, মোঙ্গল আক্রমণের তীব্রতা হ্রাস এবং দক্ষিণী রাজ্যগুলির নিরন্তর অন্তর্দ্বন্দ্বজনিত অনৈক্য শক্তিক্ষয় আলাউদ্দিনের দক্ষিণ ভারত বিজয়ের কাজ অনেক সহজ করে দেয়।

আলোচ্য পর্বে দাক্ষিণাত্যের চারটি প্রধান রাজ্য ছিল রামচন্দ্রদেব শাসিত দেবগিরি, কাকতীয় বংশের রাজা প্রথম রুদ্রদেব শাসিত তেলেঙ্গানা, তৃতীয় বীর বল্লাল শাসিত হোয়সল রাজ্য এবং কুলশেখর শাসিত পাণ্ড্যরাজ্য। এই চারটি রাজ্যের রাজধানী ছিল যথাক্রমে দেবগিরি (বা দৌলতাবাদ), বরঙ্গল, দ্বারসমুদ্র এবং মাদুরাই। এ ছাড়াও কয়েকটি ছোটো ছোটো রাজ্য ছিল, যেমন— মানমাসিধা, কোল্লাস, ম্যাঙ্গালোর ইত্যাদি।

১৩০৬-১৩০৭ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারতে দুটি অভিযান পাঠান। প্রথম অভিযান প্রেরিত হয় গুজরাটের বহিষ্কৃত রাজা রায়করণের বিরুদ্ধে। গুজরাট থেকে বিতাড়িত হবার পর রায়করণ প্রথমে দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রদেবের আশ্রয় নেন। পরে মালব-সীমান্তে বগলানা অঞ্চলে কোনোক্রমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেন। আলাউদ্দিনের নির্দেশে আলপ খাঁ বগলানা আক্রমণ করেন। সম্ভবত, এর পেছনে গুজরাটের প্রাক্তন রানি এবং বর্তমানে আলাউদ্দিনের অন্যতমা পত্নী কমলাদেবীর একটি ভূমিকা ছিল। যখন কমলাদেবী গুজরাট থেকে দিল্লিতে আনীত হন, তখন তাঁর শিশুকন্যা দেবলাদেবীকে নিয়ে গুজরাটের রাজা করণদেব দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান এবং বগলানায় আশ্রয় নেন। এখন কমলাদেবী আলাউদ্দিনকে অনুরোধ করেন তাঁর কন্যাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। এই কারণে উলুঘ খাঁ বগলানা আক্রমণ করেন। রায়করণ বরঙ্গলে পালিয়ে যান। দেবলাদেবীকে বন্দি করে আলপ খাঁ সসম্মানে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে আলাউদ্দিনের পুত্র খিজির খাঁর সাথে দেবলাদেবীর বিবাহ দেওয়া হয়।

