আলাউদ্দিন খলজির রাজস্ব নীতি:

আলাউদ্দিন খলজির লক্ষ্য ছিল মোঙ্গলদের যে-কোনো রকমের আক্রমণ প্রতিহত করা এবং একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচি রূপায়িত করা। বলবনের মতো মোঙ্গলদের ভয়ে রাজ্যবিজয় নীতি পরিত্যাগ করার ইচ্ছা আলাউদ্দিনের ছিল না। তাঁর এই দুটি কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য আবশ্যিক ছিল একটি সুসজ্জিত ও সুবিশাল সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন ছিল সমৃদ্ধ রাজকোষের। তাই আলাউদ্দিন সামরিক কর্মচারীর পাশাপাশি সংস্কারমূলক কর্মসূচিও রূপায়িত করার উদ্যোগ নেন। কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে রাজকোষের আয়ের প্রধান সুত্র যে ভূমিরাজস্ব, — এ বিষয়েও তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী সুলতানেরা রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেননি। তাঁরা চিরাচরিত রাজস্বব্যবস্থার সাথে তাল রেখেছিলেন মাত্র। কিন্তু আলাউদ্দিন রাজস্বব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন অনুভব করেন। কেবল রাজকোষকে সমৃদ্ধ করা নয়; রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতেও তিনি রাজস্ব প্রশাসনের খোলনলচে পরিবর্তনের গুরুত্ব অনুভব করেন।

ড. সাক্সেনা মনে করেন, আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী শাসকেরা রাজস্বব্যবস্থার পরিবর্তনে অনাগ্রহী ছিলেন। কারণ এই কাজ দক্ষতার সাথে সম্পাদন করার মতো যথেষ্ট গ্রামীণ কর্মচারী সরকারের ছিল না। তাই হিন্দু আমল থেকে প্রতিষ্ঠিত কৃষিনির্ভর কায়েমি গোষ্ঠীকে অব্যাহত রেখে তাঁরা যথাসম্ভব সরকারের প্রাপ্য আদায় করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আলাউদ্দিন প্রথম এই রাজস্বব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান।

আলাউদ্দিনের সিংহাসন আরোহণের সময় প্রচলিত ভূমিব্যবস্থা অনুসারে কৃষিযোগ্য জমিগুলি কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। সুলতানের ‘খালিসা’ জমিগুলির রাজস্ব সরাসরি রাজকোষে জমা পড়ত। দেওয়ান-ই-উজিরত-এর অধীনে আমিল, কারকুন প্রমুখ কর্মী এই রাজস্ব সংগ্রহ করত। কিছু জমি ইজারা’ হিসেবে ইক্তাদার বা মাকৃতি’রা ভোগদখল করতেন। এই জমিকে বলা হত ইকতা’। মাকৃতি জমির রাজস্ব সংগ্রহ করে ইতার ব্যয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ কেন্দ্রীয় রাজকোষে পাঠাতে বাধ্য ছিলেন। তবে এই সময় ইক্‌তা প্রশাসন নানা অজুহাতে সমস্ত রাজস্বই ভোগ করত। খুৎ, মুকদ্দম, চৌধুরী নামধারী রাজস্ব সংগ্রাহকবৃন্দ ইতার রাজস্ব আদায় এবং কারচুপি কাজে জড়িত ছিল। স্বাধীন হিন্দু-রাজাদের অনেকেই সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। এঁরা দিল্লির আনুগত্য স্বীকার এবং নিজ নিজ ভূখণ্ড থেকে আদায়ীকৃত রাজস্বের নির্দিষ্ট অংশ সুলতানের কোষাগারে জমা দেবার শর্তে কিছু ভূমি ভোগদখল করতেন। এ ছাড়া কিছু জমি দান বা উপহার হিসেবে (মিল্‌ক, ইনাম, ওয়াকফ্ জ্ঞানী, বা ধার্মিক ব্যক্তিদের বরাদ্দ করা হয়েছিল। বহু সরকারি কর্মী বা অভিজাতও এরূপ জমি ভোগদখল করতেন।

রাজস্বসংস্কার কর্মসূচি হিসেবে আলাউদ্দিন এক জাওবিৎ জারি করে বিভিন্ন সরকারি কর্মী, অভিজাত বা অন্যান্যদের হাতে বরাদ্দ মিল্ক, ইনাম, ওয়াকভুক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেন। এগুলি সুলতানের খালিসা জমির অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সরকারি সংগ্রাহকবৃন্দ মারফত সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দু-মুসলমান, সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির কাছ থেকেই এ ধরনের জমি কেড়ে নেওয়া হয়। অতঃপর আলাউদ্দিন গ্রামীণ রাজস্ব সংগ্রাহকদের দিকে দৃষ্টি দেন। ‘খুৎ’, ‘মুকদ্দম’, ‘চৌধুরী’ নামধারী এই মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী পূর্বরীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট গ্রাম বা গ্রাম সমষ্টির রাজস্ব সংগ্রহ করে তা চুক্তিমতো রাজকোষে জমা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।

ড. বেনারসীপ্রসাদ সাক্সেনা লিখেছেন : “Alauddin was the first ruler to take a step in organising a new revenue system in villages which had been subject to group assessment.” Group assessment’ শব্দটির যথার্থ প্রয়োগ মোরল্যান্ড করেছেন বলে ড. সাক্সেনা মনে করেন। কিন্তু মোরল্যান্ড হিন্দু সামন্ত-রাজা এবং খুৎ, মুকদ্দম, চৌধুরী প্রমুখের অবস্থানগত পার্থক্য নির্দিষ্ট করেননি। এ ব্যাপারে বারাণীর বিবরণ আমাদের কিছুটা পরিষ্কার ধারণা দেয়। ‘রায়’ বা ‘রনক’, ‘রানা’, ‘রাওত’ ইত্যাদি নামে পরিচিত সামন্ত রাজাদের সাথে ‘খুৎ’, ‘মুকদ্দম’ ও ‘চৌধুরী’ নামধারী ব্যক্তিদের মৌলিক প্রভেদ ছিল। সামন্তরা নিজ নিজ অঞ্চলের রাজস্ব সরাসরি রাজকোষে চুক্তিমতো জমা দিতেন। এক্ষেত্রে চুক্তিভঙ্গ না করলে সুলতান তাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন না, আলাউদ্দিনের সংস্কার-পরিকল্পনার প্রায় বাইরে ছিলেন এঁরা। অবশ্য ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছিল। এঁদের অধিকারের বাইরে ছিল আলাউদ্দিনের ‘খালিসা’ জমি। সেগুলিতে গ্রামভিত্তিক বা একাধিক গ্রামভিত্তিক রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকতেন ‘চৌধুরী’, ‘মুকদ্দম’ প্রভৃতি গ্রাম প্রধান বা মুখিয়া। ‘খুৎ’ নামের উৎপত্তি সম্ভবত ‘খ’ থেকে, যার অর্থ চুক্তি বা অঙ্গীকার। ‘খুৎ’ সম্ভবত সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট গ্রাম থেকে অঙ্গীকারমতো রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত ছিল।

