আলাউদ্দিন খলজির সাম্রাজ্যবাদ ও আলাউদ্দিন:

ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত রূপকার ছিলেন আলাউদ্দিন খলজি। মহম্মদ ঘুরি বা কুতুবউদ্দিন আইবক যে সীমিত ভূখণ্ডের ওপর দিল্লি-সুলতানির সূচনা করেছিলেন, ইলতুৎমিস বা বলবন তাকে আদৌ সম্প্রসারিত করেননি। ইলতুৎমিস তাঁর পূর্বসূরিদের একদা অধিকৃত কিন্তু পরে বিচ্ছিন্ন রাজ্যখণ্ডগুলি পুনর্দখল করার একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা চালান, আর বলবন ক্ষমতা বা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মোঙ্গল আক্রমণের ভয়ে নতুন রাজ্যজয়ের জন্য দিল্লির বাইরে যাওয়া নীতিগত ও কৌশলগতভাবে অনুচিত ভেবে নিশ্চেষ্ট থাকেন। ড. আর. ত্রিপাঠী লিখেছেন যে, বলবন আলাউদ্দিনের তুলনায় কম সামরিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন ছিলেন না। কিন্তু তিনি সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সাকে পূরণ করার কোনো উদ্যোগ নেননি; কিন্তু আলাউদ্দিন তাঁর সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচি রূপায়িত করতে পেরেছিলেন। সিংহাসনের ওপর নিজের অধিকার ও কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার পরই আলাউদ্দিন সাম্রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী হন। তাঁর ক্ষমতালাভের দু-দশকের মধ্যে গুজরাট, মালব, রাজস্থান-সহ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং সুদুর দক্ষিণে মাদুরাই পর্যন্ত ভূখণ্ডে আলাউদ্দিনের বিজয়পতাকা উড্ডীন হয়। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র লিখেছেনঃ “এই বিরাট অঞ্চল দিল্লির সরাসরি শাসন কর্তৃত্বের মধ্যে আনারও চেষ্টা করা হয়। সুলতানি সাম্রাজ্যবিস্তারের এই নতুন পর্ব আলাউদ্দিন খলজি সুত্রপাত করেন।”

সাম্রাজ্যবাদের রূপকার হিসেবে আলাউদ্দিন ‘সিকন্দার-ই-সানি’ বা ‘দ্বিতীয় আলেকজান্ডার’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজের মুদ্রায় তা খোদিত করেন। বারাণী লিখেছেন : “গুজরাট-বিজয়ের পর আলাউদ্দিন একটি নতুন ধর্মের প্রচারক (নবি) এবং ‘বিশ্ববিজেতা’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা নেন।” আলাউদ্দিন মনে করতেন, হজরত মহম্মদ যেমন তাঁর চারজন প্রধান উত্তরসূরি আবুবকর, ওসমান, ওমর ও আলির সাহায্যে ধর্মবিজয় ও রাজ্যবিজয় সম্পন্ন করেছেন, তেমনি আলাউদ্দিন ও তাঁর চার প্রধান অনুচর উলুঘ খাঁ, নুসরৎ খাঁ, জাফর খাঁ ও আলপ খাঁ’র সাহায্যে হজরত মহম্মদের মতোই এক নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করতে সক্ষম। আবার নিজের সামরিক দক্ষতার ওপরে ছিল তাঁর অগাধ আস্থা। তাঁর এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে, উপরোক্ত চার অনুগামীর সহায়তায় তিনি গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের মতোই সারা বিশ্বে দিল্লি সুলতানির বিজয়পতাকা উড্ডীন করতে পারবেন। নিঃসন্দেহে এই দুটি পরিকল্পনাই ছিল আলাউদ্দিনের সীমাহীন দত্ত ও অযৌক্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর মিত্র ও দিল্লির কোতোয়াল আলাউল্-মুল্ক-এর পরামর্শে আলাউদ্দিন তাঁর পরিকল্পনা সংশোধিত করেন। কোতোয়াল সুলতানকে বোঝান যে, “নতুন ধর্মের উদ্ভাবন ও প্রচার নবির কাজ, সুলতানের নয়। তা ছাড়া, কেবল শক্তি বা দত্ত দ্বারা নবির সাফল্য আসে না। নবি সফল হন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে। তাই ঈশ্বরের নির্দেশ ব্যতিরেকে সুলতান যদি এই চেষ্টা করেন তবে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।” দিগ্‌বিজয় প্রসঙ্গে কোতোয়াল বোঝান যে, এই হিন্দুস্তানের অধিকাংশ ভূখণ্ড সুলতানি সাম্রাজ্যের বাইরে রয়েছে। সুলতানের উচিত সেইসব অঞ্চল দখল করে সাম্রাজ্য গঠন করা, দিগ্‌বিজয় নয়। প্রবীণ কোতোয়ালের যুক্তি আলাউদ্দিনকে প্রভাবিত করে। তিনি নতুন ধর্মপ্রচারের ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন এবং দিগ্‌বিজয়ের পরিবর্তে ভারত-বিজয়ের কর্মসূচি নেন। অবশ্য বিশ্ববিজয়ের গভীর বাসনা যে আলাউদ্দিনের মনে লুকিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর মুদ্রায়। বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করলেও নিজ মুদ্রায় তিনি ‘সিকন্দর সানি’ বা ‘দ্বিতীয় সিকন্দার’ উপাধি নিতে দ্বিধা করেননি। অবশ্য নিজামী-সহ আধুনিক ঐতিহাসিকেরা বারাণীর এই বিবরণকে আলাউদ্দিনের প্রকৃতির সাথে বেমানান বলে মনে করেন। যাই হোক্, প্রবীণ কোতোয়ালের পরামর্শ অনুসরণ করে যে তিনি ভুল করেননি, তার প্রমাণ কিছুদিনের মধ্যে অনুভূত হয়। মোঙ্গলদের দ্রুত আক্রমণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী আঞ্চলিক শাসকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ দমনের জন্য এই সিদ্ধান্ত আবশ্যিক ছিল।