একই সময়ে দ্বিতীয় অভিযানটি পাঠানো হয় দেবগিরির বিরুদ্ধে। এই অভিযানে বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদাসহ মালিক কাফুরকে নেতৃত্ব দেওয়া হয়। মালব ও গুজরাটের শাসকদ্বয় যথাক্রমে আইন উল-মুল্ক ও আলপ খাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যেন মালিক কাফুরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। বস্তুত, এই সময় থেকে কাফুর দিল্লির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভূমিকা নিতে শুরু করেন, যা শেষ পর্যন্ত আলাউদ্দিনকেও ছাপিয়ে যায়। যাই হোক্, দেবগিরির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযানের মূল কারণ ছিল রামচন্দ্রদেব কর্তৃক সুলতানকে প্রতিশ্রুতিমতো বাৎসরিক অর্থ প্রদানের ব্যর্থতা। ইসামীর বর্ণনায় দেখা যায় যে, রামচন্দ্রদেব তাঁর এই ব্যর্থতার জন্য নিজপুত্র ভিল্লামা এবং অভিজাতদের দায়ী করে আলাউদ্দিনকে এক গোপন পত্র দ্বারা নিজের অসহায়ত্বের কথা জানান। অধ্যাপক নিজামীর মতে, রামচন্দ্রদেব এই পত্র দ্বারা প্রকারান্তরে সুলতানকে দেবগিরি অভিযান করে দিল্লি-বিরোধী গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার সংকেত দেন। রামচন্দ্রদেবের প্রতি সুলতানের পরবর্তী আচরণ অবশ্য এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে। খসরুর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, দেবগিরি একপ্রকার বিনা প্রতিরোধে সুলতানি-বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ইসামী লিখেছেন, মালিক কাফুর এবারেও দেবগিরি নগর ধ্বংস করেন। কিন্তু ফেরিস্তার মতে, “মালিক কাফুর দেবগিরির অধিবাসী ও তাদের সম্পত্তি রক্ষায় এতই আন্তরিক ছিলেন যে, একটি পিপীলিকাও এ কারণে আঘাত পায়নি।” অধ্যাপক সাক্সেনাও এই মত সমর্থন করে লিখেছেন : “It was a part of Ala-ud-din’s policy to win over both the Raj and his people.”

রামচন্দ্রদেব আত্মসমর্পণ করলে কাফুর অত্যন্ত মর্যাদার সাথে তাঁকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। আলাউদ্দিনও তাঁর প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন। সুলতানের অতিথি হিসেবে রামচন্দ্র দিল্লিতে প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত করেন। খসরু লিখেছেন : “Everyday his status and honour increased till, like a crescent moon, in the course of time he attained the full circle of light.” ফেরিস্তা লিখেছেন : “রামচন্দ্রদেবকে যে বিশাল সম্মান দেওয়া হয়েছিল, তাতে সভাসদগণ সুলতানের সাথে তাঁর কোনো প্রভেদ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।” আলাউদ্দিন রামচন্দ্রকে ‘রায়-রায়াণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ১ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করেন। সম্মানী হিসেবে একটি ‘স্বর্ণবর্ণ ছত্র’ দেন এবং গুজরাটের নভসরী অঞ্চলটি দেবগিরির সাথে যুক্ত করে রামচন্দ্রকে অর্পণ করেন। এই সময় রামচন্দ্র তাঁর কন্যা ঝট্যাপল্লীকে আলাউদ্দিনের সাথে বিবাহ দেন। দক্ষিণী-রাজ্যের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং মিত্রতাপূর্ণ কূটনৈতিক আচরণ আলাউদ্দিনের মর্যাদা ও ক্ষমতাবৃদ্ধির সহায়ক হয়। পরবর্তীকালে দেবগিরিকে কেন্দ্র করে তিনি দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যগুলিকেও পরাস্ত করেন।

দেবগিরির সাফল্যের পর আলাউদ্দিন তেলেঙ্গানা রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান। এবারেও সৈনাপত্য পান মালিক কাফুর। তাঁর সহকারী হিসেবে থাকেন খাজা হাজি। ইতিপূর্বে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতানি বাহিনী বরঙ্গল আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়েছিল। সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ এবং তেলেঙ্গানা রাজ্যের ধনসম্পদ সংগ্রহ করাই ছিল এই অভিযানের মূল লক্ষ্য। বারাণীর বিবরণ থেকে জানা যায়, অভিযানের প্রাক্কালে সৈনাপত্য অর্পণের পর আলাউদ্দিন কাফুরকে বলেছিলেন, “বরঙ্গল দখল এবং রাজা প্রতাপরুদ্রদেবকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে; কিন্তু রাজা তাঁর ধনসম্পদ, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি সমর্পণ করতে রাজি হলে এবং বার্ষিক করপ্রদানে সম্মত হলে অনর্থক কঠোর হয়ো না।” অর্থাৎ এক্ষেত্রেও সুলতানের লক্ষ্য ছিল তেলেঙ্গানার আনুগত্য ও নিয়মিত অর্থ আদায় করা।