আলাউদ্দিন এই সকল গ্রামীণ রাজস্ব সংগ্রাহকদের বিলাস-বৈভব ও অসাধুতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে এদের কঠোরভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত নেন। বেয়ানার কাজি মুঘিসউদ্দিনের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে আলাউদ্দিন জানান যে, ‘খুৎ’, ‘মুকদ্দম’ প্রমুখ মহার্ঘ পোশাক পরেন, ঘোড়ায় চড়েন, শখের শিকার খেলায় অর্থব্যয় করেন, কিন্তু নিজেদের জমি থেকে এঁরা খিরাজ, জিজিয়া, ঘরী, চরাই ইত্যাদি খাতে এক জিতল ও রাজকোষে প্রদান করেন না। অথচ এঁরা সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট জমি থেকে যথারীতি অনেক ক্ষেত্রে বেশি ‘খুতি’ আদায় করেন এবং নিজেদের ভোগে লাগান। ফলে সাধারণ চাষি (বলাহার) শোষিত হয়, কিন্তু সরকার উপকৃত হয় না। এই অব্যবস্থা দুর করার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন কয়েকটি সংশোধনমূলক আইন (জাওবিৎ) জারি করেন। এই প্রসঙ্গে বারাণী ‘হিন্দুদের দমনের উদ্দেশ্যে’ কথাটি ব্যবহার করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আলোচনা করেছি। তবে এক্ষেত্রে বারাণী ‘হিন্দু’ অর্থে কেবলমাত্র গ্রামীণ অভিজাতদের (খুৎ, মুকদ্দমদের) বোঝাতে চেয়েছেন বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন। আলাউদ্দিনের প্রথম জাওবিৎ অনুযায়ী চাষযোগ্য জমি জরিপ করে খুৎ, মুকদ্দম এবং বলহার বা সাধারণ কৃষককে একই হারে প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজস্বের হার নির্দিষ্ট করা হয় উৎপাদনের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে খুৎ এবং বলহারের মধ্যে রাজস্বের তারতম্য তুলে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় জাওবিৎ অনুযায়ী ভূমিরাজস্ব ছাড়াও ‘ঘরী’ বা গৃহকর, চরাই বা পশুচারণ কর, ‘করহি’ নামের একটি করের উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও এর অর্থ সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা নিঃসন্দেহ নন। কে. এস. লালের মতে, এটি সম্ভবত এক ধরনের বাণিজ্য কর। আবার অধ্যাপক হোডিভালা (Hodivala)-র মতে, ‘করহি’ এবং ‘ঘরাই’ একই জিনিস ছিল।

‘Group assessment’ ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব লুপ্ত করার ফলে প্রশাসন পরিচালনার জন্য একদল সুদক্ষ সরকারি রাজস্ব কর্মীর প্রয়োজন হয়। আলাউদ্দিন এই কাজের জন্য মুহশিল (রাজস্ব-নির্ধারক), আমিল (কর-সংগ্রাহক), গোমস্তা (প্রতিনিধি), মুতাশরিফ (হিসাব পরীক্ষক), দফতরি (অফিস-কর্মী), নভীসদাস (করণিক) প্রমুখকে নিয়োগ করেন। পাটোয়ারী বা গ্রামীণ হিসাবরক্ষকের কাছে সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়। বারাণী লিখেছেন যে, পাটোয়ারী লিপিবদ্ধকরণের কাজে পারসি শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন না। এ থেকে অনুমিত হয় যে, রাজস্ব-প্রশাসনে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু।

আলাউদ্দিনের রাজস্বব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল জমির পরিমাপ বা জরিপ। তবে জরিপের অন্তর্ভুক্ত এলাকা সম্পর্কে বারাণীর বিবরণ ভৌগোলিক দিক থেকে কিছুটা বিভ্রান্তিকর। তবে এ ব্যাপারে মোরল্যান্ডের বিবরণ অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য বলে ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেন। মোরল্যান্ডের বিবরণ থেকে জানা যায় দিল্লি, যমুনা ও দোয়াবের সন্নিহিত অঞ্চল জরিপের আওতাভুক্ত ছিল। পূর্বদিকে অযোধ্যা ও বিহার বাদে রোহিলাখণ্ড এবং পশ্চিমদিকে মালব এবং রাজপুতানা জরিপ করা হয়েছিল। তবে গুজরাট এর বাইরে ছিল। পশ্চিমে মুলতান ছাড়া সমগ্র পাঞ্জাব জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সমগ্র রাজ্য জরিপের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলেও জমির পরিমাপের ভিত্তিতে রাজস্ব-নির্ধারণের রীতি প্রবর্তন করে আলাউদ্দিন রাজস্বব্যবস্থাকে বিজ্ঞানসম্মত রূপ দেন। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র, কে. এস. লাল প্রমুখ মনে করেন, আলাউদ্দিন খলজিই সর্বপ্রথম জমি জরিপের রীতি প্রবর্তন করেন। ড. লাল লিখেছেন : “Measurement of land was unknown before Alauddin’s time and that the reform was original. “অবশ্য ড. ইউ. এন. ঘোষাল এর মতে, প্রাচীন ভারতে জমি জরিপ করে রাজস্ব-নির্ধারণের রীতি ছিল। তবে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে কিছুকাল এবং সুলতানি প্রতিষ্ঠিত হবার পরে কিছুকাল রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই ব্যবস্থা মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল। একথা সত্য হলেও বলা চলে যে, আলাউদ্দিন একটা বিস্মৃতপ্রায় অথচ যুক্তিবাদী ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন দ্বারা প্রশাসনকে ন্যায়সংগত রূপ দিতে পেরেছিলেন।

আলাউদ্দিন রাজস্ব আদায়ের কাজে নিয়োজিত কর্মীদের অসাধুতা বা বেয়াদপি বন্ধ করার বিষয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এ কাজে তাঁর প্রধান সহায়ক ছিলেন ‘নায়েব-উজির’ শরাফ কইনি। সুলতানের নির্দেশে গোমস্তা, মুতাশরিফ, মুহশিল প্রভৃতি রাজস্ব কর্মচারীর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার জন্য ‘দেওয়ান-ই-মুস্তাকরাজ’ নামে একটি স্বতন্ত্র দফতর খোলা হয়। কোনো কর্মচারী তার কাজে ফাঁকি দিলে কিংবা সংগৃহীত অর্থ রাজকোষে জমা না দিয়ে পুরোপুরি বা আংশিক আত্মাসাৎ-এর চেষ্টা করলে তাদের ওপর কঠোর শাস্তি নেমে আসত। বেত্রাঘাত, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, মুচলেকা নেওয়া ইত্যাদি নানারকম শাস্তি দেওয়া হত। পাটোয়ারীর মাধ্যমে মুস্তাকরাজ দপ্তর যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব সংগ্রহ করত, তাতে কারও ফাঁকি দেওয়া ছিল অসম্ভব। তাই ড. ত্রিপাঠী (R.P. Tripathy) লিখেছেন : “Alauddin was apparently the first muslim ruler whose hands reached as far as patwaris who were the best source of information in all matters pertaining to the land and its revenue.”