আলাউদ্দিনের রাজ্যজয়কে দু-ভাগে ভাগ করা যায়— উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত। উত্তর ভারতের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান চলেছিল ১২৯৭ থেকে ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দক্ষিণ ভারতের বিরুদ্ধে তাঁর প্রধান অভিযানগুলি পরিচালিত হয়েছিল ১৩০৬ থেকে ১৩১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তবে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিরুদ্ধে আলাউদ্দিনের সমরাভিযানের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ অভিন্ন ছিল না। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির আর্থিক গুরুত্ব তাঁকে স্থায়ীভাবে এ অঞ্চল দখল করে সুলতানির ভৌমিক ও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিকরণে প্রলুব্ধ করেছিল। দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য ছিল তাৎক্ষণিক লাভ। অর্থাৎ দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকে ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করা। তা ছাড়া, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিকে দখল করে তিনি সরাসরি সুলতানি শাসনের অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে তাঁর এ ধরনের ইচ্ছা থাকলেও, বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে তা করেননি। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি থেকে বাৎসরিক কর ও আনুগত্যলাভের বিনিময়ে স্থানীয় শাসকদের হাতে ওই সকল অঞ্চলের শাসনদায়িত্ব ছেড়ে দেন। অবশ্য উভয়ক্ষেত্রেই তাঁর কর্মসূচি ছিল নিছক আগ্রাসনমূলক। ড. শ্রীবাস্তব লিখেছেন : “His wars were mostly unprovoked and undertaken in persuit of a resolute ideal, namely the conquest of the entire country.”

আলাউদ্দিন খলজির উত্তর ভারত অভিযান :