তেলেঙ্গানায় প্রবেশ করে সুলতানী বাহিনী প্রথমে শিবপুর দুর্গ দখল করে। ১৩১০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তারা ‘বরঙ্গল দুর্গ’ অবরোধ করে। প্রতাপরুদ্র প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু এক মাস প্রতিরোধের পর তিনি উপলব্ধি করেন যে, সুলতানি বাহিনীকে পরাস্ত করা অসম্ভব। ফলে তিনি সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং আলাউদ্দিনের নির্দেশ অনুযায়ী কাফুর সাদরে তা গ্রহণ করেন। প্রতাপরুদ্র কাফুরকে একশো হাতি, সাত হাজার ঘোড়া ও প্রচুর ধনসম্পদ প্রদান করেন। কাফি খাঁর বিবরণ থেকে জানা যায়, এই সময় প্রতাপরুদ্র ‘কোহিনূর মণি’ আলাউদ্দিনকে প্রদান করেন। দিল্লিকে বাৎসরিক কর দিতেও তিনি সম্মত হন।

দেবগিরি এবং বরঙ্গল বিজয়ের ফলে আলাউদ্দিনের সেনাপতিদের সাহস, আত্মপ্রত্যয় এবং দুঃসাহসিক কাজের উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। অতঃপর সুলতানের পরামর্শে তারা বিনা দ্বিধায় আরও দক্ষিণে হোয়সল রাজ্য আক্রমণে অগ্রসর হয় (১৩১০-১১ খ্রিঃ)। মালিক কাফুর ও তাঁর সহকারী খাজা হাজি দেবগিরিতে পৌঁছে গোদাবরীর তীরে ‘জালনা’ নামক স্থানে একটি মধ্যবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করেন। কারণ দেবগিরির ভাবী রাজা শংকরদেবের ভূমিকা সম্পর্কে এঁরা নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাই দিল্লির সাথে অগ্রবর্তী বাহিনীর সংযোগরক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হয়। দ্বারসমুদ্রের রাজা তৃতীয় বীরবল্লাল ঠিক সেই সময় পাণ্ড্যরাজ্য আক্রমণে ব্যস্ত ছিলেন। সুলতানি বাহিনীর আক্রমণ-সংবাদ পেয়ে বীরবল্লাল দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং পাণ্ড্যরাজ্যের সহায়তায় সুলতানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেন। তবে প্রায় বিনাযুদ্ধেই তিনি কাফুরের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং প্রভূত পরিমাণ ধনসম্পদ দান করেন। ভবিষ্যতে দিল্লির অধীনতা মেনে চলতে এবং বাৎসরিক কর প্রদান করতেও স্বীকৃত হন। আলাউদ্দিন প্রতিদানে বীরবল্লালকে স্বরাজ্য শাসনের অধিকার দান করেন।