আলাউদ্দিনের রাজস্বব্যবস্থার সংস্কারের ফলে গ্রামীণ মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি অর্থাৎ খুৎ, মুকদ্দম চৌধুরী ইত্যাদির আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে উঠেছিল। বারাণী লিখেছেন : “তাদের বশ্যতা এত চরমে উঠেছিল যে, শহরের রাজস্ব-দপ্তরের একজন চাপরাশী (footman) কুড়িজন খুৎ, মুকদ্দম এবং চৌধুরীর গলা একত্রে বেঁধে রাজস্ব আদায়ের জন্য বেত্রাঘাত ও পদাঘাত করতে পারত।” বারাণী আরও লিখেছেন : “রাজস্ব সংস্কার হিন্দুদের কপর্দকশূন্য করে ছেড়ে দেয়। অর্থাভাবের দরুন খুৎ ও মুকদ্দমদের পত্নীরা মুসলমানদের ঘরে দাসীবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।” প্রায় একই রকম করুণ অবস্থা হয় নবনিযুক্ত রাজস্ব আদায়কারী অসৎ কর্মচারীদের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, রাজস্ব সংগ্রাহকদের কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় বন্দি অবস্থায় নিপীড়নের মধ্যে কাটাতে হত এবং কোনো পিতা নিজ কন্যার সাথে এদের বিবাহ দিতে রাজি হতেন না।

আলাউদ্দিনের রাজস্ব-নীতি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ড. ইরফান হাবিব লিখেছেন যে, “আলাউদ্দিন রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে গ্রামীণ দুই শ্রেণির সংঘাতে সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন” (“Alauddin consciously utilized the conflict between the two rural ‘classes’ by standing forth as the protector of the ‘weak’ against the ‘strong.”) অর্থাৎ খুৎ, মুকদ্দম প্রমুখের শোষণ থেকে আলাউদ্দিন সাধারণ কৃষক বা বলহারদের রক্ষা করেন। সাধারণ কৃষকদের গ্রাসাচ্ছাদনের প্রতি আলাউদ্দিনের সহানুভূতিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় বারাণীর একটি বিবরণে। আলাউদ্দিন একটি নির্দেশে বলেছেন যে, রাজস্ব এমনভাবে আদায় করতে হবে যাতে কৃষকদের খাদ্যশস্য, দুধ, দই ইত্যাদির অভাব না হয়, আবার তাদের হাতে যেন অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চিত না হয়। ড. সাক্সেনার মতে, আলাউদ্দিনের বাস্তব দর্শন অনুসারে দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করত। কারণ দৈনিক খাদ্য-পানীয়ের অতিরিক্ত সঞ্চয় চাষিদের হাতে থাকত না, যা দিয়ে আপৎকালীন অবস্থা তারা সামাল দিতে সক্ষম। তথাপি ইতিপূর্বে কখনোই মোট উৎপাদনের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত না। কিন্তু আলাউদ্দিন কলমের খোঁচায় এই হার বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে দেন। এই বৃদ্ধিকে কখনোই সুস্থ অর্থনৈতিক চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলা যায় না।

আলাউদ্দিনের রাজস্ব-নীতির সাথে তাঁর হিন্দু-নীতির প্রশ্নটি সম্পর্কিত। হিন্দুদের প্রতি আলাউদ্দিনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণের বিষয়টি বিতর্কিত। ঐতিহাসিকেরা এ প্রসঙ্গে একাধিক এবং পরস্পরবিরোধী মতপ্রকাশ করেছেন। ড. ইউ. এন. দে মনে করেন, হিন্দুদের প্রতি আলাউদ্দিনের আচরণ কোনোভাবেই কঠোর বা অমর্যাদাকর ছিল না। ড. আর. পি. ত্রিপাঠীর মতে, আলাউদ্দিন মুসলমানদের যেমন বিশেষ সুযোগ দেননি, তেমনি হিন্দুদেরও বিশেষ সুযোগ দিতে অস্বীকার করেছেন। পক্ষান্তরে ড. কে. এস. লাল মনে করেন, হিন্দুদের সম্পর্কে আলাউদ্দিনের গৃহীত ব্যবস্থাদি সত্যই ছিল নিপীড়নমূলক। এলিয়ট ও ডাউসন লিখেছেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের প্রতি আলাউদ্দিন সম আচরণ করেননি। মুসলমানদের প্রতিও তিনি কঠোর ছিলেন, কিন্তু তাদের হিন্দুদের মতো ভিক্ষুকের শ্রেণিতে নামিয়ে আনেননি।”

