দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে আলজেরিয়া ফরাসিদের ঔপনিবেশিক আধিপত্য ছিন্ন করতে সক্ষম হয়।
আন্দোলনের সূচনা: দীর্ঘ ফরাসি শাসন ও শােষণের পর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে। আলজেরিয়ার জঙ্গি জাতীয়তাবাদী সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (ফরাসি ভাষায় Front de Liberation Nationale’ বা FLN) গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সেদেশে ফরাসি শক্তিকে বিপর্যস্ত করে তােলে। এই সংগঠনের জাতীয়তাবাদী নেতা বেন বেল্লা (Ben Bella) সারা দেশে আন্দোলনকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তােলেন।
স্বাধীনতা লাভ: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি বাহিনীর দমননীতিও তীব্রতর হতে থাকে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গল আন্দোলন থামানাের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আলজেরিয়ায় পরিকল্পিত গণভােটের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। শেষপর্যন্ত ফ্রান্স ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে আলজেরিয়াকে তাদের বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের প্রধান নেতা আহমেদ বেন বেল্লা আলজেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার পর বিংশ শতকের শুরু থেকে আলজেরীয়রা জাতি হিসেবে সচেতন হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আলজেরিয়ার জাতি সংগঠন ও বিকাশ কর্মসূচিকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়, যথা-
-
[1] প্রথম পর্যায় (১৯০০-১৯৫৪ খ্রি.),
-
[2] দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৫৪-১৯৬০ খ্রি:) এবং
-
[3] তৃতীয় পর্যায় (১৯৬০ খ্রি.-বর্তমান সময় পর্যন্ত)।
প্রথম পর্যায় (১৯০০-১৯৫৪ খ্রি.): এই পর্বে আলজেরিয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি উপনিবেশ। এই সময় আলজেরিয়ার সাধারণ মানুষের ওপর ফ্রান্সের ব্যাপক ঔপনিবেশিক শােষণ চলে। অবশ্য তারা আলজেরিয়ায় শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা প্রসার ঘটায়। কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ধনী আলজেরীয়রা সেখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই পর্যায়ে আলজেরিয়া জাতি হিসেবে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা ঔপনিবেশিক ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে ফেলে। দেশবাসীর ওপর ফরাসিদের তীব্র দমন ও শােষণনীতি তাদের আতঙ্কিত করে। প্রতিবাদের পথে অগ্রসর না হলে ফরাসিরা চিরকাল আলজেরীয়দের পদানত করে শােষণ চালিয়ে যাবে—এই বিষয়টি আলজেরীয়দের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে তারা ফরাসি ঔপনিবেশিক শােষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হতে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসনের বন্ধন ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে তারা ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘােষণা করে।
দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৫৪-১৯৬২ খ্রি.): জাতি সংগঠনের দ্বিতীয় পর্যায়ে আলজেরিয়ায় ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট-এর প্রধান নেতা বেন বেল্লা। জাতীয় সংহতি ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ আলজেরিয়ার জনগণ বিদেশি শাসকদের বিতাড়িত করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জীবনমরণ সংগ্রামে শামিল হয়। শেষপর্যন্ত ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির পতন ঘটে এবং ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক আলজেরিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের প্রধান নেতা আহমেদ বেন বেল্লা আলজেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এই সময় আলজেরিয়ায় জাতীয়তাবাদী চেতনার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে।
তৃতীয় পর্যায় (১৯৬২ খ্রি.-বর্তমান সময় পর্যন্ত): তৃতীয় পর্যায়ে আলজেরিয়া একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রায় আট লক্ষ ফরাসি শ্বেতাঙ্গ আলজেরিয়া ছেড়ে ফ্রান্সে ফিরে যায়। অবশ্য মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই বেন বেল্লাকে পদচ্যুত করে তার মন্ত্রী হৌয়ারি বৌমডিয়েন দেশের ক্ষমতা দখল করেন। তাঁর আমলে আলজেরিয়ার কৃষি ও শিল্পায়নে উন্নতি ঘটলেও তিনি মূলত সামরিক শক্তির সহায়তায় শাসন পরিচালনা করায় তার জনপ্রিয়তা নষ্ট হয়। এই সময় দেশে ইসলামি মৌলবাদ মাথাচারা দিয়ে ওঠে। ১৯৯০-এর দশকে এদেশে সামরিক বাহিনী ও ইসলামি মৌলবাদীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
Leave a comment