আলাউদ্দিন খলজির শাসনব্যবস্থা:

বিদ্রোহাত্মক প্রবণতা দমনের ব্যবস্থাদি : আলাউদ্দিন সুলতানের নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী ক্ষমতার তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই আত্মীয়পরিজন এবং রাজকর্মচারীদের উপর্যুপরি বিদ্রোহ তাঁকে গভীরভাবে চিন্তান্বিত করে। তিনি অনুভব করেন যে, প্রচলি: রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেই বিদ্রোহাত্মক প্রবণতার বীজ লুক্কায়িত আছে। তাই রণথম্ভোর অবরোধের সময় তিনি বিদ্রোহের সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধানের জন্য তাঁর একান্ত পরিষদ ‘মজলিস-ই-খাস’-এর সদস্যদের সাথে আলোচনা করেন। সমস্ত দিন বিচার করার পর সুলতান বিদ্রোহের চারটি সম্ভাব্য কারণ স্থির করেন। এগুলি হলঃ (১) প্রজাসাধারণের শুভাশুভ সম্পর্কে সুলতানের অজ্ঞতা, (২) অবাধ মদ্যপানের সুবাদে বিভিন্ন মানুষের একত্রিত হওয়া এবং মিত্রতাবদ্ধ হয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়া, (৩) অভিজাতদের অবাধ মেলামেশা, পারস্পরিক আত্মীয়তা এবং পারিবারিক মিলনসূত্রে সুলতানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জোটবদ্ধ হওয়া এবং (৪) জনগণের হাতে অধিক অর্থসম্পদ সঞ্চিত হওয়া এবং সেই সূত্রে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পাওয়া এবং প্রচুর অবসরের সুযোগে ‘অলস মস্তিষ্ককে শয়তানের কর্মশালায়’ পরিণত করা ইত্যাদি।

উল্লিখিত কারণগুলি নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন চারটি জরুরি নির্দেশনামা জারি করেন। প্রথম নির্দেশনামা দ্বারা রাষ্ট্রপ্রদত্ত সমস্ত রকমের ধর্মীয় দান (ওয়াক্ফ), অনুদান (মিল্ক), উপহার (ইনাম) ইত্যাদি হিসেবে প্রদত্ত জমি অধিগ্রহণ করে ‘খালিসা’ জমিতে পরিণত করা হয়। ইতিপূর্বে ইনাম, মিল্ক, ওয়াকফ ইত্যাদি সূত্রে সম্পত্তি লাভ করার ফলে বহু পরিবার সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। এমনকি আলাউদ্দিনও সিংহাসনে আরোহণ করার সময় এইসব খাতে বহু জমি দান করেছিলেন। অবশ্য দু-একটি ব্যতিক্রমও ছিল। যেমন, ইসামীর বংশধরদের প্রদত্ত দুটি গ্রাম ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। তবে সামগ্রিকভাবে এই ব্যবস্থা অনেক পরিবারের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়। একইসঙ্গে আলাউদ্দিন তাঁর কর্মচারীদের আদেশ দেন যে, আইন বাঁচিয়ে প্রজাদের কাছ থেকে বেশি সম্ভব অর্থ আদায় করে নেবার ব্যাপারে তাঁরা যেন যত্নবান হন। বারাণী লিখেছেন: “এই আদেশের ফলে দিল্লিতে মালিক, আমির, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী, মুলতানি বণিক ও হিন্দু ব্যাঙ্কারগণ ব্যতীত খুব কম লোকের হাতেই স্বর্ণ সঞ্চিত ছিল।” ফলে জনসাধারণকে জীবিকা অর্জনের জন্য সদাব্যস্ত থাকতে বাধ্য হতে হয় এবং সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অবকাশ চলে যায়।

দ্বিতীয় নির্দেশনামা দ্বারা রাজ্যের গুপ্তচর-বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। হাট-বাজার এবং অভিজাতদের আবাস থেকে সমস্ত ধরনের সংবাদ সংগ্রহ করে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তা সুলতানের কর্ণগোচর করার জন্য বারিদ মুনসি, জাসুস্ নামক অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়। বারাণী লিখেছেন: “গুপ্তচরব্যবস্থার ব্যাপকতার ফলে অভিজাতগণ সর্বদা সংকুচিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন। এমনকি প্রকাশ্য স্থানে তাঁরা নিজেদের মধ্যে মতবিনিময়ের একান্ত প্রয়োজন হলেও মুখে না বলে আকারে-ইঙ্গিতে তা ব্যক্ত করতেন।” মোরল্যান্ডের মতে, “গুপ্তচরব্যবস্থার ব্যাপকতা সাম্রাজ্যের হাসিখুশিপূর্ণ প্রাণোচ্ছল জীবনধারাকে সন্দেহ ও হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিল। একই সঙ্গে ষড়যন্ত্রের সামান্যতম সম্ভাবনাও নষ্ট করেছিল।”

তৃতীয় নির্দেশনামা দ্বারা দিল্লিতে মদ্যপান ও মদ্য প্রস্তুত করা নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার অনুমোদিত মদ্য প্রস্তুতকারকদের দিল্লি থেকে বহিষ্কার করা হয়। সুলতান স্বয়ং মদ্যপান ত্যাগ করেন এবং সমস্ত মদের পিপ বদাউন গেটের কাছে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। শোনা যায়, এখানে এত মদ ঢালা হয়েছিল যে, বিস্তীর্ণ এলাকা বর্ষাকালের মতো কাদায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য মদের চোরাই আমদানি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই নির্দেশ কিছুটা সংশোধিত হয়। বলা হয় যে, কোনো ব্যক্তি একান্তভাবে নিজের ব্যবহারের জন্য নিজের গৃহাভ্যন্তরে আইনানুগ ভাবেই মদ প্রস্তুত করতে পারবেন। এই সংশোধনী থেকে বোঝা যায় যে, আলাউদ্দিনের এই ব্যবস্থা ধর্মীয় বা নৈতিক বোধ সঞ্জাত ছিল না, এটি ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনবোধের ফসল। এই আইনে জুয়াখেলা কিংবা ভাং খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

চতুর্থ নির্দেশনামা দ্বারা অভিজাতদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা, কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আনন্দ সভায় একত্রিত হওয়া এবং সুলতানের অনুমতি ব্যতিরেকে নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। বস্তুত, এই ব্যবস্থার ফলে সমাজজীবন থেকে আনন্দরস সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন: “….the inevitable result that the amenities of social life disappeared and the life became an intolerable burden.” তবে অভিজাতদের গোষ্ঠীচক্র গড়ে উঠার সম্ভাবনা এই নির্দেশে দূরীভূত হয়। ড. নিজামী লিখেছেন : “The esprit de corps, which had been the course of the Mameluk nobility, was not allowed to grow up in the nobility of Alauddin.”