১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন তাঁর দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি উলুঘ খাঁ ও নুসরৎ খাঁ’র নেতৃত্বে গুজরাটের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান। ‘রসমালা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গুজরাটের জনৈক মন্ত্রী মাধবের অবর্তমানে গুজরাটের রাজা করণ বাঘেলা (রায় করণ) ওই মন্ত্রীর স্ত্রীর অমর্যাদা করেন। এই অন্যায়ের প্রতিকারার্থে মাধব আলাউদ্দিনের সাহায্য প্রার্থনা করলে সুলতান গুজরাটের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান। এই কাহিনির যথার্থতা অস্বীকার করা যায়নি। কারণ গুজরাটের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে দিল্লির সুলতানেরা সফল হননি। তা ছাড়া রাজস্থান ও মালবের মধ্য দিয়ে গুজরাটে পৌঁছানো সহজ ছিল। কিন্তু ওই দুটি রাজ্য তখনও দিল্লির কর্তৃত্বের বাইরে। তথাপি ওই দূরদেশে আলাউদ্দিন প্রথম অভিযান পাঠান সম্ভবত ওই রাজ্যের আমলার গোপন সাহায্যের আশ্বাসের অবশ্য গুজরাট অভিযানের এটি ছিল তাৎক্ষণিক কারণ। এই অভিযানের পশ্চাতে সুলতানের গভীর অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও নিহিত ছিল। গুজরাট, মালব প্রভৃতি স্থানের ভূমি ছিল উর্বর। তা ছাড়া, এখানকার সমুদ্র বন্দরগুলি এবং গাঙ্গেয় উপত্যকার সাথে যুক্ত বাণিজ্যপথগুলি এইসব দেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বহির্বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলের কোষাগার ছিল পরিপূর্ণ। তা ছাড়া, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার মোঙ্গল আধিপত্য স্থাপিত হবার ফলে ওই অঞ্চল থেকে স্থলপথে ভারতে ঘোড়া আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অথচ তখন ভারতে ভালো জাতের ঘোড়া উৎপাদন হত না। এমতাবস্থায় পশ্চিম ভারতের সমুদ্রবন্দর মারফত আরব ও তুর্কিস্তান থেকে ঘোড়া আমদানি করা সহজ ছিল। তাই মালব, গুজরাট দখল করে আলাউদ্দিন যুগপৎ সুলতানির আর্থিক ও সামরিক চাহিদা পূরণ করতে চেয়েছিলেন।

সুলতানি-বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে বিভ্রান্ত হয়ে গুজরাটের শাসক রায়করণ কোনোরূপ বাধা না দিয়ে কন্যা দেবলাদেবীকে নিয়ে দেবগিরিতে পালিয়ে যান। তাঁর পত্নী কমলাদেবী ধৃত হন এবং আলাউদ্দিন তাঁকে বিবাহ করেন। সুলতানি বাহিনী অনহিলবারা-সহ বহু সুসজ্জিত নগর ধ্বংস করে। নবনির্মিত সোমনাথের মন্দির লুণ্ঠিত হয়। ক্যাম্বের ধনী বণিকদের কাছ থেকেও সুলতানের ফৌজ বহু অর্থসম্পদ সংগ্রহ করে। ক্যাম্বে থেকেই মালিক কাফুর (হাজারদিনারী) নামক জনৈক ক্রীতদাসকে বন্দি করে দিল্লিতে আনা হয়। ইনি পরে আলাউদ্দিনের খুবই প্রিয়পাত্রে পরিণত হন এবং দক্ষিণ ভারতের বিরুদ্ধে সুলতানের অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ড. নিজামী, অধ্যাপক সতীশচন্দ্র প্রমুখ মনে করেন, গুজরাটের শাসক জনপ্রিয় ছিলেন না এবং প্রশাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও অন্তদ্বন্দ্ব ছিল। তাই এত সহজে গুজরাট সুলতানির অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়। আলপ খাঁ গুজরাটের শাসক পদে নিযুক্ত হন। তবে রায়করণ কিছুদিন পরে দক্ষিণ গুজরাটের একাংশে নিজের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন এবং ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।

গুজরাট বিজয়ের পর আলাউদ্দিন রাজস্থানের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের উদ্যোগ নেন। রাজপুত বীরদের শৌর্যবীর্য এবং রাজপুত রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব যেন দিল্লি-সুলতানির মানমর্যাদা ও কর্তৃত্বের উজ্জ্বলতাকে কিছুটা ম্লান করে রেখেছিল। তাই আলাউদ্দিন এই রাজপুত রাজ্যগুলিকে গ্রাস করে সুলতানির সাম্রাজ্যিক মহিমা প্রসারিত করার জন্য সচেষ্ট হন। প্রথমে তিনি আক্রমণ করেন চৌহানবংশীয় হামিরদেব শাসিত রণথম্ভোর। সুলতানি বাহিনী গুজরাট অভিযান সম্পূর্ণ করে প্রত্যাবর্তনের পথে ‘নব-মুসলমান নাম্নী মোঙ্গল সৈন্যগণ বিদ্রোহী হলে তাদের অধিকাংশকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।* এই সময় মহম্মদ শাহ ও খবরু নামক দুজন মোঙ্গল বিদ্রোহী রণথম্ভোরে আশ্রয় নেয়। আলাউদ্দিন ওই দুই বিদ্রোহীকে প্রত্যর্পণের আদেশ দিলে রানা হামির তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমতাবস্থায় উলুঘ খাঁ ও নুসরৎ খাঁ রণথম্ভোর আক্রমণ করেন। সুলতানি ফৌজ ঝইন ও রণথম্ভোরের ওপর ব্যাপক ধ্বংসকার্য চালালেও দুর্গ দখল করতে ব্যর্থ হন। এবার আলাউদ্দিন স্বয়ং রণথম্ভোর অভিযানে অংশ নেন। তাঁর সঙ্গী হন সুপ্রসিদ্ধ পারসিক কবি আমির খসরু। রাজপুত যোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই চালিয়ে যায়। তিন মাস অবরোধের পর দুই রাজপুত রণমল ও রতিপালের বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে আলাউদ্দিন দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন (১৩০১ খ্রিঃ)। রাজপুত রমণীরা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মর্যাদা রক্ষা করেন। খসরুর বিবরণী থেকেই ‘জহরব্রতের কথা প্রথম জানা যায়। রণথম্ভোর জয় করার পর সুলতানি সেনা বহু মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করে দেয়। ঝইন-সহ রণথভোরের শাসনাদায়িত্ব আলাউদ্দিন তাঁর সেনাপতি উলুঘ খায়ের ওপর ন্যস্ত করেন।

