সূচনা: বিংশ শতকে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ায় তীব্র স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়।
[1] আন্দোলনের সূত্রপাত: ইউরােপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮ খ্রি.) শুরু হলে আলজেরীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই সময় আলজেরিয়ায় নতুন প্রজন্মের ইসলামি নেতৃত্বের বিকাশ ও সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। তারা আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহী গােষ্ঠী ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে দেশবাসীকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এবং ন্যাশনাল আলজেরিয়ান মুভমেন্ট। বেন বেল্লা (Ben Bella)-এর নেতৃত্বে আলজেরিয়ার সর্বত্র ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে ওঠে। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে এই সংগঠন আলজেরিয়ায় ফরাসি শক্তিকে বিপর্যস্ত করে তােলে। তাদের উদ্যোগে স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
[2] রাজনৈতিক অধিকারের দাবি: ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আলজেরিয়ায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংকট দেখা দেয়। আলজেরিয়ার মানুষ এর জন্য ফরাসি শাসনকে দায়ী করে ফরাসিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ শুরু করে। ফ্রান্সের কাছ থেকে রাজনৈতিক অধিকার পাওয়ার আশায় আলজেরীয়রা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫ খ্রি.) প্রথমদিকে ফরাসিদের পক্ষ নিলেও কিছুদিন পরই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। আলজেরীয় নেতা ফারহাৎ আবাস বহু জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিক নেতার স্বাক্ষর সংবলিত একটি দাবিপত্র ফরাসি সরকারকে জমা দেন (১৯৪৩ খ্রি.)। এতে আলজেরিয়ায় নিজস্ব সংবিধান প্রণয়ন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলজেরীয়দের অংশগ্রহণের অধিকার, আইনের সাম্য প্রভৃতি দাবি করা হয়।
[3] মিছিলে ফরাসি আক্রমণ: আলজেরিয়ায় বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা বিভিন্ন অধিকার এবং সুযােগসুবিধা ভােগ করলেও আলজেরিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা তা থেকে বঞ্চিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে আলজেরিয়ার জনগণ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মে এক বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করলে ফরাসি বাহিনী তাতে আক্রমণ চালায়। এতে কয়েকজন আলজেরীয় বাসিন্দার মৃত্যু হলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।
[4] ফরাসি দমননীতি: আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদীরা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু করলেও আলজেরিয়ার স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে ফরাসি সরকার আলজেরিয়ার। বাসিন্দাদের নাগরিকত্বের অধিকার অত্যন্ত সংকুচিত করে। ফরাসি জেনারেল জেকুইস ম্যাসু আলজেরিয়ায় এসে তীব্র দমনপীড়ন শুরু করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সেনা ও পুলিশ নির্বিচার আক্রমণ চালিয়ে বেশ কয়েক হাজার আলজেরীয় আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। ফরাসিরা আলজেরিয়ার জাতীয়তাবাদী নেতা মেসালি হাজকে গ্রেপ্তার করে এবং তার অনুগামীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন চালায়। ফরাসি সেনা কয়েকটি গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দেয় এবং ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার আলজেরীয়কে হত্যা করে।
[5] স্বাধীনতা যুদ্ধ: শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বাধীনতা লাভের কোনাে সম্ভাবনা না থাকায় আলজেরিয়ার নেতৃবৃন্দ ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী ও সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র আলজেরিয়া জুড়ে ফরাসিদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে। তারা আগস্ট মাসে ফিলিপ্পেভিলে শহরে বড়াে ধরনের হত্যাকাণ্ড চালায়। গেরিলা যােদ্ধারা আলজেরিয়ার ওরানের এক বাজারে প্রকাশ্যে বিপুল সংখ্যক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে (১৯৬২ খ্রি.)।
[6] ব্যাপক ধ্বংসলীলা: আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ ক্রমশ নির্মম হতে থাকে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই যুদ্ধে সাড়ে তিন লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ আলজেরীয়র মৃত্যু হয় এবং ২০ লক্ষের বেশি মানুষ বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ৮ বছরের স্বাধীনতা যুদ্ধে আলজেরিয়ার অপরিসীম ক্ষতি হয়। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।
[7] স্বাধীনতা লাভ: শেষপর্যন্ত ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ ইভিয়ান চুক্তির মাধ্যমে আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং জনগণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক আলজেরিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা আহমেদ বেন বেল্লা আলজেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। তিনি দেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ গ্রহণ করেন।
উপসংহার: স্বাধীনতা লাভের পর আলজেরিয়া থেকে অধিকাংশ ফরাসি জাতীয়তাবাদী এবং বহু ইউরােপীয় দেশত্যাগে বাধ্য হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী আলজেরিয়ায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
Leave a comment