এই বিতর্কিত বিষয় আলোকপাত করার কাজে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জিয়াউদ্দিন বারাণীর বিবরণ, বেয়ানার কাজি মুঘিসউদ্দিনের সাথে আলাউদ্দিনের কথোপকথন এবং মোরল্যান্ডের বিশ্লেষণ। মোরল্যান্ড এবং বারাণীর বিবরণ থেকে একথা স্পষ্ট হয়েছে যে, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী ‘খুৎ, ‘মুকদ্দম’, ‘চৌধুরি’প্রমুখ প্রতিনিধি গ্রামভিত্তিক বা গ্রামের সমষ্টিভিত্তিক রাজস্ব সংগ্রহ করে চুক্তিমতো রাজকোষে জমা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু এঁরা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করলেও তা রাজকোষে জমা না দিয়ে নিজেরা আত্মসাৎ করতেন। এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির অর্থবল তাদের মধ্যে বিদ্রোহপ্রবণতার জন্ম দিত। এই বিপত্তিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে আলাউদ্দিন এদের সম্পর্কে কী শাস্তিমূলক ব্যবহার করা যায়,—সে সম্পর্কে আইনবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মোরল্যান্ড লিখেছেন : “Alauddin demanded from learned man rules and regulations, so that the Hindu should be ground down, and property and possessions, which are the causes of disaffection and rebellion, should not remain in his house.” এখানে ‘হিন্দু’ শব্দটি বিপত্তি ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ আলাউদ্দিন কেবল হিন্দুদের দমন করার পথ অনুসন্ধানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, অন্যের নয়। এই সন্দেহ তীব্রতর হয় মুঘিসউদ্দিনের উক্তি থেকে। তিনি আলাউদ্দিনকে নাকি বলেছিলেন যে, “পবিত্র কোরানে হিন্দুবিধর্মীদের জন্য কঠোরতর শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। একজন হিন্দুর মুখে রাজস্ব সংগ্রাহক যদি থুথু ছিটিয়ে দিতে চায়, তাহলে বিনা প্রতিবাদে মুখ খুলে তার গ্রহণ করা উচিত।”অবশ্য কাজির এই উক্তি কতটা সত্য এবং কতটা বারাণীর বানানো, তা বলা বেশ কঠিন। বারাণী নিজে ছিলেন গোঁড়া। তিনি মনে করতেন, পৌত্তলিকদের ধ্বংস না করলে ইসলামের মহিমা প্রচার করা সম্ভব হবে না। তাই P. Hardy মনে করেন, বারাণী নিজের মতটাকে মুঘিসউদ্দিনের মুখ দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গটি তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু আলাউদ্দিনের ‘রাজতন্ত্রের আদর্শ অনুসরণ করে বলা যায় যে, নিছক ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে তিনি হিন্দুদের দুর্বল করতে চাননি। ড. নিজামী ও মহম্মদ হাবিব মনে করেন যে, আলাউদ্দিন ছিলেন বাস্তববোধসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন যে, একটি হিন্দুপ্রধান দেশের তিনি একজন মুসলমান শাসক। তাই হিন্দুদের কাছে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থাই তাঁর রাজত্বকে স্থায়িত্ব দিতে পারে। সমকালীন লেখক আমির খসরুর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী হিন্দুরাজাদের প্রতি সুলতান অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহারই করতেন। হিন্দু রীতিনীতির প্রতিও আলাউদ্দিনের যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল। তাই হিন্দু রাজা (রায়, রনক, সামন্ত ইত্যাদি)-দের ঐতিহ্যগত অধিকার ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই আলাউদ্দিন তাঁর রাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন করেছিলেন। বারাণীর হতাশাব্যঞ্জক কিছু উক্তি থেকেও এই ধারণা সমর্থিত হয়। তিনি লিখেছেন : “অবিশ্বাসীদের ছুঁড়ে ফেলা এবং পৌত্তলিকদের ধ্বংস করার ইচ্ছা ভারতের মুসলমান শাসকদের হৃদয়ে স্থান পায়নি। পক্ষান্তরে ‘জিজিয়া’ প্রদানের শর্তে এইসব সংরক্ষিত (জিম্মি) মানুষ শাসকদের সাহায্য ও সহানুভূতি অর্জন করেছে, সমৃদ্ধিশালী হয়েছে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে উচ্চ রাজপদে।”

ড. ত্রিপাঠী, ড. লাল প্রমুখ মনে করেন, হিন্দুদের প্রতি আলাউদ্দিনের নীতি নিছক ধর্মীয় সংকীর্ণতা দ্বারা সৃষ্ট ছিল না। এর পশ্চাতে ছিল মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনবোধ। রাজকোষে প্রয়োজন ছিল অর্থের এবং এই কাজের দায়িত্বে ছিল যে খুৎ, মুকদ্দম চৌধুরিরা, ঘটনাচক্রে তারা ছিল হিন্দু। তাই এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণিকে শায়েস্তা করার প্রসঙ্গে হিন্দুদের শায়েস্তা করার প্রসঙ্গটি জড়িয়ে পড়েছে। সম্ভবত, সত্যের অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন স্যার উলসী হেগ। তিনি লিখেছেন : “Alauddin framed a special code of laws against Hindus, who were obnoxious to him, partly by reason of their faith, partly by the reason of the wealth which many of them enjoyed and partly by reason of their turbulance especially in the Doab.” আলাউদ্দিন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে একই দৃষ্টিতে দেখতেন—একথা যেমন সত্য নয়; তেমনি এও সত্য নয় যে, তিনি কেবল হিন্দুদের জব্দ করার জন্যই তাঁর রাজস্বনীতি প্রবর্তন করেছিলেন। প্রাচীনকাল থেকেই রাজস্ব-প্রশাসনে হিন্দুদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। তাই রাজস্বব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার কারণে মূলত হিন্দুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

আলাউদ্দিন খলজির বাজার-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা :

আলাউদ্দিন খলজির বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা ছিল বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মূল্য-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। জিয়াউদ্দিন বারাণীর ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ এবং ‘ফুতুহ-ই-জাহান্দারি’ গ্রন্থদ্বয় থেকে এই ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। সমকালীন লেখক আমির খসরুর ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’ গ্রন্থও এ ব্যাপারে আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করে। সুফিসন্ত নাসিরুদ্দিন চিরাগের ‘খয়ের-উল্-মজলিস্’ এবং ফেরিস্তার ‘বিবরণীতেও এ বিষয়ে বিশেষ আলোচনা পাওয়া যায়। তবে বারাণীর বিবরণই এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান উপাদান হিসেবে সাহায্য করে।

বারাণী লিখেছেন যে, চিতোর অভিযানের সময় (১৩০৩ খ্রিঃ) তার্থীর নেতৃত্বে মোঙ্গলদের আক্রমণ দিল্লি-সুলতানি তথা আলাউদ্দিনের সামনে যে অস্তিত্বের সংকট খাড়া করেছিল, তাতে আলাউদ্দিন নিজের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা শুরু করেন। এই বিপর্যয় আলাউদ্দিনকে অবাস্তব স্বপ্নের স্বর্গ থেকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনে। সুলতান এই মুহূর্তে নতুন নতুন রাজ্যজয়ের পরিবর্তে দিল্লির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণের কাজে হাত দেন। এই কর্মসূচির অন্যতম বিষয় ছিল ন্যায্যমূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা করা এবং সরকার-নির্ধারিত মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ। এই উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন দিল্লিতে কয়েকটি ন্যায্যমূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা করেন, যেমন—মাণ্ডি বা শস্যবাজার, সেরা-ই আদল বা ফল, বস্ত্র বাজার, পশু ও দাস-বাজার, অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার ইত্যাদি। এই সকল বাজারে দ্রব্যাদি সরবরাহ, বাজারের পরিচালনা, বিনিময়মূল্য নির্ধারণ প্রভৃতির জন্য সুলতান একাধিক নির্দেশনা (জাওবিৎ) জারি করেন।