রণথভোরের বিরুদ্ধে অভিযান চলার সময় আলাউদ্দিনকে একাধিক অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। তাঁর নিকট আত্মীয় আকৎ খাঁ, মালিক উমর, মঙ্গু খাঁ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী সরকারি কর্মী হাজিমৌলা ইত্যাদি ক্ষমতা দখলের জন্য কয়েকটি ব্যর্থ প্রয়াস চালান। আলাউদ্দিন খলজি অত্যন্ত তৎপরতা ও কঠোরতার সাথে এইসব বিদ্রোহ দমন করে সসৈন্যে রণথস্তোরে উপস্থিত হন এবং এই রাজপুত রাজ্যটিকেও জয় করেন। কিন্তু রণথম্ভোর থেকে আলাউদ্দিন সোজা দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তাই শহরের উপকণ্ঠে প্রায় মাসাধিক কাল তিনি অতিবাহিত করেন। অধ্যাপক সাকসেনা, লাল প্রমুখ মনে করেন, দিল্লিতে নিজের সুরক্ষা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হবার জন্যই তিনি এই ধরনের আচরণ করেছিলেন। পিতৃব্য জালালউদ্দিনের প্রতি তাঁর নিজের আচরণের কথা স্মরণ করে হয়তো তিনি একটু বেশি সাবধান হয়েছিলেন।

রণথম্ভোরের পতনের পর রাজস্থানের সর্বাধিক শক্তিশালী রাজ্য ছিল মেবার। মেবারের রাজধানী ছিল চিতোর। সুউচ্চ পাহাড়ের শীর্ষে নির্মিত চিতোরগড় দুর্গ ছিল যেমন সুন্দর তেমনি দুর্ভেদ্য। স্বাধীনতা ও শক্তির প্রতীক মেবারকে পদানত করার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন স্বয়ং ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে চিতোর আক্রমণ করেন। দীর্ঘ সাত মাস প্রতিরোধ চালানোর পর রানা রতন সিংহ সুলতানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। গোরা ও বাদল নামক দুই রাজপুত যোদ্ধা মুসলমান সৈন্যদের বিরুদ্ধে অপূর্ব কৃতিত্ব দেখান। আমির খসরু ও ইসামীর বর্ণনা অনুসারে আলাউদ্দিন রতন সিংহকে বন্দি করলেও হত্যা করেননি। কিন্তু অতঃপর ইতিহাসে রানা রতন সিংহের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তাই মনে হয়, তিনি যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। শোনা যায়। এই সময় সুলতানি বাহিনী একদিনে প্রায় ৩০ হাজার রাজপুতকে হত্যা করে। রাজপুত রমণীরা দুর্গের মধ্যে ‘জহরব্রত’ পালন করে অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেন। আলাউদ্দিন তাঁর নাবালক পুত্র খিজির খাঁ’কে চিতোরের শাসক নিযুক্ত করেন এবং এই স্থানের নাম হয় ‘খিজিরাবাদ’। তবে চিতোরে মুসলমান শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজপুতদের নিরন্তর ও প্রবল অসহযোগিতা এবং বিরোধিতার ফলে খিজির খাঁ জনৈক বংশধর রাজপুত মালদেবের হাতে চিতোরের দায়িত্ব ন্যস্ত করে ফিরে যান (১৩১১ খ্রিঃ)। রাজপুতরা হামিরের নেতৃত্বে মালদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে মালদেবের মৃত্যুর পর হামির সমগ্র মেবার দখল করে নেন।