দ্বারসমুদ্র অভিযান সম্পন্ন করে কাফুর মাবার বা পাণ্ড্যরাজ্য আক্রমণ করেন। এই সময় পাণ্ড্যরাজ্যে এক গৃহবিবাদ চলছিল। রাজা কুলশেখরের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র সুন্দর পাণ্ড্য এবং বীর পাণ্ড্য সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে মত্ত হন। বীর পাণ্ড্য এই ভ্রাতৃযুদ্ধে সফল হলে সুন্দর পাণ্ড্য আলাউদ্দিনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। সম্ভবত, এই ইতিবাচক দিকটি ছিল বলে কাফুর বিনা বাধায় রাজধানী মাদুরাতে উপস্থিত হন। বীর পাণ্ড্য দিল্লির বশ্যতা স্বীকার না করেই আত্মগোপন করেন। কাফুর তাঁর সন্ধান না পেয়ে মাদুরা লুণ্ঠন করেন। আমির খসরুর বিবরণ অনুসারে কাফুর তাঁর সন্ধান না পেয়ে মাদুরা লুণ্ঠন করেন। আমির খসরুর বিবরণ অনুসারে কাফুর সেতুবন্ধন, রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং সেখানকার বিখ্যাত মন্দিরটি ধ্বংস করে তার স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু ইসামী বা বারাণী এ প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছেন। তাই ঐতিহাসিক Sewell, Dr. K. S. Lal প্রমুখ বিরুদ্ধ-মত পোষণ করেন। ড. লালের মতে, কাফুর মাদুরা থেকেই দিল্লিতে ফিরে যান, রামেশ্বরে তিনি আদৌ যাননি। খসরুর ‘আশিকা’গ্রন্থে কাফুর কর্তৃক রামেশ্বরে মসজিদ নির্মাণের কথা বলা হলেও, ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’ গ্রন্থে এর উল্লেখ নেই। এই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে, পাণ্ড্যরাজ্য থেকে কাফুর যে বিশাল ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছিলেন, তা ইতিপূর্বে কোনো অভিযান থেকে পাননি। এবং এর পরিমাণ জানতে পারলে কবরে শায়িত সুলতান মামুদও (গজনি) চমকে উঠতেন। জনৈক ঐতিহাসিক তাই লিখেছেন : “The treasures that were looted might have made Mahmud turn in his grave at Ghazni with wistful eyes.” আলাউদ্দিন লুণ্ঠিত ধনরত্নের অনেকটাই আনন্দে সামরিক-বাহিনীর সদস্য ও দিল্লির অভিজাতদের মধ্যে বণ্টন করে দেন।

দাক্ষিণাত্যের বিরুদ্ধে আলাউদ্দিনের শেষ অভিযান প্রেরিত হয় দেবগিরির বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়বার দেবগিরি আক্রমণের কারণ হল মৃত রাজা রামচন্দ্রদেবের পুত্র শংকরদেবের স্বাধীনতাকামিতা। সিংহাসনে আরোহণ করে (১৩১২ খ্রিঃ) শংকরদেব দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করেন এবং বার্ষিক করদান বন্ধ করে দেন। ফলে মালিক কাফুর আবার দেবগিরিতে উপস্থিত হয়ে শংকরদেবকে পরাজিত ও হত্যা করেন। অতঃপর তিনি নিজহাতে দেবগিরির শাসনভার গ্রহণ করেন। এখান থেকে কাফুর কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগ জয় করে রাইচুর ও মুগলে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেন। দাভোেল এবং চাউল বন্দরও তাঁর হস্তগত হয়। দিল্লি প্রত্যাবর্তনের পথে হোয়সল রাজ্য পুনরায় আক্রমণ করে তিনি বহু ধনরত্ন সংগ্রহ করেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আলাউদ্দিন দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির প্রতি ‘বশ্যতার বিনিময়ে স্বরাজ্যশাসন’ নীতি অনুসরণ করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যের প্রভূত সম্পদ তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার মেটানোর কাজে সহায়ক হয়েছিল। তথাপি পণ্ডিতদের মতে, আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য অভিযান ছিল প্রায় নিষ্ফল। ঐতিহাসিকের ভাষায় : “It was neither complete nor permanent.” কারণ পাণ্ড্যরাজ্য দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করেনি। দেবগিরি কিছুদিন পরে বশ্যতা অস্বীকার করেছিল। এমনকি চুক্তিবদ্ধ রাজ্যগুলির কর সংগ্রহের জন্য বার্ষিক অভিযান চালাতে হত। এতদ্‌সত্ত্বেও দুটি কারণে আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য অভিযানকে ফলপ্রসূ বলা চলে—

  • (১) দাক্ষিণাত্যের লব্ধ সম্পদ দিল্লির রাজকোষকে স্ফীত ও শক্তিশালী করে এবং 

  • (২) দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক মেলবন্ধন দ্বারা ভারত সাম্রাজ্য গঠনের পথ প্রশস্ত করেন।