‘মাণ্ডি’ ছিল প্রধান শস্য-বাজার। মূল মাণ্ডি বাজারের পাশাপাশি দিল্লি নগরীর বিভিন্ন মহল্লায় এই ধরনের ছোটো ছোটো একাধিক বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এক নির্দেশনামা দ্বারা এই সকল বাজারে খাদ্যশস্যের বিনিময় মূল্য নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন— প্রতি মন গম ৭২ জিতল, বার্লি ৪ জিতল, চাউল (শালী) ৫ জিতল, ডাল ৫ জিতল ইত্যাদি। কীসের ভিত্তিতে খাদ্যশস্যের মূল্য নির্ধারিত হয়েছিল— এ বিষয়ে সুনিশ্চিত বলা যায় না। এ বিষয়ে বারাণী তাঁর উভয় গ্রন্থেই উল্লেখ করেছেন যে, আলাউদ্দিন স্বয়ং উৎপাদন-ব্যয়ের ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতেন। খাদ্যশস্য ছাড়া অন্যান্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মুনাফা এবং দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টিও বিবেচনা করা হত। আলাউদ্দিনের জীবিতাবস্থায় কোনো পরিস্থিতিতেই উল্লিখিত মূল্যমানের সামান্যতম বৃদ্ধি ঘটেনি। অধ্যাপক বেনারসীপ্রসাদ সাক্সেনা লিখেছেন : “শস্য-বাজারের এরূপ স্থির মূল্যমান ছিল, যা সে যুগের এক বিস্ময়কর ঘটনা।”

অতঃপর শস্য-বাজার পরিচালনা, শস্য-সরবরাহ, অন্যায় লেনদেন বন্ধ করা, পরিবহণ সুনিশ্চিত করা ইত্যাদির জন্য একাধিক নির্দেশনামা জারি করা হয়। শস্য-বাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক বা “শাহানা ই মাণ্ডি’ হিসেবে আলাউদ্দিনের বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মচারী মালিক কাবুল (উলুখ ঘানী)-কে নিয়োগ করা হয়। পদামর্যাদা অনুযায়ী তাঁকে ইতা’ প্রদান করা হয় এবং তাঁর পছন্দমতো একজন সহকারী নিয়োগ করার ব্যবস্থা রাখা হয়। বাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ‘সাহানা’-র অধীনে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য রাখা হয়। আলাউদ্দিন মাণ্ডির খবরাখবর নিয়মিত সংগ্রহের জন্য ‘বারিদ’ ও ‘মুনশি’ নামক গুপ্তচর নিয়োগ করেন।

শস্য সংগ্রহের বিষয়ে জারি করা নির্দেশনামায় বলা হয়, দোয়ার অঞ্চলের সমগ্র খালিসা জমির ‘খিরাজ’ দিল্লির সরকারি গুদামে জমা করতে হবে। ঝইন অঞ্চলে সুলতানের প্রাপ্য রাজস্ব অবশ্যই শস্য দিয়ে মেটানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সংগৃহীত শস্য প্রথমে ঝইনে জমা করা হত এবং পরে সবটাই দিল্লিতে পাঠানো হত। এই ব্যবস্থার ফলে দিল্লির প্রতিটি মহল্লায় দু-তিনটি বাড়ি সুলতানের শস্যে সর্বদা পরিপূর্ণ থাকত। চতুর্থ নির্দেশনামায় শস্য-সরবরাহকারী বণিকগোষ্ঠী নায়েক’দের ন্যায্য মূল্যে এবং নিয়মিত দিল্লির বাজারে শস্য সরবরাহের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। সরকার-নির্দিষ্ট শস্য সরবরাহ সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত এদের গলায় এক ধরনের ‘চাকতি’ ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কৃতকর্মের জন্য এদের পরিবার-পরিজনকে জামিন রাখা হয়। নির্দেশে আরও বলা হয় যে, এরা শস্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ‘যৌথ দায়িত্ব’ পালনে বাধ্য থাকবে। বেআইনি মুনাফা অর্জন বন্ধ করা এবং খাদ্যশস্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সরকারি প্রতিনিধি, অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে দুটি নির্দেশনামা জারি করা হয়। দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব আদায়কারী সমস্ত সরকারি কর্মী ও প্রতিনিধিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হত যে, তারা নিজ নিজ অঞ্চলে অন্যায় মুনাফা অর্জনের (Regrating বা ইহতিকার) যে-কোনো প্রচেষ্টা কঠোর হাতে দমন করবেন। এ ধরনের কোনো কাজ সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে জবাবদিহি করতে হবে। উক্ত শস্যাদি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। অপর নির্দেশনামা অনুসারে দেশের শাসন ও রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের লিখিত অঙ্গীকার করতে হত যে, তারা নিজ নিজ এলাকার চাষিরা যাতে শস্য ঝাড়াই করার সঙ্গে সঙ্গে মাঠ থেকেই নগদ মূল্যে বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়, সেদিকে কড়া নজর রাখবে। এরূপ ব্যবস্থা হলে কৃষকেরা বাড়িতে শস্য লুকিয়ে রেখে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের সুযোগ পাবে না। অবশ্য উৎপাদকরা ইচ্ছা করলে স্থানীয় বণিকের পরিবর্তে নিকটবর্তী বাজারে গিয়ে ন্যায্যমূল্যে শস্য বিক্রয় করতে পারত। ফেরিস্তার মতে, কেবল দিল্লির বাজারে নয়, যে কোনো স্থানীয় বাজারে শস্য বিক্রয় করা যেত। স্থানীয় রাজস্ব-কর্মীরা যাতে নির্দিষ্ট মূল্যের কমে শস্য দিতে উৎপাদকদের বাধ্য করতে না পারে, সম্ভবত, সেই কারণে স্থানীয় বাজারে শস্যবিক্রয়ের বিকল্প অধিকার দেওয়া হয়েছিল। মাণ্ডির সমস্ত খবর সুলতান তিনটি সূত্র থেকে সংগ্রহ করতেন। এরা হল, মাণ্ডির প্রধান, সুলতানের গোয়েন্দা অফিসার (বারিদ) এবং বিশ্বস্ত গুপ্তচরবাহিনী (মুনহি)। জনসাধারণ বা ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই সরকারি নির্দেশ অমান্য করার দুঃসাহস দেখাত না। ফলে ন্যায্যমূল্যে প্রচুর খাদ্যশস্য সর্বদা দিল্লির বাজারে পাওয়া যেত।

আলাউদ্দিনের রাজত্বকালে দিল্লিতে কখনোই দুর্ভিক্ষ হয়নি। কারণ- (১) সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের যথেষ্ট মজুত এবং (২) খরা বা দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পাওয়ামাত্রই সরকারি ভাণ্ডার থেকে ‘রেশনিং’ ব্যবস্থানুযায়ী সমস্ত শ্রেণির মানুষকে খাদ্যশস্য সরবরাহের ব্যবস্থা। খাদ্যাভাবে কারও অপমৃত্যু ঘটলে শাহানাকে জবাবদিহি করতে ও শাস্তিভোগ করতে হত।