আলাউদ্দিনের চিতোর অভিযানের সাথে পদ্মিনীর কাহিনি জড়িত হবার ফলে এই ঘটনা একটা রোমান্টিক চরিত্র পেয়েছে। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে আলাউদ্দিন রতন সিংহের অনন্যা সুন্দরী রানি পদ্মিনীকে লাভ করার জন্য চিতোর আক্রমণ করেছিলেন। আবুল ফজল, হাজি-উদ্-দরীর, ফেরিস্তা, নান্সী প্রমুখ লেখক এই কাহিনিকে সত্য বলে মনে করেন। কিন্তু ড. কে. এস. লাল, ড. গৌরীশংকর ওঝা প্রমুখ ইতিহাসবিদ এই ঘটনাকে ‘কাল্পনিক ও যুক্তিহীন’ বলে বর্ণনা করেছেন। এঁদের মতে, (১) চিতোর অভিযানে আলাউদ্দিনের সঙ্গী কবি আমির খসরু পদ্মিনীর বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেননি। এমনকি সমকালীন লেখক বারাণী বা ইসামীও এ সম্পর্কে কোনো উল্লেখ করেননি। পদ্মিনীর কাহিনি সত্য হলে এঁরা নিশ্চয়ই উল্লেখ করতেন। (২) একমাত্র মালিক মহম্মদ জায়সীর ‘পদ্মাবৎ’ কাব্যে এই কাহিনি উল্লিখিত হয়েছে। অথচ এই কাব্য রচিত হয়েছে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ আলাউদ্দিন কর্তৃক চিতোরবিজয়ের ২৩৭ বছর পর। ফেরিস্তা লোকমুখে শোনা এই কাহিনিকে ইতিহাসের সাথে যুক্ত করেছেন। রাজস্থানী চারণকবিরা রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে আদৌ পরিচিত না হয়েই, এই কাহিনিকে সত্য বলে প্রচার করেছেন। (৩) এঁরা মনে করেন, আলাউদ্দিনের চিতোরবিজয়ের সময় মেবারের রানা ছিলেন রতন সিংহ। কিন্তু পদ্মিনী ছিলেন ভীম সিংহের স্ত্রী। ভীম সিংহের সাথে রতন সিংহের সময়ের ব্যবধান প্রায় দেড়শো বছরের। অর্থাৎ চিতোর আক্রমণকালে পদ্মিনীর জন্মই হয়নি। অন্যদিকে ড. শ্রীবাস্তব পদ্মিনী-কাহিনির মধ্যে কিছুটা সত্য আছে বলে মনে করেন। তাঁর মতে, আমির খসরু ইথিওপিয়ার সলোমন কর্তৃক মেবার রানি বিলকিকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাভিত্তিক যে রূপক রচনা করেছেন, তার মধ্যে পদ্মিনীর কাহিনি লুকিয়ে আছে। এখানে সলোমনকে আলাউদ্দিন এবং পদ্মিনীকে মেবার রানি রূপে কল্পনা করা হয়েছে। ড. দশরথ শর্মা তাঁর Rajasthan through the Ages’ (Vol-I) গ্রন্থে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, আমির খসরুর ‘খাজাইন-উল ফুতুহ’ গ্রন্থ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে মালিক মহম্মদ জায়সী পদ্মিনীর রোমান্টিক কাহিনি রচনা করেছেন। ‘পদ্মাবৎ’ কাব্যের অধিকাংশ কাহিনিই কল্পনাভিত্তিক, কিন্তু রতন সিংহ ‘কর্তৃক আয়নায় প্রতিবিম্বের মাধ্যমে আলাউদ্দিনকে পদ্মিনীর রূপ প্রদর্শন এবং সুলতান কর্তৃক রতন সিংহকে বন্দি—এই সংবাদে রাজপুত রমণীদের অগ্নিতে প্রাণবিসর্জন এবং কামনার আগুনে দগ্ধ সুলতান কর্তৃক হাজার হাজার রাজপুতকে হত্যার ঘটনার মধ্যে ইতিহাসগত ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করা কষ্টকর।

অতঃপর আলাউদ্দিন একে একে মালব (১৩০৫ খ্রিঃ), শিবানা (১৩০৮ খ্রিঃ), জালোর (১৩১১ খ্রিঃ) প্রভৃতি অঞ্চল দখল করেন। মাড়োয়ার রাজ্যটির অধিকার সম্পর্কে কোনো লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। সম্ভবত, এটিও আলাউদ্দিনের কর্তৃত্বের বাইরে ছিল না। যাই হোক, কাশ্মীর, নেপাল, আসাম এবং উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের একাংশ ছাড়া প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত আলাউদ্দিনের কর্তৃত্বাধীনে আনীত হয়েছিল।

আলাউদ্দিন খলজির রাজপুত নীতি :

অধ্যাপক মহম্মদ হাবিব ও নিজামী মনে করেন, আলাউদ্দিন দিল্লির অভ্যন্তরীণ শাসন এবং দাক্ষিণাত্যের নববিজিত রাজ্যগুলি সম্পর্কে এক স্থিরনীতি গ্রহণ করলেও, রাজস্থানের রাজ্যগুলি সম্পর্কে তাঁর কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি ছিল না। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র লিখেছেন, “সম্ভবত রাজপুত রাজ্যগুলির ওপর প্রত্যক্ষ শাসন আরোপ করার চেষ্টা আলাউদ্দিন করেননি। রাজপুত রানারা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। তবে সুলতানকে নিয়মিত কর প্রদান করা এবং সুলতানের আদেশ মান্য করা তাদের স্বাধিকার ভোগের অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল।”সামরিক প্রয়োজনে রণথম্ভোর এবং ঝইন রাজ্যদুটি আলাউদ্দিন সরাসরি দিল্লির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং একই অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু চিতোরে প্রচুর রক্তপাত করা সত্ত্বেও সেখানে দিল্লির রাজকীয় আইন বা জাওবিৎ প্রবর্তনের কোনো চেষ্টা করেননি। রাজপুতনার কোনো সামন্ত-সর্দার তাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করলে আলাউদ্দিন সত্বর তাকে উৎখাত করেছেন। কিন্তু কোনো স্থানীয় রাই দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করে অর্থপ্রদানে সম্মত হলে তাকে নিজ জাইগিরদারিতে বহাল রেখেছেন। রাজপুতানার কৃষক বণিকদের ওপর সুলতানি চাপিয়ে দেবার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। রাজস্ব আদায়ের কাজে সুলতানের নিযুক্ত কোনো মুসলমান কর্মচারীর সমতুল্য কাজ যদি কোনো স্থানীয় রাজপুত-সর্দার করতে পারতেন, তাহলে আলাউদ্দিন তাঁকেই ওই দায়িত্বে নিযুক্ত করতেন। রাজস্থানের অধিকৃত অঞ্চলের সামাজিক সংগঠন বা অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা তিনি করেননি।

অধ্যাপক বি. পি. সাক্সেনা লিখেছেন : “We can only say that the plan of annexing Rajasthan was attempted in part and then given up impracticable.” রাজপুতানার রাজ্যগুলি সম্পর্কে আলাউদ্দিনের এই দ্বিধাগ্রস্ততার অন্যতম কারণ ছিল রাজপুত রাজ্যগুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা। মুঘল আমলে রাজপুতদের যে ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়েছিল এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে তারা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সুলতানি আমলে তা ছিল না। আলাউদ্দিন উপলব্ধি করেছিলেন যে, অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ রাজপুতদের মিত্রতা তাঁর শক্তিবৃদ্ধি করতে যেমন পারবে না, তেমনি এরা কখনোই মিলিতভাবে দিল্লি সুলতানির অস্তিত্ব ও কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতেও পারবে না। তাই ভৌগোলিক বাধা অতিক্রম করে এই আক্রমণে সরাসরি সুলতানি শাসন কায়েম করতে চেষ্টা করেননি। চিতোর, রণথম্ভোর ও জালোর দুর্গ দখল করার সময় দিল্লির প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছিল। কিন্তু এখান থেকে উল্লেখযোগ্য সম্পদ তিনি পাননি। তাই রাজপুতানার পরিবর্তে দক্ষিণ ভারতের সমৃদ্ধ নগর ও রাজ্যগুলির দিকে তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ হয়। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, একান্ত সাম্রাজ্যবাদী ইচ্ছা দ্বারাই তিনি রাজস্থানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিলেন। এখানে দিল্লির প্রত্যক্ষ শাসন কায়েম করার ইচ্ছাও তাঁর ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।