‘সেরা-ই-আদল’ বা ন্যায়-ভবন ছিল বস্তু, চিনি, ঘি, মাখন, শুকনো ফল, জ্বালানি তেল ইত্যাদির বাজার। সুলতানের নির্দেশে বদাউন গেটের পাশে ‘সবুজ প্রাসাদের’ সংলগ্ন মাঠে এই বাজার গড়ে তোলা হয়। সুলতানি বণিক ও অন্যান্য ব্যবসায়ীদের ওপর নির্দেশনামা জারি করে বলা হয় যে, তারা প্রত্যেকে ব্যক্তিগত বা সরকার প্রদত্ত অর্থে ক্রীত সমস্ত দ্রব্যাদি নিজগৃহ বা অন্য কোনো বাজারে না। নিয়ে সরকারি ‘সেরা-ই-আদল’ বাজারে আনবে। এই আইন লঙ্ঘন করলে কিংবা ১/২ জিতল বেশি দামেও কোনো জিনিস বিক্রি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর সমস্ত মাল বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। ফেরিস্তা লিখেছেন: “If any one open his packages elsewhere, his joints were to be opened with the swords. ” এক্ষেত্রেও সুলতান বিভিন্ন বস্ত্র ও দ্রব্যাদির দাম নির্দিষ্ট করে তালিকা বাজারে টাঙিয়ে দেন। দিল্লি বা দিল্লির বাইরের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত বণিককে বাণিজ্যমন্ত্রক বা “দিওয়ান-ই-রিয়াসত্-এর দপ্তরে নাম নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। দ্রব্য আমদানিকারী বণিকদের অঙ্গীকার করতে হত যে, তারা নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্রব্যাদি ‘সেরা-ই-আদলে’ আমদানি করবে এবং নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রয় করবে। এইসব ‘মিজানী সওদাগর’ এত মাল আমদানি করে যে, ‘সেরা-ই-আদল’ বাজার সর্বদা ভরপুর থাকে।

বস্ত্র আমদানির কারবারে মূল ভূমিকা ছিল মুলতানি হিন্দু-বণিকদের। উন্নতমানের বস্ত্র ও পোশাক সংগ্রহ করা ছিল চরম প্রতিযোগিতামূলক এবং সর্বদা সরকার-নির্ধারিত মূল্যে তা বিক্রি করা সম্ভব হত না। তাই আলাউদ্দিন এক নির্দেশনামা দ্বারা ‘মিজানী সওদাগরদের’ ২০ লক্ষ টঙ্কা অনুদান দেবার ব্যবস্থা করেন, যাতে মুলতানি বণিকরা দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে উৎকৃষ্ট দ্রব্যাদি ‘সেরা-ই-আদলে’ এনে নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রি করতে পারে। অতি মূল্যবান দ্রব্যাদি যাতে সাধারণ মানুষ বেশি দামে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করতে না পারে, সেজন্য সুলতান একজন বিশেষ অফিসার (পরোয়ানা রায়) নিয়োগ করেন। এই অফিসার ক্রেতার মর্যাদা ও অর্থবলের বিচারে এই জাতীয় মহার্ঘবস্তু ক্রয়ের অনুমতি দিতেন। সাধারণত আমির, মালিক ও অন্যান্য অভিজাতদের এই অনুমতি দেওয়া হত।

মাণ্ডি এবং ‘সেরা-ই-আদল’ ছাড়া আরও দু-ধরনের নিয়ন্ত্রিত বাজার আলাউদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একটি হল ঘোড়া, গোরু, মহিষ ইত্যাদি পশু ও ক্রীতদাসদের বাজার এবং অন্যটি হল নিত্যব্যবহার্য অন্যান্য জিনিসপত্রের বাজার। ঘোড়ার মূল্য-নিয়ন্ত্রণ সুলতানের পক্ষে বিশেষ জরুরি ছিল, কারণ ন্যায্যমূল্যে উন্নতমানের ঘোড়া সংগ্রহ করতে না পারলে সেনাবাহিনীর দক্ষতা হ্রাস পাবে। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী একজন ব্যক্তি নিজের অর্থে ঘোড়া ক্রয় করে তাকে প্রশিক্ষ দেবার পর ‘মামালিক-ই-আর্জ’-এর দপ্তরে হাজির করত। এই দপ্তর ঘোড়া পরীক্ষার পর মূল্য স্থির করে ওই ব্যক্তিকে তা প্রদান করত। এই সকল অশ্বসংগ্রাহক মূলধনের অভাবে মহাজন ও দালালদের খপ্পরে পড়ত এবং অতিরিক্ত মূল্যে ঘোড়া ক্রয় করতে বাধ্য হত। তাই আলাউদ্দিন প্রথমে ঘোড়ার মূল্য বেঁধে দেন। উৎকৃষ্ট ঘোড়ার মূল্য স্থির হয় ১০০ থেকে ১২০ টঙ্কা। মধ্যম ও নিকৃষ্ট ঘোড়া যথাক্রমে ৮০ ১০ টঙ্কা এবং ৬০-৭০ টঙ্কার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়। ভারতীয় টাট্টু ঘোড়ার দাম হয় ১০ থেকে ২৫ টঙ্কা। অপর নির্দেশনামায় সমস্ত দালাল ও মহাজনদের পশু-বাজারে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। অসৎ ঘোড়া ব্যবসায়ীদের অনেককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়। ফেরিস্তার মতে, অশ্ব-ব্যবসায়ীদের প্রতি এই কঠোর নির্দেশ ছিল সাময়িক। মূল্যের স্থিতাবস্থা আসার পর এই কঠোরতা হ্রাস করা হয়েছিল। দাস-বাজার এবং গবাদিপশুর বাজারের ক্ষেত্রেও কঠোরতা ছিল, তবে কম। গুণমানের ভিত্তিতে দাস ও পশুর সরকার-নির্ধারিত দাম উল্লেখ করে এইসব বাজারে ঝোলানো থাকত। মূল্য তালিকা অনুসরণ করা ছিল বাধ্যতামূলক।

আলাউদ্দিনের পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম খুব কমে গিয়েছিল। ফেরিস্তা এবং নাসিরুদ্দিন চিরাগ দিল্লির জনগণের স্বাচ্ছন্দ্যের বর্ণনা দিয়েছেন নানাভাবে। কিন্তু আলাউদ্দিন আকস্মিক অর্থব্যবস্থা নিয়ে ব্যক্ত হলেন কেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে তাঁর একান্ত কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য? ইতিহাসবিদগণ এ বিষয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ করেছেন; যদিও কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি গ্রন্থে বারাণী লিখেছেন যে, মোঙ্গল আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি বিশাল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন বাজার-নিয়ন্ত্রণ নীতি কার্যকর করেছিলেন। এই সেনাবাহিনী কেবল সংখ্যায় বিশাল হবে না, কার্যদক্ষতা ও আনুগত্যের দিক থেকেও হবে সর্বশ্রেষ্ঠ। বারাণীর মতে, সেনাবাহিনীর সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আলাউদ্দিনের পিতৃসুলভ দৃষ্টি ছিল। কারণ সাম্রাজ্যবাদী একজন শাসক হিসেবে তিনি জানতেন যে, এই বাহিনীর আনুগত্য, সেবা ও দক্ষতার ওপরেই তাঁর কর্তৃত্ব ও সাম্রাজ্য দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সমস্যা হল রাজকোষের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি না করে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন কীভাবে সম্ভব! নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধি সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধির দাবিকেও জোরদার করবে। এবং সেক্ষেত্রে রাজকোষের ক্ষমতা কয়েক বছরের মধ্যেই ভেঙে পড়বে। এমতাবস্থায় আলাউদ্দিন তাঁর পরামর্শদাতাদের সাথে আলোচনা করে স্থির করেন যে, তিনি সেনাবাহিনীর বার্ষিক বেতন স্থায়ীভাবে বেঁধে দেবেন। ফলে রাজকোষের ওপর অকারণ চাপ পড়বে না। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সর্বোচ্চ মূল্য এমনভাবে এমনহারে নির্দিষ্ট করা হবে, যাতে নির্দিষ্ট বেতনভোগী সৈন্যদের সুখী ও সুস্থভাবে জীবনধারণ অসম্ভব না হয়। অতঃপর তিনি একজন পদাতিক সৈন্যের বার্ষিক বেতন ৭৮ টঙ্কা স্থির করেন। একজন অশ্বারোহী সৈনিক বার্ষিক ১৫৬ টঙ্কা পাবেন বলে স্থির হয়। যদি কোনো সৈনিক সরকার প্রদত্ত ঘোড়ার অতিরিক্ত ঘোড়া রাখেন তাহলে তিনি অতিরিক্ত ৭৮ টঙ্কা পাবেন। অর্থাৎ একজন অশ্বারোহী সৈনিকের পক্ষে বার্ষিক ২৩৫ টঙ্কা বেতন পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়। জিয়াউদ্দিন বারাণীর এই যুক্তি আধুনিক গবেষকদের অনেকেই সত্য বলে মনে করেন। ড. পি. শরণও মনে করনে, সীমিত বেতনে সৈন্যদের স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন মূল্য-নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন : “The problem of maintaining the huge army in a good state of equipment and efficiency with limited resources….. was the sole motive which prompted control of prices of all necessities of life…..”

ড. কে. এস. লালও ড. শরণের মন্তব্যকে সমর্থন করেন। তিনি লিখেছেন: “আলাউদ্দিনের সীমাহীন রাজ্যজয়ের আকাঙ্ক্ষা এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপথে মোঙ্গলদের উপর্যুপরি আক্রমণ তাঁকে যে বিশাল সেনাবাহিনী গঠনে বাধ্য করেছিল, তাদের ক্রমবর্ধমান বেতন মেটানো রাজকোষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। দেবগিরির বিপুল সম্পদ কিংবা ৫০ শতাংশ রাজস্ব আরোপ করেও এই বিশাল ব্যয় মেটানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই তিনি সৈন্যদের বেতন স্থির রেখে এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য হ্রাস করে সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হন।”

ড. লাল লিখেছেনঃ “It was simple arithmetical calculation and simple economic principle; since he had decided to reduce and fix the salary of soldiers, he also decided to reduce and fix the price of things of common use.” কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হল, যে বিচারে তৎকালীন একজন সৈন্যের বেতনকে সামান্য বলা হচ্ছে তা যথার্থ নয়। কারণ সম্রাট আকবরের সময়, যখন দ্রব্যমূলের আনুপাতিক হার ছিল ১:২, তখন একজন অশ্বারোহী সেনার মাসিক বেতন ছিল ২০ টঙ্কা, অর্থাৎ বার্ষিক ২০ × ১২ = ২৪০ টঙ্কা। শাহজাহানের সময় এই বেতন ছিল বার্ষিক ২০০ টঙ্কা। স্বভাবতই আলাউদ্দিনের আমলে দুই ঘোড়ার অধিকারী একজন সৈনিক ১৫৬ + ৭৮ = ২৩৪ টঙ্কা বেতনকে জীবনধারণের পক্ষে অল্প বলা চলে না। অবশ্য সতীশ চন্দ্রের মতে, চতুর্দশ শতকে একজন তুর্কি-অশ্বারোহী সৈনিক প্রাচুর্যের সাথে জীবনযাপনে ইচ্ছুক ছিল, সে বিচারে আলাউদ্দিনের আমলে নির্দিষ্ট বেতনকে কম বলা চলে।

বারাণী তাঁর ‘ফুতুহ-ই-জাহান্দারি’ গ্রন্থে ‘মূল্যনিয়ন্ত্রণ-বিষয়ক উপদেশ’ অংশে উল্লেখ করেছেন যে, ‘সৈন্যবাহিনী রাজকোষ থেকে প্রদেয় বেতনের ওপর নির্ভরশীল; বেতনের অর্থমূল্য নির্ভরশীল দ্রব্যের মূল্য-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর। তেমনি দ্রব্যমূলের নিম্নহার ব্যতীত জনসাধারণের সুখ, সমৃদ্ধি এবং স্থিরতা সম্ভব নয়।” অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য স্থির রাখার পশ্চাতে শাসকের মনে একটা গণ-কল্যাণমুখী চিন্তা থাকা স্বাভাবিক। আলাউদ্দিনও হয়তো এই ধারার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই বক্তব্যকে পুষ্ট করে সুফিসন্ত নাসিরুদ্দিন চিরাগের ‘খয়ের-উল-মজলিস’ এবং আমির খসরুর ‘খাজাইন-উল্-ফুতুহ’ গ্রন্থের বিবরণ। দুটি গ্রন্থের রচনাকালের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান থাকলেও বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নাসিরুদ্দিনের ‘বিবরণ’ থেকে জানা যায়, কাজি হামিদউদ্দিন এবং মালিক কারাবেগের সাথে কথোপকথন প্রসঙ্গে সুলতান আলাউদ্দিন নাকি বলেছিলেন : “সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আমার ওপর জীবজগতের মঙ্গলসাধনের যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সে বিষয়ে কী আমার করণীয়? আমি যদি রাজকোষের সব অর্থ বিলিয়ে দিই, তা সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছাবে না; আমি যদি সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি বিলিয়ে দিই, তা-ও সকল মানুষের কল্যাণের পক্ষে যথেষ্ট হবে না। তাই আমি ভেবেছি, সমস্ত পণ্য শস্যের মূল্য বেঁধে দেব এবং সেই সুযোগ গ্রহণ করবে দেশের সমস্ত মানুষ।”

খসরু তাঁর গ্রন্থে আলাউদ্দিনের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলিকে জনকল্যাণের প্রেক্ষিতে প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছেন : “বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রেই ‘জাহাঙ্গীর’ অর্থাৎ রাজ্যবিজেতা অপেক্ষা ‘জাহান্দার’ অর্থাৎ দক্ষ প্রশাসককে অধিক মর্যাদা দেন। ঈশ্বরের সন্তানদের প্রতি সুলতানের ভালোবাসা চাঁদ বা নক্ষত্রের প্রতি সূর্যের ভালোবাসার থেকে অনেক বেশি ছিল। তাই আলাউদ্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বেঁধে দেন। তীক্ষ্ণ নজরদারির ব্যবস্থা করেন। পাথরের বাটখারার পরিবর্তে লোহার বাটখারা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেন। এবং ওজনে কম দিয়ে ক্রেতাকে বঞ্চিত করলে বিক্রেতার শরীর থেকে মাংস কেটে নেবার কঠোর নির্দেশ দেন।” অর্থাৎ কেবল সেনাবাহিনী নয়; সাধারণ প্রজাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের চিন্তাও আলাউদ্দিনকে বাজার ও মূল্য-নিয়ন্ত্রণের কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

বারাণীর বক্তব্য থেকে এও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, হিন্দুদের জব্দ করার একটা পরোক্ষ ইচ্ছা আলাউদ্দিনকে মূল্য-নিয়ন্ত্রণের কাজে উৎসাহিত করেছিল। কারণ তখন খাদ্যশস্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবসায় হিন্দু নায়েকদের প্রাধান্য ছিল। মূল্য-নিয়ন্ত্রণের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এরাই। তবে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র প্রমুখ অনেকেই মনে করেন, এমন ধারণা ভিত্তিহীন। কারণ পশ্চিম ও পূর্ব এশিয়ায় স্থলপথে বহির্বাণিজ্যে মুলতানি ও খোরাসানী বণিকদের প্রাধান্য ছিল। এদের অধিকাংশ ছিল মুসলমান এবং মূল্য-নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলে এরাও বাঁধা পড়েছিল।

ড. ইউ. এন. দে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির এক স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, একমাত্র সেনাবাহিনী কিংবা সামগ্রিকভাবে দেশের জনসাধারণের কথা চিন্তা করে আলাউদ্দিন মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি কার্যকর করেননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল দিল্লির সেনাবাহিনী এবং জনগণের স্বার্থচিন্তা। ড. দে লিখেছেন যে, তখন দিল্লি ছিল রাজধানী তথা বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তাই সেখানে সর্বদা বিশাল সেনাবাহিনী হাজির থাকত। বাণিজ্যসূত্রে সেখানে আসত বহু লোকজন। ফলে দিল্লির লোকসংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় এবং স্বাভাবিক কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। সুলতান এই মুদ্রাস্ফীতি রোধ এবং খাদ্যশস্যের জোগান অব্যাহত রাখার প্রয়োজনেই বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মূল্য-নিয়ন্ত্রণ নীতি রূপায়ণ করেন।

এই প্রসঙ্গে আর একটি বিতর্ক দেখা দেয় যে, আলাউদ্দিনের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কেবল দিল্লি শহরে বলবৎ ছিল, নাকি সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রযোজ্য ছিল। বারাণীর বিবরণ থেকে মনে হয় যে, এটি কেবল দিল্লিতে বলবৎ ছিল। এরই ভিত্তিতে Moreland লিখেছেন : “No attempt was made to keep down prices throughout the country, effort was limited to Delhi, where the standing army was concentrated.” এক্ষেত্রে বারাণীর মধ্যে স্ববিরোধিতা লক্ষণীয়। কারণ তিনিই লিখেছেন, মূলত সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে এই ব্যবস্থার উদ্ভাবন। ড. সাক্সেনা (B. P. Saxena) এখন প্রশ্ন তুলেছেন যে, সেনাবাহিনী সংগ্রহ করা হত সারা দেশ থেকে। কেবল দিল্লিতে মূল্য নিয়ন্ত্রণ বলবৎ থাকলে, দেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সেনা-পরিবারগুলি কীভাবে উপকৃত হত? ফেরিস্তার বিবরণ থেকে অনুমিত হয় যে, দিল্লির মূল্যব্যবস্থা সমগ্র দেশে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু ড. শরণ, ড. লাল প্রমুখ এর বিরোধিতা করেছেন। সতীশ চন্দ্রের মতে, “তথ্যের অভাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়।”

যাই হোক্, আলাউদ্দিনের বাজার-নিয়ন্ত্রণ নীতির উদ্দেশ্য ও প্রয়োগক্ষেত্র সম্পর্কে যেমন বিতর্কের অবসান হয়নি, তেমনি এই ব্যবস্থার ফলাফল সম্পর্কেও কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কষ্টকর। অধ্যাপক শরণের মতে, “আলাউদ্দিনের বাজার-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল অযৌক্তিক এবং অর্থনীতির নিয়মবহির্ভূত একটি প্রয়াস। সুলতানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে বলপ্রয়োগে কার্যকরী করা।” ড. লাল মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে সাধারণ ক্রেতা উপকৃত হয়নি, কিন্তু দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল উৎপাদকগোষ্ঠী ও বণিকসম্প্রদায়। চাহিদা, জোগান ও উৎপাদন-ব্যয়— অর্থনীতির এই তিনটি মূল শর্ত লঙ্ঘিত হবার ফলে, এই ব্যবস্থা আলাউদ্দিনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে। এতদ্‌সত্ত্বেও ঐতিহাসিক লেনপুল আলাউদ্দিনের অর্থনীতির বিশ্লেষণ করে তাঁকে একজন ‘রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ’ বা ‘Political economist’ বলে অভিহিত করেছেন।

ড. সাক্সেনা লিখেছেন : “The economic regulations of Alauddin are the greatest administrative achievement of the Sultanate period.” ফেরিস্তা মনে করেন, এটি ছিল নিখুঁত ও স্মরণীয় সাফল্য। ইতিপূর্বে অর্থনীতির ক্ষেত্রে এত বড়ো সাফল্য কেউ পাননি; ভবিষ্যতেও এমন উদ্ভাবনী কর্মসূচির প্রয়োগ ঘটবে কিনা বলা কঠিন। তিনি লিখেছেন : “It was a unique and remarkable achievement. Nothing like this had been accomplished before and no one can say whether it will be possible again.” বস্তুত, আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোর ছিল এবং ত্রুটিমুক্তও ছিল না। কিন্তু মৌলিক ব্যবস্থা হিসেবে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সম্ভবত, অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র এ বিষয়ে যথার্থই বলেছেন: “হিন্দু ও মুসলমান উভয় শ্রেণির বণিকরা হয়তো এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল; কিন্তু কেবল সেনাবাহিনী নয়, সকল শ্রেণির নাগরিক খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সত্তা মূল্যের জন্য উপকৃত হয়েছিল।